ফারুকির নির্মম হত্যাকান্ডে কে এই রহস্যময় মহিলা ?
লিখেছেন লিখেছেন মোশারোফ ২৯ আগস্ট, ২০১৪, ০২:৩৪:৫৮ দুপুর
মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যাকান্ডে ক্রমশ নতুন নতুন রহস্যের জন্ম দিচ্ছে । পারিবারিক সুত্রে এবং অনুসন্ধানে জানা গেছে ,গত বুধবার চ্যানেল আইয়ের জনপ্রিয় ইসলামী অনুষ্ঠান ‘শান্তির পথে’ ও ‘কাফেলা’-র উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে জবাই করে হত্যার কয়েকঘন্টা আগে তার বাসায় এসেছিলেন আসমা নামের এক মহিলা। ওই মহিলা বাসা থেকে চলে যাওয়ার ১৫ মিনিট পরই এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গত কয়েকদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়ে মাওলানা ফারুকীকে ফোন করে আসছিলেন তিনি।এর আগে মঙ্গলবারও ফারুকীকে ফোন করেন তিনি।
বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত এক সংবাদ সুত্রে জানা গেছে, ফারুকীর দ্বিতীয় স্ত্রী লুবনা বলেন, ‘ওই মহিলা আমার স্বামীকে ফোনে জানান তিনি অনেকদিন ধরেই তার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছেন। বুধবার ওই মহিলা ফোন করে বাড়ির ঠিকানা নেন। বিকাল ৪টার দিকে আমাদের বাসায় আসেন আসমা নামের ওই মহিলা। তার বয়স ৪০ থেকে ৫০ বছর হবে। তার পরনে ছিল একটি ময়লা বোরকা ও হাতে হ্যান্ডব্যাগ। ওই মহিলার দাবি তিনি বরিশাল থেকে এসেছেন।’ কিন্তু ফারুকীর বাসায় প্রবেশের পর ওই মহিলা বাসাটি বেশ খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে শুরু করেন। লুবনা বলেন, ‘আসমা আমার স্বামীর রুমও ঘুরে দেখেছেন।’ এমনকি ফারুকীর বাসায় খাবার ইচ্ছাও প্রকাশ করেন আসমা। লুবনা বলেন, ‘খাবার তৈরির সময় ওই মহিলা আচমকা রান্নাঘরে প্রবেশ করে। আমি তাকে জানাই বেডরুমেই খাবার নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম তিনি রান্নাঘরটি খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছেন। এবং আমার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাইছেন।’পরে আসমা নামের ওই মহিলা ফারুকীকে জানান, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করে এক সন্তানকে প্রকৌশলী বানিয়েছেন। তার সন্তান এখন মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় করে। কিন্তু সন্তান কোনও সহায়তা না করায় খুবই বিপদে আছেন তিনি।
মাওলানা ফারুকীর স্ত্রী লুবনা জানান, ওই মহিলা নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করলেও আশ্চর্যজনক ভাবে মাগরিবের নামাজ আদায় করেননি। তিনি বলেন, ‘নামাজের পর আসমা আবারো জানান তিনি নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জ থেকে এসেছেন। মাত্র কিছুক্ষনের মধ্যেই বিভিন্ন জায়গার পরিচয় দেয়ায় কথা আমি বিস্মিত হই। এরপরই ওই মহিলা জানান তিনি রাতেও আমাদের বাসায় থাকতে চান। কিন্তু আমার স্বামী তাতে রাজি হননি। আমার ছেলে ফয়সাল তাকে ফার্মগেটে দিয়ে আসে। যাতে তিনি সেখান থেকে বাসে উঠতে পারেন। আমার স্বামী টাকা দিতে চাইলেও নেননি আসমা। সঙ্গে ৩ হাজার টাকা আছে বলে জানান তিনি।’
লুবনা জানান, আসমা নামের ওই মহিলা তাদের বাসা থেকে চলে যাওয়ার পরই প্রায় ২৫ বছর বয়সি দুই যুবক তাদের বাসায় আসেন এবং মাওলানা ফারুকীর সঙ্গে হজের বিষয়ে কথা বলেন। এদের মধ্যে একজনের মাথায় টুপি ও মুখে ছোট ছোট দাড়ি ছিল। ওই দুইজনই গত মঙ্গলবারও ফারুকীর বাসায় এসেছিলেন। ওইদিন তারা প্রায় ১৫/২০ মিনিট ফারুকীর সঙ্গে কথা বলার পর আবার আসবেন বলে চলে যান। এরপর বুধবার রাত নয়টার দিকে আসেন তারা। এসেই ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করেন। এর দুই/তিন মিনিটের মধ্যে জিন্স-টিশার্ট পরিহিত আরও কয়েকজন তরুণ বাসায় প্রবেশ করে। লুবনা বলেন, ‘তারা বেডরুমে এসেই আরেকটি রুম থেকে লুঙ্গি ও শাড়ি কেটে আমি, আমার শ্বাশুড়ি জয়গুন্নেসা, বাড়ির কাজের লোকের মুখ, হাত, পা বেধে একটি রুমে লক করে দেন।’ তিনি আরও বলেন , ‘তাদের সবার হাতেই পিস্তল ছিল। তারা ৫০ লাখ টাকা চাঁদা চেয়েছিল। কিন্তু আমার স্বামী জানান দেড়লাখ টাকা আর সোনাদানা ছাড়া বাসায় কিছু নেই।’
খুন করে যাওয়ার সময় তারা বাড়িতে থাকা টাকা নিয়ে গেছে বলেও দাবি করেন তিনি। ফারুকীর ভাতিজা মারুফ বলেন, ‘যখন ওই দুইজন বাসায় প্রবেশ করে চাচা আমাকে দুটি চেয়ার আনতে বলেন। চেয়ার আনার পর আমি দেখি একজন পিস্তল বের করে চাচার দিকে তাক করে রেখেছে। আরেকজনের হাতে ছুরি। তারপর তারা আমাকে ডাইনিং রুমে নিয়ে একটি চেয়ারের সঙ্গে বেধে ফেলে। এর কয়েকমিনিট পরই তারা চাচাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।’
লুবনা বলেন, ‘হত্যাকারীরা আমাদের পুলিশকে জানাতে মানা করেছিল। তারা এসময় হুমকিও দেয়। ওই খুনের পর আমরা কেউ বাসার ফোন রিসিভ করছিনা। পুলিশ যদি আমার স্বামীর কল লিস্ট চেক করে এবং ওই মহিলাকে গ্রেফতার করতে পারে তবে আসল খুনিকে ধরতে পারবে।’ পুলিশ ইতিমধ্যেই ফারুকীর কল লিস্ট চেক করা শুরু করেছে বলে জানা গেছে। লুবনা দাবি করেন, সত্য কথা এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলায় মাওলানা ফারুকীকে হত্যা করতে পারে দুর্বৃত্তরা।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে খুনিরা প্রশিক্ষিত ও পেশাদার বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তারা । র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) কর্ণেল জিয়াউল আহসান বলেন, ‘ধর্মীয় মতবাদ ছাড়াও রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক ও পারিবারিক কোনও বিরোধ রয়েছে কি-না সেসব মোটিভ নিয়ে তারা কাজ করছেন।’সি আব্দুল মোমেন বলেন, অপরাধীদের ধরতে আমরা চেষ্টা করছি। ওই সময় মাওলানা ফারুকীর বাসায় থাকা তিনজন দশনার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে ।
তেজগাঁও জোনের ডেপুটি কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ‘এতে কোনও সন্দেহ নেই যে খুনিরা পুরোপুরি পেশাদার। তারা শুধু মাত্র ফারুকীকে হত্যা করতেই তার বাসায় এসেছিল।’
Ads by Cinema-Plus-1.6cAd Options
এদিকে, মাওলানা ফারুকীর ছেলে ফয়সালের দাবী , জঙ্গিরাই তার বাবাকে খুন করেছে।
যে কারণে ডাইনিং রুমে খুন হলেন মাওলানা ফারুকী
রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের ১৭৪ নম্বর হোল্ডিংয়ের চারতলা ভবনের দোতলায় মাওলানা ফারুকীর ফ্ল্যাটে ঢুকলে প্রথমে পড়ে ডাইনিং স্পেস। এর প্রস্থ হবে আনুমানিক আট ফুট ও দৈর্ঘ্য প্রায় ১২ ফুট। ডাইনিং স্পেসের দক্ষিণ ও পূর্বদিকে তিনটি রুম এবং উত্তর দিকে সিঁড়ি ও পশ্চিমে বাথরুম ও রান্নাঘর। অর্থাৎ পুরো ডাইনিং স্পেসটি দেয়াল ঘেরা।
এই ডাইনিং স্পেসেই বুধবার রাতে দুবৃর্ত্তদের হাতে খুন হলেন মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, শোবার ঘর কিংবা ড্রয়িং রুম ছেড়ে ডাইনিং স্পেসে কেন খুন করা হল মাওলানা ফারুকীকে?
দেখা গেছে, তিন রুমের ফ্লাটে থাকতেন মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী। ফ্ল্যাটের রুমগুলো ছোট হলেও বাইরের দিকে খোলা। অর্থাৎ তিনটি রুম থেকেই বাইরের দৃশ্য দেখা যায় এবং বাইরে থেকেও রুমের ভেতরটা দেখা যায়। শুধু ডাইনিং স্পেসটা বদ্ধ খাঁচার মতো।
ধারণা করা হচ্ছে, খুনিরা আগে থেকেই মাওলানা ফারুকী, তার পরিবারের সদস্য এবং ফ্ল্যাটটির ওপর গভীর নজর রাখছিল। তারা ভালো করেই জানত সবার অগোচরে কিভাবে ও কোন স্থানটিতে খুন করলে বাইরের কেউ টের পাবে না। একারণে বাসার সবাইকে বেঁধে ডাইনিং স্পেসে নিয়ে মাওলানা ফারুকীকে জবাই করা হয়। আর যদি শোবার ঘর কিংবা ড্রয়িং রুমে তাকে খুন করা হত তাহলে বাইরে থেকে কারো না কারো নজরে আসত। সেক্ষেত্রে খুনিদের ধরা পডার বা চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল বেশি।
মাওলানা ফারুকীকে জবাই করার পর খুনীরা কিভাবে চলে গেল তা স্পষ্ট হয়নি। তবে স্থানীয়দের ধারণা, কোনও ধরনের বাধা ছাড়াই খুনটি করার পর নির্বিঘ্নে ফ্ল্যাটটি থেকে দুর্বৃত্তরা বের হয়ে গেছে। এর অর্থ ভবনটির নিচে ও আশেপাশেও খুনিদের লোকজন পাহারায় ছিল এবং পুরো ঘটনাটিই ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। এ কারণে আশেপাশের লোকজন কোনও কিছু টের পাওয়ার আগেই তারা নিরাপদে সটকে পড়ে।
শেরেবাংলা নগর থানার গ্রিনরোড থেকে পশ্চিম দিকে প্রায় ২০ ফুট চওড়া রাস্তা ধরে কিছুদূর এগুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরস্ কোয়ার্টারের পরেই মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকীর বাসা। প্রায় ২০ বছর ধরে চারতলা ভবনটির দোতলায় ভাড়া থাকতেন তিনি।
রাস্তার ধারে অবস্থিত আলোচিত ভবনটির নিচতলার সামনের অংশে তিনটি দোকান। এগুলো হল ভাই ভাই ব্রয়লার হাউজ নামের মুরগির দোকান, দ্বিতীয়টি তামান্না জুয়েলার্স বা স্বর্ণকারের দোকান এবং তৃতীয়টি মুদি দোকান। প্রতিদিন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত খোলা থাকে দোকানগুলো। বুধবার রাতেও যথারীতি এগুলো খোলা ছিল।
তিন দোকানের মধ্যে পূর্বদিকের মুদি দোকানটির মালিক বাড়িওয়ালা মাহবুবুর রহমান। বাকি দু’টি ভাড়া দেওয়া। মাহবুবের মুদি দোকানের পাশে লোহার গেট। এই গেট পেরিয়ে প্রথম ভবনটারই দোতলায় থাকতেন মাওলানা ফারুকী। এই ভবনের পর সরু গলি দিয়ে উত্তরে গেলে আরো দু’টি ভবন রয়েছে। একটি গলিতে একাধিক বাড়ি থাকলেও কোন নাইট গার্ড নেই। বাড়ি মালিকরা নিজ উদ্যোগেই গেটে তালা মেরে রাখেন।
মাওলানা ফারুকীর ফ্ল্যাটের নিচতলায় সপরিবারে থাকেন বাড়ি মালিক মাহবুবুর রহমান। সন্ধ্যার পর তাকে খোঁজাখুজি করে পাওয়া যায়নি। বাড়ির গেটের সামনে আসলাম নামের এক যুবক জানান, তিনি (মাহবুব) কারো সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন না। এ কারণে ভবনের অন্যান্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সম্পর্কে বলার মত কাউকে পাওয়া যায়নি।
ভবনের সামনের অংশটা সব সময় আলোকিত থাকে। কিন্তু ভবনের ভেতর এত বড় ঘটনা ঘটল কেউ জানতেই পারল না? এর জবাবে ভাই ভাই ব্রয়লার হাউজের মালিক মেরাজ বলেন, সারাক্ষণই লোকজন এই রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করে। বাড়ির ভেতর অনেকগুলো ফ্ল্যাট আছে। লোকজনও প্রচুর যাতায়াত করে। কে কি করছে সেটা জানা তো সম্ভব না। তবে মাওলানা ফারুকীকে হত্যা করা হয়েছে এমন খবর পেয়ে অন্যদের সঙ্গে তিনিও ওই ফ্ল্যাটে যান।
একই কথা বলেন তামান্না জুয়েলার্সের মালিকের ভাতিজা সোহাগ মিয়াও। তিনি বলেন, সন্ধ্যার পর আমি দোকানে বসা ছিলাম। হঠাৎ হুজুরের (মাওলানা ফারুকী) ছেলে ফয়সাল রাস্তায় এসে চিৎকার করে বলতে থাকেন যে, তার বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে। এরপর অনেকের সঙ্গে তিনিও ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখেন হুজুরকে হত্যা করা হয়েছে। দোকান মালিক আবদুল খালেক বলেন, ঘটনার দিন তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার রাজাবাজার এসেছেন। তিনি বলেন, মাওলানা ফারুকী খুব ভাল লোক ছিলেন।
মাওলানা ফারুকী হত্যার ঘটনার পর রাজাবাজারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার রাজাবাজারের প্রবেশ পথগুলোতে প্রহরা বসান হয়। গ্রিনরোড সংলগ্ন পূর্বমুখী একটি গলির গেট বিকেলে বন্ধ করে দেয় পুলিশ। ওই গেটের গার্ড শহীদ জানান, অন্যান্য সময়ে রাত ১২টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত এই গেট বন্ধ থাকে। কিন্তু পুলিশের নির্দেশে বৃহস্পতিবার বিকালে গেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্থানীয় লোকজন এখন পান্থপথ ঘুরে অন্য গলি দিয়ে রাজাবাজার প্রবেশ করছে বলে জানান তিনি।
বিষয়: বিবিধ
১৩৩১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন