মুসলমানদের ঈদের পোশাক
লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ আবদুল কাহহার নেছারী ১১ জুলাই, ২০১৪, ০২:৫২:১০ রাত
মুহাম্মদ আবদুল কাহহার নেছারী
দ্বিতীয় হিজরীর রমযান মাসে রোযা ফরয করা হয়। মুসলমানরা প্রথমবারের মতো ঈদ উদযাপন করেছিল দ্বিতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে। বদরের যুদ্ধের সুস্পষ্ট বিজয়ের পর এই ঈদ উদযাপিত হয়েছিল। আল্লাহর রাসূল সা. মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় যাওয়ার পর তাদেরকে দেখলেন পারসিক প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে বসন্তের পূর্ণিমা রজনীতে ‘মেহেরজান’ আর হেমন্তের পূর্ণিমা রজনীতে ‘নাওরোজ’ নামক উৎসব পালন করে। যে উৎসব ছিল অশ্লীলতায় পরিপূর্ণ। মদীনার নওমুসলিমগণও জাহিলী যুগ থেকে তাদের মতো করে এ অনুষ্ঠান পালন করতো। রাসূল সা. বললেন, “আল্লাহ এ দুটি দিনের পরিবর্তে অন্য দু’টি দিন তোমাদের উৎসব করার জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার একটি হলো ‘ঈদুল ফিতর’ অন্যটি ‘ঈদুল আযহা’। তোমরা পবিত্রতার সাথে এ দু’টি উৎসব পালন করবে।” (আবু দাউদ ও নাসায়ী)। যতগুলো উৎসব আমাদের দেশে পালন করা হয় তার মধ্যে ঈদুল ফিতর উল্লেখযোগ্য। রোযাদারদের জন্য এক মহাপুরস্কার ‘ঈদুল ফিতর’। এর অর্থ হচ্ছে রোযা ভঙ্গের ঈদ। এক মাস সাওম পালন করার পর আমরা যেহেতু রোযা ভেঙ্গে ফেলি সেজন্যই ঈদুল ফিতর নামকরণ করা হয়েছে। সাওম ও ঈদুল ফিতরের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জনের প্রশিক্ষণ নেয়ার কথা থাকলেও সে দিকে তেমন গুরুত্ব নেই; অন্তত বাংলাদেশে ঈদের পোশাক কেনাকাটা ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা দেখলে তাই মনে হয়।
মানুষ পরিকল্পিতভাবে যেই কাজগুলো করে তার মধ্যে পোশাক ক্রয় সম্পর্কীয় পরিকল্পনা একটি। পোশাক পরিধান করা মানবীয় রীতি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মার্জিত যে কোন ধরনের পোশাকই ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী গ্রহণীয়। পোশাক মানুষের মন ও রুচির পরিচয় বহন করে। হাতের সুন্দর লেখা যেমন হৃদয় জয় করে নানা ভাবনার জন্ম দেয় তেমনি পরিধেয় পোশাকও মানুষের চোখের ভাষা ব্যবহার করে নানা জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি করে। প্রত্যেক ব্যক্তির পোশাকই তাকে মূল্যায়ন-অবমূল্যায়ন করার কথা পরোক্ষভাবে বলে দেয়। ব্যক্তি যে মানের কিংবা যে রুচির তার পোশাকও সেই মানের হয়ে থাকে এটাই সাধারণ রীতি। সেটা কখনো ইতিবাচক কখনো নেতিবাচক। মার্জিত শালীন পোশাক সব ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য। অশালীন ও বিকৃত রুচীর পোশাক সাধারণভাবে পরিত্যাজ্য। কিন্তু ব্যক্তি বিশেষে পছন্দনীয়। ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নিয়মানুযায়ী ব্যক্তির পোশাক সময়ের ব্যবধানে পৃথক পৃথক হয়ে থাকে। বিশেষ করে ঈদের পোশাক কেমন হবে সে বিষয়ে দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কমবেশি সকলে চেষ্টা করে।
যেসব কারণে মাহে রমযানের এত গুরুত্ব তারমধ্যে অন্যতম হলো এই মাসে পবিত্র কোরআন নাযিল হওয়া। অথচ আমাদের মধ্যে কুরআন শেখার ব্যাপারে রয়েছে যথেষ্ট অবহেলা। ঈদের আনন্দ নিয়ে রয়েছে নানা বাড়াবাড়ি। অনেকের কাছেই রমযান শুরু হওয়া মানেই যেন প্রত্যহ কিছু না কিছু কেনাকাটা করা। লেটেস্ট মডেলের পাঞ্জাবি, স্যালোয়ার, জামা, পারফিউম, জুতা, নারীদের নানা পোশাকসহ প্রভৃতি আইটেম কেনার ধুম পড়ে যায় ফুটপাত থেকে আধুনিক শপিংমল পর্যন্ত। রাতের তারাবীহ ও কিয়ামুল-লাইল যেন বয়োবৃদ্ধ লোকদের জন্যই নির্দিষ্ট হয়ে গেছে।
ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে ঈদের দিনে আমরা কী করি আর রাসূল সা. কী কী করেছেন তা রাসূলের হাদীস ও নিজ কর্মের সাথে মিলিয়ে দেখা প্রয়োজন। ঈদুল ফিতরে করণীয় হলো- রোজা না রাখা : ‘রাসূল সা. দুই ঈদের দিন রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন।’ (বুখারী ও মুসলিম)। গোসল করা : রাসূল সা. ঈদের সালাতে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন। (মুয়াত্তা ইমাম মালেক)। ‘রাসূল সা. খেজুর না খেয়ে ঈদগাহে যেতেন না। (বুখারী)। সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নত। ইমাম মালিক রহ. বলেন, মুসলিম প-িতগণ প্রত্যেক ঈদে সুগন্ধি ব্যবহার করা ও সুসজ্জিত হওয়াকে মুস্তাহাব বলেছেন। (আল মুগনী)। হযরত জাবির রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা.-এর একটি সুন্দর জুব্বা ছিল যা তিনি দুই ঈদে ও জুম‘আর দিনে পরিধান করতেন। (মুসনাদে বায়হাকী)। যাদুল মায়াদ-এ উল্লেখ রয়েছে ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেছেন, “রাসূল সা. দুই ঈদেই ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন।” সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা। পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া। ‘রাসূল সা. এক রাস্তা দিয়ে যেতেন এবং অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসতেন।’ (বুখারী)। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে নানা শব্দ ও বাক্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তার মধ্যে “তাকাববালাল্লাহা মিন্না ওয়া মিনকুম” (আল্লাহ আমাকে ও আপনাকে কবুল করুন) এ বাক্যটি শুভেচ্ছা বিনিময়ে উত্তম একটি দোয়া। রাসূল সা. ঈদের দিন বের হয়ে শুধু ঈদের দু’রাকায়াত সালাত আদায় করতেন। ঈদের সালাতের পূর্বে ও পরে নফল বা অন্য কোন সালাত আদায় করতেন না। (বুখারী ও মুসলিম)। ঈদের সালাতের পরে খুৎবাহ প্রদান করা ও শোনা ওয়াজীব। কিন্তু আজ কুরআন শেখা, সালাত কায়েম করা, যাকাত দেয়াসহ কুরআনের নির্দেশ ও শিক্ষাকে উপেক্ষা করে নতুন পোশাক পরিধান করার বিষয়টিই যেন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া কারো কারো কাছে মিথ্যা, কল্পনা ও চরিত্রহীনতার নানা রূপ যেন ঈদ আনন্দেরই অংশ। ঈদের দিনটিকে অনেকেই নিছক আনন্দের দিন মনে করে। এটি যে একটি ইবাদতেরও দিন সে কথা যেন আমরা ভুলেই যাই। যে সময়ে মানুষগুলো একমুঠো ভাত ও একটি কাপড় যোগাড় করতে পারছে না, সে সময়ে কেউবা একাধিক নামিদামি কাপড় পড়ে ফ্যাশন-শো করছে! আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নেয়া, প্রতিবেশীর খোঁজখবর নেয়ার দায়িত্বকে আমরা দায়িত্ব মনে করছি না।
শপিংমল ও ফ্যাশন হাউস কর্তৃপক্ষ যথারীতি প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে ঘোষণা করেছে নানা অফার। লোভনীয় অফারগুলো পেতে কেউ কেউ টাকা ধার করে হলেও সুযোগ নিয়ে থাকে। অফারগুলোর ধরন এভাবে যে, ‘মুলা কিনলে গরু ফ্রি’। কিন্তু পোশাকগুলোর মান কেমন সেটা যাচাই করা হয় না। সে পোশাকগুলো অনেকেই ‘বাণিজ্যিক পোশাক’ হিসেবে জেনে থাকেন। গরম ও বৃষ্টির কথা চিন্তা করে কাপড়ের ধরন, রং, ডিজাইন নির্ধারণ করা হয়েছে। শার্ট, টি-শার্ট, পাঞ্জাবি, তাঁতের শাড়ি ও লুঙ্গি, শার্ট, ফতুয়া, সিনথেটিক, টাঙ্গাইল, ব্লক প্রিন্ট, স্ক্রিন প্রিন্ট, অ্যাম্ব্রয়ডারি, হাফ সিল্ক, এন্ডি সিল্ক, তাঁত কটন, মসলিন কাপড়, কাঁথা স্টিচ, বিভিন্ন ম্যাটেরিয়েলের কাজ করা হয়েছে। ছাপা শাড়ি ব্যতীত যেন ঈদই অপূর্ণ থাকে। সর্বদাই ডিজাইনে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করা হয়। এত কিছুর পরও সেসব পোশাক নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই।
পোশাক সম্পর্কে আল কুরআনের নির্দেশনা হলো, “আমি তোমাদের জন্য পোশাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং অবতীর্ণ করেছি সাজ-সজ্জার বস্ত্র এবং পরহেযগারীর পোশাক, এটিই সর্বোত্তম।” (সূরা আ’রাফ : ২৬)। এ আয়াতে পোশাকের দু’টি উপকারিতা বর্ণিত হয়েছে। (এক) গুপ্তাঙ্গ আচ্ছাদিত করা এবং (দুই) শীত-গ্রীষ্ম থেকে আত্মরক্ষা এবং অঙ্গ-সজ্জা। গুপ্তাঙ্গ ও লজ্জাস্থান ঢাকাই হলো পোশাক পরিধানের আসল সার্থকতা। যদি কোন পোশাক ডিজাইন, সঙ্কীর্ণতা, স্বচ্ছতা বা অন্য কোন কারণে এই ফরজ উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয় তাহলে তা পরিধান করা বৈধ নয়, তা যে পোশাকই হোক। পরিধান করা মানুষের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য। অথচ সেই পোশাক তৈরি ও পরিধান করার ক্ষেত্রে বিবেক কাজে লাগানো হয় না। একটি মাস সাওম পালন করে যে তাকওয়ার পরিচয় দিয়েছে তা যেন ঈদের দিনেই হারিয়ে ফেলছি আমরা। মানুষের ওপর শয়তানের প্রথম যে আক্রমণ শুরু হয়েছে সেটারও উদ্দেশ্য ছিল পোশাক খুলে বিবস্ত্র করা।
ঈমানের পর সর্বপ্রথম ফরয হলো গুপ্তাঙ্গ আবৃত করা। শয়তান মানুষের এ দুর্বলতা আঁচ করে সর্বপ্রথম গুপ্তাঙ্গ আচ্ছাদনের উপর হামলা করছে। নামায, রোযা ইত্যাদি সবই এরপর। গুপ্ত-অঙ্গ আবৃতকরণ এবং আরাম ও সাজ-সজ্জার জন্য দুই প্রকার পোশাক বর্ণনা করার পর আল কুরআনে তৃতীয় আরেক প্রকার ‘তাকওয়ার পোশাক’র উল্লেখ করা হয়েছে। এটিই হলো সর্বোত্তম পোশাক। (মাআরেফুল কোরআন)। হযরত ইবনে আব্বাস ও ওরওয়া ইবনে যুবাইর রা.-এর তাফসীর অনুযায়ী তাকওয়ার পোশাক বলে সৎকর্ম ও খোদাভীতিকে বোঝানো হয়েছে। (রুহুল-মা’আনী)।
পোশাকের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য সতর বা শরীরে গোপন অংশ আবৃত করা। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু কিছু লোক এমনভাবে প্যান্ট পরেন যা দৃষ্টিকটু ও শরীয়তের সীমালঙ্ঘন। পুরুষরা প্যান্ট নাভীর নীচে নামিয়ে পরেন, টাখনুর নীচে প্যান্ট ঝুলিয়ে প্যান্ট পরিধান করেন। অপরদিকে নারীরা প্যান্ট টাখনুর অনেক উপরে তুলে পরিধান করেন। ফ্যাশন হাউসগুলো ঐভাবেই ডিজাইন করে প্যান্ট তৈরি করছে। পোশাকের সুন্দর মডেল বললেই যেন ভারতীয় নায়ক-নায়িকাদের মতো করে ড্রেস তৈরির মডেলটিই ভেসে ওঠে। ড্রেসের মধ্যেই অশ্লীলতার ছাপ স্পষ্ট। সারাদেশে ইভটিজিংয়ের যতগুলো ঘটনা তার অধিকাংশ ঘটনার জন্য বিশেষজ্ঞরা পোশাকে অশ্লীলতা ও চাল-চলনে ভিনদেশী সংস্কৃতিকে দায়ী করেছেন। এসব পোশাক তৈরির ক্ষেত্রে কখনোই ধর্মীয় অনুশাসন মানা হয় না। ফ্যাশন হাউসগুলো যদি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে পোশাক তৈরি করত তাহলে সমাজে ইতিবাচক একটি পরিবেশ বিরাজ করতো। অন্যদিকে ইসলামী চিন্তাবিদরা যদি পোশাকের ইসলামী নীতিমালা নিয়ে আরো বেশি ভূমিকা রাখেন তাহলে খুব ভালো হয়। তরুণ ও যুবসমাজকে সঠিক পথে পরিচালনার স্বার্থে শপিংমল ও ফ্যাশন হাউসগুলোতে যথাযথ নিয়ম মেনে উত্তম পোশাক তৈরি করা ও সরবরাহ করা খুবই প্রয়োজন।
পোশাকের ব্যাপারে সাধারণ নীতিমালা হলো : পোশাক শরীরে এমন আঁটসাঁটও না হওয়া চাই, যাতে এসব অঙ্গ উলঙ্গের মতো দৃষ্টিগোচর হয়। পোশাকে অহঙ্কার ও গর্বের ভঙ্গি থাকবে না বরং ন¤্রতার চিহ্ন প্রকাশ পাবে। পুরুষদের নির্দিষ্ট কোন পোশাক নারীরা পরিধান করবে না। তেমনি নারীদেরও নির্দিষ্ট কোন পোশাক পুরুষেরা পরিধান করবে না। অধিকন্তু পোশাকে বিজাতীয় অনুকরণও হবে না। রেশমের কাপড়ে তৈরি হবে না। তাই ঈদ কিংবা অন্য যে কোন পোশাক ক্রয়ের ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। ঈদ আনন্দ ও বিনোদনের কথা বলে শরীয়তের আইনকে লংঘন করা উচিত নয়। যে পোশাক পরিধান করলে প্রথম দৃষ্টিতেই মুসলিম বলে মনে হয় সেই পোশাকই উত্তম। শরীয়াহ বিরোধী পোশাক যত দামের ও ফ্যাশনের হোক না কেন তা পরিহার করা ঈমানের দাবি। আমরা মুসলমানগণ যখন ঈদের পোশাক কেনার জন্য মার্কেট বা শপিংমলগুলোতে ভিড় করছি, তখন একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের পোশাক কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখব- এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
বিষয়: বিবিধ
১৬৮২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন