ঈদ বোনাস ও আন্দোলন

লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ আবদুল কাহহার নেছারী ১৯ জুলাই, ২০১৪, ১০:২২:৫৫ রাত

মুহাম্মদ আবদুল কাহহার নেছারী

মাহে রমজানের দ্বিতীয় দশক শেষ হতে চলেছে। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সবখানেই ঈদ ও বোনাসকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে। সকল পেশার কর্মজীবী মানুষরা বেতন-বোনাস পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছে। ঈদকে ঘিরে পরিবারে বড়দের চেয়ে ছোটদের আবদার ও আনন্দ অনেক বেশি। বাবা-মায়ের সাথে ঈদের কেনাকাটা করা বড়ই আনন্দের বিষয়। পরিবারের কর্তাব্যক্তির বেতন যাই হোক না কেন সকলেই ঈদের কেনাকাটা করতে চেষ্টা করেন। খুব কম সংখ্যক পরিবারই আছে যাদের কেনাকাটা করতে ঈদ বোনাস ও বেতনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। এছাড়া বাকি সকলকেই বেতন-বোনাসের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু সেই বেতন-বোনাস নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা টালবাহানা করে। যার ফলে প্রতিবছরই পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন পেশার শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দেয়। যা পরবর্তী সময়ে বড় ধরনের আন্দোলনে রূপ নেয়। সেই আন্দোলনের সাথে যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা অতি উৎসাহী ভূমিকা পালন করে তখন পরিবার, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।

পোশাক শিল্পের সাথে ৪৪-৪৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। বিজিএমএ-এর তথ্য মতে, জাতীয় রফতানি আয়ের ৭৭ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। যে শ্রমিকদের ঘামে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরে সে শ্রমিকদের ব্যাপারে রয়েছে নানা অবহেলা। শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার আদায়ে আন্দেলনে যেতে হয় এটা দুঃখ জনক। ঈদ বোনাস ও বেতনভাতা পাওয়ার জন্য আন্দোলন না করলে কর্তৃপক্ষ কেন যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। যদিও নতুন শ্রম আইন অনুযায়ী মূল বেতনের ৫০ শতাংশ উৎসব ভাতা ঈদের আগে পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকলেও গণমাধ্যমের বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনেক পোশাক কারখানায় জুন মাসের বেতন নির্দিষ্ট সময়ে দেয়া হয়নি। অথচ মজুরি বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতি মাসের ৭ তারিখের মধ্যে পূর্ববর্তী মাসের বেতন পরিশোধ করার কথা থাকলেও অধিকাংশ কারখানার মালিক সে নিয়ম মানছেন না। তাই শ্রমিকদের ক্ষোভ যেন বিক্ষোভে পরিণত হতে চলছে। শ্রমিকের আন্দোলন ঠেকাতে সরকারের পুলিশ-বিজিবিসহ অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহারের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। বিগত দিনে দেখাগেছে শ্রমিকের অধিকার ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও শ্রমিকদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে জমা হওয়া শ্রমিকের টাকার পূর্ণ হিসাব তারা এখনও বুঝে পাননি। শ্রমিক অসন্তোষের যতগুলো কারণ রয়েছে তার মধ্যে এটিও একটি কারণ। রানা প্লাজা ধসের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি স্থগিত হওয়া, অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স গঠনসহ সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে ঈদপূর্ব দিনগুলো খুবই স্পর্শকাতর হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ ইতোমধ্যে সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে যে, ২৬ জুলাইয়ের মধ্যে সকল শ্রমিকের বোনাস এবং জুইলাই মাসের আংশিক বেতন পরিশোধ করার। কিন্তু এই সময়সীমার মধ্যে সকল প্রতিষ্ঠান বেতন বোনাস করবে কিনা তা নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। অপর দিকে ২৬ জুলাই হচ্ছে শুক্রবার, তাই সেদিন ব্যাংক বন্ধ এই অযুহাতে কোন কোন মালিক কৌশলে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন শ্রমিকরা।

ইতোমধ্যে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নেমে মিছিল-মিটিং, সড়ক অবরোধ, কর্মবিরতি, জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটিয়েছে। এছাড়া বিগত দিনে দাবি আদায়ে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। অতীতে মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতায় লাখ লাখ শ্রমিকের ঈদ আনন্দ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। সেকারণেই এবারও পোশাক কারখানাগুলোতে সংঘর্ষের যে আশঙ্কা করা হচ্ছে তা উড়িয়ে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। ইতোমধ্যে রাজধানীর আশপাশ এলাকাসহ চট্টগ্রামের কয়েকটি কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে।

১৩ জুলাই জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন মানববন্ধনের আয়োজন করে। একই দিনে রাজধানীর কাওরানবাজারস্থ বিজিএমইএ ভবনের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে বিভিন্ন গার্মেন্টের শ্রমিক। ৯ জুলাই রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় তোবা গার্মেন্ট কারখানার শ্রমিকদের বকেয়া বেতন ভাতার দাবিতে সড়ক অবরোধ, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বিসিক শিল্প নগরীতে গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্টের মানববন্ধনসহ গত দুই সপ্তাহে ঢাকা, আশুলিয়া, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি কারখানায় শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছে। ফলে দেশের পোশাক শিল্পে অস্থিরতা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

গত ২৭ জুন, ২০১৪ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এর তথ্য মতে, গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করা ৯৮ ভাগ নারী শ্রমিকের মধ্যে ৩০ ভাগ নারী শ্রমিকই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ৭৬ ভাগ নারী শ্রমিক মনে করেন তার আর্থিক নিরাপত্তা নেই। ৪০ ভাগ নারী শ্রমিক ন্যূনতম মজুুরি পাচ্ছেন না। এমতাবস্থায় ঈদের আগে বেতন বোনাস না পেলে শ্রমিকদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আন্দোলনকে বৃহৎ আন্দোলনে পরিণত করলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা পেতে বড় ধরনের সমস্যা হবে। কারণ, বেতন-ভাতা নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ হলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা ফেরত না পাওয়ার আশা থাকবে না। বিজিএমইএর তথ্য মতে, ঈদের আগে প্রায় এক হাজার পোশাক কারখানা বেতন- বোনাস নিয়ে জটিলতায় পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এটি কোনো ইতিবাচক সংবাদ নয়। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। শিক্ষক সমাজ তাদের দাবি নিয়ে মাঠে নামতে চাচ্ছেন, বিএনপি অনবরত চূড়ান্ত আন্দোলনে নামার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর আমীর, নায়েবে আমীরসহ কয়েকজনের রায়কে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবিরের থাকতে পারে নানা প্রস্তুতি। অপরদিকে নারায়ণগঞ্জে সেভেন মার্ডার, ফেনীতে চেয়ারম্যানকে পুড়িয়ে হত্যা, মিরপুরে বিহারী ক্যাম্পে পরিকল্পিত অগ্নিসংযোগসহ রমজানে দ্রব্যমূল্য লাগামহীন বেড়ে যাওয়া, হত্যা, গুম-খুন, অন্যায়ভাবে পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্যে জনমনে প্রচ-ভাবে ক্ষোভ বিরাজ করছে। এমনি মুহূর্তে শ্রমিকরা আন্দোলনে নামলে দেশের জন্য ভালো হবে না।

শ্রমিকদের আরেকটি দাবি হলো অসময়ে গার্মেন্ট থেকে শ্রমিক ছাঁটাই করা। শ্রমিক ছাঁটাই একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটি বছরের যে কোন সময়ই হতে পারে। তবে শ্রমিকদের দাবি হলো সেটা রমজান মাসে না হওয়া দরকার। রমজানের ঈদকে কেন্দ্র করে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের খরচ বেড়ে যায়। ঈদ খরচ মেটানোই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে যায়। আর এ মাসেই যদি চাকরি হারাতে হয় তাহলে কষ্টের আর সীমা থাকে না। তাই মালিকদের এ বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত। যখনই শ্রমিকরা তাদের শ্রমিক ইউনিয়নের মাধ্যমে দাবি আদায়ে সোচ্চার হয় তখনই মালিক পক্ষ তাদের নির্যাতন করে। এ থেকে নারী শ্রমিকরাও রেহাই পায় না। গত একবছর ধরে শ্রমিকদের উপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয়েছে কিন্তু কোনোটিরই সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। পোশাক শিল্পের জন্য এমন ঘটনা অশনিসংকেত। মালিকরা ঈদের বাজার করতে বিদেশে চলে যান অথচ শ্রমিকরা নিজ দেশের ফুটপাত থেকে পোশাক কিনবে, অথচ সে সুযোগটুকুও তাদের দেওয়া হচ্ছে না। এটি সত্যিই ভাবনার বিষয়।

শুধু পোশাক শিল্পেই নয় বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীরাও ঈদের আগে জুন-জুলাই মাসের বেতন ও পূর্ণাঙ্গ ঈদ বোনাস পাওয়ার দাবি জানিয়েছেন। একদেশে দু’নিয়ম কীভাবে সম্ভব? সরকারি বেসরকারি অফিস-আদালত ও শিল্প-প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা বেতন ও পূর্ণাঙ্গ বোনাস পেতে শুরু করেছে। অথচ গার্মেন্টস কারখানায় ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেলায় প্রায়শই অনিয়ম ঘটে। পূর্ববর্তী মাসের বেতন পরবর্তী মাসের ২০-২৫ তারিখের পূর্বে কখনই পাওয়া যাওয়া না। বাস্তব সত্য হলো কোনো মাসেই সঠিক সময়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বেতন পান না। শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর একথাটি হয়তো সরকার ভুলতে বসেছে। অন্যান্য পেশার তুলনায় শিক্ষকদের বেতন তুলনামূলক কম। তদুপরি যে বেতন দেয়া হয় সেটিও পাওয়ার ক্ষেত্রে নেই কোন বিধি নিয়ম। বোনাস দেয়া হয় মূল বেতন স্কেলের ২৫%!

সর্বদাই রমজানের শেষ সপ্তাহে ঈদ বোনাস দেয়ার অর্ডার দেয়া হয়। কখনো কখনো তা ঈদের পূর্বে পাওয়া যায়। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই তা ছাড় করানো যায় না। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোতে বোনাস ছাড়ের অর্ডারের কপি পৌঁছতে বিলম্ব হওয়ায় শিক্ষকদের নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। বেতন ও বোনাস যখন দিতেই হবে তখন কিছু দিন আগে দিলে ক্ষতি কোথায়? প্রতিবছর রমজান এলেই বেতন আর বোনাসের জন্য আন্দোলনে নামতে হয়, এই অবস্থার পরিবর্তন কত দিনে হবে? শ্রমিক ও শিক্ষক উভয়েই যুলুমের শিকার। সর্বোপরি কথা হলো, যে শ্রমিকরা পোশাক তৈরি করে সেই শ্রমিকরা ঈদের পোশাক সময় মতো কিনতে পারবেন কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট



http://www.dailyinqilab.com/2014/07/18/192927.php

বিষয়: বিবিধ

১৭৪০ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

246142
২০ জুলাই ২০১৪ রাত ১২:৩২
ব্লগার সাজিদ আল সাহাফ লিখেছেন : হাম্বালীগের এই বাংলাদেশে এমন অনেককিছুই হবে যা কেউ ভাবেনি আগে...!!
246161
২০ জুলাই ২০১৪ রাত ০১:৪২
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : বেতন দিতে দেরি করার মাধ্যমে জমা টাকার উপর বারতি সুদ এর সুযোগ নিতে চান অনেক ব্যবসায়ি। আবার যত দেরি হবে বাস মালিকরাও তত বেশি সুযোগ পাবেন মানুষকে শোষন করার। এই হলো আমাদের মানসিকতা! রোজা আর ঈদের মত ধর্মিয় উৎসব কে নিয়ে ব্যবসা করা।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File