খালেদ মেশাল: আরব জাহানের মুকুটহীন সম্রাট
লিখেছেন লিখেছেন মোশারোফ ০২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০২:৫৯:৫৪ দুপুর
জন্মেছিলেন ফিলিস্তিনের পরাধীন ভূমিতে। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বাবা-মায়ের হাত ধরে শিশুকালেই দেশান্তরি হন কুয়েতে। এরপর কখনো জর্ডানে, কখনো সিরিয়ায় আবার কখনোবা কাতারে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন তিনি।
তিনি খালেদ মেশাল- ফিলিস্তিনের এক আপসহীন সিপাহশালার। গাজার ইসলামপন্থী দল হামাসের প্রধান তিনি। মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো রাজা বাদশাহকে বিশ্বের যত মানুষ চেনেন, তার চেয়ে বিশ্বব্যাপী তার পরিচিতি অনেক বেশি। দেশহীন এই মানুষটি এখন আরব জাহানের এক মুকুটহীন সম্রাট।
পরিচিতিতে তিনি হয়তো মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রতিদ্বন্দ্বী। স্বাধীনতাকামীদের হৃদয় স্পন্দন তিনি। নিজ মাতৃভূমিকে দখলদার ইসরাইলিদের কবলমুক্ত করতে লড়াই করছেন জীবন বাজি রেখে।ইসরাইলি বর্বর বাহিনী যখনই গাজার ওপর হামলে পড়ে তখন বিশ্বব্যাপী উচ্চারিত হয় একটি নাম-খালেদ মেশাল। অথচ ইসরাইলি চক্রান্ত সফল হলে এতোদিনে তার ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন হতো।
হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজায় সর্বশেষ ৫০ দিনের ইসরাইলি আগ্রাসনকে ফিলিস্তিনের মুক্তির সংগ্রামের পথে ‘মাইলস্টোন’ আখ্যা দেন এই নির্বাসিত হামাস নেতা। অথচ দু’বছর আগে হামাসের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।
গত ২০০৪ সালে ইসরাইলি হামলায় হামাস নেতা আবদেল আজিজ আল-রানতিসি এবং প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিন নিহত হলে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলনের এই সংগঠনের দায়িত্ব নেন ৫৮ বছর বয়সী খালেদ মেশাল।
২০১২ সালে তিনি প্রথমবারের মত তার প্রিয় মাতৃভূমিকে দেখার সুযোগ পান। ৪৫ বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে অবরুদ্ধ গাজায় পা ফেলেই সিজদায় লুটিয়ে পড়েন তিনি।মুকুটহীন আরব সম্রাট
মিশরের মধ্যস্ততায় ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মধ্যকার অস্ত্রবিরতির আলোচনায় অন্যতম ইস্যু গাজায় প্রতিরোধ সংগঠন হামাস। এই চুক্তিকে ফিলিস্তিনিদের জন্য বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। চুক্তি সম্পাদনে কূটনৈতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মেশাল।
চুক্তি সম্পাদনের পর মেশাল বলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের চূড়ান্ত মুক্তির পথে এটি একটি মাইলস্টোন। প্রমাণিত হয়েছে প্রতিরোধই মুক্তির একমাত্র পথ। প্রতিরোধের এই পথ ধরেই চূড়ান্ত মুক্তি অর্জিত হবে এবং দখলদাররা (ইসরাইল) পরাজিত হবে।’এর আগে ২০১২ সালে গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন বন্ধে মেশালের ভূমিকার মূল্যায়ন করতে গিয়ে পশ্চিম তীরের বিরজেইত বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জর্জ গিয়াকাম্যান বলেছিলেন, ‘কোনো নির্দিষ্ট কার্যালয় না থাকলেও তিনি রাষ্ট্রনায়কের জায়গা দখল করে রাখবেন।’
প্রতিরোধেই মুক্তি
মেশালের দৃষ্টিতে, গাজায় হামাসের প্রতিরোধ ফিলিস্তিনের মুক্তির পথ দেখিয়েছে। হামাসের প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রতি ফিলিস্তিনিদের সমর্থন মার্কিন সমর্থিত নিষ্ফল শান্তি আলোচনার প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
বিশেষ করে ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এবং প্রেসিডেন্ট মাহমুদ ও তার দল ফাতাহ’র প্রতি হতাশা বেড়েছে। শান্তি আলোচনার কথা বলে ইসরাইলের অব্যাহত ভূমি দখল ফিলিস্তিনিদের আরো ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। বিপরীতে সমর্থন বাড়ছে সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রতি।
হামাসের এই নেতা ইসরাইলের সঙ্গে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ধারণা গ্রহণ করেননি। তবে তিনি বলেন, নিজেদের ভূ-খণ্ডে ফিরে আসার অংশ হিসেবে হামাস পশ্চিমতীর, গাজা ও পূর্বজেরুজালেমকে নিয়ে সাময়িকভাবে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে থাকবে।
অধিকৃত ভূমিতেই জন্ম
রামাল্লাহ শহরের পশ্চিমতীর সংলগ্ন সিলওয়াদে ১৯৫৬ সালের ২৮ মে জন্ম নেন এই আরব নেতা। তবে জীবনের দীর্ঘ এই পথে প্রায় পুরো সময়টি কেটেছে প্রিয় মাতৃভূমির বাইরে। আর্থিক অনটনে পড়ে ছয় বছর বয়সেই বাবার সঙ্গে পাড়ি জমান কুয়েতে।১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর কুয়েত পাড়ি জমানোর আগে মেশাল সিলওয়াদের প্রাথমিক স্কুলে পড়াশোনা করেন। পরে কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় ব্যাচেলর অব সাইয়েন্স ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। পরে কুয়েতে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন।
ছাত্রসংগঠন দিয়েই ফিলিস্তিনের মুক্তির সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন মেশাল। একাধিক ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্ব দেয়া ছাড়াও নিজেই প্রতিষ্ঠা করে ছাত্রসংগঠন। পরে জড়িয়ে পড়েন মুসলিম ব্রাদারহুড ফিলিস্তিন শাখার সঙ্গে।
১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হামাসের উদ্যোক্তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মেশাল। ইরাক ১৯৯১ সালে কুয়েতে আগ্রাসন চালালে জর্দানে চলে যান তিনি। সেখানে থেকে সাংগঠনিক কাজে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন।
কিন্তু ১৯৯৯ সালে জর্দান থেকে বহিষ্কার করা হলে কাতারে চলে যান এই হামাস নেতা। এরপর কাতার থেকে সিরিয়ায় যান তিনি। সিরিয়া গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে ২০১২ সালে ফের কাতারে পাড়ি জমান তিনি। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার-আল আসাদের হত্যাযজ্ঞেরও নিন্দা জানান তিনি।ইসরাইল কর্তৃক হত্যাচেষ্টা
ইসরাইলের গুপ্তচরের হাতে নিহত হওয়া হামাস নেতার সংখ্যা নেহাত কম নয়। সরাসরি হামলা এবং প্রধানতম প্রতিপক্ষ ইসরাইলের অস্ত্রশস্ত্র তো আছেই, সঙ্গে আছে বিশ্বের অন্যতম দুর্ধর্ষ গোয়েন্দাবাহিনী মোসাদ।
জর্ডানে অবস্থানকারী মেশাল তখনো হামাসের প্রধান হননি। ১৯৯৬ সালে তিনি সংগঠনের রাজনৈতিক শাখার প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। এছাড়া প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সক্রিয়ভাবে হামাসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে তিনি ছিলেন সংগঠনের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা।
১৯৯৭ সালে উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু মোসাদ ও ইসরাইলের অন্য সব নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে এক জরুরি গোপন বৈঠকে হামাস নেতাদের হত্যা করার নির্দেশ দেন।
এরপর ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে জর্ডানের কুইন আলিয়া এয়ারপোর্ট দিয়ে কানাডিয়ান পর্যটকের ছদ্মবেশে ছয়জনের একটি দল প্রবেশ করে। তবে এরা সবাই ছিল মেশাল বধে নিযুক্ত ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সদস্য।
মেশালকে হত্যা করার জন্য মোসাদের পদ্ধতি ছিল বেশ অভিনব। কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়াই মেশালের কানে রাসায়নিক বিষ স্প্রে করে তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে মোসাদ। এই স্প্রে প্রয়োগ করলে শ্বাস-প্রশ্বাস অচল হয়ে নীরবে মারা যাওয়ার কথা ছিল মেশালের।
এরপর দীর্ঘ এক সপ্তাহ সুযোগসন্ধানী দলটি মেশালকে অনুসরণ করতে থাকে একটি সুবিধাজনক মুহূর্তের জন্য। অতঃপর ১৯৯৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সেই সুযোগ পায় তারা। প্রকাশ্য দিবালোকেই খালেদ মেশালের কানে মোসাদের তৈরি বিষ স্প্রে করা হয়।
কিন্তু পালাতে গিয়েই হলো বিপত্তি। মেশালের নিরাপত্তা বাহিনী যে এত দ্রুত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেবে, তা ভাবতেই পারেনি মোসাদ। কর্ম সমাধার পরপরই নিরাপত্তায় নিযুক্ত জর্ডানের বাহিনী মোসাদের দলটিকে তাড়া করে এবং দুজন ধরাও পড়ে। বাকিরা ইসরাইলি দূতাবাসে আত্মরক্ষার জন্য আশ্রয় নেয়।
এরপরের ঘটনাক্রম নেতানিয়াহু ও ইসরাইলের মোসাদের জন্য মোটেও সুখকর ছিল না। কারণ এ ঘটনার পর রাজধানী আম্মানে ইসরাইলি দূতাবাস ঘিরে ফেলে জর্ডানের বাহিনী। অবস্থা বেগতিক দেখে নেতানিয়াহু ও তৎকালীন মোসাদ প্রধান ড্যানি ইয়াতম জর্ডানের রাজা হুসেনের সঙ্গে গোপনে সংলাপ করেন।
সংলাপের শর্ত অনুযায়ী, যে বিষ মেশালের কানে স্প্রে করা হয়েছিল, তার প্রতিষেধক পাঠাতে বাধ্য হয় মোসাদ। পাশাপশি ইসরাইলের কারাগারে বন্দি থাকা জর্ডানের ৯ নাগরিক, ৬১ ফিলিস্তিনি এবং সবচেয়ে বড় কথা হামাসের আধ্যাত্মিক নেতা ও ইসরাইলের সবচেয়ে বড় শত্রু বলে পরিচিত আহমেদ ইয়াসিনকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় তারা।
সেই বিষ প্রয়োগের ঘটনার কথা স্মরণ করতে গিয়ে মেশাল বলেছিলেন, সত্যের পথে জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকলে একদল লোক পিছু হটার পথ নেয় আর আরেক দল হয় আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমি দ্বিতীয় দলের লোক।
প্রকৃত রাজনীতিক
সিরিয়ায় সঙ্কটের কারণে যখন মেশালকে দামেস্ক ছাড়তে হয়, তখন তার চেয়েও বিশ্বস্ত নতুন মিশরকে কাছে পান তিনি। সেখানে একটি ইসলামপন্থী সরকার হামসের চিন্তাধারার সাথে আরো বেশি সহানুভূতিশীল।
তার সহযোগীরা বলেন, মেশালেরই পুরনো বন্ধু মোহাম্মদ মুরসি ব্রাদারহুডের সমর্থন নিয়ে তখন মিশরের প্রেসিডেন্ট। আর ইসলামপন্থী ব্রাদারহুড হামাসের সাথে ঘনিষ্ঠ। কিন্তু সেনা অভ্যুত্থানে মুসরিকে উৎখাত করা হলে মিশর সরকারের রোষানলে পড়ে হামাসও।
সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে নিলেও মেশাল আসাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিকই শক্তিশালী করেছেন। সম্প্রতি ইসরাইলি আগ্রাসন মোকাবিলায় অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করায়ে ইরানকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
এছাড়া, মিশরে ব্রাদারহুড সরকারের উৎখাতে বিপাকে পড়ার পর তুরস্ক ও কাতারের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছেন মেশাল। গাজায় সাম্প্রতিক আগ্রাসনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের অবস্থান তাকে আশাবাদী করতেই পারে।
‘মেশালের ওপর আমাদের অগাধ বিশ্বাস রয়েছে, তিনি দৃঢ়তা ও সাহসের সঙ্গে কূটনীতিক দরকষাকষি চালিয়ে যেতে পারবেন’ বললেন হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা মুস্তফা আসওয়াফ।
ফিলিস্তিনি ঐক্যের অগ্রদূত
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে ঐক্যের বিষয়ে তার উদ্যোগ নিয়ে মেশাল এবং গাজার হামাস সরকারের মধ্যে মতপ্রার্থক্য দেখা দেয়। অবশ্য পরে মেশালের অবস্থান মেনে নেয় গাজার হামাস নেতারা।
মেশাল মনে করেন, একমাত্র আব্বাসই ফিলিস্তিনের বিভক্ত গ্রুপগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে নেতৃত্ব দিতে পারবেন। আর ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিনই ইসরাইলি দখলদারিত্বের অবসান ঘটিয়ে মুক্তির দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
তার মতে, হামাসের উচিত কেবল গাজায় নয়, পুরো ফিলিস্তিনের নেতৃত্ব দেয়া। গাজার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেয়ে পিএলও’ কার্যকরী সদস্য হওয়াটা শ্রেয়তর মনে করেন এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আরব নেতা।
এবার কায়রোতে যখন হামাসের সাথে ইসরাইলের আলোচন চলছিল তখন তার আপসহীন অবস্থানে মধ্যপ্রাচ্যের নতজানু শাসকরা ছিল অসন্তুষ্ট। তবে আলোচনার টেবিলে প্রায় সব দাবি আদায় করে মেশাল প্রমাণ করেছেন যে তিনিই ছিলেন সঠিক পথে।
মেশাল জানেন, শত্রু যখন ইসরাইলের মত বর্বর আর ধুরন্ধর কোনো দেশ, তখন জীবনের মায়া তুচ্ছ করে লড়াই করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকাই হলো শ্রেষ্ঠ প্রতিরক্ষা। আর তাই তো তার সাহসী উচ্চারণ, ‘ইসরাইলের সাথে এটাই শেষ যুদ্ধ নয়।’
বিষয়: বিবিধ
১৪০০ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন