বিদেশে টাকার গাছ আছে
লিখেছেন লিখেছেন গোনাহগার ২৪ মার্চ, ২০১৫, ০৭:২৩:৩৬ সকাল
লেখাটা পড়ার আগে, প্রথম দুইটা ছবি দেখে নিন। জ্বী ভাই, ভুল দেখেননি! ১ম ছবিতে যেটা দেখতেছেন, সেটা বাংলাদেশের খোলা ডাস্টবিনের চিত্র। আর ২য় ছবিতে যেটা দেখতেছেন, সেটা আরব আমিরাত মানে দুবাইয়ের পরিবেশবান্ধব ডাস্টবিনের চিত্র।
দেশের চিত্রটা আপনারা হর-হামেশা দেখেন বাট বিদেশের চিত্রটা যারা প্রবাসে আছে, তারা হর-হামেশা দেখে। দেশের মানুষের হয়তো বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। ওরা এখানে খুঁজে বেড়ায় খালি কার্টুন, এলুমিনিয়ামের ক্যান, তামার তার ইত্যাদি, যা বেচে দুটো পয়সা পাবে।
জ্বী ভাই, আপনাদের শুনতে কষ্ট হলেও এটা কঠিন বাস্তবতা। একজন মানুষ বাড়ী বেচে, জমি বন্ধক রেখে, বিয়ে করে শ্বশুর থেকে টাকা নিয়ে, মা কিংবা বউয়ের গহনা বেচে, ধার-কর্য করে কিংবা মহাজন/ব্যাঙ্ক থেকে সুদ নিয়ে, ভবিষ্যৎ সুখ-স্বপ্নে বিভোর হয়ে বিদেশে দৌঁড়ে আসে। ২-১ মাসের মধ্যে তার সুখ-স্বপ্ন অন্ধকারের অমানিশায় হারিয়ে যায়, যেমনি হারিয়ে যায় পদ্মা নদীর বুকে নিজেদের বাপ-দাদার ভিটা।
থাকা-খাওয়া সব ফ্রি এবং বেতন বাংলা হিসেবে ৪০ হাজার, কিন্তু এসে দেখে বাসা-খাবার খরচ সব নিজের, বেতন ২০ হাজার, তখন ডাস্টবিনে আশ্রয় নেয়। কেউ বড় সুপার মার্কেটে সেলসম্যানের চাকুরী নিয়ে আসে, কিন্তু এসে দেখে উত্তপ্ত রোদের মধ্যে মাটি কাটার কাজ, তখন চাকুরী স্থল থেকে পালিয়ে যায়, পরিশেষে ফেরারি হয়ে, ডাস্টবিনে আশ্রয় নেয়। কেউ দালালের মিথ্যা প্রলোভনে পড়ে, ম্যাসন হেল্পারের চাকুরী নিয়ে আসে, কিন্তু চাকুরীদাতার সাথে মিট হওয়ার পর জানতে পারে, তাকে আনা হয়েছে এলোমিনিয়াম ফ্যাক্টরিতে ট্রেইনার হিসেবে, তখন বস বেতন দেওয়া বন্ধ করে দেয়, আর বেচারার সখ্য হয় ডাস্টবিনের সাথে। হ্যাঁ অনেকে আছে, বেতন কম বলে আর পরিবারের ব্যয় অধিক বলে, পার্টটাইম ইনকাম করতে এ কাজ বেছে নেয়।
এই আমি ১ম দুবাইতে আসি ৮০০ দেরহাম(তখনকার ১৪,৫০০ টাকা) বেতনের চাকুরী নিয়ে। তদুপরি এসে জানতে পারি থাকাখাওয়া এমনকি সকালের ব্রেকফাস্টটাও নিজের। কেমন করে দিনগুলি কাটিয়েছি, মনে পড়লে হু হু করে কান্না আসে। কিছু অতিরিক্ত পয়সার আশায় কি করিনি! নিজ দোকানের খালি কার্টুনগুলো বিক্রি করেছি, স্ক্র্যাপ হিসেবে কিছু তামা পেতাম, সেগুলো বিক্রি করেছি, লোক চারজন ছিলাম বলে পেতাম চার ভাগের এক ভাগ। বাথরুম পরিষ্কারের কাজ করেছি। সারাদিন রোযা রেখে, নিজ দোকানের ১২-১৩ ঘন্টা ডিউটি করে রাতে রঙের কাজ করেছি। অন্য পার্ট টাইম চাকুরীরও চেষ্টা করেছি। কিন্তু পুলিশের ভয়ে(আমিরাতে এক স্পন্সরের অধীনে থেকে অন্য স্পন্সরের কাজ করা বেআইনি) কেউ কাজ দেয়নি।
• ওই ডাস্টবিনে রিযক অন্বেষণ করা ছেলেটির কাছে, তার বাবা যখন একটি ঘড়ির আব্দার করে চিঠি(এখন অবশ্য ইমেইল, হোয়াটস অ্যাপ-এর যুগ) পাঠায়, তখন সে না করতে পারে না। বাবাকে কি বলা যায়, ‘আমি তোমার ছেলে ডাস্টবিনে ডাস্টবিনে খুঁজে ঘরের চাহিদা মেটাচ্ছি, অতিরিক্ত কিছু চেও না!’
• মা যখন একটা বোরকা পাঠাতে বলে, রূমে গিয়ে হয়তো গুমরে গুমরে কাঁদে, বাট না বলতে পারে না।
• কিন্তু বউ যখন, পাশের বাড়ির রহীমের মত একটা গহনার সেট পাঠাতে বলে, বউ ৭দিন কথা বলবে না জেনেও, না বলে দিতে হয়।
• ছোট ভাইটা যখন একটা ক্যামেরা মোবাইলের আব্দার করে, তাকে নকিয়া-১২০০(এখন দিতে হয় চায়না মেইড) মোবাইল দিয়ে বুঝ দিতে হয়। তাকে বলা হয় না, ‘ভাইরে, এই মোবাইল কিনতে আমাকে ২০ বেলা উপোস থাকতে হয়েছে।’
• বোনটা যখন প্রাইভেটের টাকা পাঠাতে বলে, ১ মাস দেরীতে হলেও পাঠায়। রাগ করে সে বোনটা পরের মাস আর কথা বলে না।
• বুড়ো হয়ে যায়, বাট বাড়ী যাবার নাম নিতে পারে না। বিয়ে তো দিল্লী দূর অস্ত।
• ধার-কর্জ করে দেশে গেলেও, বিয়ে করতে হয় যৌতুক নিয়ে কিংবা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে।
• যাদের ভিসা-পতাকা নাই, তাদের অবস্থা আরও বেহাল। তাদের চিন্তা দেশে গিয়ে কি করবো? লাখো টাকা কর্জ-কীভাবে শোধ করবো? এসব ভেবে যতদিন ধরা না খায় ততদিন এখানে লুকিয়ে লুকিয়ে থাকে, চোর-পুলিশ খেলতে থাকে প্রশাসনের সাথে।
এই অসহায় ভাইগুলো যদিও দেশে আসতে পারে না। কিংবা বলা যায়, দালালের খপ্পড়ে পড়ে ভিসা-পতাকাহীন হয়ে যাওয়া, পরিবারের হক, বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনদের আব্দার, পাহাড়সম ঋণ কিংবা অন্ধকার ভবিষ্যত তাদের দেশে আসতে দেয় না। কিন্তু তাদের রক্ত পানি করা টাকা দেশে ঠিকই আসে। সে টাকা দিয়ে পরিবারের হাসি দেখে তার কষ্ট দূর হয়ে যায়। ময়লার ডিপো থেকে নিংড়ে বের করা বিদেশী মুদ্রা এদেশে রেমিট্যান্স নামে প্রবেশ করে। সেই রেমিট্যান্সের বিনিময়ে যখন সে টিভিতে উন্নয়নের জোয়ার(!) দেখে, তখন সম্মোহিত হয়ে সুখ সাগরে সঙ্গম করে।
• সেই টাকা দিয়ে অর্থমন্ত্রী ফি-বছর বাজেট দেয় আর আমার টাকা, আমার টাকা বলে বাগাড়ম্বর করে, শেয়ার মার্কেট লুট করে, গোপন বন্ধুদের পকেট ভারী করে।
• সেই টাকা দিয়ে মিঃ প্রেসিডেন্ট ফি-বছর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করতে যায়।
• সেই টাকা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিরাট বহর নিয়ে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায়।
• সেই টাকা থেকে উন্নয়নের নাম করে মন্ত্রীরা সুইস ব্যাঙ্ক ভরিয়ে তোলে।
• সেই টাকা মেরে দিয়ে এমপি-নেতারা গাড়ী-বাড়ির মালিক আর বিসনেজ ম্যাগনেট বনে যায়।
• সেই টাকা দিয়ে কেনা সিএনজি কিংবা রিকশাটা হরতালে পুড়িয়ে দেয় বিরোধীদল।
• সেই টাকা পেয়ে, আজীবন আবুল বিড়ি খাওয়া বাবা গোল্ডলীফ খায়।
• সেই টাকা পেয়ে, মা শাড়ির পর শাড়ি কিনে ওভারড্রোভ ভর্তি করে।
• সেই টাকা পেয়ে বউ মার্কেটে মার্কেটে ঘুরে গহনার সেট কিনে কিংবা পাতানো দেবরের সাথে পরকীয়া করে।
• সেই টাকা পেয়ে, ছোট ভাই হাল ফ্যাশনের পোশাকে আচ্ছাদিত হয়ে, কানে এয়ারফোন লাগিয়ে ঢং ঢং করে ঘুরে বেড়ায়, লাইভ কন্সার্ট বা খেলার টিকেট কিনে স্টেডিয়াম মাতিয়ে বেড়ায় কিংবা হেরোইন-ইয়াবায় রঙ্গিন জাল বুনে।
• সেই টাকা পেয়ে, ছোট বোন প্রেমিকের হাত ধরে পার্ক-সিনেমায় ঢুঁ মারে কিংবা লিটনের ফ্ল্যাটে গিয়ে সেই টাকার শ্রাদ্ধ করে।
• সেই টাকার লোভে, প্রবাসীদের সেবা-সাহায্যের নামে প্রতিষ্ঠিত এমব্যাসি গুলোতে হয়রানি করে।
• আর বেচারা কোনদিন যদি দেশে আসে সেই টাকার লোভে এয়ারপোর্ট কর্মচারীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে, ট্যাক্সি ড্রাইভাররা লাগেজ-ব্যাগ নিয়ে টানাটানি করে কিংবা ডাকাতদের সাথে আঁতাত করে তার সব তো লুট করেই, ক্ষেত্র বিশেষে জানটাও নিয়ে নেয়।
নারে ভাই, আপনাদের বিবেকে ঘা মারার চেষ্টা আমি করিনি। ওপরে কিংবা যা লিখেছি, সব হলো কল্পকাহিনী। আসল ঘটনা হলো, বিদেশে টাকার গাছ আছে। সেখান থেকে প্রবাসীরা যখন মনে চায়, ছিড়ে ছিড়ে পাঠিয়ে দেয়। আপনারা ইচ্ছেমতো, ‘জনগণের টাকা’, ‘মেহনতের টাকা’, ‘সোনার ছেলেদের টাকা’, ‘আমার বাবার টাকা’, ‘আমার ভাইয়ের টাকা’, ‘আমার সন্তানের টাকা’ মনে করে, সেই টাকার শ্রাদ্ধ করতেই পারেন।
বিষয়: বিবিধ
৩০৪১ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যে কাজ এখন বিদেশে করছে বাধ্য হয়ে সেটা করার কল্পনা কি দেশে করেছিল ?
আমেরিকাতে মাস্টার্স পাশ করা ছেলে ওসি , ডিসির কাজ করে । দেশে তো সে নিজের পানিটাও পর্যন্ত ঢেলে খেত না ।
বিদেশ তো ওকে আলালের ঘরের দুলালের মত পুষবে না !
দেশে কি নিজেই নিজের কর্ম সংস্থান করতে পারতো না ? যে সব ছোট কাজ (!) সে বিদেশে করছে তার চেয়ে কিছুটা স্ট্যান্ডার্ড কাজ সে যে টাকা দিয়ে বিদেশে গেছে সেটা দিয়েও শুরু করতে পারতো না ?
বাংলাদেশীরা নিজেদের এতটাই পরনির্ভরশীল করে তুলেছে যে যেখানেই যায় সবচেয়ে দূর্ব্যবহার তারাই পায় ।
সমসাময়িক স্বাধীন হওয়া দেশও এখন বাংলাদেশীদের চাকরি নিয়ে কাহিনী করে । স্বাভাবিক , যোগ্যতা যার আছে সে তো ডাট মারবেই।
প্রবাসিদের কল্যান এর বিষয়ে সরকারের কোন মাথাব্যাথা নাই। তারা শুধু রেমিটেন্স এর মেশিন।
বিদেশ যাওয়ার পরিকল্পনা অনেক আগেই বাদ দিয়েছি দেখি দেশেই কিছু যেনো করতে পারি।
আর রিজিকের মালিক তো ঐ এক আল্লাহ।
দু:খ ভরা পোষ্ট ।
এখন কেমন আছেন ভাই?
দোয়া রইলো
জাজাকাল্লাহ খাইরান।
আলহামদুলিল্লাহ! ভালো আছি ভাই।
মনের কষ্টের কথাগুলো লিখলেন। অনেক ধনবাদ আপনাকে।
আপনার উপরের কথাগুলো সবগুলোই হৃদয়কে টাস করার মত। এতো কষ্ট করার পরেও বউ, ছেলে সন্তান বাবার সাথে ভাইয়ের সাথে নাফরমানী করে, স্বামীর মেথরগিরির টাকা দিয়ে বয় ফ্রেন্ডের সাথে নষ্টামী করে বেড়ায়, ব্যভিচারে লিপ্ত হয়য়!!!! পারে কেমন করে, আল্লাহ্ কি তাঁদের মধ্য থেকে সব বিবেকবোধ সরিয়ে দিয়েছেন? আমার বোধগম্য নয়।
শুধু প্রবাসীদের ক্ষেত্রে নয়, উপকারীর উপকার স্বীকার, উপযুক্ত পুরুষ্কারে পুরুষ্কৃত না করলে মন ক্ষুন্ন হবেন না, তিনিতো আছেন, আপনাদের যথাযথ মর্যাদা দানের জন্যো।
মন্তব্য করতে লগইন করুন