রমজানে সিয়াম সাধানা

লিখেছেন লিখেছেন শাহীন পাহলোয়ান ০৬ জুলাই, ২০১৪, ০৪:৪১:৩০ বিকাল

সিয়াম(রোজা) – হচ্ছে দিনে ও রাত্রে সংযম (চোখের, কানের, নাকের, কথা-বার্তা, ব্যবহার, মনের বা নফসের) শিক্ষা করা। সিয়াম বিষয়টি এ রকম যে, শেষ রাতে সেহরি খাওয়া, সারাদিন পানাহার ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি যাবতীয় মিথ্যাচার, গীবত, চোগলখূরী, সেকায়েত, কাউকে গালিগালাজ করা, অশ্লীল কথা বলা, কারো সাথে ঝগড়া করা, সুদ-ঘুষ দেয়া বা গ্রহণ করা, অন্যের উপর জুলুম করা, নাচ-গান-বাদ্য, অশ্লীল বা শরিয়ত বিরোধী ছবি ও ভিডিও দেখা, ব্যভিচার ইত্যাদি যাবতীয় খারাপ এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকা, এবং সূর্য অস্তের সাথে সাথে বৈধ(হালাল) উপায়ে অর্জিত হালাল খাদ্য দিয়ে ইফতার করা। প্রতিটা নেক কাজ, ইবাদাত, বা আমলের আগে সহিহ নিয়ত করে নিতে হবে। সিয়াম তার ব্যতিক্রম নয়। কারণ, “আমলের ভিত্তি হচ্ছে নিয়ত”- বুখারী, মুসলিম। “প্রত্যেক কাজের নির্ভরতা নিয়তের উপর, যে যা নিয়ত করবে সে কেবল তাই পাবে” – বুখারী। “অবশ্যই আল্লাহ্‌ মুত্তাকীদের কাজ কবুল করেন” - মায়িদাঃ২৭। সুতরাং আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে সহিহ নিয়ত করে ফরজ সিয়াম সাধানা শুরু করতে হবে। ইফতার অনতিবিলম্বে করা উত্তম আর সেহরি দেরিতে করা উত্তম। সিয়াম সম্পর্কে আল্লাহ্‌ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার” - বাকারাঃ১৮৩। শুধু না খেয়ে থাকার নাম রোজা নয়; সিয়ামের তাৎপর্য অনুধাবন করে এর নিয়ম কানুন গুলো যথার্থ ভাবে পালনের মাধ্যমে আত্নসুদ্ধির সাধনা করাই এর মূল উদ্দেশ্য। “কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এমাসের রোজা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, অন্যদিনে গণনা পূরন করবে। আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না – যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর …” - বাকারাঃ১৮৫। অর্থাৎ পরে রোজা পূরণ(ক্বাযা) করে নিতে হবে। আথবা কাফফারা আদায় করতে হবে। গণনা পূরণ বা কাফফারা আদায় হলেও তার সম্পূরক হয়না। কারণ হযরত মোহাম্মদ(সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি শারিয়তের ওজর ব্যতীত ইচ্ছায় রোজা ভঙ্গ করলো, রমযান ব্যতীত সারাজীবন রোজা রাখলেও উহার সমতুল্য হতে পারে না” - আহমদ, তিরমিজী, আবু দাউদ, ইবনে মাযা। আর আল্লাহ্‌ বলেন, “মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিযের জন্য, কিন্তু সিয়াম তার ব্যতিক্রম, তা শুধু আমার(আল্লাহর) জন্য, আমিই তার প্রতিদান দেব” – মুসলিম। আল্লাহ্ আরও বলেন, রোজা আমার এবং আমি রোজাদারের” - হাদীস কুদসী, বোখারী। কাজেই সিয়াম সংক্রান্ত ইন্টারঅ্যাকশন আল্লাহ্‌র সাথে যার যত বেশী হবে তার মর্যাদাও ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি পাবে।

এ মাসের গুরুত্বও ব্যতিক্রম, কারণ মহান আল্লাহ্‌ বলেন, “রমজান মাস, এতেই নাজিল হয়েছে আল কোরআন – যা গোটা মানব জাতির জন্য জীবনযাপনের বিধান, যা সঠিক ও সত্য পথ প্রদর্শন করে এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য সুস্পষ্ট ভাবে তোলে ধরে” – বাকারাঃ১৮৫। অতএব, “তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিয়ো না এবং জানা সত্বেও সত্যকে গোপন করোনা” – বাকারাঃ৪২। আল্লাহ্ পাক আরও বলেন “আমরা এটি(কোরআন) কদরের রত্রিতে নাজিল করেছি। তুমি কি জান কদরের রাত্রি কি? কদরের রত্রি হাজার মাস অপেক্ষাও অধিক উত্তম” – কদরঃ ১ থেকে ৩। এ মাসের শেষের অংশে বেজোড় রাত্রি শবি কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। “এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়” – দুখানঃ৪। কাজেই এর ফায়দাও হাজার প্রকারের, হাজার গুণ। যত পারা যায় আল্লাহর কাছ থেকে ফায়দা আদায় করে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। ক্ষমাশীল আল্লাহ্‌ বলেন, “যে ব্যক্তি ঈমান অবস্থায় সওয়াবের নিয়তে কিয়ামূল লাইল(যেমন কদরের সালাত) করে তার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে” – বুখারী, মুসলিম। আল্লাহ্ পাক স্বয়ং বলেন, “পুণ্য কাজ অবশ্যই পাপ দূর করে দেয়” – হুদঃ১১৪।

রাসুল আল্লাহ্(সাঃ) ইরশাদ করেন আর “যখন রমজান শুরু হয় তখন থেকে আসমান ও বেহেশতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, দোযখের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানগুলোকে শৃংখলাবদ্ধ করা হয়” – বুখারী, মুসলিম। আর শয়তানকে শৃংখলাবদ্ধ করা হলেও মানুষের শয়তান প্রবৃদ্ধি মন, যা সর্বদা খারাপ কাজে লিপ্ত থাকার কারণে শয়তান চরিত্রে পরিণত হয়ে যায়। বিতাড়িত শয়তান তথা শয়তানী কাজ থেকে দূরে থাকলে আল্লাহ্‌র রাহে সিরাতুল মুস্তাকীমে থাকা সহজ হয়। তাই আসুন আমরা আত্নসুদ্ধি করি। যাতে রমজানের পুরো ফজিলত অর্জন করতে পারি।

এ মাসটা শুধুই ফজিলত ও বরকতময়। হযরত মোহাম্মদ(সাঃ) ইরশাদ করেন, “বেহেশতে দরজা আছে, যার নাম “আর-রাইয়ান”। বিচার দিনে তারাই সেখানে প্রবেশ করবে, যারা রমযানে সিয়াম পালন করবে। এবং যখন তারা প্রবেশ করবে সাথে সাথে দরজা বন্ধ হয়ে যাবে, আর কেহ তথা প্রবেশ করতে পারবে না” - বুখারী, মুসলিম। দুর্ভাগ্য তার যে রমযান পেল অথচ বেহেশ্ত পেলনা। এ মাসে একটি নফল ইবাদত, অন্য মাসের ফরজের সমান। এ মাসে একটি ফরজ, অন্য মাসের ৭০টি ফরজের সমান” - সহিহ ইবনে খুজাইমা। অর্থাৎ রমজানের প্রতিটা আমল কমপক্ষে ৭০গুন সাওয়াব বৃদ্ধি পায়। প্রতিবার অজু ও নামাজের আগে মিছওয়াক করা উত্তম। কারণ মিছওয়াক যুক্ত ইবাদত কমপক্ষে ৭০ গুণ সাওয়াব বৃদ্ধি হয় – আহমদ। এ মাস সবরের মাস, আর সবরের বিনিময়ে রয়েছে জান্নাত। আর সেদিন আল্লাহ্‌ বলবেন, "তোমরা যা (আমল) করতে, তার প্রতিদানে জান্নাতে প্রবেশ কর” – নাহলঃ৩২। এটা রিজিক বৃদ্ধির মাস। রোযাদারকে ইফতার করালে, গুনাহ মাফ ও জাহান্নামের আগুন হতে নিষ্কৃতির উছিলা হবে এবং সে রোজাদারের সমান সাওয়াব পাবে। এ মাসের ১ম অংশ রহমতের, ২য় অংশ মাগফিরাতের এবং শেষ অংশ দোজখ হতে মুক্তির” – বাইহাকী, তিরমিযি, তারগীব, নাসাই। হযরত মোহাম্মদ(সাঃ) ইরশাদ করেন, “ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া বিফল হয়না” - তিরমিযি, তারগীব, আহমেদ, হাকিম, ইবনে মাযাহ। “তিন জনের দোয়া কবুল করা হয়; সিয়াম পালনকারীর দোয়া, অত্যাচারিত ব্যক্তির দোয়া এবং মুসাফিরের দোয়া” – বাইহাক্কী ফি আবুল ঈমান। অন্যত্র মোহাম্মদ(সাঃ) ইরশাদ করেন “তিন ব্যক্তির দোয়া অগ্রাহ্য করা হয়না; পিতার দোয়া, সিয়াম পালনকারীর দোয়া এবং মুসাফিরের দোয়া” – বাইহাক্কী, তিরমিযি। রাসুল আল্লাহ(সাঃ) ফরমাইলেন, …ধ্বংস হোক ঐ ব্যক্তি যে পবিত্র রমজান মাস পেলো তবুও তার মাগফিরাত হল না। আমি বললাম আমীন। …ধ্বংস হোক ঐ ব্যক্তি যার সামনে আমার নাম মুবারাকের আলোচনা হয় আর সে দরুদ পাঠ করেনা। আমি বললাম আমীন। …ধ্বংস হোক ঐ ব্যক্তি যে তার বাবা-মা অথবা যে কোন একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেলো অথচ সে জান্নাতে পৌঁছতে পারলো না। আমি বললাম আমীন” – বুখারী, তিরমিযী, বাইহাক্কী, হাকীম, তারগীব, তিবরানী।

এ মাসে বেশী বশী করে দান খয়রাত করা, দিনে ও রাত্রে কোরআন পড়া, তসবিহ পড়া, জিকির করা; যেমন – “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ”, “সুবহানআল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহুয়াকবার”, সুবহানআল্লাহী ওয়া বিহামদিহী সুবহানাআল্লাহীল আজীম”; তাওবা করা; যেমন – “আস্তাগফিরুল্লাহাল্লাজী লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ হুওয়াল হাইয়ূল কাঈউম ওয়া আতুবু ইলাইহ” – আবু দাউদ, ইবনে মাজহ, নাসাঈ। এতে দুশ্চিন্তা দূর হয়, মাগফিরাত হয় ও অফুরন্ত রিজিকের ব্যবস্থা হয়। বিশেষ করে লাইলাতুল কদর ও অন্যান্য সময় বিশেষ দোয়া করা যেমন, - “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা ‘আফুয়ুন তুহিব্বুল ‘আফওয়া ফা’ফুয়ান্না”-তিরমিজি, ইবনে মাজহ। মা-বাবা’র জন্য করুণা ও আনুগত্যের সাথে দোয়া করা, “রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাআনি সাগিরা” – ইসরাঈলঃ২৪। নবী করিম(সাঃ) এর প্রতি বেশী বেশী করে দরূদ পাঠ করা; “কবরের আযাব ও জাহান্নামের শাস্তির মুক্তি চাওয়া” – বুখারী, মুসলিম; এ সব হচ্ছে মুমিনের জন্য পরহেজগারী কাজ। ফরজ নামাজ গুলো মসজিদে জামাতে আদায় করার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। নবী করিম(সাঃ) আমাদের ঘর সমূহকে কবর বানাতে নিষেধ করেছেন। তাই ঘরে বেশী করে কোরআন পাঠ ও ফরজ নামাজের সাথে সুন্নাত ও নফলের অভ্যাস বাড়াতে হবে। এবং যথা সাধ্য মসজিদের সাথে সম্পর্ক বাড়াতে হবে।

হযরত মোহাম্মদ(সাঃ) ইরশাদ করেন, “রমজানের সর্বষেশ রাত্রে রোজাদারদের মাপ করা হয়ে থাকে” – আহমেদ, বাইহাক্কী, তারগীব। রোজা ও ঈদের পূর্ণাঙ্গ ফায়দা থেকে বঞ্চিত হওয়া যাবেনা। ঈদগাহে যাবার আগে ফিতরা অবশ্যই আদায় করতে হবে। “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ” - বলতে বলতে ঈদগাহে যাওয়া ভাল। ঈদের আনন্দের শেষে আমরা যেন রমজানের পরবর্তী ফায়দা থেকে যেন বঞ্চিত না হই। “যে ব্যক্তি রমজান মাসে সিয়াম পালন করল অতঃপর শাওয়াল মাসে ৬টি সিয়াম আদায় করল সে যেন সারা বছর সিয়াম পালন করল” – ইবনে মাজাহ, মুসলিম। এভাবে ইনশাল্লাহ আমরা সিয়ামের পূর্ণতা আমাদের মধ্যে অর্জন করতে পারি। রমজান শেষে এর হক বা শিক্ষা যেন পরবর্তী মাসে ভুলে না যাই, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। এর আলোকে যেন পরবর্তী রমজান পর্যন্ত পথ চলতে পারি।

বিষয়: বিবিধ

১১০২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File