গাজায় হামাসের তীব্র প্রতিরোধের মুখে ইসরায়েল গণহত্যা চলছেই নিহত ৬৮৭
লিখেছেন লিখেছেন মোশারোফ ২৪ জুলাই, ২০১৪, ০৪:৪২:২১ বিকাল
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল হামাসের তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে। ভূখণ্ডের সুড়ঙ্গপথগুলো গুঁড়িয়ে দিতে নামা ইসরায়েলের স্থল সেনাদের সঙ্গে হামাস সদস্যদের মুখোমুখি লড়াই চলছে। একই সঙ্গে অব্যাহত রয়েছে গেরিলা কায়দায় চোরাগোপ্তা হামলা এবং ইসরায়েলি ভূখণ্ড লক্ষ্য করে রকেট হামলা। হামাসের দাবি, গতকাল বুধবার তাদের হামলায় ইসরায়েলের সাত সেনা নিহত হয়েছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) তরফ থেকে অবশ্য এ ব্যাপারে স্বীকৃতি মেলেনি। তবে ইসরায়েলের গায়ে চলমান এই লড়াইয়ের আঁচড় পড়ছে অন্য দিক থেকেও। গত মঙ্গলবার তেলআবিব বিমানবন্দরে হামাসের ছোড়া একটি রকেট পড়ার পর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ তাদের ফ্লাইট বাতিল করে দেয়। ভরা পর্যটন মৌসুমে যার চাপ গিয়ে পড়েছে সরাসরি ইহুদি রাষ্ট্রটির অর্থনীতির ওপর। বিষয়টিকে ইসরায়েলের যোগা-যোগমন্ত্রী বর্ণনা করেছেন ‘জঙ্গিদের (হামাস) হাতে উপহার তুলে দেওয়ার নামান্তর’ হিসেবে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র-জাতিসংঘের উদ্যোগে অস্ত্রবিরতির প্রচেষ্টার মধ্যেই গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা অব্যাহত রয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান নাভি পিল্লাই গতকাল ‘গাজায় ইসরায়েল যুদ্ধাপরাধ করছে’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি অবশ্য হামাসের রকেট ছোড়ারও নিন্দা জানিয়েছেন। ইসরায়েলের অপারেশন প্রটেক্টিভ এজের ১৬তম দিন পার হলো গতকাল। ১৬ দিনের অভিযানে ৬৮৭ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে তারা। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা ১৬০টিরও বেশি। আহত হয়েছে চার সহস্রাধিক। গতকাল ইসরায়েল গাজা ভূখণ্ডের একমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি উড়িয়ে দেয়। ইসরায়েল থেকে গাজায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয় গত সপ্তাহেই। ফলে বর্তমানে গাজার মাত্র ১০ শতাংশ লোক বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। এ ছাড়া প্রায় এক লাখ ২০ হাজার ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হয়েছে গত দুই সপ্তাহে। গাজার ৪৪ শতাংশ এলাকা খালি করার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েল।
তবে সার্বিক হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতির মধ্যেও সুখবর হিসেবে দেখা দিয়েছে হামাস এবং পশ্চিততীর নিয়ন্ত্রণকারী জোট ফাত্তাহর ঐক্যের সংবাদ। অস্ত্রবিরতির ক্ষেত্রে হামাসের বেঁধে দেওয়া শর্তগুলোর প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস।
চাপে ইসরায়েল : ইসরায়েলের সামরিক মুখপাত্র লে. কর্নেল পিটার লার্নার বলেছেন, ‘গাজার সুড়ঙ্গগুলোতে নিয়মিত প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছি আমরা। সুড়ঙ্গের আশপাশ এবং এর ভেতর প্রতি নিয়ত হামাসের যোদ্ধারা আমাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। চোরাগোপ্তা হামলাও চলছে।’ হামাসের সশস্ত্র শাখা ইজ্জাদ্দিন আল-কাশেম ব্রিগেড দাবি করেছে, তাদের বোমা হামলায় গতকাল ইসরায়েলের সাত সেনা নিহত হয়েছে। তবে ইসরায়েল এ প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করেনি। এ পর্যন্ত ইসরায়েলের ৩২ সেনাসহ ৩৫ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে একজন বিদেশি কর্মীও রয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের দাবি, লড়াই শুরু হওয়ার পর থেকে হামাসের ২১০ যোদ্ধাকে হত্যা করেছে তারা। এদিকে রেডিও তেহরান জানায়, গাজার আকাশে ইসরায়েলের একটি এফ-সিক্সটিন জঙ্গিবিমানে আঘাত হেনেছে হামাসের ক্ষেপণাস্ত্র। হামাস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ভূমি থেকে ছোড়া ওই ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইসরায়েলি জঙ্গিবিমানটিতে আগুন ধরে যায়, তবে বিমানটি ইসরায়েলের পূর্ব দেইর আল বালাহতে অবস্থিত একটি সামরিক ঘাঁটিতে জরুরি অবতরণে সক্ষম হয়। এ ব্যাপারে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।
এ ছাড়া হামাসের রকেট হামলার পর তেলআবিবের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরে ফ্লাইট বাতিল করেছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কেননা বিষয়টি সরাসরি ইসরায়েলের অর্থনীতির ওপর আঘাত হেনেছে।
গণহত্যা চলছেই : গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের গণহত্যা অব্যাহত রয়েছে। গতকাল এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বার্তা সংস্থা এএফপির দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজার জরুরি সেবাবিষয়ক মুখপাত্র আশরাফ আল কুদ্রা জানিয়েছেন, সকাল থেকে ৪৭ ফিলিস্তিনির লাশ পেয়েছেন তাঁরা। এই নিয়ে ১৬ দিনের অভিযানে ৬৮৭ ফিলিস্তিনি নিহত হলো। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এর ৮০ শতাংশই সাধারণ বেসামরিক নাগরিক।
ইসরায়েল যুদ্ধাপরাধী- জাতিসংঘ : গাজায় ইসরায়েলি দানবীয় হামলা শুরুর ১৬ দিন পর প্রথম তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাল জাতিসংঘ। সংস্থাটির মানবাধিকার পরিষদের প্রধান নেভি পিল্লাই গতকাল বলেন, গাজায় যুদ্ধাপরাধ করছে ইসরায়েল। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত সংস্থার এক সভায় তিনি বলেন, বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে না ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। তিনি অবশ্য নির্বিচারে রকেট ছোড়ায় হামাসেরও নিন্দা করেন। তবে জাতিসংঘের এ অবস্থানের ব্যাপারে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে ইসরায়েলের বিচারমন্ত্রী জিপি লিভনি বলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ ‘ইসরায়েলবিদ্বেষী’।
একজোট হামাস-ফাতাহ : গাজায় অস্ত্রবিরতির ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়েছে ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণকারী হামাস এবং পশ্চিম তীর নিয়ন্ত্রণকারী এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট ফাতাহ। ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী হামদাল্লাহ গত মঙ্গলবার বলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের চরম দুর্ভোগের ইতি টানার সময় এসেছে। সময় এসেছে আগ্রাসন ও অবরোধ বন্ধের। আমরা ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য ন্যায়বিচার চাই। ৪৭ বছর ধরে অবরুদ্ধ তারা।’ হামাসের অস্ত্রবিরতির শর্তও এটিই। ইসরায়েলকে অবরোধ তুলে নিতে হবে। প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালে ইসরায়েলি সেনা গিলাদ শালিতকে হামাস অপহরণের পর গাজায় অবরোধ আরোপ করে ইসরায়েল। নির্বাচনে জিতে হামাস ক্ষমতায় আসার পর এই অবরোধ আরো জোরদার করে তারা। এদিকে গত এপ্রিলে ফাতাহর সঙ্গে ঐক্যের একটি চুক্তি সই করে হামাস। হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনাকারী ইসরায়েল এই চুক্তিতে অসন্তুষ্ট হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোও হামাস সন্ত্রাসী সংগঠন বলেই মনে করে। ফলে গত কয়েক দিন থেকে অস্ত্রবিরতির আলোচনা চললেও হামাসের সঙ্গে সরাসরি সংলাপ চালায়নি যুক্তরাষ্ট্র। হামাসের ঘনিষ্ঠ কাতার ও তুরস্কের মাধ্যমে এ আলোচনা চলছিল। ফাতাহর সঙ্গে হামাস একাট্টা হওয়ার পর সেই সংকট মিটল বলেই মনে করা হচ্ছে।
কূটনৈতিক উদ্যোগ : অস্ত্রবিরতির লক্ষ্যে কূটনৈতিক তৎপরতাও কোনো অগ্রগতি ছাড়াই অব্যাহত রয়েছে। চলছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ও জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের দৌড়ঝাঁপ। গতকাল তাঁরা দুজনই ইসরায়েল সফর করেন। সেখানে বৈঠকও করেন। ফলাফল শূন্য। কেরি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গেও বসেছিলেন। বৈঠকে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে ইসরায়েলের এ অভিযান ‘যথাযথ এবং বৈধ’
সূত্র : বিবিসি, রয়টার্স, আল-জাজিরা, দ্য টেলিগ্রাফ।
বিষয়: বিবিধ
৮৫০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন