জীবন-নাট্যঃ খেলার পুতুল
লিখেছেন লিখেছেন গোনাহগার ২৩ জুলাই, ২০১৪, ০৬:৩৮:৫৮ সকাল
(কলেজ জীবনে দু’বার পুলিশের হাতে এরেস্ট হয়েছিলাম, বিনা অপরাধে। আমি অবশ্য ‘ধুয়া তুলসী পাতা’ তা বলার সাহস আমার নেই। ছোটখাট পাপ কিংবা অপরাধ আমার দ্বারা অবশ্যই সংঘটিত হয়েছে। তার জন্য নিরন্তর আত্মগ্লানিতে ভূগতেছি এবং প্রতিনিয়ত মহান আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। কিন্তু যে দু’বার পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল, কসম করে বলতে পারি আমার এক কণাও অপরাধ ছিল না। এটা অবশ্য সেই অভিজ্ঞতা নয়, শুধু সেই অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে, পুলিশের উপর ক্ষোভ থেকে সেই সময়ে গল্পটা লিখেছিলাম। পাঠকের আগ্রহ থাকলে পরবর্তীতে আমার সেই অভিজ্ঞতা তোলে ধরার ওয়াদা রইল।)
রাত ১২ টা বেজে ২০ মিনিট। রফিক এইমাত্র ফ্যাক্টরী থেকে ফিরেছে। আজ একজন সহকারী ছুটিতে গেছে বলে তাঁকে ২ ঘন্টা ওভার টাইম করতে হয়েছে। খিদেই পেট চুঁ চুঁ করতেছে। সে শার্টটা খুলেই একটা কুলি করে খেতে বসলো। খাওয়া যখন মাঝপথে তখনি ছোটবোন রাদিয়া হন্তদন্ত হয়ে ছোটে এলো, ‘ভাইয়া মা জানি ক্যামন করতেছে!’ রফিক তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে মায়ের রুমে গিয়ে দেখলো, মায়ের ব্লাড প্রেশার বেড়ে গিয়ে খিঁচুনি আরম্ভ হয়েছে।
- মাকে ওষুধ খাওয়াসনি!
- - ওষুধ তো ভাইয়া দুপুরে ফুরিয়ে গেছে
- আনিয়ে নিসনি কেন?
- - টাকা থাকলে তো!
রফিক এবার চুপ করে গেলো। মা আর একমাত্র বোনকে নিয়ে তাদের টানাটানির সংসার। বাবা মারা গেছেন সেই কবে। সবে মাত্র মেট্রিক পাশ করে কলেজে ঢুকেছিল। বন্ধ হয়ে গেলো লেখাপড়া। সংসারের ভার এসে পড়ল নিজের ওপর। কাজের জন্য হন্য হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিল অনেকদিন। বি.এ পাশ, এম.এ পাশ ছেলে চাকুরী পায়না সেতো মাত্র মেট্রিক পাশ। কিন্তু রাখে আল্লাহ্ মারে কে! একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে ‘টাইম কিপারে’র চাকুরী তার জুটে গেলো। ভাগ্য ভালো যে, ফ্যাক্টরীর মালিক তার এলাকার লোক। সে থেকে তাদের তিনজনের সংসার কোনমতে খেয়ে না খেয়ে চলে যাচ্ছে। অভাবের কারণে বোনকেও লেখাপড়া করাতে পারছে না।
‘ভাইয়া তাড়াতাড়ি ওষুধ নিয়ে আস’- বোন রাদিয়ার কণ্ঠস্বরে রফিকের চিন্তাজাল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। পকেটে টাকা কিছু আছে। কিন্তু ফার্মেসী কি খোলা থাকবে! আশা-নিরাশার দোলা নিয়ে রফিক বেরিয়ে পড়লো।
বরাতজোরে একটা ওষুধের দোকান খোলা পেয়ে গেল রফিক। কম্পাউন্ডারকে বলে কিছু ওষুধ নিল। দোকান থেকে বের হয়ে মোড়ে আসতেই একটা মেয়ের মুখোমুখি হয়ে গেল। তারই পাড়ার মেয়ে। মেয়েটাকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। কাপড়-চোপর এলোমেলো, মাটি আর ধুলাবালি লেগে রয়েছে।
- ‘রহীমা তুমি! এতো রাতে কোত্থেকে! কি হয়েছে তোমার!’- রফিকের কন্ঠে একরাশ বিস্ময়।
- - ‘রফিক ভাই, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে।’ – বলেই এতোক্ষনে সমস্ত শক্তি দিয়ে আটকে রাখা অশ্রুর বন্যা বয়ে দিল।
- কি হয়েছে আমাকে খুলে বল!
- - গার্মেন্টস থেকে ফিরছিলাম, কাঁচাবাজারে গিয়েছিলাম তাই আজ একটু রাত হয়ে গিয়েছিল। জেল রোড পেরিয়ে আসতেই চার নরপশু আমাকে ঐ নির্মাণাধীন বিল্ডিঙয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে ... ... ...
আর বলতে পারলো না রহিমা। ভয়, ক্রোধ আর অশ্রু তার কণ্ঠরোধ করে দিল। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না রফিক। কিছুক্ষণ আগে যে মেয়েটি তার অমূল্য সম্পদ হারিয়ে এসেছে, তাকে কী বলে সান্ত্বনা দেবে সে। কি করবে ভেবে যখন দিশেহারা তখনি দু’টি তীব্র হেডলাইট তাদের ওপর এসে স্থির হল। একটা মাইক্রোবাস তাদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে থামল। গাড়ি থেকে নেমে এল নেভীব্লু এবং সাদা পোশাকধারী পুলিশ।
‘এই শালা, মাঝ রাইতে মাইয়া মানুষ নিয়া মৌজ-মস্তি করিস! ওঠ্ গাড়ীতে ওঠ্!’- এই বলে টেনে হিঁচড়ে তাদেরকে গাড়ীতে তোলে ফেলল। রফিকের কোন অনুনয়-বিনয়, কাকুতি-মিনতি ওরা শুনল না। ওদিকে রহিমা কান্না থামিয়ে বোবা বনে গেছে। গাড়ী ছেড়ে দিল। রফিক সুযোগ বুঝে হাবিলদারকে সব খুলে বলল।
সব শুনে হাবিলদার বলল, ‘অ বুঝেছি তুমি ভালা পুলা’, তারপর রহিমার দিকে লুলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘কিন্তু মাইয়াটার কথা বিশ্বাস হয় না, দুই নাম্বার মাইয়া!’
‘না, না... ও আমার প্রতিবেশি, গরীব কিন্তু একজন সৎ মেয়ে’- রফিক বলতে গিয়ে একপ্রকার চিৎকার করে ওঠে!
‘সৎ মাইয়া!’- হাবিলদার ভেংচি কাটে, ‘কত্তো দেখলাম, দেখিতে দেখিতে বা... পাকি গেছে। ওই বেডির কথা পরে’ তারপর রফিকের কানের কাছে মুখ নিয়ে নিম্নস্বরে বলে, ‘স্যারের জন্য বিন্সন কিনার টাকা দাও, আমি স্যারকে ম্যানেজ করে নেব।’
রফিক সব ইচ্ছাশক্তি একত্র করে বলল, ‘বিশ্বাস করুন আমার কাছে এই পাঁচ টাকা ছাড়া আর এক পয়সাও নেই, মায়ের ওষুধের জন্য সব খরচ হয়ে গেছে, এই দেখুন ওষুধ।’
‘টাকা নাই, তাইলে আমারও উপায় নাই’- এই বলে হাবিলদার রাজ্যের সব বিরক্তি মুখে এনে রফিকের বিপরীত দিকে তাকিয়ে রইল। যেন যে দু’টো কথা রফিকের সাথে সে বলেছে, তাতে তার বিরাট লোকসান হয়ে গেছে।
বিষয়: বিবিধ
১০৭৭ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন