ট্যানারীর বর্জ্যে অতীষ্ট নগরবাসী

লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ আবদুল কাহহার নেছারী ০৩ জুলাই, ২০১৪, ০৭:৫৪:৪২ সন্ধ্যা

ট্যানারীর বর্জ্যে অতীষ্ট নগরবাসী

মুহাম্মদ আবদুল কাহহার নেছারী

১৯৪০ সালে আরপি সাহা নারায়ণগঞ্জে সর্ব প্রথম ট্যানারী শিল্প স্থাপন করেন। সময়ের পরিবর্তনে ৬২ বছর পূর্বে ১৯৫১ সালের ০৩ অক্টোবর ঘোষিত এক গেজেটের নোটিফিকেশনের মাধ্যমে ভূমি অধিগ্রহণপূর্বক ট্যানারী শিল্পকে নারায়ণগঞ্জ থেকে হাজারীবাগে স্থানান্তরিত করা হয়। পরবর্তীতে নগরীতে বেশী দূষণকারী শিল্পখাত হিসেবে ২৮ বছর আগে ১৯৮৬ সালে তৎকালীন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্ন্য়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় ১৮ টি খাতের ৯০৩ টি শিল্প কারখানাকে পরিবেশ দূষণের জন্য চিহ্নিত করে। হাজারীবাগের সব ট্যানারী ওই তালিকায় আইনের দৃষ্টিতে ‘লাল’ ক্যাটাগরিভুক্ত হয়। বর্তমানে সারাদেশে মোট ট্যানারী শিল্প রয়েছে ২৭০ টি । যার ৯০% ঢাকার হাজারীবাগে প্রায় ২৫ হেক্টর জায়গার উপর অবস্থিত। ট্যানারী শিল্পগুলো প্রতি বছর গড়ে ১.৫ কোটি বর্গফুট চামড়া পাকা করে থাকে। যার শতকরা ১৫ ভাগ দেশীয় চাহিদা পূরণ করে, আর ৮৫ ভাগ বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। বিশ্ব অর্থনীতির বাজারে এর অবদান অনস্বীকার্য। দেশের সর্ববৃহৎ চামড়া প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল এবং একমাত্র বিশেষায়িত চামড়া শিল্প বিষয়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কলেজ অব লেদার টেকনোলজির অবস্থান হিসেবে হাজারীবাগ নামটি বেশ পরিচিত ।

২০১১ খ্রি.ঢাকা সিটি কর্পোরেশন বিভক্তির পরে এটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এর অধীনে অন্তর্ভুক্ত হয়। সকলের ধারনা ছিল সিটি কর্পোরেশন বিভক্তির পর শহরের রাস্তা-ঘাট উন্নয়ন হবে, সার্বক্ষণিক গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি পাওয়া যাবে। পয়:নিষ্কাষন ব্যবস্থা অনেকাংশে বাড়বে। ট্যানারী শিল্প খুব দ্রুত স্থানান্তরীত হয়ে সাভারের হেমায়েত পুরে চলে যাবে। ময়লার নগরী হিসেবে হাজারীবাগের নামটি ঘুচে গিয়ে ধানমন্ডি, ঝিগাতলা, নিউ মার্কেট, লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, কেরানীগঞ্জ, রায়েরবাজার ও বসিলা সহ বুড়িগঙ্গা নদীর দু’পাড়ের বসবাসরত লক্ষ-লক্ষ মানুষ ফিরে পাবে ৭০ বছর পূর্বের গ্রামীণ পরিবেশ। নদী ফিরে পাবে তার যৌবনের গান। নদীর শোভা মাছ ও জলজ প্রাণীরা ভেসে উঠে আনন্দ দিবে জেলে ও নগরবাসীকে। অথচ সেই পানি এবং বাতাস ভারী হয়ে আছে ট্যানারী শিল্পের নানা বর্জ্যের মাধ্যমে। ট্যানারীগুলো স্থানান্তরীত হওয়ার কথা থাকলেও সব কাজ ঢিমে-তেতালা ভাবে চলছে। তাইতো নগরবাসীর প্রশ্ন হাজারীবাগ টু হেমায়েতপুর কি এক যুগের পথ ? ঢাকা শহর দূষণ মুক্ত কবে হবে ?

রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটার পরিবেশ নাই। পথের পাশে খোলা জায়গাতেই পশুর পশম, লেজ, চামড়ার অবশিষ্টাংশ, হাঁড় সহ নানা পঁচা-গলা বর্জ্য ফেলে রাখা হয়েছে। যার দুর্গন্ধে অত্র এলাকায় বসবাস করা জীবন-মরণ যুদ্ধের মতো। এই পরিবেশেই রয়েছে শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। হাজার হাজার কোমলমতি শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকের পাশাপাশি ১৫ থেকে ২০ লাখ লোক এই পরিবেশের মধ্যে ও আশেপাশে বেড়ে উঠতে হয়। এ থেকে মুক্তি দেয়া, মুক্তি পাওয়া মানবাধিকের অর্ন্তভুক্ত। গ্রামাঞ্চলের কোন আত্মীয়-স্বজন কিংবা পিতা-মাতা পর্যন্ত হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থানরত তার আদরের সন্তানের বাসায় বা কোন আত্মীয়ের বাসায় আসতে বা থাকতে চায়না। গোটা এলাকার পরিবেশে গন্ধ আর গন্ধ। ফলে কষ্ট করে হলেও বৃদ্ধ মা-বাবাকে গ্রামের বাড়ীতে একা-একা থাকতে হয়। দুঃখের সময় কিংবা ঈদের দিন ব্যতীত মা-বাবার মুখ দেখা সম্ভব হয়না। ট্যানারীগুলো স্থানান্তরীত হলে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।

এই এলাকায় বসবাসরত অসংখ্য মানুষ চিকিৎসকদের পরামর্শ গ্রহণ করলেও সুস্থ হতে পারছেনা। চিকিৎসক জানিয়ে দেন হাজারীবাগ এলাকায় বসবাস করলে খুব অল্প সময়ে ভাল হয়ে যাবেন, তা চিন্তা করা ভুল। ট্যানারী বর্জ্য ও পরিবেশকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞ মহল। এই এলাকায় উৎপাদিত শাক-সবজি, ফল-মূল সহ হাঁস-মুরগির ডিম ও গোশত না খাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। বন ও পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেছেন, ‘ট্যানারী দূষণের কারণে ঢাকা মহানগরী বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে’। ট্যানারীকে ঘিরে গড়ে উঠছে প্রায় শতাধিক ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান, যাদের অধিকাংশ অনিয়মের মধ্যে চামড়ার বিভিন্ন অংশ কাঁচা ও পাকাকরণের সাথে জড়িত। যারা পরিবেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার প্রয়োজন অনুভব করেনা। এ ব্যাপারে নেই কোন সরকারি পদক্ষেপ । এলাকাবাসী এসকল বিষয়ে সরকারি হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এছাড়াও খোলা ড্রেন রয়েছে যার ফলে দূষিত পানি,কর্দমাক্ত রাস্তা, আন্ডার ড্রেন ভরে গেছে, চামড়ার আবর্জনা, ঝিল্লিসহ পলিথিন, উচ্ছিষ্ট, উৎকট গন্ধ, মশা- মাছির উপদ্রব। বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতায় আটকে থাকে এলাকা বাসী। নোংড়া পানিতে বস্তীবাসীর সকল ধরণের ময়লা পানিতে ভেসে আসে। রাস্তায় খানা-খন্দ থাকায় কিছু কিছু এলাকায় রিক্সায় চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ে। বৃষ্টির দিনে অফিসগামী মানুষদের অতিরিক্ত পোশাক নিয়ে বাসা থেকে বের হতে হয়। অধিকাংশ সময় রিক্সা পাওয়া যায় না। অনুপায় হয়ে ময়লা পানি পেঁড়িয়ে কাজে যেতে হয়। ছোট-বড় প্রায় ২৫০ টি ট্যানারীতে প্রায় ৩০ হাজারের অধিক শ্রমিক কাজ করছে। একজন শ্রমিকের সাথে তার গোটা পরিবার বাস করছে। ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়ার মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। স্কুল-মাদ্রাসা-কলেজগামী শিক্ষার্থীদের এধরনের পরিবেশের মধ্যেই বেড়ে উঠতে হয়। ট্যানারীর বর্জ্য সাধারণত দুপুর ও বিকালে বেশী নির্গত হয়, আর এ সময়ই বেশী মানুষের কাজে বের হওয়ার সময়। সুতারং এদের স্বাস্থ্য ঝুকিও সবচেয়ে বেশী।

মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের এক গবেষণায় দেখা যায়, ট্যানারী এলাকার মাটি ভয়ানক ভাবে দূষিত। মাটি থেকে বিষাক্ত পদার্থ ঢুকে পড়ছে উদ্ভিদে, যা খাদ্যচক্রের মাধ্যমে জমা হয় মানব ও পশু দেহে। হাজারীবাগ এলাকায় অপরিশোধিত বর্জ্য পিএইচ-এর পরিমাণ ৭.৮% থেকে ১১.৪%। এগুলো খুবই ক্ষারীয় এবং মাটিতে ইলেকট্রিক্যাল কন্টাকটিভিটি ৩৬৭৪ ডিএস/এম। হাজারীবাগ ট্যানারী থেকে ৩০০ মিটার দূরেও উদ্ভিদে কেডমিয়াম পাওয়া গেছে ২.২৩ পিপিএম, লেড ১৫০.৫৮ পিপিএম। (আলোকিত বাংলাদেশ, ১২.০১.১৪)। পরিবেশ অধিদফতর ও সোসায়টি ফর এনভারনমেন্ট আ্যন্ড হিউম্যান ডেভলপমেন্টের (সেভ) গবেষণা জরিপ “হেলথ অব ট্যানারী ওয়ার্কশপ” থেকে জানা যায়, সারা দেশে প্রতিদিন ১৮ মেট্রিক টন বর্জ্য নির্গত হয়, যার ৮৮ মেট্রিক টন নির্গত হয় হাজারীবাগ ট্যানারী থেকে। সারা দেশে তরল বর্জ্য নির্গত হয় প্রতিদিন ৮.৪৭ মিলিয়ন লিটার, যার ৭.৭০ মিলিয়ন লিটার নির্গত হয় হাজারীবাগ ট্যানারী থেকে, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। বায়ু দূষণের ফলে স্বাস্থ্যহানী ঘটছে। অজান্তেই শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢুকে পড়ছে নানা বিষাক্ত পদার্থ। জন্ডিস,আলসার, চর্ম রোগ, শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, সাইনোসাইটিস, টিবি, হাঁপানি, ফুসফুসের ক্যানসার, রি মেটিক ফিভার, আমাশয়, ডায়রিয়া, নিদ্রাহীনতা, মানষিক সমস্যা, অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি, কিডনি ও ফুসফুস জনিত নানা রোগ দেখা দেয় । চামড়ার উচ্ছিষ্ট দিয়ে মাছ ও ব্রয়লার মুরগীর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় । এসকল খাদ্য গ্রহণকারী মাছ ,মুরগী , মুরগীর ডিম যা জীবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবার সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান স¦াক্ষরীত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ট্যানারীর বর্জ্য সরাসরি বছরে প্রায় ৪০ কোটি ১৫ লাখ টাকার পরিবেশের ক্ষতি করছে। (মানব কন্ঠ,৩০.০৬.২০১৩)। বুড়িগঙ্গা নদী দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস হাজারীবাগের ট্যানারী শিল্প। পৃথিবীর সবচাইতে দূষিত তালিকার মধ্যে হাজারীবাগের নামটি স্থান পেয়েছে। এতেই বুঝা যায় কতটা নোংড়া ও অপরিচ্ছন্ন এ এলাকা। জার্মানের বার্লিন শহরে গত ১১ ফেব্রুয়ারি হয়ে গেল বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব। উৎসবে ক্যানাডিয়ান পরিচালক জেনিফার বেইচওয়াল আর এডোয়ার্ড বার্টিনিস্কি নির্মিত ‘ওয়াটারমার্ক’ তথ্যচিত্রে ১০ টি দেশের ২০ টি স্থানের ছবি পেয়েছে। এর মধ্যে আছে হাজারীবাগ। ট্যানারীর কারণে নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে ওঠার কাহিনি বলা হয়েছে সে ডকুমেন্টারিতে। (বিডি প্রেস ডট নেট-এএফপি)। এছাড়া সুইজারল্যান্ডের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ সংস্থা ‘দ্য ইনিস্টিটিউট অ্যান্ড গ্রিন ক্রস’ সম্প্রতি বিশ্বেও শীর্ষ ১০ দূষিত স্থানের নাম প্রকাশ করেছে তাতে হাজারীবাগের নাম স্থান পেয়েছে। এ ধরণের নেতিবাচক সংবাদ বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে ছোট করে তুলছে।

ট্যানারীর বর্জ্যরে কারণে জলজ প্রাণী মুক্ত এক নদী তার নাম বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গা নদী সহ শীতালক্ষ্যা, তুরাগ এর ১১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পানির চেয়ে বর্জ্যই বেশী। পানি বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড.আইনুন নিশাত বলেছেন, ট্যানারীর বর্জ্যরে কারণে বুড়িগঙ্গা নদী ৯০ ভাগ বিষে জর্জরিত। পানির গন্ধ, স্বাধ, রং পরিবর্তন হয়ে ভিন্ন এক অবস্থায় পরিণত হয়েছে। জাতের মেয়ে কালো ভালো আর নদীর পানি ঘোলাও ভাল সেই লোক কথা আজ অসত্যে পরিণত হয়েছে। নদীর পানির স্বাবাভিক অবস্থা কেমন তা এলাকার কোন শিশু কিংবা বালক বলতে পারবেনা। অল্প বয়সে আক্রান্ত হচ্ছে এলাকার বাসিন্দারা। ১৪০ টিরও বেশী গোপন সুরঙ্গ পথে পরিশোধন ব্যতীত ৭০ ধরনের রাসায়নিক বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে। বিশেষ করে ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, ফসপোজিপসাম, পারদ, ক্লোরিন নানা ধরনের এসি দস্তা , লোগাম অ্যালকালি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এর দ্বারা শ্বসনতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র, জননতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে বুড়িগঙ্গাকে মৃত নদী হিসেবে ঘোষণা করেছে। তাদের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এ নদীতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকবেনা । পরিবেশ অধিদফতর সম্প্রতি বুড়িগঙ্গার সবকটি পয়েন্টের পানি পরীক্ষা করে কোথাও গ্রহণযোগ্য মাত্রার অক্সিজেন পায়নি। বুড়ি গঙ্গার যৌবন ফিরে পেতে হলে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারী শিল্প স্থানান্তরের বিকল্প নেই।

চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা.এম মুজিবুল হক বলেন, হাজরিীবাগের ট্যানারী পুরনো ঢাকার বাসিন্দাদের জন্য অভিশাপ। ট্যানারী অঞ্চল ও আশেপাশের মানুষ খোস,পাচড়াসহ নানা জটিল রোগে ভুগছে এ অঞ্চলের মানুষ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সম্প্রতি এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্যানারীর রাসায়নিক বর্জ্যরে কারণে হাজারীবাগে শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৮০০০ বেশী শ্রমিক চর্ম, পরিপাক ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত। এসকল ক্ষতিকর দিক থেকে নগরবাসীকে মুক্ত রাখতে না পারলে মানব সম্পদ হারিয়ে যাওয়ার আশংঙ্কা রয়েছে।

চামড়া শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে যেমন সরকারি-বেসরকারি পদক্ষেপ দরকার তেমনি ট্যানারী শিল্পের ক্ষতিকর পদার্থ ও বর্জ্য থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দেয়া অপরিহার্য। ট্যানারীগুলো যত তাড়াতাড়ি স্থানান্তরীত হবে নগরবাসী ততই ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে। ট্যানারী মালিকদেরকে যথাযথ চাহিদানুযায়ী অর্থ বরাদ্দ দিলে স্থানান্তরের কাজটি এগিয়ে যাবে বলে বলে ধারণা করছে নগরবাসী। এজন্য মালিকদেরকে ব্যাংক ঋণ কিংবা ভর্তুকী দিয়ে সহায়তা করা অপরিহার্য। তাহলেই সরকারের মন্ত্রীদের ঘোষণা বাস্তবায়নের মুখ দেখবে। নচেৎ ঘোষণা কাগজ-কলমেই থেকে যাবে। এর যুক্তি হিসেবে শিল্প মন্ত্রী আমির হোসেন আমুর কথাটি সবচেয়ে বেশী গ্রহণ যোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে ট্যানারী স্থানান্তরের জন্য ট্যানারী মালিকদেরকে এ পর্যন্ত ১৯৭ টি চূড়ান্ত নোটিশ দেয়া হয়েছে এর পরেও ট্যানারী শিল্প সরানো হয়নি’। এ কথাই প্রমাণ করে চাহিদানুযায়ী মালিকদের শর্ত পূরণ করা হয়নি, তাই সরকারকে আরো বেশী আন্তরীক হবে। সরকার এদিকে নজর না দেয়ায় স্থানীয়রা অসুস্থ হওয়ার পাশাপাশি ট্যানারীর ক্ষতিকর রাসায়নিকে শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে । সরকার কারখানার শ্রমিক ও এলাকাবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা নেয়নি। এই প্রক্রিয়া যত বিলম্বিত হবে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি তত বেশী হবে। যাই-যাচ্ছি বলে যেভাবে সময়ক্ষেপন করা হচ্ছে তা মোটেই জনকল্যাণ নয়। সরকারের উচিৎ যত দ্রুত সম্ভব ট্যানারী মালিকদেরকে যথাযথ চাহিদা মোতাবেক টাকা ভর্তুকি কিংবা ঋণ দিয়ে সহায়তা করা । যদি তা না করা হয় তাহলে শুধু ট্যানারী স্থানান্তরের ঘোষণা কার্যকরী হতে আরো কয়েক যুগ পার হয়ে যাবে।

এক দশক আগে পরিবেশ ও নদীকে দূষণমুক্ত রাখতে ট্যানারীগুলো হাজারীবাগ থেকে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় অনুমোদন দেয়া হয় সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগর প্রকল্প। বহু দফায় সময় বৃদ্ধি করেও এখনো পর্যন্ত স্থানান্তরীত করা যায়নি। কবে নাগাদ শেষ হতে পারে তা বলাও মুশকিল। সরকার ও ট্যানারী মালিক পক্ষ কেউই যেন কথা রাখছেন না। নগরবাসীর ক্ষতির দিক চিন্তা করে ট্যানারী মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) তাদের ট্যানারীগুলো স্থানান্তরে যথাশীঘ্র ব্যবস্থা নিবেন বলে নগরবাসী মনে করছে। তেমনি ভাবে সরকারের কাছে বিটিএর যে সকল ক্ষতিপূরণ দাবী ও শর্ত রয়েছে সে দাবী যত তাড়াতাড়ি পূরণ হবে ট্যানারী স্থানান্তরের কাজটি ততবেশী এগিয়ে যাবে। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ট্যানারী শিল্প-কারখানা দ্রুত স্থানান্তরে ‘ওয়ার্কিং টিম’ গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। অপরদিকে ট্যানারী শিল্প উদ্যোক্তারা সরকারকে চারটি প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবগুলো গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হলে চামড়া শিল্প আশাতীত সফলতা পাবে। প্রস্তাবগুলো হলো : সিইটিপি নির্মাণ, ২০০ একর জমি অধিগ্রহণের ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করা, সহজশর্তে কম সুদে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণদান ও রফতানি প্রণোদনা প্রদান ও ব্যাংকিং সহজীকরণ করা। ট্যানারী শিল্প নিয়ে যে সকল জটিলতা দেখা যায় শীঘ্রই তার অবসান হওয়া দরকার। মন্ত্রী আরো বলেন, যে সকল ট্যানারী স্থানান্তরীত হবেনা সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে। এরকম আশার বাণী শুনতে শুনতে জনগণ যেন কারো কথার প্রতিই আস্থা আনতে পারছেনা। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন সাগর-রুনীর হত্যাকারীদের ৪৮ ঘন্টার মধ্যে বের করার ঘোষণা দিয়েছিল অথচ দু’বছর পার হলেও তার কোন কুল কিনারা হয়নি। তেমনি শিল্পমন্ত্রী ঘোষণা করেন, খুব শীঘ্রই ট্যানারী স্থানান্তরীত করার প্রক্রিয়া শুরু হবে। এ রকম বহু ওয়াদা বা ঘোষণা সরকারের পক্ষ থেকে এসেছে কিন্তু বাস্তবের সাথে কিছুই মিলছেনা। এখন পর্যন্ত নগরবাসী ক্ষতির হাত থেকে মুক্তি পায়নি। ২০১৬ এর মধ্যে স্থানান্তরের শতভাগ কাজ শেষ হবে বলে দাবী করা হচ্ছে। বাস্তবে কতটুকু কার্যকর হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

* লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

বিষয়: বিবিধ

১১৮৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File