বন্ধ হোক পাহাড় কাটা
লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ আবদুল কাহহার নেছারী ২৯ আগস্ট, ২০১৪, ০৯:১৬:১৩ সকাল
মুহাম্মদ আবদুল কাহহার নেছারী : মানুষের কর্মকা-ের উপর ভিত্তিকরে মূল নামের পাশাপাশি অনেকেরই উপনাম থাকে। তা কখনো ইতিবাচক কাজের জন্য হয়, আবার কখনো নেতিবাচক কাজের জন্য হয়। তবে নেতিবাচক কাজের জন্য পাওয়া নামগুলোই জনপ্রিয় হয়। ‘পাহাড় কাটা ইঁদুর’ সে রকমই একটি নাম। পাহাড় বলতে অপেক্ষাকৃত ছোট পর্বতকে বোঝায়। প্রচলিত আছে যে, পাহাড়ের মাটি স্বাভাবিক মাটির তুলনায় জমাটবাঁধা, শক্ত প্রকৃতির। যে কারণে সব প্রজাতির ইঁদুরেরা পাহাড়ী মাটি খুঁড়তে পারে না। তবে একশ্রেণীর পাহাড়ী ইঁদুর আছে যারা পাহাড় কাটে, মানুষদেরকে ভয় পায় না। তেমনিভাবে এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা ক্ষমতার দাপটে পাহাড় কেটে মাটির ব্যবসা করছে। এরা হলো মানুষ নামের পাহাড় খেকো ইঁদুর বা পাহাড় কাটা ইঁদুর। তারা প্রশাসনকে ভয় করে না। ভয় করার কিছু নেই এ জন্য যে মাসোয়ারা দিয়ে বীরদর্পে পাহাড় কেটেই চলে। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন এ নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা নেই। সব সরকারের আমলেই তারা সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা কর্মী বনে যান। এদের মধ্য থেকেই তৈরি হয় নুরহোসেন ও এরশাদ শিকদার। এরা অনুপস্থিত থাকলেও রেখে যায় তাদের উত্তরসূরী। এদেরকে রক্ষা করার জন্য থাকে এক শ্রেণীর গডফাদার। এরা দেশ ও জাতির জন্য বড়ই ভয়ঙ্কর। তাদের কাছে জাতীয় সঙ্গীত বিনোদনের অংশমাত্র। দেশপ্রেম থাকলে দেশের মানুষের ক্ষতি করে নিজেরা অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে পারত না।
পাহাড় ও টিলা মহান আল্লাহ পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করেছেন। যা মাটি ও পাথর অথবা অন্য কোন কঠিন পদার্থ সমন্বয়ে গঠিত। বাংলাদেশে যে পাহাড়গুলো ধ্বসে পড়ে সেগুলো পাথরের নয় বরং মাটির পাহাড়। এক দিকে সাগর আর অন্য দিকে পাহাড় দিয়ে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা অপরূপের দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই পাহাড় শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক না হয়ে, ধ্বংস ডেকে আনছে। বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে অনেক লোক নিহত হয়েছে। প্রবল বর্ষণে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মাগুরছড়া পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় ধসে কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা অবনতি হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে যার চিত্র ফুটে ওঠেছে। চট্টগ্রামে অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ করায় প্রতিবছর পাহাড় ধসে মানুষের মৃত্যু হয়। পাহাড় কাটার ফলে সেখানকার জলবায়ু, মাটি, পানি ও প্রাণী বৈচিত্র্যের উপর ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে। সেখানকার বাসিন্দারা ভূমিকম্পের কারণে মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামের কুসুমবাগ, কাইচ্যাঘোনা, সেনানিবাসের লেডিস ক্লাব সংলগ্ন লেবু বাগান, বায়েজিদ বোস্তামি ও মতিঝর্ণাসহ সাতটি স্থানে প্রবল বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে ১৩২ জন, ২০০৮ সালের লালখান বাজারের মতিঝর্ণা এলাকায় ট্যান্কির পাহাড় ধসে একই পরিবারের পাঁচ জনসহ ১১ জনের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালে চকরিয়া উপজেলার হারবাং ও খুটাখালি ইউনিয়নে ৫ জনের প্রাণহানি, ২৭ জুন বান্দরবানের লামার ফাতরং ইউনিয়নে নারী ও শিশুসহ ২৩ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৩ সালে দেয়াল ধসে ১৮ জন মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। ২০১০ সাল থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত পাহাড় ধসে মৃত্যুও সংখ্যা ৪৫০ জনের অধিক। প্রতিবছর ১১ জুন পাহাড় রক্ষা দিবস পালনের দাবি জানিয়ে আসছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। এতে করে কিছুটা হলে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পাবে।
ভূতাত্ত্বিক গবেষকদের মতে, বাংলাদেশের পাহাড়ের ভূপ্রকৃতি বালি ও কাদা মাটির মিশ্রণে গঠিত। পাহাড়ের উপরিভাগে মোটা দানার বালির বিশাল স্তর, তার নি¤œভাগে রয়েছে কাদামাটির স্তর। পাহাড়ী অঞ্চলের অনেক স্থানে ফাটল থাকায় ঘন বর্ষায় তাতে পানি ঢুকে সহজেই ধসে পড়ে। পাহাড়ে ঘরবাড়ি তোলা নিরাপদ নয়। স্থান ও পাহাড় অনুযায়ী পাহাড়ের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ভিন্ন। পাহাড় কেটে ঘর-বাড়ি নির্মাণের মতো পাহাড় বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। তাই বিশেষজ্ঞদের সিদ্ধান্ত ছাড়া পাহাড় কাটা সম্পূর্ণরূপে অনুচিত।
কিন্তু তার পরেও পাহাড় খেকো মানুষেরা পাহাড়ের মাটি, বালু ও গাছ কেটে বাণিজ্য করায় পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট, অবৈধ দখলদারিত্ব, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে বিলীন করে তৈরি করা হচ্ছে বাগানবাড়ি। অনেক সময় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো নামে-বেনামে মাটি ও বালু বিক্রি করছে। যার কারণে বসবাসকারীরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী, কক্সবাজারের চকোরিয়া উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের অর্ন্তগত মছন্যাকাটা, বানিয়াছড়া, মাহমুদনগর, পাহাড়তলী, ভিলেজপাড়া, মুসলিম পাড়া, শান্তিনগর, ফইজ্যার ডেবা, লম্বা ঘোনা, ইসলাম নগর, বেতুয়া বাজার, মেধাকচ্ছপিয়া, নয়াপাড়া, বার আউলিয়া নগর, শাহ ওমর নগর, নয়াপাড়া, ছগিরশাহ, ছায়রা খালী পাহাড়ী এলাকার কমপক্ষে ১০ হাজার পরিবারে প্রায় ৫০ হাজার অধিবাসী বাস করছে। বান্দরবানের লামায় পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় ৪০০০ পরিবার। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের ঢালুতে বসবাসকারী পরিবারগুলোর বেশিরভাগই দরিদ্র শ্রেণীর। কোন কোন পরিবার মাতামুুহুরী নদীর ভাঙ্গনের শিকার হয়ে ভিটেবাড়ী হারিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়কেই নিরাপদ বসবাসের জায়গা করে নিয়েছেন। সুতারাং এসব অধিবাসীদের ঢালাওভাবে উচ্ছেদ না করে তাদের পুনর্বাসন করা খুবই দরকার। তা না হলে যে কোন মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের কোন দুর্ঘটনা। কখনো কখনো দেখা যায় স্থানীয় প্রভাবশালী মহল আইনের ঊর্ধ্বে উঠে প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে পাহাড়ের ঢালুতে নি¤œমানের আবাসন তৈরি করে তা ভাড়া দিয়ে প্রচুর টাকা আয় করে। যার কারণে অবৈধ বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। প্রশাসন চেষ্টা করেও নানা কারণে ব্যর্থ হচ্ছে। যে কোন অনিয়মই হোক না কেন তা আইন করে সম্পূর্ণভাবে সফল হওয়া যায় না। এজন্য জনসচেতনতা প্রয়োজন।
বান্দরবানের পাহাড়গুলো পাললিক শিলা দ্বারা গঠিত। যা সহজেই ভঙ্গুর প্রকৃতির। এছাড়া বৃক্ষ নিধন, পাহাড় খুঁড়ে পাথর উত্তোলন, অপরিকল্পিত জুম চাষ, পাহাড়কেটে ইটভাটা স্থাপনের ফলে পাহাড় ধস হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম-সিলেট অঞ্চলের পাহাড়গুলোর গড় উচ্চতা সাধারণত ৬০ থেকে ১৫০ মিটার। এ পাহাড় কাটতে গিয়েও প্রাণ হারাচ্ছে অনেক শ্রমিক। ২০১০ সালের পূর্বে পাহাড় কাটার অপরাধে তেমন কোন আইন ছিল না। শুধু পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের আদেশে অভিযুক্তদের বিচারের ব্যবস্থা হতো। ২০১০ সালে পরিবেশ আইনে পাহাড় কাটার অপরাধটি যুক্ত করা হয়। এছাড়া পাহাড়কাটা সম্পর্কে দেশীয় আইন অনুযায়ী অপরাধীর শাস্তি হলো ১০ বছরের জেল বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা। বিশেষজ্ঞদের মতে, পাহাড়কাটা যে ধরনের অপরাধ সে তুলনায় শাস্তি বা জরিমানা বিধান নিতান্তই কম। তদুপরি সে আইনেরও খুব-একটা প্রয়োগ নেই। নাগরিক সুবিধা দেয়ার নামে পাহাড় কাটা হচ্ছে। পাহাড়ী এলাকা ও তার আশেপাশের উপজেলার বাস্তবায়নাধীন উন্নয়নমূলক একাধিক প্রকল্পেও বালির পরিবর্তে পাহাড়ের মাটি ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। গত ডিসেম্বরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় কমপক্ষে ৩৫টি স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে প্রায় ৩০০ শ্রমিক পাহাড় কাটার কাজে জড়িত থাকার কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। যারা পাহাড়ের মাটি কেটে বিক্রি করছে তারা স্থানীয় প্রভাবশালী বা সরকারদলীয় রাজনৈতিক পরিবার। তবে পাহাড়কাটার বিষয়টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতায় নিয়ে আসলে দেশের সম্পদ রক্ষা করা যেতে পারে। অভিযো আছে, বন বিভাগ ও প্রশাসনকে ব্যবহার করেই চলে এসব অনিয়ম। পাহাড় কাটার সময় যাতে প্রশাসনের লোকজন কাউকে হাতে-নাতে ধরতে না পারে সেজন্য দু’য়ের অধিক শিফট করে বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা এবং রাত ৩টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত পাহাড় কাটা হয়ে থাকে। সুপরিকল্পিতভাবেই এ সময় নির্ধারণ করছে অসাধু ব্যক্তিরা। এ সময়ে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা কর্মস্থলে থাকেন না সে সুযোগটাই তারা কাজে লাগাচ্ছে।
সংবাদ মাধ্যমগুলো পাহাড়কাটা বিষয়ে যথারীতি রিপোর্ট করে আসলেও সরকারের পক্ষ থেকে নেই তেমন কোন প্রতিকার। যখনই কোন ঘটনা ঘটে তখনই কেবল গণমাধ্যম কর্মী ও জনগণের চাপ এড়ানোর জন্য তড়িঘড়ি নানা ব্যবস্থাপনার অবতারণা করা হয়। প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মাঠ পর্যন্ত সকলেই ঘুম থেকে জেগে ওঠা মানুষের মতো নড়ে-চড়ে বসে। মুমূর্ষু রোগীরা যেমন শেষ মুহূর্তে সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষের আচরণ করে তেমনি বড় ধরনের কোন দুর্ঘটনা ঘটলেই কর্তা ব্যক্তিরা শিশুসুলভ আচরণ করে যা অন্য কোন সময়ে দেখা যায় না। তাদের ব্যবহার দেখে মনে হয়, এর চেয়ে সুন্দর ব্যবহার আর হতে পারে না।
পাহাড় ধসে মানুষ মারা গেলে সরকার একধাপ এগিয়ে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল ও নিরবতা পালনের মাধ্যমে শোক পালনের আয়োজন করে। অন্যদিকে দুর্ঘটনার জন্য কারা দায়ী সরকারের কর্তাব্যক্তিদের এমন প্রশ্ন করা হলে তারা কোন ধরনের চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই বলে দেয়, ‘আমাদের লোকবল কম থাকায় তদারকি করা যায়নি’। রেলে দুর্ঘটনা বা মাওয়ায় লঞ্চ ডুবির দুর্ঘটনা সবখানেই যেন কর্তৃপক্ষের লোকবল কম বলে অযুহাত দিতে দেখা যায়। তাই যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে লোকবল কেন নিয়োগ করা হয় না-এই প্রশ্ন সবার। কোন অঘটন ঘটলেই মানুষের দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরানোর জন্য ‘তদন্ত কমিটি’ গঠন করা প্রচলিত রেওয়াজের মতো। অনেক ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটির রিপোর্টও পাওয়া যায় না। জানতে চাওয়া হলে, তদন্ত রিপোর্টের ফাইল খুঁজে পাওয়া যায় না। তার জন্যও দরকার হয় পুনঃতদন্ত কমিটি। এভাবেই আড়ালে থেকে যায় না জানা অনেক সত্য ঘটনা। গত কয়েক মাস ধরে বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ায় পাহাড়ী অঞ্চলের বাসিন্দারা তাদের ঝুঁকির কথা গণমাধ্যমকে জানালেও সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হচ্ছে না তেমন ব্যবস্থা। কোন অঘটন ঘটে যাওয়ার পরে কর্তা ব্যক্তিরা সেখানে হাজির হয়তো বলবেন, সরকার আগে থেকে জানতে পারলে ব্যবস্থা নিতো। এভাবেই শেষ হয় সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, নি¤œ পর্যায়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তি, রাজনৈতিক-আমলাদের দায়িত্ব পালনের মহড়া।
পাহাড় ধস ও প্রাণহানি রোধে সংশ্লিষ্ট এলাকায় সচেতনতামূলক সভা ও প্রচারপত্র বিলি করে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মানুষ নামের পাহাড়কাটা ইঁদুরদেরকে আইনের আওতায় এনে পাহাড়ী এলাকায় বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অধিবাসীদের পুনর্বাসন করলে আশা করা যায় পাহাড় ধস অনেকাংশে কমে আসবে।
লেখক : কলামিস্ট
**ইনকিলাব ঃ ২৯.০৮.২০১৪
http://www.dailyinqilab.com/2014/08/29/201795.php
বিষয়: বিবিধ
১২৮৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন