আশা ভঙ্গ
লিখেছেন লিখেছেন কিশোর কারুণিক ২১ জুলাই, ২০১৪, ১০:৩২:২৬ রাত
আশা ভঙ্গ
কিশোর কারুণিক
নিখিল দিন মজুর, ষাট টাকা মজুরিতে কাজ করে । গাধার মত পরিশ্রম করেও সংসারে অভাব যায় না, দিন যত যাচ্ছে অভাব যেন ততই বেড়ে যাচ্ছে। একটা ছেলে সন্তানের জন্য আশা করে তিনটা কন্যা সন্তার । বিয়ে করেছে প্রায় দশ বছর হলো । সংসারে কোন সুখ নেই । ওর খুব রাগ হয় যখন দেখে পাশের বাড়ির রতনকে; কারণ রতনের চারটা ছেলে । রতন ভ্যানগাড়ি চালায় । আয় উর্পাজন মোটা মুটি খারাপ না । ওর খুব শখ একটা ভ্যানগাড়ি কিনবে । প্রতিদিন দশ টাকা করে জমা করে রাখছে । একটা ভ্যানগাড়ি কিনতে তিন/চার হাজার টাকা লাগবে । সময় সময় ভাবে এই জীবনে গাড়ির মালিক হতে ও পারবে না । বউটার যদি একটু বুদ্ধি থাকত, তবে কিছু করতে পারতাম। একটা লক্ষীছাড়া মেয়েকে বিয়ে করে জীবনটা শেষ হয়ে গেল আমার ।
মানুষ বিয়ে করে কত উন্নতি করে, আর আমি দিন দিন ফকির হচ্ছি । আচ্ছা আমি তো কোন দোষ করিনি, তবে আমার এমন হচ্ছে কেন ! ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছি আমি । আর রতন তো স্কুলেই যায় নি । ওর উন্নতি হচ্ছে, আসলে ওর বউটা লক্ষী ।
শালা যদি রতনের বউটাকে বিয়ে করতে পারতাম । তাহলে আমি চারটা ছেলের বাবা হতে পারতাম । সংসারে অভাব থাকত না । কেন যে শিল্পীর মাকে তখন ভাল লাগল ! রতন তো বিয়েতে কাউকে খাওয়াই নি, শালা কীপটে ।
মানুষ বিয়ে বারবার করে! মাইক বাজিয়ে বিয়ে করতে গিয়েছিলাম । বরযাত্রী প্রায় চল্লিশ জন। না, মানুষ খাওয়ে কোন লাভ নেই । শ্বশুর যে টাকা গুলো দিয়েছিল, টাকাগুলো জমা করে রাখলে রতন আমার সাথে পারত না । বার হাজার টাকা । রতনের মত তিনটা ভ্যানগাড়ি হয়ে যেত ।
“এই বসে আসিছ ?”
হেড মিস্ত্রির কথায় ধ্যান ভঙ্গ হলো । রতন একটু রেগে উঠে, “গরম কত, তোমার গরমে আমি ধার ধারি না ।”
হেড মিস্ত্রি রেগে উঠে, “এই তুই কাল থেকে কাজে আসবি না ।”
“নে বাবা, তোমার সাথে কাজ না করলে, না খেয়ে মরে যাব?”
হেড মিস্ত্রি বলল, “শালা মার খেলো তো ।”
“গাল দিবা না , তোমার সাথে বোনের বিয়ে দিয়েছি ?”
হেড মিস্ত্রি হেসে বলল, “আমার বউ তোর
বোনই তো হয় শালা ।”
“ঠিক আছে, তাহলে তুমি আমার দোলাভাই হলে, দোলাভাই আজ একশোটা টাকা দিবা ।”
“কাজ কর ,কাজ কর !”
নিখিল কাজ করা শুরু করল । মাটি কাটা কাজ । বিকাল পাচঁটা বাজলো । কাজ ছুটি করে বাড়ি ফিরে দেখে বউ বারান্দায় বসে মাথা আচঁড়াচ্ছে । নিখিলকে দেখে বউ মৃদু হাসলো । বউ এর হাসি মুখ দেখে নিখিল খুশি হলো । বউ এর পাশে বসে, “বউ তোরে আজ মানান লাগছে ।”
বউ আবার হাসলো । নিখিল বলল, “বউ সিনেমা দেখতে যাবি ?”
বউ না বোধক মাথা নাড়ল ।
“কেন রে, চল যাই ।”
“সিনেমা দেখতে টাকা খরচ হবে না ?”
“আরে টাকা কী হবে, হেভি সিনেমা নায়িকাদের হাফ-- ।” ব’লে চুপ করে গেল ।
“ঘরে চাল নেই, যাও বাজার করে আসো ।”
“এই শিল্পীর মা- তোর নাক খালি ক্যা?”
“নাকফুল ভেঙে গেছে ।”
“নাকফুলটা দে, ঝালাই করে নিয়ে আসি । বউ জানিস আমি যে বাড়ি কাজ করি ঐ বাড়ির বউ পায়ে কী যেন দিয়েছে, হাঁটলে ঝুমুর ঝুমুর শব্দ হয় ।”
“ওটা নুপুর ।”
“তুই পায়ে দিবি ?”
“না ।”
“কেন রে, চল স্বর্ণকার দোকানে যাই, তোরে আজ নুপুর কিনে দেব ।”
“না, আমার ল্গাবে না ।”
“তুই আমার সাথে এমন করিস ক্যা, আমার কী সখ হয় না তোকে কিছু দিতে, তুই আমাকে ভালবাসিস না ।”
“হ, তোমায় ভালবাসি না; যদি ভাল না বাসতাম তবে কবে বাপের বাড়ি চলে যেতাম ।”
“এই বউ রাগ করলি? রাগ করিস না, আমি বুঝি তোর মনে অনেক দুঃখ, তোর বাপ আমার সাথে বিয়ে দিলো যে ক্যা? তোর ভাল জায়গায় বিয়ে হতো । তুই সুখে থাকতিস, নুপুর পায়ে দিতিস ।”
বউ এর মনে স্বামীর প্রতি কেমন মায়া হলো, মৃদু হেসে, “নুপুর কিনতে টাকা লাগবে না ?”
“কেন রে মাটির ব্যাংকে যে টাকা আছে ঐ টাকা দিয়ে নুপুর কিনব ।”
“ না ঐ টাকা দিয়ে তুমি ভ্যান কিনবা ।”
“ভ্যান পরে কিনা যাবে, চল বাজার যাই ।”
নিখিলের বউ একটু রেগে বলল, “ বলছি না, ভ্যান কিনবা । নুপুর পায়ে দিলে ক্ষিধে মিঠবে?”
“তোরে কি না খাইয়ে রেখেছি? আমার মাথা গরম করিছ নে, বাজারে চল, তোরে আজ নুপুর কিনে দেব ।” ব’লে ঘরে
ঢুকে মাটির ব্যাংকটা নিয়ে মাটিতে বারি মাড়লো । ব্য্ংাকটা ভেঙে গেল । বউ ঘরে ঢুকে দেখে স্বামী খুচরা পয়সা গুণছে, বউ কেঁদে ফেলল । কাদু স্বরে, “যা ইচ্ছা তাই করবা?”
“হ্যাঁ, তোর জন্যে আমি সব করতে পারুম, চুপ করে থাক ।”
দরজার পাশে দাড়িঁয়ে বউ কাঁদতে লাগলো । টাকা পয়সা গুণা হয়ে গেল । বউকে বুঝিয়ে শুনিয়ে পরিস্কার পোশাক পরে রিক্সায় এক জুয়েলার্স দোকানে নামল। দোকানে ঢুকে বেশ তেজি কণ্ঠে, “নুপুর আছে?” সেল্সম্যান মাথা ঝাকাল, ডিসপ্রে ট্রেতে অনেক নাকফুল । বউকে বলল, “দেখ কোন অপেল নিবি।”
বউ বলল, “ তুমি পছন্দ করো ।”
ভাঙা অপেল জমা দিয়ে আর কিছু টাকা দিয়ে নতুন অপেল নিলো। টাকায় হলো না বলে নুপুর কিনা হলো না । নিখিলের মনটা খারাপ হয়ে গেল, বড় মুখ করে বউকে বলেছিল নুপুর কিনে দেবে কিন্তু কিনে দিতে পারলো না। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরলো । নিখিলের বউ মনে মনে একটু সুখ পেল, বউ ভাবলো, টাকা গুলো দিয়ে ছাগলের বাচ্চা কিনবে ।
হঠাৎ নিখিলের মা উচ্চস্বরে, “এ কী হলো ।” মা’র কণ্ঠস্বর শুনে ঘরে ঢুকে দেখে ছোট মেয়েটা শুয়ে কেমন যেন করছে । মেয়েকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে গেল,
ডাক্তার ভালভাবে দেখে, “ ভয়ের কিছু নেই, ঔষধ দিয়ে দিচ্ছি ঔষধগুলো খাওলে ভাল হয়ে যাবে ।” ডাক্তারের বিল পরিশোধ করে আর টাকা রইলো না । শুন্য হাতে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো ।
রাতে খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়ল, বউ এর সোহাগ মাখা হাতের পরশে নিখিল কেঁেদ ফেলল । বলল, “আমাকে দিয়ে কিছু হবে না, টাকা গুলো সব খরচ হয়ে গেল ।” বউ নিখিলকে স্বান্তনার বাণী শুনাতে লাগল ।
বিষয়: সাহিত্য
১২৯৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন