মুসলিম উম্মাহ্’র বেদনাদায়ক অধ্যায়ের শুরু কবে থেকে??
লিখেছেন লিখেছেন হামজা ২১ জুলাই, ২০১৪, ১২:৩৫:৫৮ রাত
৮০২ খ্রীষ্টাব্দে যখন রোমান সম্রাট নিকোফোরাস মুসলিমদের বাৎসরিক খাজনা দিতে অস্বীকার করলো (যা দেবার জন্য রোমানরা মুসলিমদের সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিল এবং এ চুক্তি এই মর্মে হয়েছিল যে, এই খাজনার বিনিময়ে মুসলিমরা কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয় অভিযান থেকে বিরত থাকবে), তখন তৎকালীন খলীফা হারুন-উর-রশীদ নিকোফোরাসের কাছে এক লিখিত বার্তা প্রেরণ করলেন। প্রেরিত এই বার্তায় খলীফা হারুন-উর-রশীদ নিকোফোরাসকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন, “বিশ্বাসীদের আমীর হারুন-উর-রশীদ এর পক্ষ হতে রোমান কুকুর নিকোফোরাসের প্রতি; আমি তোমার পত্র পেয়েছি। কিন্তু, এর জবাব তুমি আমার কাছ থেকে শুনবে না বরং দেখবে!” এরপর, উদ্ধত রোমান সম্রাটকে শাস্তি দেবার লক্ষ্যে তিনি বিশাল এক সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী রোমান শহর হেরাক্লিয়া অবরোধ করেন এবং এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। এ বিজয় অভিযানের পর রোমান সম্রাট নিকোফোরাস পুনরায় বাৎসরিক খাজনা প্রদানে বাধ্য হয়েছিল।
একইভাবে, খলীফা মু’তাসিম বিল্লাহ’র শাসনামলে একজন মুসলিম নারী রোমান অধিকৃত ভূখন্ডে রোমান সৈন্য কর্তৃক লাঞ্ছিত হবার পর চিৎকার করে বলেছিল,“ইয়া মু’তাসিম!” বস্তুতঃ, সেই নারী শুধু এই কথাটুকুই উচ্চারণ করেছিল। কিন্তু, যখন মুসলিম নারীর এই আর্তনাদ বাগদাদে খলীফার নিকট পৌঁছালো, তখন তিনি তার হাতের পানির পেয়ালা ছুঁড়ে ফেলে তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “আল্লাহ্’র কসম, আমি সেখানে এমন বিশাল এক বাহিনী প্রেরণ করবো যে, সে বাহিনী যখন রোমান ভূখন্ডে প্রবেশ করবে তখনও তাদের বাকী অংশ আমাদের ভূখন্ড ত্যাগ করতে থাকবে। আর তোমরা আমাকে বলে দাও, রোমানদের সবচাইতে শক্তিশালী শহর কোনটি, আমি সে শহরেই আমার সেনাবাহিনী প্রেরণ করতে চাই।” মুসলিম নারীর আর্তনাদের জবাবে এটাই ছিল তৎকালীন খলীফার গৃহীত সিদ্ধান্ত। এরপর মুসলিমরা রোমান শহর আমুরিয়া (বর্তমানের আঙ্কারা), যেখানে উক্ত নারীকে আটকে রাখা হয়েছিল, তা জয় করে নিয়েছিল। এই ঘটনা ঘটে ৮৩৮ খ্রীষ্টাব্দে।
এছাড়া, ১৭৯৫ খ্রীষ্টাব্দে, খলীফা সুলতান তৃতীয় সেলিমের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র আলজেরিয়ার তৎকালীন ওয়ালী গাজী হাসান পাশার সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছিল। এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র উসমানী খিলাফতকে বছরে ৬ লক্ষ ৪২ হাজার ডলার মূল্যের সমপরিমাণ স্বর্ণ ও ১২ হাজার উসমানী লিরা খাজনা প্রদানে সম্মত হয়েছিল। এর বিনিময়ে আটলান্টিক ও ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামুদ্রিক জাহাজগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং আলজেরিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের ১০০ জন বন্দী নাগরিককে মুক্তি দেয়া হয়। এ চুক্তি স্বাক্ষরকালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো তার নিজস্ব ভাষার পরিবর্তে অন্য কোন ভাষায় চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং সে ভাষা ছিল উসমানী খিলাফতের ভাষা। ১৭৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এ চুক্তি সৌহার্দ্য ও শান্তির চুক্তি (Treaty of Amity & Peace) হিসাবে আখ্যায়িত হয়।
খিলাফতের নেতৃত্বের অধীনে এরকমই ছিল মুসলিম উম্মাহ্’র ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের চিত্র। এভাবেই মুসলিম জাহানের খলীফাগণ বারে বারে ইউরোপ ও আমেরিকাকে মুসলিমদের শাসন-কর্তৃত্বের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য করেছিলেন, যার মাত্র কয়েকটি উদাহরণ আমরা আপনাদের সামনে তুলে ধরেছি। মুসলিম উম্মাহ্’র সুদীর্ঘ গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের ঝুলিতে এরকম হাজারো উদাহরণ রয়েছে। তাই এতে বিস্মিত হবার কোন কারণ নেই যে, ১৩৪২ হিজরীর ২৮ রজব (১৯২৪ সালের ৩ মার্চ) যখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বৃটেন ও তার দালাল মোস্তাফা কামাল (তার উপর আলাহর লানত) এর হাতে খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেল, সেদিন মুসলিমদের চিরশত্রু কুফর শক্তি দারুণভাবে উল্লসিত হয়েছিল।
১৯২৪ সালের ২৪ জুলাই, লুজেন চুক্তি (Lausanne Treaty) স্বাক্ষরিত হবার পর হাউস অফ কমন্সে তৎকালীন বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী লর্ড কার্জন ঘোষণা দিয়েছিল যে, “মূল বিষয় হচ্ছে তুরস্ক ধ্বংস হয়ে গেছে এবং এটি আর কোনদিনও মাথা তুলে দাঁড়াবে না। কারণ, আমরা তাদের আধ্যাত্মিক শক্তিকে ধ্বংস করে দিয়েছি। আর তা হল খিলাফত এবং ইসলাম।” এছাড়া, আল-কুদস এ দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার পর বৃটিশ জেনারেল অ্যালেনবি ঘোষণা করে, “আজ ক্রুসেডের সমাপ্তি ঘটল।” আর, দামেস্ক দখল করে নেবার পর ফরাসী জেনারেল গরো (Gourou) তড়িৎ গতিতে সালাহউদ্দীন আইয়্যুবী’র সমাধিস্থলে প্রবেশ করে তার কবরে লাথি মেরে বলেছিল, “উঠো, সালাহউদ্দীন! আমরা আবার ফিরে এসেছি।”
এভাবেই মুসলিম উম্মাহ্’র শাসন-কর্তৃত্ব ধ্বংস করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের আনন্দ ও উল্লাস প্রকাশ করেছিল এবং তাদের প্রকাশিত এই উল্লাস ভিত্তিহীনও ছিল না। আজ এই সময়ে খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে আমরা যদি নিজেদের দিকে তাকাই, তাহলে কোন অবস্থায় নিজেদের দেখতে পাই? আজ আমরা পৃথিবীতে বাস করছি অধঃপতিত এক জাতি হিসাবে, যদিও পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত হিসাবে অভিহিত করেছেন। আজ আমাদের ভূখন্ডে আমাদের শিশুরা প্রতিদিন ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে মৃত্যুবরণ করছে, যদিও আমাদের ভূখন্ডগুলো ব্যাপক সম্পদে সমৃদ্ধ এবং আমাদের ভূমিগুলো বিশ্বের মধ্যে সবচাইতে বেশী উর্বর। আজ আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের সন্তানদের, ভাইদের হত্যাকান্ড এবং সেই সাথে আমাদের মা-বোন ও কন্যার সম্ভ্রম হরণের বেদনাদায়ক ঘটনার সাক্ষী হচ্ছি। সাম্রাজ্যবাদী কুফর শক্তি আজ ফিলিস্তিন, ইরাক, আফগানিস্তান, চেচনিয়া ও কাশ্মীরে অন্যায় দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রতাপশালী মুসলিম উম্মাহ্ আজ পরাজিত, অপমানিত। শত্রুপক্ষের এই অন্যায় আগ্রাসন ও সাম্রাজ্যবাদীদের অবৈধ দখলদারিত্ব প্রতিহত করতে মুসলিম উম্মাহ্ আজ অক্ষম, যদিও আমাদের রয়েছে পঞ্চাশ লক্ষাধিক সৈন্য সমৃদ্ধ বিশাল সেনাবাহিনী।
প্রকৃতপক্ষে, আমাদের পরাজয় ও অপমানের বেদনাদায়ক অধ্যায়ের শুরু হয়েছে তখনই যখন আমরা খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা হারিয়েছি। এরপর, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে তাদের স্বার্থ রক্ষাকারী তাঁবেদার ও দালাল শাসকদের। মেরুদন্ডহীন বাদশাহ, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ইত্যাদি বিভিন্ন নামে তাদের এ সমস্ত দালালরাই আজ আমাদের শাসন করছে। এই দালাল শাসকেরা আজ আমাদেরকে তথাকথিত স্বাধীনতার নামে পঞ্চাশটিরও বেশী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ফলে, আজ আমরা আমাদের ব্যাপক ও বিস্তৃত সম্পদকে একত্রিত করতে ব্যর্থ হচ্ছি, যদিও এ সম্পদ সমূহকে একত্রিত করে আমরা একটি অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হতে পারি। এই শাসকরা - যাদের মধ্যে রয়েছে গণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী কিংবা রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকারী - অবিশ্বাসী কুফর শক্তিকে তাদের প্রভু বলে স্বীকার করে নিয়েছে এবং মুসলিম দেশগুলোর সেনাবাহিনীগুলোকে ইসলামের শত্রুপক্ষের আজ্ঞাবহ করে রেখেছে।
শাইখ আসিম আল হাকিমের সেই কথাগুলো খুব মনে পড়ে, তিনি বলেছিলেন,
“মুসলিম দেশগুলোর মুনাফিকরা বলেঃ যদি তুমি শারিয়াহ (ইসলামি আইন) অনুসরণ করো, এটা তোমাকে হাজার বছর পেছনে নিয়ে যাবে!
আমি বলিঃ এটা আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সময়ে? নাকি উমারের (রা) সময়ে যখন তিনি পারস্য আর বাইজানটাইন সাম্রাজ্যকে পরাজিত করেছিলেন? এটা কি আমাদের উমাইয়া খিলাফাতে নিয়ে যাবে, যখন তা দক্ষিন ফ্রান্স আর গেটস অফ চায়না পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল? নাকি সেই সময়ে যখন আমরা আন্দালুসিয়া আর আজকের সমগ্র স্পেন শাসন করেছিলাম? সে কি ভুলে গেছে কুতয এর সময়ের কথা, যিনি মুসলিম বিশ্বকে মঙ্গোলদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন? অথবা হয়তো সে বুঝিয়েছে সালাহুদ্দিন আইয়ুবীর সময়ের কথা, যিনি বর্বর ক্রুসেডারদের থামিয়ে দিয়ে আর পরাজিত করে জেরুজালেমকে মুক্ত করেছিলেন? নাকি সে উসমানীও সাম্রাজ্যের কথা বলছে যখন মুসলিমরা এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের অংশবিশেষে ৬ শতাব্দী ধরে রাজত্ব করে?
আল্লাহর কসম, শারিয়াহ আমাদের যেই যুগেই নিয়ে যাক না কেন, তা আমাদের যেকোন কল্পনার চাইতেও উত্তম। এটাই সময় আমাদের শারিয়াহ মেনে চলার এবং শারিয়াকে আল্লাহর রহমাতে আমাদের সম্মান, গৌরব আর মর্যাদার সময়ে নিয়ে যেতে দেয়ার। আল্লাহ সেইসব সোনালী দিন আবার ফিরিয়ে আনুন।”
বিষয়: বিবিধ
৩০৭৪ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন