জামাই’র গরুর দুধের চা!

লিখেছেন লিখেছেন মোশারোফ ০১ আগস্ট, ২০১৪, ০২:৫৯:১৪ দুপুর



ময়মনসিংহ: জ্বলন্ত একটি চুলোয় কেটলিতে টগবগে ফুটছিল গরম পানি। পাশের কেটলিতে চা পাতি। আরেক চ‍ুলোয় বড় আকারের সসপেনে জ্বাল দেওয়া হচ্ছে গরুর দুধ।

চুলোর পাশেই নিজের দোকানে বসে বিরতিহীনভাবে চা বানিয়ে যাচ্ছিলেন জয়নাল আবেদিন। চ‍ুলোর তাপ আর ভ্যাপসা গরমে ঘাম জড়ছিলো তার শরীর থেকে। সুঠাম দেহে জড়ানো গেঞ্জিটা ঘামে ভিজে একাকার।

কিন্তু ক্লান্তিহীন গলদঘর্ম অবস্থায় ৪৫ বছর বয়সী জয়নাল ব্যস্ত চা তৈরিতে। স্থানীয়দের কাছে তিনি পরিচিত ‘জামাই’ নামে। ময়মনসিংহ শহরতলী শম্ভুগঞ্জ টোল প্লাজার দক্ষিণ পূর্ব দিকে ছোট্ট দোকানটিতে তার হাতে বানানো গরুর দুধের চা এখন আলাদা ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।

স্বাদে ভিন্নতার কারণেই ক্রেতাদের অনেকেই তার দোকানের ৮ টাকায় এককাপ চা খেতে ৫০ টাকা পযর্ন্ত রিকশা ভাড়া দিয়ে এখানে আসেন।

ময়মনসিংহ শহরের অলিতে-গলিতে এখানে সেখানে মানুষের সুবিধার্থেই গড়ে উঠেছে চা’র দোকান। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ‘জামাই’র দোকানের গরুর দুধের চা শহরবাসীর কাছে অন্যতম বিশেষ আকর্ষণ। ময়মনসিংহ-শম্ভুগঞ্জ সড়ক ব্যবহার করে যারা এ পথে ছুটে চলেন তারাও জামাই’র দোকানের চায়ের ভিন্ন স্বাদ নিতে ভুল করেন না।

ময়মনসিংহ-শেরপুর মহাসড়কের ব্রহ্মপুত্র নদীর উপরে শম্ভুগঞ্জ ব্রিজ থেকে দেড় কিলোমিটার পূর্ব দিকে টোল প্লাজার একটু আগে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু দোকানপাট। এসব দোকানপাটের মধ্যেই জামাই’র চা’র দোকান। দোকানের সামনে সকাল থেকে রাত অবধি ভিড় লেগেই থাকে।

জয়নালের বাড়ি নেত্রকোণার শ্যামগঞ্জ এলাকায়। বিয়ের সূত্রে ১০ বছর আগে ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ টোল প্লাজা এলাকায় বসতি গড়েন জয়নাল। মূলত ওই সময় থেকেই সেখানে গরুর দুধের চায়ের দোকান খুলে বসেন।

৪০ কেজি গরুর দুধে প্রতিদিন গড়ে তৈরি করেন ৪শ কাপ চা। প্রতি কাপ চা’র দাম ৮ টাকা। চায়ের দাম কাপপ্রতি ৩ টাকা বেশি রাখার পেছনে তিনি দুধের চড়া দামকেই দায়ী করেন।

নিত্য ধূমায়িত চা কে নতুনভাবে উপস্থাপনের জন্যই জামাই’র হাতে তৈরি চা সবার থেকে আলাদা। কৌশলও বেশ সাধাসিধে। জয়নাল জানান, গরুর দুধ জ্বাল দেওয়ার পর ঘন হয়ে যখন লাল রঙ ধারণ করে মূলত তখনই গ্লাসে দুধ ঢালেন। প্রতি গ্লাসে ঢালা হয় অর্ধেকের বেশি দুধ।

এরপর অল্প পরিমাণে লিগার আর গরম পানির মিশ্রণ ঘটিয়ে তৈরি করেন সুস্বাদু চা। এ চা পানে শরীরে চলে আসে চাঙ্গাভাব।

চা’র পাশাপাশি মিনারেল ওয়াটার ও কোল্ড ড্রিংকস বিক্রি করেন জয়নাল। চা’র জন্য কেনা দুধ থেকে আবার খাঁটি ঘিও তৈরি করেন। সপ্তাহে এক কেজি থেকে দেড় কেজি ঘি বিক্রি করেন ১ হাজার ২শ টাকা কেজি দরে।

জামাইয়ের চায়ের দোকানে কোনো কর্মচারী নেই। ‘সেলফ সার্ভিস’ পদ্ধতিতে তিনি চা বিক্রি করেন। ‘এই যে চা অইয়্যা গেছে’ বলে সব সময় হাঁক দেন তিনি। পরে ক্রেতারা নিজেরাই এসে চা’র গ্লাস নিয়ে যান।

আঞ্চলিক ভাষায় জয়নাল বলেন, ‘কর্মচারী রাহনের মতো সামত্থ্য (সামর্থ) আমার নাই। আমার দোহানের কাস্টমাররা নিজের চা নিজেই লইয়্যা খায়।’

দিন-রাত চা বিক্রি করেও নিজের ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে পারেননি দারিদ্র্যের সঙ্গে বেড়া উঠা জয়নাল। সাত সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম তিনিই। তবে এ নিয়ে মোটেও আক্ষেপ নেই জয়নালের। চায়ের দোকান থেকে খরচ বাদে যা আয় হয় তা ব্যয় হয় ৩ কন্যা ও দু’পুত্রের পড়াশুনা ও ভরণপোষণে।

এ নিয়ে সহজ-সরল জয়নালের সরল স্বীকারোক্তি এমন, ‘আল্লাহ মান সম্মান রাইখ্যা ডাল-ভাত খাওয়াইয়্যা নিতাছে। পোলাপানরে লেহাপড়া করাইতে পারতাছি। পোলাপানরে ঠিকমতো মানুষ করাইতে পারলেই আমি খুশি।

জয়নালের সঙ্গে আলাপকালে স্থানীয় বাসিন্দা চাঁন মিয়া (৫০) বলে উঠলেন ‘জয়নাল চা প্রিয়দের হৃদয়ের মানুষ। তার হাতে বানানো চায়ের জাদুকরি টানে দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন এখানে মানুষ ছুটে আসেন। চায়ের কাপে চুমুক দিলেই মনটা জুড়িয়ে যায়।’

বছরের পুরোটা সময় জয়নালের দোকানে চা পিয়াসীদের দিন-রাত ভিড় লেগে থাকলেও ঈদের সময়ে জয়নালের ব্যবসা আরো জমজমাট। ক্রেতার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় একা চা বানাতে গিয়ে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।

বিষয়: বিবিধ

১০১৫ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

249981
০১ আগস্ট ২০১৪ রাত ১০:২৪
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ২০০৫-৬ সালের দিকে সেখানে একাধিকবার মালাই চা খেয়েছি। এলাকার বর্ননা শুনে মনে হচ্ছে এই দোকানেই হতে পারে।
250008
০২ আগস্ট ২০১৪ রাত ০২:১৫
আফরা লিখেছেন : দোকানির এর ঘামের যে বর্ণনা দিলেন এর পর চা খাওয়ার ইচ্ছা নাই ।
০২ আগস্ট ২০১৪ রাত ০২:২৩
194345
ভিশু লিখেছেন : Rolling on the Floor আমারও...Worried Tongue
250011
০২ আগস্ট ২০১৪ রাত ০২:২৫
ভিশু লিখেছেন : তবে চা'টা অনেক মজারই হওয়ার কথা!
250026
০২ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৮:০৮
জোনাকি লিখেছেন : থাম্বস আপ জয়নাল।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File