ছোটবেলার স্মরণীয় ঘটনাঃ তাবিজ

লিখেছেন লিখেছেন গোনাহগার ১৮ জুলাই, ২০১৪, ০৭:৪৮:০৪ সন্ধ্যা

আমাদের বাড়ীর পশ্চিম পাশে আরাকান রোড(পুরাতন ঢাকা-কক্সবাজার রোড)। তার সাথে প্রায় সমান্তরাল বয়ে গেছে একটি খাল। রাস্তার পশ্চিমপাশে আমাদের আবাদী জমি আছে। জমির মাঝখান দিয়ে খাল খনন করার ফলে জমিটার আয়তন এখন ক্ষুদ্র হয়ে গেছে। সেখানে এখন রবিশস্য উৎপাদন করা হয়। যখনকার ঘটনা লিখছি, তখন সেখানে মরিচগাছ রোপন করা হয়েছে।

একদিন চাচাত ভাই ওয়াসিমের সাথে মরিচ ক্ষেত দেখতে গিয়েছিলাম। ওয়াসিম মরিচ চারাগুলোর পরিচর্যা করছিল আর আমি খালপাড়ে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ দেখলাম বাড়ীর কয়েকটা ছেলে খানিকটা দূরে খালের মধ্যেই শনগাছের(যা দিয়ে চাটাই বানানো হত) মূল তোলে তোলে খাচ্ছে। আমি আর লোভ সামলাতে পারলাম না। কেননা শনমূল আমাদের মত ছোট ছোট ছেলেদের খুব প্রিয় ছিল। আর অপেক্ষা না করে খালে নেমে সাঁতার কেটে বাড়ীর ছেলেগুলোর নিকট পৌঁছলাম। আর ওদের সাথে শনমূল তোলে মজা করে খাচ্ছিলাম।

কিছুক্ষণ পর শুনি আমার আব্বার চিৎকার! তিনি ‘রিফাত’ ‘রিফাত’ বলে ডাকছিলেন এবং সেইসাথে একটা শোরগোলও শুনছিলাম। হঠাৎ দেখলাম চাচাত ভাই তাছির আমাদের দিকে দৌড়ে আসছেন, আরাকান রোড ধরে। আমিতো বিরাট ভয় পেলাম।

আমাদের রক্ষণশীল পরিবার, খুব হিসাব করে চলতে হয়। পান থেকে চুন খসলে খবর আছে। মাঝরুম থেকে সামনের রুমে গেলে বলে যেতে হয় যে, আমি সামনের রুমে যাচ্ছি। যদিও এখন খানিকটা অবাধ্য হয়ে গেছি। অতিরিক্ত শাসনই তার কারণ কিংবা হয়তো মানুষ অন্যের অধীন চিরদিন থাকতে চায় না বলে। ওয়াসিমের সাথে খালপাড়ে গিয়েছি- এটা ঘরের কাউকে বলে যাইনি। তাই হয়তো আব্বা রেগে গেছেন এবং মারবার জন্য আমাকে খুঁজছেন। অন্তত আমার তাই মনে হলো।

তাছির ভাই রাস্তা থেকে বললেন, ‘রিফাত এদিকে ওঠে এসো’। ভয়ে তখন আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। মন বলছিল উল্টোদিকে ওঠে দৌঁড়ে পালাই।

আবারও তাছির ভাইয়ের কণ্ঠস্বর শুললাম, ‘কোন ভয় নেই, ওঠে এস-আমরা সবাই আছি’।

কিছুটা সাহস সঞ্চার হল মনে। রাস্তায় ওঠে দেখলাম, অনেক লোক জমে গেছে। আব্বা এবং চাচাত ভাই সাজিদ আমাদের দিকে দৌঁড়ে আসছে। উল্টোদিকে পালাবার ঝোঁক অনেককষ্টে দমন করলাম। রুটিন ক্যাম্পে স্থানান্তররত কয়েকটা মিলিটারীর গাড়ী এবং অন্যান্য গাড়ীও দাঁড়িয়ে আছে দেখলাম। কয়েকজন আর্মি কি বুঝে জানি খালের পানির দিকে অস্ত্র তাক করে রয়েছে। আমিও কিছু না বুঝে হা করে সবকিছু দেখছিলাম। আর সবাই যেন দেখছিল শুধু আমাকেই। কে ভেবেছিল এতো সব আয়োজন সব আমাকে ঘিরেই! তাছির ভাই আমাকে কোলে তোলে নিলেন। আমিও তাকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার আব্বা ভীষণ রাগী। কি হবে না হবে সেই ভয়ে বুক দুরুদুরু কাঁপছে।

বাড়ীতে এসে দেখি হুলস্থূলকান্ড। ব্যাপার দেখে আমি বোবা হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল যেন সূর্যটা ওইদিন পশ্চিমদিকে ওঠেছিল। চারিদিকের পরিবেশ ছিল অস্বাভাবিক। ঘরে ঢুকতেই আম্মা জড়িয়ে ধরলেন।

‘তোর কি হয়েছিল’, ‘তুই কোথায় চলে গিয়েছিল’, ‘তোকে কে নিয়ে গিয়েছিল’- এসব বলে মা মায়াকান্না জুড়ে দিলেন।

আমার খুব অস্বস্তি হতে লাগল, আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আম্মার চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝার চেষ্টা করলাম- না পারলাম না, সে ভাষা বড় দুর্বোধ্য। ইতিমধ্যে আমাদের ঘরে বাড়ির ছেলে-বুড়ো সবাই হামলে পড়েছে।

ওদের মধ্যথেকে কেউ একজন আমার আম্মার উদ্দেশে বলল, ‘ওরে বউ, না কেঁদে আগে মাথায় পানি ঢাল!’ অমনি বালতি, মগ, পানি এসে গেল। এতক্ষণ পুরো শরীরটা খালের পানিতে ডুবন্ত ছিল। যে মাথাটা শুকনা ছিল তাও ভিজিয়ে দেওয়া হল। ঠান্ডা পানির পরশে আমার দেহে শীতল স্রোত বয়ে যেতে লাগল। বুঝতে পারলাম জ্বর ব্যাটা আজ দেহে ভর করবেই।

পানির অত্যাচার শেষ হতেই বুড়োবুড়িদের শোরগোল আরম্ভ হল।

কেউ বলল, ‘তাড়াতাড়ি মাওলানা ডেকে আন্‌ গা-টা বন্‌ধ্‌ করে দিক।’

‘মাওলানা নয় একটা সাধন ডেকে আন্‌ আগে ঝাড়ফুঁক করা দরকার’- আরেক বুড়ীর কন্ঠ শুনতে পেলাম।

কে যেন বলল, ‘নাতি আমার বড় বাঁচা বেঁচে গেছে, অ-সাবের(আমার আব্বাকে উদ্দেশ্য করে) একটা ফকিরকে ভাত খাওয়াইস আর কিছু চাল ও একটা মুরগীর বাচ্চা সদ্‌কা করে দিস।’

তার সাথে আরেকজন বলল, ‘একজন হুজুরকে দিয়ে মহসিন আউলিয়ার মাজারে এক খতম কুরান পড়াইস।’

এরি মাঝে আমার দাদীর কান্নাজড়িত কন্ঠ শুনতে পেলাম, ‘আমার নাতিরে আজ মারি ফালাইত, শাহজানরা(আমার সাথে খালে যারা শনমূল খাচ্ছিল) আছিল বইলা নিতে পারে নাই। অ-আল্লাহ তর বহুত শোকর, তুই ন-বাঁচাইলে আঁর নাতি ন- বাঁচিত!’

আমার মাথাটা কিছুকিছু পরিষ্কার হতে লাগল। এ অস্বাভাবিক পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে প্রাণ আমার ছটফট করতে লাগল। সেই প্রচেষ্টায় মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘মাগো আমার কি হয়েছে? তোমরা এমন করছ কেন?’

‘ওরে, তোকে ওরা নিয়ে যাচ্ছিল, পানিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলত, শাহজানরা ছিল বলে নিতে পারেনি’- এই বলে মা আমাকে আরও জোরে বুকে জড়িয়ে ধরল। মায়ের কথা শুনে মনের মেঘ আরও কিছুটা সরে গেল- বুঝলাম কোথাও কোন বড় মিসগাইড হয়েছে।

যত নষ্টের গোড়া চাচাত ভাই ওয়াসিম। অবশ্য ভুল আমারও ছিল। আমি ওয়াসিমের অগোচরেই খালে নেমেছিলাম। সে নিজের কাজ সেরে হয়ত আমাকে এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি করেছিল। কোথাও দেখতে না পেয়ে সে চিৎকার জুড়ে দিয়েছিল যে, রিফাতকে জ্বীনে নিয়ে গেছে, রিফাতকে জ্বীনে নিয়ে গেছে। তার চিৎকারে পাড়ার সবাই জড়ো হলেও আমরা শনমূল ভোজনরত কেউই শুনতে পাইনি, কেননা আমরা ওয়াসিম থেকে বেশ অনেক দূরে তার আওয়াজের রেঞ্জের বাইরে ছিলাম। শাহজানদের দিকে তাকালাম। ওরা যথাসম্ভব আমার থেকে দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের চোখে দেখলাম, আতঙ্ক আর সন্দেহের যুগপৎ সম্মিলন।

আমি শাহজানদের ইঙ্গিত করেই বললাম, ‘মা, ওরা মানে কারা! আমাকে তো কেউ নিয়ে যাচ্ছিল না, আমি তো শাহজানদের নিকট নিজেই গিয়েছিলাম, শনমূল খেতে’।

‘অ-বউ, নাম ন-ধরিস, ওরা যার ওপর আশিক হয় তার আশে পাশেই থাকে, তাড়াতাড়ি হুজুর ডেকে নিয়ে আয় না কেউ, আমার নাতির গা-টা বন্ধ করে দিক।’- পাড়াতো দাদী এবার আমার উদ্দেশে বলল, ‘অ-নাতি, কথা ন-কইস, মনে মনে সূরা ইয়াছিন পড়্‌’।

অল্পক্ষণ পর মৌলানা সাব এলেন। ওনার বিড়বিড় করে দোয়া বর্ষণের সাথে সর্ষের তেলের অত্যাচার এবং আমগাছের ডালের পিটুনী সহ্য করতে হল অনেক্ষণ। হুজুর সাহেব যাওয়ার সময় একদলা তাবিজ দিয়ে গেলেন। কে যেন তাবিজের পিতল খোল এবং রেশম সূতা এনে রেখেছিল। ওগুলোর সহায়তায় আমার গলায় তাবিজের ঘন্টা ঝুলানো হল। তারপর আর এক পশলা মাথায় পানি ঢালা হল।

সেই রাতে আমার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল। তিনদিন ছিল। তিনদিন পর যখন জ্বর সারল, তখন সবার ধারণা হল আমি মুক্তি পেয়ে গেছি। আর এই মহা কৃতিত্বের সব সাফল্য গিয়ে পড়ল মহসিন আউলিয়া মাদ্রাসার হুজুরটার উপর। অনেকদিন পর্যন্ত এমন কেটেছে যে, পাড়ার ছেলেরা ভয়ে আমার সাথে মিশেনি কিংবা খেলেনি।

তাদের মধ্যে দু’একজন যারা একটু সাহসী ছিল, তারা আমাকে ভয় দেখিয়ে বলত,

‘রিফাত একটু সাবধানে থাকিস ভাই, রাত্রে কোথাও বের হুসনে। একা একাও চলাফেরা করিসনে। একা পেলে তোকে আবারো নিয়ে যাবে রে ভাই’!

ওদের সবাইকে আমি অনেক বুঝিয়েছি যে, সত্যিই সেদিন আমাকে কোন জ্বীনে পাইনি। আমি তো শনমূল খেতে নিজে থেকেই শাহজানদের নিকট গিয়েছিলাম।

ওরা আমার কথা বিশ্বাস করত না। বলত, জ্বীনে ধরলে মানুষের হুঁশ থাকে না, তাই তোর কিছু মনে নেই। শাহজানদের দেখে তোকে ছেড়ে দিয়েছে। আর তাতে তোর হুঁশ ফিরে এসেছিল, নাহলে তোকে ধরে নিয়ে যেত রে। এখনো ভয় রয়ে গেছে, একটু সাবধানে থাকিস।

‘দূর, ভয় কিসের! আবার যদি ওই জ্বীন ব্যাটা ধরে, নিশ্চয়ই তোদের কেউ দেখে ফেলবি, তখন বাবাজীর আর ছেড়ে না দিয়ে উপায় থাকবে না’- আমি ঠাট্টা করে বললাম।

‘যদি আমরা কেউ না দেখি, তখন তো তোকে নিয়ে যাবে’- আদিল ভীতকন্ঠে জবাব দিল।

‘আচ্ছা বলতো, জ্বীন মানুষ ধরে নিয়ে গিয়ে কি করে? রাক্ষসের মত হাড় চিবিয়ে খায় নাকি!’- আমার মুখে আবারো ঠাট্টা।

বিজ্ঞ লোকের মত এবার বয়ান শুরু করল আমাদের আরেক চাচাতো ভাই জাকির, ‘আরে না, দাদীর কাছে শুনেছি, ওদের কেউ ক্ষতি করলে কিংবা কাউকে অপছন্দ হলে ওরা সেই মানুষটাকে তালগাছ কিংবা সুপারীগাছের মত লম্বা গাছে তোলে ফেলে। তারপর সুযোগবুঝে মাটিতে আছাড় মারে। তখন মানুষটি মরে যায়, আর বেঁচে থাকলে পাগল হয়ে যায়’

‘আর পছন্দ হলে ---!’- কৌতূহল মিশ্রিত কন্ঠে বলে আমাদের আরেক পাড়াতো বন্ধু ইদ্রিচ।

‘আর কাউকে যদি পছন্দ করে তবে সেই মানুষটাকে ওরা নিজের দেশে নিয়ে যায়। সেখানে কারো সাথে বিয়ে দিয়ে ওখানেই রেখে দেয়’- জাকির জবাব দেয়।

এবার সুযোগবুঝে আমি বললাম, ‘তাহলে আমার তো কোন ভয় নেই। নিয়ে গেলে ওদের দেশটা দেখতে পাব। সেটা নিশ্চয়ই খুব সুন্দর দেশ- দাদী কী রকম বলেছে রে!’

‘হ্যাঁ, দাদী বলেছে, ওখানে নাকি সোনা-দানা, হীরে-মাণিক্যের অভাব নেই’।

এবার ওয়াসিম আমাকে ঘায়েল করার জন্য বলে, ‘রিফাত ভাইয়া, হীরে মাণিক্যের ভান্ডার সেতো পাবি জ্বীন তোকে পছন্দ করলে। কিন্তু ওরা যদি তোকে অপছন্দ করে?’

সাথে শ্লেষ মাখানো তীর ছুড়ল আরেক বন্ধু বশির, ‘গাছে তোলে ফক্কা, ফট্‌ করে অক্কা!’

ভয়ের মাঝেও সবাই হেসে ফেলল।

আমি ওদের কথা থোড়াই কেয়ার করে বললাম, ‘না মারতে পারবে না’।

এবার শাহজান ঠোঁট উল্টে বলল, ‘ক্যান মারতে পারবে না! তুই কি বীরপুরুষ!’

আবারো সবার মুখে হাসির রোল পড়ে গেল।

আমি ঘাবড়ে না গিয়ে বললাম, ‘দূর বীরপুরুষ আমি না, বীরপুরুষ হল আমাদের মহসিন আউলিয়া মাদ্রাসার হুজুর। জ্বীন বাবাজী আমার কাছে ঘেঁষার সাহসও পাবে না।

এই দেখ্‌ আমার গলায় হুজুরের দেওয়া মহা অস্ত্র- তাবিজ’।

বিষয়: বিবিধ

১৩৮১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

245814
১৮ জুলাই ২০১৪ রাত ০৯:১৩
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : খুব মজা পেলাম!!!
এইভাবে কত হুজুর যে ব্যবসা করে।আমার বাড়িও ওইদিকেই যদিও জন্ম থেকেই শহরের বাসিন্দা।
১৮ জুলাই ২০১৪ রাত ১০:০৭
190886
গোনাহগার লিখেছেন : ধন্যবাদ। আসলে ব্যবসার সুযোগ তো আমরাই করে দেই।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File