মাদকদ্রব্যে সয়লাব সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি
লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ আবদুল কাহহার নেছারী ০২ জুলাই, ২০১৪, ০৭:৫৩:১৫ সন্ধ্যা
মুহাম্মদ আবদুল কাহহার নেছারী
প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও ২৬ জুন মাদকদ্রব্য অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস পালিত হলো। ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৪২ তম অধিবেশনের সিদ্ধান্ত (৪২/১১২) অনুযায়ী প্রতিবছর এ দিবসটি পালিত হয়। মাদকদ্রব্য ব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি ও এর বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখার জন্য সমাজকে উদ্বুদ্ধকরণের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘভুক্ত সকল দেশে দিবসটি পালিত হয়। এই সংক্রান্ত কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশও ১৯৯০ সাল থেকে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে আশির দশক থেকে মাদকের ক্রমবর্ধমান অপব্যবহার জাতিকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। এদেশে মাদকাসক্তের অধিকাংশ তরুণ এবং শতকরা ৮৫ ভাগ মাদকাসক্তের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। (বিশ্ব দিবস)।
বিশেষত্ব অনুযায়ী এক এক অঞ্চলকে এক নাম দেয়া হয়েছে। কুষ্টিয়া জেলার ২৬ টি গ্রাম গাঁজা উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত বলে এ অঞ্চলকে গোল্ডেন ভিলেজ, মাদক পাচার ও চোরা চালানের জন্য বিখ্যাত বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল সীমান্তে অবস্থিত অঞ্চলকে গোল্ডেন ওয়েজ, আফিম মাদক উৎপাদনকারী আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ইরান সীমান্তে অবস্থিত অঞ্চলকে গোল্ডেন ক্রিসেন্ট এবং মায়ানমার , লাওস ও থাইল্যান্ড সীমান্তে অবস্থিত অঞ্চলকে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল বলা হয়। মাদক উৎপাদনকারী গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল ও গোল্ডেন ক্রিসেন্টের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। স্বর্নের বিনিময়ে আফিম কেনা হতো বলেই সম্ভবত এর নাম দেয়া হয়েছে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল। ভৌগলিক হিসেবে অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ মাদক পাচারের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
এক সময় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার স্বাধীন রাষ্ট্র লাওসের দক্ষিণাঞ্চলের কুখ্যাতি ছিল পপি চাষ এবং পপি থেকে হেরোইন উৎপাদনের জন্য। লাওসের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা স্টিংয়ের ছোট্ট গ্রাম ফিয়ার। ফিয়ার গ্রামেই রয়েছে উচ্চমাত্রার নেশা উদ্রেককারী মাদকের অনেক গোপন কারখানা। এ মাদককে সবাই মেথামফেটামাইন হিসেবে চেনে। এটি ১৮৮৭ সালে আবিষ্কার হয়। সর্বপ্রথম ব্যবহৃত দেশ হলো জার্মান। মেথামফেটামাইন বিভিন্ন ভাবেই গ্রহণ করা যায়। ধোঁয়া গ্রহণ, নাক দিয়ে গ্রহণ ও ইনজেকশনের মাধ্যমেও গ্রহণ করা যায়। এটি সাময়িকভাবে শরীরে শক্তি যোগালেও ধীরে ধীরে শরীরকে অবসাদগ্রস্ত করে দেয়। এটি যৌন উদ্দীপনা যোগায়। এর থাই নাম হচ্ছে ইয়াবা। ইয়াবা এশিয়ার কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেশাদ্রব্য। তবে হেরোইন, প্যাথেড্রিন, গাঁজা, আফিম, চরস, ভাং, মরফিন, হাসিস, কোকেন, হেলুসিনোজেন, বাজুকো, ঘুমের ঔষধ ইত্যাদির ব্যবহারও কম নয়।
মাদকগ্রহণের ফলে সে সকল সমস্যা দেখা যেতে পারে তার মধ্যে-ফ্যাটি লিভার, জন্ডিস, বুকজ্বালা, গ্যাস্ট্রিক-আলসার, আগ্নাশয়ের প্রদাহ, শ্বাসনালী ও খাদ্যনালী , মুখগহবর, বৃহদান্তের ক্যান্সার, কিডনি বিকল, স্মৃতি ভ্রষ্টতা, মস্তিষ্কে স্ট্রোক, বিষণœতা, দুশ্চিন্তা, মানসিক অস্থিরতা, অনিদ্রা, কাজে একাগ্রতার অভাবসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে ইয়াবা গ্রহণের ফলে রক্তচাপ বৃদ্ধি, রক্তনালীর স্থায়ী ক্ষতি, অস্বাভাবিক হৃদ-স্পন্দন, হার্ট-এ্যাটাক, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মৃত্যু, ঘুমের ব্যাঘাত, নার্ভের ক্ষতি, অস্বস্তিকর মানসিক অবস্থা, কিডনি বিকল, চিরস্থায়ী যৌন-অক্ষমতাসহ ফুসফুসে টিউমার ও ক্যান্সার হতে পারে।
বিশ্বের শতাধিক দেশের ৫০/৬০ কোটি মানুষ মাদকে আসক্ত বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক রিপোর্টে (২০১৩) প্রকাশ করা হয়েছে। অন্য এক জরিপে জানা গেছে মোট জনসংখ্যার ৫% মানুষ বিভিন্ন প্রকার ড্রাগে আসক্ত। আমেরিকাতে প্রতি তিন জন মাদকাসক্তে একজন মহিলা আসক্ত। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী মাদকাসক্তির কারণে প্রতিবছর দু’লাখ লোক মারা যায়। আরেক জরিপে এর সংখ্যা ৭০ লাখের বেশি। বাংলাদেশে গত দু’দশক ধরে মাদকসেবিদের সংখ্যা প্রায় জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। গত দু’বছর আগের এক জরিপে জানা বাংলাদেশে জানা গেছে ১৭ লক্ষ লোক মাদকাসক্ত। অথচ দশম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সংসদে বলেন, ‘ভারত, মিয়ানমার ও পাকিস্তানের মাদক সিজারের তুলনামূলক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে বাংলাদেশে মাদক পরিস্থিতি অতটা ভয়াবহ নয়।’ প্রকৃত অর্থে এ ধরণের বক্তব্য মাদককে উৎসাহের নামান্তর। যে দেশগুলো মাদকদ্রব্য উৎপাদন করে এবং অনৈতিকতার শীর্ষে সে সব দেশের উদাহরণ দিয়ে বাংলাদেশকে বিবেচনা করা মোটেই সমীচীন নয়। ঘরে ঘরে মাদক ব্যবহার হচ্ছে, ফুটপাতে হাতের নাগালে মাদকদ্রব্য পাওয়া যাচ্ছে, নূর হোসেনের মত লোকেরা মাদকের পাহাড় গড়ে তুলছে । তারপরেও সরকারের কাছে পরিস্থিতি ভয়াবহ বলে মনে হচ্ছেনা ! এ ধরণের মন্তব্য সর্বদাই পরিত্যাজ্য। এছাড়া ১১ জুন ’১৪ সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। মাদক ও ইয়াবা পাচার রোধকল্পে গত বছরের ২৭ অক্টোবর টেকনাফ উপজেলায় ৯ জনবল সংবলিত একটি অস্থায়ী সার্কেল অফিস স্থাপন করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি এবং কোস্টগার্ড নিরলসভাবে কাজ করছে। এত কিছুর পরেও লম্বা কথার আড়ালেই থেকে যায় ইয়াবা সিন্ডিকেট। আশার বানী শুনতে শুনতে বাংলাদেশীরা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কবে আসবে সে দিনটি যে দিন শাসক শ্রেণীর কথা-কাজে মিল পাওয়া যাবে ? যে বাহীনীর সদস্যরা মাদক, স্বর্ন ও যাবতীয় চোরাচালানের সাথে জড়িত, যেই দেশের এমপি-মন্ত্রীরা মদ পান করে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকে, যারা মদের লাইসেন্স দেয় তাদের কাছ থেকে ভাল কিছু আশা করা অর্থহীন।
‘বিএসএফ’র মদদে বাংলাদেশ সীমান্তে চাপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার পদ্মা নদীর চরসহ বিভিন্ন সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকায় বিভিন্ন সময় মাদকের উপাদান পপি ফুলের চাষ করা ভাল কোন লক্ষণ নয়। সোনা মসজিদ স্থলবন্দর সংলগ্ন সীমান্তের নো-ম্যান্সল্যান্ডে বিএসএফ’র মদদে সীমান্ত পিলার ঘেষেই পপি চাষ করছে ভারতীয় জমির মালিকরা। তার একটি অংশ প্রক্রিয়াজাত হয়ে বাংলাদেশি মাদক সিন্ডিকেটের হাত ঘুরে দেশের সর্বত্র যুব সমাজের হাতে চলে যাচ্ছে। এভাবেই একটি দেশের গর্বিত সন্তানরা হারিয়ে যায় অমানুষের দলে। তারপরেও নাকি ভারত বাংলাদেশের বন্ধু প্রতিম দেশ ! এ সমস্যা ও ব্যাধি থেকে খুব শীঘ্রই মুক্তি প্রয়োজন।
১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের এক সাধারণ অধিবেশনে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও লাওসের প্রতিনিধিরা ২০১৫ সালের মধ্যে তাদের অঞ্চলকে মাদকমুক্ত করবেন বলে আশা ব্যক্ত করলেও গত ১৫ বছরে তেমন ফল পাওয়া যায়নি। মাদকদ্রব্যের ব্যবহার মানুষের জীবনকে তীলে তীলে ক্ষয় করে দেয়। মাদক গ্রহণ করলে ব্যক্তি জীবনে কেমন প্রভাব ফেলে সেটা পরীক্ষার জন্যই অনেকে ধীরে ধীরে মাদকের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে হয়ে পড়ে মাদকাসক্ত। যখন তার ক্ষতিকর দিকটি বুঝবার মতো চেতনা ফিরে আসে ততক্ষণে পার হয়ে গেছে জীবনের মূল্যবান সময়। মাদক গ্রহণ করার ফলে তার মধ্যে হীতাহীত কোন জ্ঞান থাকেনা। ন্যায়-অন্যায় ভুলে সে নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়। এমন কোন কাজ নেই যা করতে সে দ্বিধাবোধ করে। কাছের লোকগুলো শত্রুতে পরিণত হয়। বাবা-মা কে হত্যা করতেও পিছপা হয়না। ২০ বছরের শিশু (?) ঐশি রহমান বাবা-মা কে হত্যা করার ঘটনা কালের স্বাক্ষী হয়ে হয়ে আছে। এর পেছনেও ছিল মরণ নেশা ইয়াবার প্রভাব।
গত ২৩ জুন’১৪ রাত ১ টায় এবিসি রেডিও এফ এম ৮৯.২-এ ‘যাহা বলিব সত্য বলিব’ অনুষ্ঠানের অতিথী লিটন (৩২) নামে একজন লোক অকপটে স্বীকার করে যাচ্ছিলেন তার ফেন্সিডিল ও ইয়াবা গ্রহণের তিক্ত অভিজ্ঞতা। সেই সাথে অনুতপ্ত হয়েছেন তার পূর্ব কৃতকর্মের জন্য। এমন কোন কাজ নেই যা সে করেনি। তিনি নির্দ্ধিদায় স্বীকার করছেন তিনি এখনও মাদকাসক্ত। আর মাদক থেকেই তার সকল অন্যায়ের শুরু। তার মা তার পায়ে হাত দিয়ে তাকে বুঝিয়েছিলেন মাদক গ্রহণ না করার জন্য। কিন্তু সে মায়ের অনুরোধটিও রাখেননি। এখন টাকার অভাবে অনেক মাদকদ্রব্য গ্রহণ করতে পারছেনা। তবে দিনে তিন প্যাকেট সিগারেট গ্রহণ করতে হয়। হতাসা থেকেই তার নেশার জগতে প্রবেশ বলে সে জানিয়েছে। অধিকাংশ পরিবারে এমন লিটনদের উপস্থিতি লক্ষনীয়। সম্প্রতি ব্যাপকহারে অসংখ্য তরুণ ও যুবক প্রতিনিয়ত মাদকাসক্ত হচ্ছে। মাদকদ্রব্যগুলো সহজলভ্য হওয়ায় অপ্রাপ্তরা অপরাধ জগতে ঢুকে পড়ছে। রেডিও-টেলিভিশনের সাক্ষাৎকার ও লেখালেখিগুলো যদি মাদকাসক্তরা শুনতে পারতো তাহলে অনেক ভালো হতো। অথবা তাদের শুভাকাঙ্খিরা যদি তাদের সামনে এসকল দৃষ্টান্ত ও তথ্য উপস্থাপন করতো তাহলে হয়তোবা এক সময় বড় ধরণের একটা পরিবর্তন আসতো।
বিশেষজ্ঞ মহল মাদক থেকে বেঁচে থাকতে চার ধরনের পরামর্শ দিয়েছেন : গণসচেতনতা বৃদ্ধির ফলে চাহিদা হ্রাস, আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে সরবরাহ হ্রাস, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। দেশে মানুষের তৈরী প্রচলিত আইন থাকলেও নেই আইনের শাসন, নেই ন্যায় বিচার। আইন অনুযায়ী শাসন ব্যবস্থা থাকলে কিছুটা হলেও অপরাধ কমে যেত বলে বিশ্বাস। শাসক হিসেবে অমর হয়ে আছেন ইরানের প্রায়ত নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনী। তিনি মাদক উৎপাদন, বিক্রি, পাচারকারী, মাদক গ্রহণ ও পানকারীসহ মাদকের সাথে সংশ্লিষ্ট এক হাজার জনকে কঠিন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ফাঁসি দিয়েছিলেন (দৈনিক পূর্বকোণ : ২১.০৮’১৩)। চরিত্র ও জীবন ধ্বংসের মতো জঘন্য একটি বিষয়কে পাশ কাটিয়ে পরিকল্পিত ভাবে জাতিকে ধ্বংস করার পায়তারা চলছে। মাদকের বৈধ-অবৈধ পাচার ও বৈধ-অবৈধ ব্যবহার বন্ধ হোক সে প্রত্যাশাই করি। সকল অশুভ শক্তিকে মোকাবেলা করে ন্যায় ভিত্তিক একটি সমাজ প্রতিষ্ঠাই হোক আজকের দিনের প্রতিজ্ঞা।
লেখক : মুহাম্মদ আবদুল কাহহার নেছারী
শিক্ষক ও কলামিস্ট
বিষয়: বিবিধ
১৩২৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন