হজ্জে যাওয়ার আগে যা জানা ও করা প্রয়োজন
লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ আবদুল কাহহার নেছারী ২৪ আগস্ট, ২০১৪, ০৫:৪২:১৩ সকাল
দৈনিক ঃ সংগ্রাম --২৪.০৮.২০১৪
মুহাম্মদ আবদুল কাহহার নেছারী :
হজ্জ মুসলমানদের জন্য একটি মৌলিক ইবাদত। এটি আল্লাহর মনোনীত ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ। হজ্জ শব্দটি আরবি ভাষার একটি শব্দ হওয়ায় বাংলাতে এর উচ্চারণ লিখতে গিয়ে বিভিন্ন শব্দরূপ ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন : হজ/হজ্জ/হজ্ব/হাজ্জ (আরাবি : ح ج হাজ্জ)। শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জীবনে একবার হজ্জ সম্পাদন করা ফরয। হজ্জ একমাত্র ইবাদত যা একইসঙ্গে শারীরিক ও আর্থিক ইবাদত। যারা হজ্জ সম্পন্ন করেন তাদের হাজী বলা হয়। তবে অধিকাংশ হাজী সাহেবান অতি উৎসাহী হয়ে নামের পূর্বে হাজী বা আলহাজ্জ শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। এর ফলে অধিকাংশ সময় ব্যক্তির মাঝে অহঙ্কার প্রবেশ করে থাকে। তাই এ ধরনের যত শব্দ বা উপাধী রয়েছে তা ব্যবহার না করা ভালো। হজ্জ হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও সৌভাগ্যের মিলন মেলা। ধনী-গরীব সকলেরই পবিত্র হজ্জ পালন করার নেক আশা থাকে। কারো আশা পূরণ হয় আর কারো আশা অপূর্ণ থাকে। শারীরিক শক্তি থাকা অবস্থায় আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হওয়ার সাথে সাথেই পবিত্র হজ্জ আদায় করা উচিত। এক্ষেত্রে কালক্ষেপণ করা মারাত্মক গোনাহের কাজ। তিরমিযি ও মাসনাদে আহমদে বর্ণিত হয়েছে : যার বায়তুল্লাহর হজ্জ করার সামর্থ্য ও সঙ্গতি আছে কিন্তু সে হজ্জ করলো না, রাসূল (স.) তার সম্বন্ধে বলেছেন : সে ইয়াহুদি কিংবা নাসারা হিসেবে মারা গেলে তাতে কিছু আসে যায় না। কেননা আল্লাহ বলেছেন, বায়তুল্লাহ শরীফ যাওয়ার সামর্থ্য আছে তার আল্লাহর উদ্দেশ্যে সে গৃহের হজ্জ করা অবশ্য কর্তব্য। (মিনহাজুস সালিহীন : পৃ.১৭৯)। উল্লেখ্য যে, কুরআনে ১০ বার হজ্জ, ১ বার হিজ্জ ও ১ বার হাজ্জু ব্যবহৃত হয়েছে। আর উমরা শব্দটি ২ বার কুরআনে এসেছে। (কুরআনের পরিভাষা)।
কতিপয় পরিভাষা ও এর বর্ণনা : ক. ইহরাম : মূলত হজ্জের নিয়ত করা। পুরুষের জন্য দু’খানা সেলাইবিহীন চাদর পরিধান করা এবং মাথা ও মুখম-ল খোলা রাখা হয়। মহিলাদের জন্য মুখ ও দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত খোলা রাখতে হয়। খ. দম : হজ্জ বা উমরাহ আদায়ে কোনো ওয়াজিব ছুটে গেলে অথবা ইহরাম নষ্ট হয় এমন কাজ করলে হারাম এলাকার ভেতরে একটি পশু কোরবানি করে গরীবদের মধ্যে বিতরণ করতে হয়। গ. সায়ী : সাফা ও মারওয়াহ পাহাড়দ্বয়ের মাঝে সাতবার প্রদক্ষিণ করাকে সায়ী বলা হয়। ঘ. হাদী : হজ্জের কোরবানি (তামাত্তু ও ক্বেরান আদায়কারীদের উপর ওয়াজিব)। ঙ. তাওয়াফ : পবিত্র কাবাঘরকে ৭ বার প্রদক্ষিণ করাকে তাওয়াফ বলে। চ. তাওয়াফে ইফাদা/জিয়ারাহ : হজ্জের ফরজ তাওয়াফ যা আরাফাত, মুজদালিফা ও মিনার প্রথম দিনের কাজ শেষে মক্কায় এসে সম্পন্ন করতে হয়। ছ. বিদায়ী তাওয়াফ : হজ্জ বা ওমরাহর যাবতীয় কাজ শেষে মক্কা ত্যাগের পূর্বের তাওয়াফ। জ. ইজতেবা : পুরুষের ইহরামের চাদরকে ডান বগলের নিচে দিয়ে এনে বাম কাঁধে রেখে ডান কাঁধ খালি রাখা। ঝ. রমল : মক্কায় পৌঁছে প্রথম তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে পুরুষগণ ছোট ছোট পদক্ষেপে সামান্য দৌড়ের ভঙ্গিতে দুই হাত দুলিয়ে চলা। ঞ. হাতীম : কাবাঘরের রোকনে ইরাকী ও রোকনে শামীর মাঝে দেয়াল ঘেরা অর্ধচক্রাকৃতি অংশ যা পূর্বে কাবাঘরের অংশ ছিল। চ. রমি : রমি অর্থ কঙ্কর নিক্ষেপ। জামরাতে হাজীসাহেবগণ ১০ জিলহজ্জ বড় জামরাতে ৭টি এবং ১১ ও ১২ জিলহজ্জ ৩টি জামরাতে ৭টি করে কঙ্কর নিক্ষেপ করেন। কঙ্কর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। ছ. মাবরুর হজ্জ : যে হজ্জে হাজীকে কোনো গোনাহ স্পর্শ করে না এমন হজ্জকে মাবরুর হজ্জ বলে।
হজ্জে যাওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি : সবার আগে মনোবল দৃঢ় করা। শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য মেডিকেল চেকআপ করিয়ে নেয়া। কমপক্ষে হজ্জ ফ্লাইটের ৩০ দিন পূর্বে ম্যানেনজাইটিস ইনজেকশন ও ইনফ্লুয়েঞ্জা জ¦রের টিকা দিয়ে তার সার্টিফিকেট কপি ট্রাভেলস অফিসে জমা দেয়া। হজ্জের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে অবগত হওয়া। নিজ জেলার থানা থেকে পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের ছাড়পত্র এবং পাসপোর্ট, ভিসা প্রসেসিং, মহিলা হজ্জযাত্রীদের মোহরেমাত এফিডেভিট, মেডিকেল কার্ড, টিকিটসহ যাবতীয় অফিসিয়াল কাগজপত্র সংগ্রহের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা। বায়তুল্লাহ ও মদীনা মুনাওয়ারার অত্যন্ত কাছে সুন্দর পরিবেশে হোটেল বা বাড়িতে থাকা ও দেশীয় রান্নায় খাওয়ার সুব্যবস্থা বিষয়ে ট্রাভেলস কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা চূড়ান্ত করে নেয়া। একাধিকবার হজ্জ করেছেন এমন বিজ্ঞ আলেম বা প্রশিক্ষকের নিকট থেকে হজ্জের কার্যাদি ভালোভাবে অবগত হওয়া। হজ্জে গমনেচ্ছু ব্যক্তিদের সুবিধার্থে বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা ট্রাভেলস কর্তৃক হজ্জবিষয়ক যে সকল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় তাতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। আরবি ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষ নন এমন ব্যক্তিরা সম্ভব হলে আরবি ও ইংরেজি ভাষায় প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করে নিতে পারলে ভালো হয়। পবিত্র মক্কা ও মদীনার ঐতিহাসিক পুণ্যময় জায়গাসমূহ এবং আল্লাহর দরবারে দোয়া কবুল হওয়ার যে স্থানগুলো রয়েছে সে সম্পর্কে অবগত হওয়া। প্রয়োজনে রাজধানী ঢাকার কাঁটাবন মসজিদ সংলগ্ন দোকান বা স্থানীয় নির্দিষ্ট দোকান থেকে হজ্জবিষয়ক বই, বিগত হজ্জের অডিও ও ভিডিও চিত্র সংগ্রহ করে জ্ঞানার্জন করা।
হজ্জের সফরে যেসব দ্রব্যাদি সঙ্গে রাখা প্রয়োজন : যোগাযোগের জন্য আন্তর্জাতিক ফোন নম্বরসহ মোবাইল, প্রয়োজনীয় অর্থ, পবিত্র হজ্জবিষয়ক ও প্রয়োজনীয় বই, পুরুষের ইহরামের জন্য আড়াই হাত বহরের আড়াই গজ করে দুই পিস ও তিন গজ করে দুই পিস সাদা কাপড়, মহিলাদের ইহরামের জন্য সালোয়ার, কামিজ ও বোরকা ইত্যাদি সাধারণ কাপড়ই যথেষ্ট। কোমরে বাঁধার জন্য ১টি বেল্ট, একজোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল সঙ্গে নিবেন এবং তাওয়াফের সময় জুতা/স্যান্ডেল রাখার জন্য একটি কাপড়ের ব্যাগ, পাসপোর্ট ও মূল্যবান কাগজপত্র রাখার জন্য একটি গলার ব্যাগ, একটি ইহরামের কাপড় রাখার ব্যাগ, একটি পাথর রাখার ব্যাগ, একটি ছাতা, ইহরাম থেকে হালাল হওয়ার সময় মাথা মু-ানোর জন্য ব্লেড ও রেজার সঙ্গে নেয়া। এ ছাড়াও পরিধেয় বস্ত্র পরিমাণ মতো সঙ্গে নেয়া যাহা ইহরাম খোলার পর ব্যবহার করিতে হইবে। যেমন- লুঙ্গি, পায়জামা/প্যান্ট, জামা, গেঞ্জি, টুপি, গামছা, জুতা, মোজা, মহিলাদের জন্য সালোয়ার, কামিজ, ওড়না, বোরকা সঙ্গে রাখবেন। খাবারের জন্য মেলামাইন প্লেট, গ্লাস, চায়ের কাপ, প্রয়োজনীয় শুকনা খাবার, মেসওয়াক/ব্রাশ ও পেস্ট, লাইলনের রশি, টয়লেট পেপার, আয়না, চিরুনী, তেল, সাবান, দাঁতের খিলাল, ব্যক্তিগত খরচের টাকা, প্রয়োজনীয় প্রেসক্রিপশনসহ ৪৫ দিনের ওষুধ, বিছানার চাদর, একটি প্লাস্টিক মাদুর, পাম্পিং বালিশ, ইত্যাদি সঙ্গে নিবেন।
হজ্জের কার্যাদি আদায়বিষয়ক তথ্য : হজ্জের ১ম দিন (৮ই জিলহজ্জ) : ইহরাম অবস্থায় মিনায় পৌঁছে যোহর, আসর, মাগরিব, ইশার সালাত আদায় করে সেখানেই রাত্রি যাপনসহ ফজরের সালাত আদায় করা। মিনায় রাত্রি যাপন করা সুন্নত। হজ্জের ২য় দিন (৯ই জিলহজ্জ) : ফজরের সালাত আদায় করে আরাফার ময়দানে উপস্থিত হওয়া। আরাফাত ময়দানে সূর্য হেলার পর হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা ফরয। সম্ভব হলে আরাফাতে অবস্থিত মসজিদে নামিরার ইমাম সাহেবের পেছনে যোহর ও আসরের সালাত আদায় করা। অথবা নিজ তাবুতে জামায়াতের সাথে সালাত আদায় করে নেয়া। সূর্যাস্তের পর মাগরিবের সালাত আদায় না করে মুজদালিফায় রওয়ানা হওয়া। মুজদালিফায় ইশার ওয়াক্তের সময় একই আজানে জামায়াতের সাথে মাগরিব ও ইশার সালাত আদায় করে নেয়া। মুজদালিফায় রাত্রি যাপনসহ ফজরের ওয়াক্ত পর্যন্ত অবস্থান করা ওয়াজিব। এবং মুজদালিফা থেকেই রাত্রে ছোট-ছোট ৪৯টি কঙ্কর সংগ্রহ করে নিতে হইবে। হজ্জের তৃতীয় দিন (১০ই জিলহজ্জ) : মুজদালিফা থেকে ফজরের সালাত আদায় করে সূর্য ওঠার কিছুক্ষণ পর মিনার উদ্দেশে রওয়ানা করা। মিনায় পৌঁছে সূর্য হেলে যাওয়ার পূর্বেই বড় জামরাতে ৭টি কঙ্কর নিক্ষেপ করা এবং নিজ জিম্মায় কোরবানি করা উভয়টি ওয়াজিব। তারপর পুরুষগণ মাথার চুল মু-িয়ে গোসলকরত ইহরাম খুলে ফেলতে হবে। মহিলারা মাথার চুলের ১ ইঞ্চি পরিমাণ অগ্রভাগ মাহরাম দ্বারা কাটানো ওয়াজিব। তারপর মক্কা শরীফে তাওয়াফে জিয়ারত করা ফরয। তাওয়াফ শেষে মিনায় রাত্রি যাপন করা সুন্নত। তাওয়াফে যিয়ারত ও কোরবানি ১২ জিলহজ্জের মাগরিবের পূর্ব পর্যন্ত আদায় করা যায়। হজ্জের ৪র্থ দিন (১১ জিলহজ্জ): তাওয়াফে যিয়ারত, কোরবানি এবং চুল মু-ন না করা হয়ে থাকলে সেটা সম্পন্ন করা। মিনায় ৩টি জামরাতে ৭টি করে (প্রথমে ছোট জামরাহ, ২য়তে মেঝ জামরাহ ও তৃতীয় তে বড় জামরাহ) মোট ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। সূর্য হেলার পর, সূর্য ডুবার আগে মিনাতেই রাত্রি যাপন করা। হজ্জের ৫ম দিন (১২ জিলহজ্জ): ১১ জিলহজ্জের অনুরূপ কাজ করে সূর্য হেলে যাওয়ার পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্বে তিনটি জামরাতে ৭টি করে মোট ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে এবং সূর্যাস্তের পূর্বে মিনা ত্যাগ করে অবশ্যই মক্কায় রওয়ানা করা। তবে ১২ জিলহজ্জ সূর্যাস্তের পূর্বে মিনা ত্যাগ না করলে ১৩ জিলহজ্জ মিনায় অবস্থান করে আরও ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করা সুন্নত। এরপর মক্কা শরীফে চলে যেতে পারবেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বিশুদ্ধ ও মকবুল হজ্জ পৃথিবী এবং পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু অপেক্ষা উত্তম। জান্নাত আর কোনো কিছুই এর বিনিময় বা প্রতিদান হতে পারে না।’ (বুখারী ও মুসলিম)। সুতরাং যারা যারা হজ্জে যাওয়ার নিয়ত করেছেন, তাদের আল্লাহ হজ্জ করার তৌফিক দিন। এবং আল্লাহ তাদের হজ্জকে কবুল করুন। আমীন।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
http://www.dailysangram.com/news_details.php?news_id=155029
বিষয়: বিবিধ
১৩২৫ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন