রোযা, ঈদ, লাইলাতুল কদর ও আরাফার দিন সহ চাঁদ নির্ভর প্রতিটি ইবাদাতে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বারের বা দিনের ভিন্নতা কেন? কুরআন, সুন্নাহ্, ফিক্হ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান কী বলে? ৯ম অংশ
লিখেছেন লিখেছেন হামজা ১৮ জুলাই, ২০১৪, ০২:১৯:৪৬ দুপুর
যারা নিজ নিজ দেশের চাঁদ অনুযায়ী রোজা ও ঈদ পালন করে থাকেন তাদের দলীল ও তাঁর জবাব
হাদিসে কুরাইব (রাঃ)
বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে সমাজে প্রচলিত এলাকা ভিত্তিক আমলকে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য কিছু সংখ্যক ওলামায়ে কিরাম হাদিসে কুরাইব (রাঃ) নামে প্রসিদ্ধ একটি হাদীসকে দলীল পেশ করেন। উক্ত হাদিসটি নিম্নরূপঃ
মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে: উম্মুল ফাযল বিনতুল হারিছ তাকে (কুরাইব) আশ-শামে মুয়াবিয়ার কাছে প্রেরণ করলেন; তিনি বলেন: “আমি আশ-শামে গেলাম এবং তার (উম্মুল ফাযল বিনতুল হারিছ)-এর পক্ষ থেকে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড সম্পাদন করলাম। আশ-শামে তখন রমযান মাস শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেখানে আমি শুক্রবারেই রমযানের নতুন চাঁদ দেখেছিলাম। মাসের শেষদিকে আমি তখন মদিনায় ফিরে এলাম, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) আমাকে রমযানের নতুন চাঁদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেন: তুমি এটা কখন দেখেছ? আমি বললাম: শুক্রবার রাতে আমরা এটা দেখেছি। তিনি বললেন: তুমি কি এটা নিজে দেখেছ? আমি বললাম: হ্যাঁ, আমি দেখেছি এবং অন্যান্য লোকজনও দেখেছে এবং সিয়াম পালন করেছে, মুয়াবিয়া (রা) ও সিয়াম পালন করেছেন; একথা শুনে তিনি বললেন: কিন্তু আমরা এটা দেখেছি শনিবার রাতে। অতএব আমাদেরকে ত্রিশ পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত অথবা এটি শাওয়্যালের (নতুন চাঁদ) না দেখা পর্যন্ত সিয়াম পালন অব্যাহত রাখতে হবে। আমি বললাম: মুয়াবিয়ার চাঁদ দেখা কি আপনার জন্য যথেষ্ট না? তিনি বললেন: না, কারণ এভাবেই আল্লাহর রাসূল আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন”।
পবিত্র হাদীসটির জবাব
সুবিজ্ঞ মুহাদ্দেসীনে কিরাম এবং হানাফী, হাম্বলী ও মালেকী মাযহাবের ইমামগণ অত্র হাদিসে পাককে দলীল হিসেবে গ্রহণ না করে হাদিসটির নিম্নরূপ জবাব দান করেছেন-
১। এই ধারাবাহিক লেখায় “রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম-এর নিজ আমল” শিরোনামে (http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/9430/Hamza/48879) পবিত্র মিশকাত শরীফের ১২৭ ও ১৭৪ পৃষ্ঠা থেকে যে তিনটি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে তার দ্বারা প্রমাণিত যে, রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম একজন মরুচারীর সংবাদকে ভিত্তি করে নিজে রোযা রেখেছেন এবং অন্যদেরকে রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। দূরদূরান্ত থেকে আগত একটি কাফেলার সংবাদের ভিত্তিতে ৩০শে রমযান মনে করে রাখা রোযা নিজে ভঙ্গ করেছেন এবং অন্যদেরকেও ভাঙ্গার নির্দেশ দিয়েছেন।
তাহলে যেখানে শরীয়ত প্রবর্তক নিজেই অন্যের সংবাদ গ্রহণ করে রোযা রেখেছেন এবং ঈদ করেছেন, সেখানে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রদি আল্লাহু তায়ালা আনহু কুরাইব রদি আল্লাহু তায়ালা আনহু-এর সংবাদ গ্রহণ করলেন, কি করলেন না তা ধর্তব্য নয়।
২। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র আমল বিষয়ক উক্ত হাদীস তিনটি হাদিসে মারফু। (মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কথা ও কাজ), আর কুরাইব রদি আল্লাহু তায়ালা আনহু-এর হাদীস হচ্ছে হাদিসে মাওকুফ। (সাহাবীগণের কথা ও কাজ) অতএব অছুলে হাদীস বা হাদীস ব্যাখ্যার মূলনীতি অনুযায়ী হাদিসে মারফুর মোকাবিলায় হাদিসে মাওকুফ আসলে, হাদিসে মারফু অমুযায়ী আমল করতে হয়।
৩।হাদিসে কুরাইব (রাঃ)-এর মধ্যে
هكذا امرنا النبى صلى الله عليه وسلم এবং فلانزال نصوم حتى نكمل ثلثين اونراه
বিশেষ উক্তি দু’টি মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম-এর নয় বরং অত্র উক্তিদ্বয় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রদি আল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নিজস্ব উক্তি। তাই একজন সাহাবীর নিজস্ব উক্তির তুলনায় কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াত এবং মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম-এর নির্দেশ ও আমল প্রাধান্য পাবে।
৪। ছহীহ মুসলিম শরীফের বর্ণনায় কুরাইব রদি আল্লাহু তায়ালা আনহু-এর চাঁদ দেখার স্বীকৃতি মূলক শব্দ نعم رأيته “হ্যা আমি চাঁদ দেখেছি” কথাটির উল্লেখ থাকলেও তিরমীযী সহ অন্যান্য বর্ণনায় কুরাইব (রাঃ) নিজে চাঁদ দেখেছেন এরকম শব্দের উল্লেখ নেই। ফলে অত্র হাদিসটি مضطرب বা মূল ভাষ্য কম-বেশী। তাই এর বিপরীতে স্পষ্ট মারফু হাদিস দলীল হিসেবে প্রাধান্য পাবে।
৫। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রদি আল্লাহু তায়ালা আনহু তার উক্তিদ্বয় দ্বারা মূলত ইঙ্গিত করেছেন রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম-এর বাণী- لاتصوم حتى تروه ولاتفطرو حتى تروه এবং صوموا لرؤيته وافطروا لرؤيته এর দিকে। আর রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম-এর এ বাণীর আমল উম্মতগণ কিভাবে করবেন তা মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম নিজ জীবদ্দশায়ই আমল করে দেখিয়ে গেছেন। তাহলো সকলকে চাঁদ দেখতে হবে না বরং কিছু সংখ্যকের দেখাই অন্যদের দেখার স্থলাভিষিক্ত হবে। অতএব ইবনু আব্বাস রদি আল্লাহু তায়ালা আনহু-এর উক্ত উক্তিদ্বয় দ্বারা নিজ নিজ এলাকায় চাঁদ দেখে আমল করতে হবে এ ব্যাখ্যা ঠিক নাও হতে পারে। (আল্লাহই ভাল জানেন)
৬।আল্লামা শাওকানী (রঃ) তার লিখিত “নাইলুল আওতার” গ্রন্থের ৪র্থ খন্ডে উল্লেখ করেছেন যে, “হযরত কুরাইব রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহু-এর সংবাদ এবং শামবাসীর চাঁদ দেখাকে গ্রহণ না করা এটা আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রদি আল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নিজস্ব ইজতিহাদ, যা সার্বজনীন আইন হিসেবে প্রযোজ্য নয়”।
ইমাম শাওকানী রহমাতুল্লাহি আলাইহী “নাইলুল আওতার” কিতাবে আরও লিখেছেন,
“ইবনে আব্বাস রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহু, রাসূল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এইকথার দিকে ইঙ্গিত করে থাকতে পারেন ‘রোযা রাখ চাঁদের আবির্ভাবে, ঈদ কর এর (চাঁদের) আবির্ভাবে, যদি সন্দেহ হয় ত্রিশ পূর্ণ কর’। এটাই ছিল নির্দেশ। ইহা একথা বলেনা যে এতটুকু বা এতপরিমান দূরত্ব হিসাব করা উচিত, অথবা সাক্ষ্যটি হওয়া উচিত এতটুকু বা এতপরিমান দূরত্বের মধ্যে”।
ইমাম সিদ্দীক হাসান খান (রঃ) তাঁর “রওযাতুন নাদীয়া” গ্রন্থের প্রথম খন্ডের ৩৩১ পৃষ্ঠায় ইমাম শাওকানী (রঃ) এর উক্ত বক্তব্যের প্রতি সমর্থন প্রদান করেছেন।
৭। ইবনে আব্বাস রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহু যদি স্হানীয় চাঁদ দেখার মতটিকে গ্রহন করতেন তাহলে তিনি (চাঁদ দেখার) ব্যপারটিকে যাচাই করতেন না বরং সাধারনভাবে বলে দিতেন এক এলাকার চাঁদ দেখা অন্য এলাকার জন্য প্রযোজ্য নয়।কিন্তু তিনি তা না করে বরং সংবাদটি যাচাই করেছেন এই প্রশ্নদুটি করে "তুমি এটা কখন দেখেছ? এবং “তুমি কি এটা নিজে দেখেছ?”
৮।আল্লামা ইবনু হুমাম (রঃ) ফতহুল কাদীরে এবং আল্লামা ইবনু নাজীম (রঃ) বাহরুর রায়েক-এর মধ্যে উল্লেখ করেছেন যে, পরিষ্কার আকাশে পবিত্র রমযানের চাঁদ দেখা প্রমাণিত হওয়ার জন্য শরয়ী পদ্ধতি হচ্ছে ৪টি। একঃ দু’জন আকেল, বালেগ ও স্বাধীন মুসলিম সাক্ষ্য দিবে, দুইঃ উক্ত গুণে গুণান্বিত দু’জন, অনুরূপ দু’জনের চাঁদ দেখার প্রতি সাক্ষ্য দিবে। তিনঃ অনুরূপ গুণে গুণান্বিত দু’ ব্যক্তি চাঁদ দেখায় কাজীর ফয়সালার প্রতি সাক্ষ্য দিবে। চারঃ চাঁদ দেখার খবর মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রচার পেয়ে দৃঢ়তার পর্যায়ে এমন ভাবে পৌঁছে যাবে যাকে মিথ্যা বলে ধারণা করা যায়না।
হাদিসে কুরাইবের ব্যাখ্যা এমনটি হতে পারে শামবাসীর চাঁদ দেখার সংবাদ কুরাইব রদি আল্লাহু তায়ালা আনহু কর্তৃক অত্র চার পদ্ধতির কোন পদ্ধতিতেই ইবনু আব্বাস রদি আল্লাহু তায়ালা আনহু-এর নিকট উপস্থাপিত হয়নি। তাই হয়তো শরয়ী বিচারে তিনি উক্ত সংবাদ গ্রহণ করেননি। (আল্লাহই ভাল জানেন)
৯। আল্লামা ইবনু ক্বুদামাহ্ (রঃ) তার মুগণী কিতাবে এবং শাইখুল হিন্দ হোসাইন আহমদ মাদানী (রঃ) মায়ারিফুল মাদানিয়া-এর মধ্যে উল্লেখ করেছেন যে, যদিও ইবনু আব্বাস রদি আল্লাহু তায়ালা আনহু-এর সাথে কুরাইব রদি আল্লাহু তায়ালা আনহু-এর আলোচনা হয়েছিল রমজানের চাঁদ দেখা নিয়ে কিন্তু এর প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া পড়ছিল অত্যাসন্ন ঈদুল ফিতরের উপর। কারণ উক্ত হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কুরাইব রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহু রমযানের শেষের দিকে শাম থেকে মাদিনায় এসে ছিলেন। আর শরীয়তের সিদ্ধান্ত মোতাবেক কমপক্ষে দু’জনের সাক্ষী ছাড়া রোযা ছেড়ে ঈদ করা যায়না। তাই হয়তো ইবনু আব্বাস রদি আল্লাহু তায়ালা আনহু একজনের সাক্ষ্য গ্রহণ না করে বলেছিলেন- هكذا امرنا النبى صلى الله عليه وسلم এবং فلانزال -نصوم حتى نكمل ثلثين اونرا
ইমাম ইবনে ক্বুদামাহ্ (রঃ) বলেন, “তারা শুধুমাত্র কুরাইব (রাঃ) এর কথায় রোযা বন্ধ করতে (ঈদ করতে) পারতেন না”। কারন দু’জনের সাক্ষী ছাড়া রোযা ছেড়ে ঈদ করা যায়না।
[(দেখুনঃ তানযীমুল আশতাত, খন্ড-২, পৃঃ-৪১, মিফতাহুন্নাজ্জাহ, খন্ড-১, পৃঃ-৪৩২,মায়ারিফুল মাদানিয়া, খন্ড-৩, পৃঃ-৩২-৩৫)]
১০। বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীসের সাবেক সভাপতি মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহিল কাফী আল কুরাইশী (রঃ) হাদীসে কুরাইব সম্পর্কে লিখেছেন,
“রাসূলুল্লাহ (দঃ) কি আদেশ করিয়াছেন, ইবনে আব্বাস তাহা উল্লেখ করেন নাই, রাসূলুল্লাহর (দঃ) আদেশের যে তাৎপর্য তিনি উপলদ্ধি করিয়াছেন, তিনি কেবল তাহাই উল্লেখ করিয়াছেন, সুতরাং এক প্রদেশের রূয়ত অন্য প্রদেশের জন্য প্রযোজ্য না হওয়া হযরত ইবনে আব্বাসের নিজস্ব ইজতিহাদ মাত্র। রাসূলুল্লাহর (দঃ) নির্দেশ ইমাম আহমাদ, মুসলিম ও তিরমিযি প্রভৃতি ইবনে উমর ও আবু হুরায়রার (রাঃ) বাচনিক রেওয়ায়েত করিয়াছেন:
“হিলাল (চাঁদ) দর্শন করার পর রোযা রাখিবে আর উহা দর্শন করিয়া ফিতর (ঈদ) করিবে, যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়, তাহা হইলে দিন গণনা করিবে”। অন্য রেওয়ায়েতে আছে, রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলিলেন, “আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হইলে ত্রিশের সংখ্যা পূর্ণ করিবে”। (বুখারী (১) ২১৫, মুসলিম (১) ৩৪৭, তিরমিযী (২) ৩৪ পৃঃ)
রাসূলু্ল্লাহর এই আদেশ ব্যাপক, কোন অঞ্চল বা ভূভাগকে তাঁর আদেশে সীমাবদ্ধ করা হয় নাই সুতরাং একস্হানের রূয়ত (দেখা) দ্বারা সকল স্হানে উহার বিধান বলবৎ করার আদেশ অধিকতর স্পষ্ট এবং নস্সের ব্যাপক আদেশকে ইবনে আব্বাসের ইজতিহাদ সীমাবদ্ধ করিতে সক্ষম নয়।
বুখারী ও মুসলিমের উল্লিখিত হাদীস প্রসঙ্গে ইমাম শাওকানী লিখিয়াছেন:
“রাসূলুল্লাহর (দঃ) আদেশ আঞ্চলিক বিভিন্নতার জন্য পৃথক পৃথক হয় নাই, সকল মুসলমান উক্ত আদেশে সম্বোধিত হইয়াছেন, সুতরাং এক নগরের রূয়ত অন্য নগরের প্রতি প্রযোজ্য হইবার ব্যবস্থা – না হইবার ব্যবস্থা অপেক্ষা সুস্পষ্ট। কারণ এক শহরের মুসলমানের চন্দ্র দর্শন সকল মুসলমানের দর্শনের অনুরূপ, সুতরাং সেই শহরের মুসলমানগণের উপর যাহা প্রযোজ্য হইবে, অপর স্হানের মুসলমানদের উপর ও তাহা বলবৎ হইবে”। (ইমাম শাওকানীর কথা এপর্যন্তই এখানে দেয়া হয়েছে) [(নাইলুল আওতার)]
তারপর এক শহরের রূয়ত (দেখা) অন্য শহরের জন্য অনুসরণীয় না হওয়াই যদি ইবনে আব্বাসের ইঙ্গিতকৃত হাদীসের তাৎপর্য হয়, তাহা হইলে দূরত্বের পরিমাণ এবং মত্লার পার্থক্য ইত্যাদি বিষয় সম্বন্ধে উহাতে কোন উল্লেখ নাই। আবার ইহাও লক্ষ্য করার বিষয় যে শাম ও মদীনার দূরত্ব এত দূর নয় যাহাতে মতলার পার্থক্য ঘটিতে পারে, সুতরাং ইবনে আব্বাসের শামের রূয়ত অস্বীকার করার হেতুবাদ তাহার ইজতিহাদ মাত্র”। (মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহিল কাফী আল কুরাইশী (রঃ) এর কথা এপর্যন্তই এখানে দেয়া হল) ।
মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহিল কাফী আল কুরাইশী (রঃ) আরও লিখেছেন,
“ইবনে আব্বাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহর (সঃ) বাচনিক এমন কোন হাদীস রেওয়ায়েত করেন নাই, যদ্বারা আমরা বিবেচনা করিয়া দেখিতে পারি যে, উহা হযরতের (সঃ) ব্যপক আদেশকে সীমাবদ্ধ করিতে পারে কিনা। সর্বশেষ কথা এই যে, ইবনে আব্বাসের ইজতিহাদকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর ব্যপক আদেশের সংকোচক বলিয়া মানিয়া লইলে বেশীর বেশী এইটুকু সাব্যস্ত হইতে পারে যে, মদীনা হইতে দামেশকের দূরত্ব যতখানি ততখানি দূরত্বে অবস্থিত কোন শহরের রূয়ত অন্য শহরের উপর প্রযোজ্য নয়, কিন্তু ইবনে আব্বাসের (রাঃ) ইজতিহাদকে মারফু হাদীসের সংকোচক স্বীকার করার উপায় নাই।
ইমাম কুরতুবী তাঁহার উস্তাদগনের উক্তি উদ্ধৃত করিয়াছেন যে,
“এক নগরীর অধিবাসীরা হিলাল দর্শন করিলে সকল প্রদেশের অধিবাসীগণের জন্য উহা অনুসরণীয় হইবে ইহাই ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালিক এবং ইমাম আহমাদের সিদ্ধান্ত”। (ইমাম কুরতুবীর কথা এপর্যন্তই এখানে দেয়া হয়েছে) [গায়াতুল আমানী (৯) ২৭২ পৃষ্ঠা]
রাসূলুল্লাহর (দঃ) স্পষ্ট নির্দেশের সহিত এই সিদ্ধান্তই সুসামঞ্জস্য এবং আমরা ইহাকেই অনুসরণযোগ্য মনে করি।” (মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহিল কাফী আল কুরাইশী (রঃ) এর কথা এপর্যন্তই এখানে দেয়া হল) ।
১১। হযরত ইবনু আব্বাস রদি আল্লাহু তায়ালা আনহু-এর আমলকে দলীল গ্রহণ করে, যে সকল পূর্ববর্তী আলেমগণ এলাকা ভিত্তিক আমলের সপক্ষে মতামত দিয়েছেন তারা প্রায় সকলেই একথা বলেছেন যে, “নিকটবর্তী দেশ বা অঞ্চলে চাঁদের উদয় স্থলের ভিন্নতা গ্রহণীয় হবে না। এক স্থানের দেখা দ্বারাই সকল স্থানে আমল করতে হবে। আর যদি চাঁদ দেখার দেশটি চাঁদ না দেখার দেশ থেকে অনেক দূরে হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে যার যার দেখা অনুযায়ী আমল করতে হবে।” একটু গভীর ভাবে লক্ষ্য করলে সকলের নিকটই একথা সূর্যালোকের মত পরিষ্কার যে, এক দেশের চাঁদ দেখার সংবাদ অন্য দেশ থেকে গ্রহণ করা না করার দিক থেকে ঐ সকল সম্মানিত ওলামাই কিরাম পৃথিবীকে নিকটবর্তী ও দূরবর্তী এ দু’ভাগে ভাগ করার কারণ হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যা। তাদের যুগে যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে তাদের এ মতামত ঐ যুগের জন্য যুক্তিযুক্ত এবং যথার্থ ছিল। কিন্তু পূর্ববর্তী সম্মানিত ওলামাই কিরামের ঐ মতামত (প্রত্যক জায়গায় স্হানীয় চাঁদ) এর বিপরীত মত (উদয়স্থলের অভিন্নতা Global moon sighting) বর্তমানে দু’টি কারণে প্রাধান্য পাওয়া উচিত। এক: যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির কারণে বর্তমান পৃথিবীর বিপরীত মেরুর দেশ দু’টিও তাদের যুগের পাশাপাশি অবস্থিত দু’টি জেলা শহরের চেয়েও অধিক নিকটবর্তী। সুতরাং আজকের যোগাযোগ ব্যবস্থায় দূরবর্তী দেশ বলতে আর কোন কথা নেই। দুই: তারা যে ওজর বা বাধ্যবাধকতার কারণে এ মতামত দিয়েছেন আজকের বিশ্ব ব্যবস্থায় সে ওজর সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
১২। ইমাম যায়লায়ী (রহঃ) যিনি নিজ নিজ দেশে বা এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে চাঁদ দেখে সেই অনুযায়ী পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন বারে রোজা ও ঈদ পালন করার ব্যপারে মত প্রকাশ করেছেন, তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে বেশীর ভাগ ফকীহ বা ফিকাহবিদ সারা পৃথিবীতে একই দিনে রোযা শুরু ও সারা পৃথিবীতে একই দিনে ঈদ করার মত গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তার সমসাময়ীক সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে চাঁদ উদয়ের সংবাদ দেয়া-নেয়ার সমস্যার সমাধান কল্পেই হয়তো তিনি সহ আরও অনেক সম্মানিত ইমাম নিকটবর্তী দেশ এবং দূরবর্তী দেশ অনুসরণের ফাতওয়া দিয়েছিলেন। বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থার কোন অসুবিধা না থাকায় যে সকল ইমামগন উদয়স্থলের অভিন্নতার ফাতওয়া দিয়েছেন সেটাই প্রাধান্য পাওয়া উচিত।
বর্তমান বিশ্বের প্রখ্যাত আলিম শাইখ আল্লামা তাক্বী উসমানী (দাঃ বাঃ) যথার্থই বলেছেন,
“নিকটবর্তী ও দূরবর্তী শহর বলে যে পার্থক্য পরবর্তী হানাফি উলামাগন করেছেন তা চাঁদের উদয়স্হলের ভিন্নতার বাস্তবতার বিরুদ্ধে যায় কারন নিকটবর্তী ও দূরবর্তী শহরের প্রকৃত (বা নির্ধারিত) কোন দূরত্ব নাই।”
১৩। পাকিস্তানের মুফতিয়ে আজম হযরত রফী উসমানী (দাঃ বাঃ) হানাফী ফিকহ থেকে ফতহুল কাদীর, মালিকি ফিকহ থেকে শরহে কাবীর, হাম্বলী ফিকহ থেকে শরহে মুনতাহা আল ইরাদত এর উদ্ধৃতি (যা বিশ্বব্যপী একই দিনে রোজা ঈদের পক্ষের মতের উদ্ধৃতি) এবং শাফেয়ী ফিকহ থেকে তুহফাত আল মুহতাজ এর উদ্ধৃতি (যা স্থানীয় চাঁদ দেখার পক্ষের মত) উল্লেখ করার পর ইমাম ইবনে ক্বুদামাহ এর উদ্ধৃতি (যা বিশ্বব্যপী একই দিনে রোজা ঈদের পক্ষের মতের উদ্ধৃতি) দিয়েছেন এবং এরপর নিজের মতামত লিখেছেন এভাবে,
“এই দূর্বল বান্দা রফী উসমানীর বক্তব্য হচ্ছে, আমাদের কাছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মতামত অধিকাংশের একমত হওয়া মতামতের সাথে, আর তা হচ্ছে উদয়স্হলের ভিন্নতা বিবেচনা না করা, উপরে বর্ণিত প্রমানগুলির সাপেক্ষে এবং নিম্নোক্ত কারনে
(১) এই বিশ্বের (প্রায়) সব দেশেই মুসলিমরা বাস করছে। আজকের দিনে ও যুগে বিশ্বটি একটি গ্রামের মত। এটা হয়েছে অন্যান্য অগ্রগতির সাথে সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও গনমাধ্যমের উন্নতির কারনে। এখন গোটা বিশ্বে সংবাদ আদান প্রদান করা খুব দ্রুত সময়েই সম্ভব হচ্ছে। দেশ থেকে দেশান্তরে ভ্রমনের দ্রুতগামীতা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।এই অবস্থা দাবী করে দুই ঈদের উদযাপন ও আনন্দ মুসলিমদের মধ্যে ভাগাভাগি হবে একই দিনে।
(২) আজকের দিন ও যুগে আন্তর্জাতিক প্রায় প্রতিটি দেশেই চার ইমামের ফিকহের অনুসারীরা বাস করছে এমন বিস্তৃতভাবে যে আপনি দেখবেন জাপানের অঞ্চল গুলির একটি শহর এলাকাতেও। উদাহরনস্বরূপ তাদের কেউ কেউ মালিকি ফিকহের পাশাপাশি কেউ কেউ শাফেয়ী ফিকহের। সুতরাং উদাহরন স্বরূপ মালিকি ফিকহের অনুসারীরা স্থানীয় চাঁদ দেখা ধর্তব্য মনে করেননা এবং ঈদ উদযাপন করেন প্রতি সময় দূর পশ্চিমের চাঁদ দেখার সংবাদ অনুযায়ী যখন শাফেয়ী ফিকহের অনুসারীরা ঈদ উদযাপন করেননা স্থানীয় চাঁদ দেখা গ্রহনের কারনে। এই অবস্থা আজকের দিনে ও যুগে অপমান ও মানহানিকর অবিশ্বাসীদের কাছে। এটা লজ্জাষ্কর ও বটে মুসলিমদের অবস্থা বুঝতে যা প্রতিবছর দেখা যায়।এই বিষয়টি অমুসলিম (সংখ্যাগরিষ্ঠ) দেশগুলিতেও বিশৃংখলা তৈরী করছে ঈদের জন্য ছুটির দিন নির্ণয় করতে।” (মুফতি রফী উসমানী সাহেবের কথা এ পর্যন্তই এখানে দেয়া হলো) [(Mathabah- Mufti Rafi Usmai)]
১৪। যদি সকল তর্ক-বিতর্ক বাদ দিয়ে হাদিসে কুরাইব-এর ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন দিনে রোযা ও ঈদ মেনে নেওয়া হয় এবং রোযা, ঈদ, কুরবানীসহ চাঁদের তারিখ সংশ্লিষ্ট ইবাদাত সমূহ সমগ্র বিশ্বে একই দিনে অনুষ্ঠিত না হয় তাহলে এমন সব জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয় যার কোন সমাধান নেই। নিম্নে এরকম প্রধান প্রধান কিছু সমস্যা তুলে ধরা হল-
(১) বাংলাদেশে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সমূহের ( যেমন সৌদি আরব, ইয়েমেন, ওমান, ইরাক, কুয়েত, জর্দান ইত্যাদি দেশের ) একদিন পরে সিয়াম / রোজা শুরু করলে, বা বাংলাদেশে মধ্যপ্রাচ্যের একদিন পরে ঈদ করলে এই অবস্হা হয়: বাংলাদেশ থেকে কেউ রোযা শুরু করে রমযান মাসের যে কোন দিন মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে সেখানে ঈদ করলে তার রোযা ২৮ বা ২৯ টি হয় অর্থাৎ অন্যদের চেয়ে একটি কম হয়, আবার মধ্যপ্রাচ্য থেকে কেউ রোযা শুরু করে রমযান মাসের যে কোন দিন বাংলাদেশে এসে ঈদ করলে তার রোযা ৩০ বা ৩১ টি হয় অর্থাৎ অন্যদের চেয়ে একটি বেশি হয়। অথচ ২৮ বা ৩১ রোজার বিধান ইসলামে নাই। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে আরবী মাস ২৯-এর কম হবেনা এবং ৩০-এর বেশী হবেনা। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ঈদের দিন রোযা রাখা হারাম। ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন দিনে রোযা ও ঈদ মেনে নিলে এই ২৮ বা ৩১ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
(২) ঠিক একই ভাবে আরও কিছু প্রশ্ন এসে যায়, যেমন মধ্যপ্রাচ্যে কেউ ঈদুল ফিতরের দিন ঈদের নামাজ আদায় করে ঐদিন বাংলাদেশে এসে দেখল (স্হানীয়ভাবে আলাদা চাঁদ দেখে আমলের কারনে) বাংলাদেশের মানুষ রোজা করছে। তাহলে সে দিনের বাকী সময় পানাহার করতে পারবে কিনা? একইভাবে, আফগানিস্তানে কেউ ঈদুল ফিতরের দিন ঈদের নামাজ আদায় করে ঐদিন (মানুষের তৈরী হারাম জাতীয়তাবাদী সীমান্ত পার হয়ে) একেবারে পাশের দেশ পাকিস্তানে এসে দেখল (স্হানীয়ভাবে আলাদা চাঁদ দেখে আমলের কারনে) মানুষ রোজা করছে। তাহলে সে দিনের বাকী সময় পানাহার করতে পারবে কিনা?
আবার বাংলাদেশে কেউ স্হানীয়ভাবে আলাদা চাঁদ দেখে শাবানের হিসাব করে শাবানের শেষ দিন দিনের বেলা খাওয়া-দাওয়া করে ঐদিন মধ্যপ্রাচ্যে যেয়ে দেখল মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ রমজানের রোজা করছে। তাহলে সে দিনের বাকী সময় পানাহার করতে পারবে কিনা? একইভাবে, পাকিস্তানে কেউ স্হানীয়ভাবে আলাদা চাঁদ দেখে শাবানের হিসাব করে শাবানের শেষ দিন দিনের বেলা খাওয়া-দাওয়া করে ঐদিন (মানুষের তৈরী হারাম জাতীয়তাবাদী সীমান্ত পার হয়ে) একেবারে পাশের দেশ আফগানিস্তানে যেয়ে দেখল আফগানিস্তানের মানুষ রমজানের রোজা করছে। তাহলে সে দিনের বাকী সময় পানাহার করতে পারবে কিনা? এইসকল সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়না।
(৩) জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া, জাহান্নামের দরজা বন্ধ করা, মূল শয়তানকে বন্দি করা এগুলি দুই দিনে দুই বার নয় বরং এক বারই হয়ে থাকে। ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন দিনে রোযা ও ঈদ মেনে নিলে এগুলি একাধিক বার হয় বলে মেনে নিতে হয় যা বিবেকগ্রাহ্য নয়।
(৪) রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন যে, “আরাফার দিনে রোযার ব্যাপারে আমি আল্লাহর নিকট আশা রাখি, তা পূর্ববর্তী বছর এবং পরবর্তী বছরের গুনাহ্ মুছে দিবে (বা ঐ দিনের রোযার বিনিময়ে আল্লাহ পাক রোযাদারের পূর্ববর্তী এক বছর এবং পরবর্তী এক বছরের গুনাহ্ ক্ষমা করে দেন)”। [(মুসলিম শরীফ, অধ্যায় সাওম, হাদীস নং ২৬০২ ও ২৬০৩, অথবা অধ্যায় ৬, হাদীস নং ২৬০২ ও ২৬০৩) অথবা (মুসলিম শরীফ, অনুবাদ – আ.স.ম. নুরুজ্জামান, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ১১১ - ১১২, অধ্যায় ১৪ - কিতাবুস সাওম, হাদীস নং ২৬১২ ও ২৬১৩)]
আরাফার দিন হচ্ছে সেটাই যেদিন হাজীগন আরাফার মাঠে থাকেন। ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন দিনে রোযা ও ঈদ মেনে নিলে আরাফার দিন দুটি হয়ে যায় অথচ আরাফার দিন একটাই।
(৫) চাঁদের উদয় স্থলের ভিন্নতা অনুযায়ী নিশ্চিতভাবে সঠিক স্হায়ী সীমানা নির্ধারন করা যায়না। কারন উদয় স্থল সর্বদা একই রকম থাকেনা। যে কোন বছরে যে কোন মাসের চাঁদ পৃথিবীতে প্রথম উদিত হলে যে এলাকাসমূহ তার আওতাভূক্ত থাকে তার সীমানা প্রতিমাসে একরকম থাকেনা, প্রতি বছরেও একরকম হয়না। তারপরেও যদি চাঁদের উদয় স্থলের ভিন্নতার ভিত্তিতে পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকার সীমানা নির্ধারন করে একই দিনে সেই সীমানার এক পাশে রোযা অন্য পাশে ঈদ হয়, তবে সেই সীমান্ত অঞ্চলের মানুষ কি রোযা করবে নাকি ঈদ করবে এর কোন সমাধান পাওয়া যায়না।
(৬) চাঁদ দেখার সংবাদ যদি নিকটবর্তি এলাকায় গ্রহণ করা হয় আর দূরবর্তি এলাকায় গ্রহণ না করা হয় তাহলে যে এলাকাকে সর্বশেষ নিকটবর্তি এলাকা মনে করে সংবাদ গ্রহণ করা হচ্ছে আর তার একেবারে পাশের এলাকাকেও দূরবর্তি মনে করে সংবাদ গ্রহন করা হচ্ছে না, এই দুই এলাকার সীমান্ত অঞ্চলের মানুষ সংবাদ গ্রহণ করবে কিনা এর কোন সমাধান পাওয়া যায়না।
(৭) “চাঁদ দেখার নির্ভরযোগ্য সংবাদ সর্বোচ্চ কতদূরত্বের মধ্য থেকে আসলে তা গ্রহনযোগ্য হবে” অথবা “সর্বনিম্ন কতটুকু দূরত্বের বাইরের চাঁদ দেখার নির্ভরযোগ্য সংবাদ গ্রহনযোগ্য হবে না” তার নির্ধারিত কোন পরিমান কুরআনের আয়াত বা রাসূল (সাঃ) এর হাদীসে পাওয়া যায় কি??? (এই দূরত্বের সঠিক পরিমানের কথা উল্লেখ আছে এমন কোনো কুরআনের আয়াত বা রাসূল (সাঃ) এর হাদীস অধম লেখকের ক্ষুদ্রতম জ্ঞানে জানা নাই। সম্মানিত পাঠক, এমন কোনো কুরআনের আয়াত বা রাসূল (সাঃ) এর হাদীস পেলে, অধম লেখককে জানানোর বিনীত অনুরোধ রইল।)
(৮) হারাম জাতিয়তাবাদী বর্ডার বা দেশের সীমারেখা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন দিনে রোযা শুরু বা ভিন্ন ভিন্ন দিনে ঈদ মুসলিমরা কেন করবে? দেশে দেশে এই সীমান্ত তো মানুষের তৈরী, আল্লাহর দেয়া নয়, তাহলে ব্রিটিশের দেয়া বর্ডার অনুযায়ী কেন মুসলিমরা ভিন্ন ভিন্ন বারেরোযা শুরু করবে, আর কেনইবা ভিন্ন ভিন্ন বারে ঈদ করবে?? আফগানিস্তান ও পাকিস্তান একেবারে পাশাপাশি এবং একটাই মুসলিম ভূমি। অথচ আফগানিস্তানের সরকারী ঘোষনা অনুযায়ী যেদিন ঈদুল ফিতর হয়, সাধারনত পাকিস্তানের সরকারী ঘোষনা অনুযায়ী তার পরদিন ঈদুল ফিতর হয়। আফগানিস্তান ও পাকিস্তান একটাই মুসলিম ভূমি হওয়া স্বত্তেও হারাম জাতিয়তাবাদী বর্ডার বা দেশের সীমারেখার কারনে সরকারী ঘোষনা অনুযায়ী আফগানিস্তানে যেদিন ঈদুল ফিতর হচ্ছে পাকিস্তানে সেদিন রোজা হচ্ছে। অথচ ঈদের দিন রোযা রাখা হারাম। কি আশ্চর্য্য! একই ভূমিতে একই মুসলিম জাতি একই দিনে সরকারী ঘোষনা মানতে গিয়ে ব্রিটিশের দেয়া বর্ডার বা সীমান্ত অনুযায়ী সীমান্তের এক পাশে ঈদ আর অন্য পাশে রোজা করতে বাধ্য হচ্ছে!! হায়রে মুসলিমদের অবস্হা!! পৃথিবীর সমস্ত মুসলিম একই জাতি হওয়াস্বত্তেও ব্রিটিশের ভাগ করা সীমান্ত, আলাদা আলাদা হারাম জাতিয়তাবাদী পতাকা, হারাম জাতিয়তাবাদী দালাল সরকার এইসবের কারনে ৫৭ টুকরায় বিভক্ত হয়ে আছে, এমনকি রোযা ঈদ পর্যন্তও এগুলি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে!! বৃটিশরা দাগ টেনেছে মাটিতে, আর কিছু মুসলিম সেই দাগ আকাশেও টেনে বলছে, আমার দাগের ভিতরে চাঁদ আসলে এটা আমার চাঁদ, তোমার দাগের ভিতরে আসলে তোমার চাঁদ! কি ভয়ংকর জাতিয়তাবাদ!!
রাসূল (সঃ) বলেন, “সে আমাদের অন্তর্ভূক্ত নয় যে জাতিয়তাবাদের দিকে আহবান করে, জাতিয়তাবাদের জন্য যুদ্ধ করে বা জাতিয়তাবাদের জন্য মারা যায়” [(আবু দাউদ)]
রাসূল (সঃ) আরও বলেন, “যে আসাবিয়্যার (অর্থাৎ জাতীয়তাবাদের) জাহেলী আহবানের দিকে মানুষকে ডাকে সে যেন তার পিতার লজ্জাস্হান কামড়ে ধরে পড়ে আছে (তাকে ছাড়তে চাইছে না) । (এরপর রাসূল সাঃ বলেন) এবং একথাটি লুকিয়ে রেখোনা (অর্থাৎ বলার ক্ষেত্রে কোনো লজ্জা বা অস্বস্তি বোধ করোনা)”। [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২১২৩৩]
সুতরাং কোনো জাতি রাষ্ট্রের সীমানা অনুযায়ী মুসলিম উম্মত বিভক্ত হওয়া হারাম। শরীয়তের দৃষ্টিতে প্রত্যেক মুসলিম পরস্পর ভাই ভাই এবং তাদের ভূমিগুলো একই ভূমি হিসেবে বিবেচিত হয়।
১ম অংশ: কিছু প্রশ্ন http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/9430/Hamza/48800
২য় অংশ: পবিত্র কুরআনের বক্তব্য http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/9430/Hamza/48868
৩য় অংশ: হাদীস শরীফের বক্তব্য http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/9430/Hamza/48879
৪র্থ অংশ: ফিকাহ এর সিদ্ধান্ত http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/9430/Hamza/48891
৫ম অংশ: ও, আই, সি (OIC) - এর সিদ্ধান্ত http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/9430/Hamza/48895
৬ষ্ঠ অংশ: বৃটেন ও কানাডার সমস্যা এবং মুফতি বৃন্দের ফাতওয়া http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/9430/Hamza/48901
৭ম অংশ: ভৌগোলিক জ্ঞান সংশ্লিষ্ট কিছু প্রশ্ন এবং তার জবাব http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/9430/Hamza/48916
৮ম অংশ: সারা পৃথিবীতে একই সময়ে নামাজের ওয়াক্ত হয়না তাহলে একই দিনে রমজান মাস শুরু হবে কিভাবে? http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/9430/Hamza/48934
৯ম অংশ: যারা নিজ নিজ দেশের চাঁদ অনুযায়ী রোজা ও ঈদ পালন করে থাকেন তাদের দলীল ও তাঁর জবাব http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/9430/Hamza/49494
১০মঅংশ: আহবান http://www.onbangladesh.org/blog/blogdetail/detail/9430/Hamza/49520
সম্পূর্ণ লেখা http://moonsighting.ucoz.com/Global_Moon_Sighting_by_Amir_Hamza_.pdf
বিষয়: বিবিধ
৩২৪২ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এই প্রশ্নে দুটি দিক রয়েছে।
(১) “একই সময়ে” আর “একই দিনে” এর তুলনা করা হয়েছে।
(২) নামাজের ওয়াক্তের সাথে রমজান মাস শুরুর তুলনা করা হয়েছে
নিম্নে এ দুইটি বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
(১) একই সময়ে আর একই দিনে কথাটির পার্থক্য
এখানে “একই সময়” আর “একই দিনে” কথাটির পার্থক্য বুঝতে হবে। “একই সময়” অর্থ একইসেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা । আর “একই দিনে” অর্থ “একই বারে” যেমন শনিবার, রবিবার, সোমবার। আমরা কখনোই বলিনি সারা পৃথিবীতে রোজা “একই সময়ে” রাখতে হবে । আমরা বলেছি সারা পৃথিবীতে রোজা “একই দিনে” রাখতে হবে।
সারা পৃথিবীতে নামাজ যেমন “একই সময়ে” (সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা) পড়া যায়না, সারা পৃথিবীতে রোজাও তেমনি “একই সময়ে” রাখা যাবে না।
কিন্তু সারা পৃথিবীতে নামাজ “একই দিনে” পড়তে হয়। যেমন জুম্মার নামাজ সারা পৃথিবীতে একই দিনে (শুক্রবারে) পড়তে হয়। ঠিক তেমনিভাবে সারা পৃথিবীতে রোজা “একই দিনে” রাখতে হবে।
সারা পৃথিবীতে একই সময়ে নামাজ পড়া যায়না
সারা পৃথিবীতে একই সময়ে রোজা রাখা যায়না বা সাহরী করা যায়না
সারা পৃথিবীতে একই সময়ে ইফতার করা যায়না
কিন্তু
সারা পৃথিবীতে
একই দিনে নামাজ পড়তে হয় যেমন জুম্মার নামাজ শুক্রবারে পড়তে হয়
সারা পৃথিবীতে একই দিনে রোজা রাখতে হয়
সারা পৃথিবীতে একই দিনে ঈদ করতে হয়
সারা পৃথিবীতে জুম্মার নামাজের ওয়াক্ত যেমন একই সময়ে হয়না, সারা পৃথিবীতে ঈদের নামাজের ওয়াক্তও একই সময়ে হয়না।
সারা পৃথিবীতে জুম্মার নামাজের ওয়াক্তের বা সময়ের পার্থক্য বজায় রেখেই জুম্মার নামাজ যেমন একই দিনে আদায় করতে হয় তেমনি সারা পৃথিবীতে ঈদের নামাজের ওয়াক্তের পার্থক্য বজায় রেখেই ঈদের নামাজ ও একই দিনে বা বারে (যেমন শুক্র শনি রবি -----বৃহঃ) আদায় করতে হবে।
(২)নামাজের ওয়াক্তের সাথে রমজান মাস শুরুর তুলনা সঠিক নয়
নামাজের ওয়াক্ত, সাহরী এবং ইফতার সূর্যের সাথে সম্পর্কিত, চাঁদের সাথে নয়। যেমন ইফতার করতে হয় সূর্য ডোবার পর, চাঁদ ডোবার পর নয়। একইভাবে মাগরিব পড়তে হয় সূর্য ডোবার পর, চাঁদ ডোবার পর নয়। জুম্মার ওয়াক্ত যেমন সূর্য অনুযায়ী হয় ঈদের নামাজের ওয়াক্তও তেমনি সূর্য অনুযায়ী হয়। সাহরী, ইফতার ও নামাজের ওয়াক্ত চাঁদ অনুযায়ী হয়না, চাঁদের সাথে এগুলির আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। সুতরাং সাহরী, ইফতার ও নামাজের ওয়াক্ত হয় সূর্য অনুযায়ী।
কিন্তু প্রতি আরবী মাসের প্রথম তারিখ নির্ধারিত হয় চাঁদ অনুযায়ী। রমজান মাসের প্রথম তারিখ নির্ধারণ সূর্য উঠার দ্বারা হয় না বরং রমজানের চাঁদ দেখার দ্বারা হয়। তেমনি শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখ বা ঈদুল ফিতরের তারিখ নির্ধারণ ও সূর্য উঠার দ্বারা হয়না বরং ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখার দ্বারা হয়। রমজান মাস কবে থেকে শুরু হবে তার সাথে সূর্যের কোনো সম্পর্ক নেই। সুতরাং রমজান মাস শুরু হওয়া চাঁদের সাথে সম্পর্কিত, ঈদ হওয়াটাও চাঁদের সাথে সম্পর্কিত ।
কাজেই সূর্যের সাথে সম্পর্কিত নামাজের ওয়াক্ত আর চাঁদের সাথে সম্পর্কিত রমজান মাস শুরু হওয়া এই দুইটির তুলনা যুক্তিযুক্ত নয়। সূর্য ও চাঁদের হিসাব আলাদা
জাজাকাল্লাহু খাইরান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন