মানবদেহের পরিত্যক্ত হাত-পায়ের হাড় দিয়েই এখন তৈরি হচ্ছে বোন টিস্যু।
লিখেছেন লিখেছেন বদনা চোর ২৮ জুন, ২০১৪, ০২:২৯:৫৪ দুপুর
দুর্ঘটনায় কেউ হাত-পা হারালে তা ‘ক্লিনিক্যাল বর্জ্য’ হিসেবেই বিবেচিত হতো এতো দিন। আর পরিত্যক্ত এসব অঙ্গের স্থান হতো আবর্জনার ভাগাড়ে। কিন্তু দিন পাল্টেছে। মানবদেহের পরিত্যক্ত হাত-পায়ের হাড় দিয়েই এখন তৈরি হচ্ছে বোন টিস্যু।
আর সেই টিস্যু ব্যবহার করা হচ্ছে চোখ, অর্থোপেডিক্স কিংবা পোড়া রোগীর চিকিৎসায়। তাই শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে মানবদেহের কেটে ফেলা অঙ্গ এখন আর ফেলনা নয়। পরিত্যক্ত হাড় দিয়ে তৈরি বিশেষ এই টিস্যু মানব দেহে পুন:স্থাপনের মাধ্যমে নতুন জীবন ফিরে পাচ্ছেন অনেকে।
এখন দেশের ১শ’ ২৮ টি হাসপাতাল থেকে প্রতিদিন সংগ্রহ করা হচ্ছে মানব দেহের পরিত্যক্ত হাত- পা। প্রায় সাড়ের তিনশ’র মতো চিকিৎসক নিয়োজিত রয়েছেন এ প্রক্রিয়ায়।
রানা প্লাজা ধসের পর হাত পা হারাতে হয় অনেককে। এ ছাড়াও রোগীর জীবন রক্ষায় চিকিৎসকদের পরামর্শেও কেটে ফেলতে হয় হাত কিংবা পায়ের অংশ।
মানব দেহের পরিত্যক্ত এসব হাত পাএর ভাগ্যে কি ঘটছে তা জানার চেষ্টা করে বাংলানিউজ।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, দেশের শতাধিক হাসপাতাল থেকে সংগৃহীত এসব পরিত্যক্ত মানব অঙ্গের গন্তব্য সাভারে, পরমাণু গবেষণা প্রতিষ্ঠানের টিস্যু ব্যাংকিং অ্যান্ড বায়োম্যাটেরিয়াল রিসার্চ ইউনিটে।
সেখানকার বিশেষায়িত পরীক্ষাগারে দেখা গেলো, সড়ক দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন কারণে পরিত্যক্ত মানব দেহের হাত কিংবা পা দিয়েই তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন রকমের চিপস। অব্যবহৃত কিংবা পরিত্যক্ত এসব অঙ্গ থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় মানব টিস্যু সংগ্রহ করে তা বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। পরে তা বিকিরণের সাহায্যে জীবাণুমুক্ত ও যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণ করে প্রযোজ্য রোগীর পুনর্বাসনে ও শল্য চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ।
টিস্যু ব্যাংকিং অ্যান্ড বায়োম্যাটেরিয়াল রিসার্চ ইউনিটের পরিচালক ড. এস এম আসাদুজ্জামান বাংলানিউজকে জানান, গামা রশ্মির সাহায্যে জীবাণুমুক্ত করে বিভিন্ন প্রকার মানব টিস্যু গ্রাফট্ (অ্যামনিয়ন, অস্থি ইত্যাদি) এর মাধ্যমে অনেকে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছেন। বিশেষ করে এর সুফল পেয়েছেন ত্বকের ক্ষত কিংবা পুড়ে যাওয়া, অর্থোপেডিক ও চোখের রোগ সংক্রান্ত জটিলতায় থাকা রোগীরা।
তিনি জানান, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ও অগ্নিকাণ্ড একটি নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। এ ধরনের দুর্ঘটনা ও ব্যধিজনিত কারণে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক কর্মক্ষম মানুষ হঠাৎ করে বিকলাঙ্গ হয়ে কর্মক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন। যা আর্থ-সামাজিক দিক থেকে তাদের পরিবারে বয়ে আনে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। টিস্যু ব্যাংকিং গবেষণাগারে প্রস্তুত টিস্যু গ্রাফটের মাধ্যমে এ ধরনের কর্মক্ষমতাহীন মানুষকে পুনর্বাসন ও কর্মক্ষম করে তোলা সম্ভব। যার আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম-যোগ করেন টিস্যু ব্যাংকিং অ্যান্ড বায়োম্যাটেরিয়াল রিসার্চ ইউনিটের পরিচালক ড.এস এম আসাদুজ্জামান।
তিনি জানান, পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের একটি প্রধান ও প্রত্যক্ষ প্রয়োগ হচ্ছে চিকিৎসা কাজে বিকিরণের ব্যবহার। আমাদের টিস্যু ব্যাংকিং গবেষণাগারে বিভিন্ন প্রকার মানব টিস্যু সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিকিরণের সাহায্যে জীবাণুমুক্ত করে পাঁচ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
ইন্টারন্যাশনাল এটমিক এনার্জি এজেন্সির (আইএইএ) সমন্বিত কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশে টিস্যু ব্যাংকিং গবেষণা কাজের সূচনা হয় ১৯৮৫ সালে। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন প্রকার অব্যবহৃত কিংবা পরিত্যক্ত মানব টিস্যু সংগ্রহ করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিকিরণের সাহায্যে জীবাণুমুক্ত করে পুনর্বাসন ও শল্য চিকিৎসায় ব্যবহার করা।
টিস্যু ব্যাংকিং অ্যান্ড বায়োম্যাটেরিয়াল রিসার্চ ইউনিটের পরিচালক ড. এস এম আসাদুজ্জামান বাংলানিউজকে জানান,রোগীর চাহিদার আলোকে আমরা বিভিন্ন আকৃতির বোন টিস্যু সরবরাহ করে থাকি। আর তাদের কাছ থেকে নাম মাত্র মূল্যে এই সেবা দেয়া হয়। আর এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তির গবেষণা আর উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হয়।
কিছু মৌলিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হলে জীবন রক্ষাকারী ও অত্যাবশ্যক এই সেবা প্রান্তিক ব্যবহারকারীদের কাছে পৌছুনো সম্ভব বলে মন্তব্য করেন ড. এস এম আসাদুজ্জামান।
এরইমধ্যে এই ইউনিটের গবেষণাগারে ৫৯৯ টি অ্যামনিয়ন মেমব্রেন (প্লাসেন্টা), ৪২১টি অস্থি সংগ্রহ ও ২২৮৯টি অ্যামনিয়ন এবং ৪০৪১টি অস্থি গ্রাফ্ট তৈরি করা হয়েছে। এ সময়ে ১১৮৩ টি অ্যামনিয়ন, ২৯৭৭টি বোন, ৮৪টি আই গ্রাফ্ট এবং ০৮ ভায়াল ডিভিএম (অস্থি) গ্র্যানিউলস প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিকিরণের সাহায্যে জীবাণুমুক্তকরণ ও মান-নিয়ন্ত্রণ কাজ সম্পন্ন করে দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সরবরাহ করা হয়েছে। এসব টিস্যু গ্রাফট্ এর মাধ্যমে ত্বকের ক্ষত ও পুড়ে যাওয়া ১শ’ ৫৫ জন রোগী, ২২ জন চক্ষু রোগী, ১শ’ ৬২ জন অর্থোপেডিক রোগী এবং ৭ জন দন্ত রোগীর পুনর্বাসন শল্য চিকিৎসা সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। যা থেকে প্রসেসিং চার্জ হিসাবে মাত্র এক লাখ একাত্তর হাজার আটশত সত্তর টাকা আয় করে প্রতিষ্ঠানটি। অথচ সেবামূল্য হিসেবে তা কয়েক কোটি টাকারও বেশি।
এ ছাড়াও চলমান গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রমকে আরো আধুনিক ও বিস্তৃত করতে ‘Mammalian Cell Culture’ শীর্ষক একটি গবেষণা কর্মসূচি গ্রহণ শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি।এর অংশ হিসেবে এই গবেষণাগারে মানব ত্বক প্রস্তুত করে ত্বকের বিভিন্ন রকমের ক্ষত যেমন অগ্নিদগ্ধ, এসিড দগ্ধ, শ্বেতীরোগ প্রভৃতি রুগীর উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে পুনর্বাসনে বেশ সফলতা অর্জন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
ড.এস এম আসাদুজ্জামান বাংলানিউজকে জানান, সরকার “পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি” স্বাক্ষরের মাধ্যমে দেশে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে অঙ্গিকারাবদ্ধ। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন প্রকার সেবাধর্মী কাজ করে যাচ্ছে।
টিস্যু ব্যাংকিং গবেষণা কার্যক্রম এ ধরনের গবেষণা কর্মসূচি বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। এ গবেষণা কর্মসূচির মাধ্যমে গত ২ বছরে ৭শ’ ৪৬ জন রুগীকে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের হাত হতে রক্ষার মতো সেবাদান করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল এটমিক এনার্জি এজেন্সির (আইএইএ) হিসেবেই এসব রুগীর মাঝে ৩৪ কোটি টাকার গ্রাফট সরবরাহ করা হয়েছে। আমাদের প্রস্তাবিত কর্মসূচিটি বাস্তবায়িত হলে বছরে সাড়ে ৫শ’ রুগীকে মৃত্যু কিংবা পঙ্গুত্বের হাত হতে রক্ষার মাধ্যমে ২৫ কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
তিনি আরো বলেন,একটা সময় ছিলো যখন চিকিৎসকদের টিস্যু গ্রাফটের বিষয়টি বোঝানো খুব সহজ কাজ ছিলো না। এ জন্যে আমাদের দিনের পর দিন সভা-সেমিনার করতে হয়েছে। তবে এখন দেশের ১শ’ ২৮ টি হাসপাতালের সাড়ে তিনশ’র মতো চিকিৎসক সংগ্রহ করছেন মানব দেহের পরিত্যক্ত হাত-পা। এ কারণে এর সেবা গ্রহিতার সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।
বি:দ্র:
পোষ্ট বন্ধনা: বদনামার্কা পোষ্টটি একটি চুরির মাল।
চুরির উৎসঃ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর
বিষয়: বিবিধ
১২৬৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন