মিডিয়া এবং আমরা।

লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মারিয়া ২০ জুন, ২০১৪, ১২:২৬:১৭ দুপুর

এই তো কিছু দিন আগেও মিডিয়া বলতে দুয়েকটি পত্রিকার নাম শোনা যেত। পত্রিকাগুলোতে কিছু ছাপলেই তা মিডিয়ার একমাত্র বক্তব্য মনে করা হত। সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের সুযোগ তেমন হত না। এরপর এতে যোগ হলো কিছু টিভি চ্যানেল, যাদের পরিবেশিত সংবাদকেই অনেকে মিডিয়ার পুরোটা মনে করে নিত। গত কয়েক বছরে মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নিয়েছে ইন্টারনেটভিত্তিক মিডিয়া, যাকে আমরা অনলাইন মিডিয়া বলেও জানি।

শুরুতে অনলাইন মিডিয়াতে গতানুগতিক মিডিয়াগুলোর প্রাধান্য থাকলেও ধীরে ধীরে এর পরিবর্তন ঘটে। ইন্টারনেটের প্রত্যেক ব্যবহারকারীই হয়ে উঠেন এ মিডিয়ার একেক জন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। বিগত কয়েক বছরে ফেইসবুক, টুইটার, লিংকডইনসহ সামাজিক ওয়েবসাইটগুলোর আগমনের পর ‘অনলাইন মিডিয়া’ এখন ‘সোশাল মিডিয়া’ হিসেবেই বেশি পরিচিত।

সোশাল মিডিয়া বা সামাজিক গণমাধ্যমের মূল বক্তব্য হলো, এখানে প্রত্যেকেই একেকজন মিডিয়াকর্মী। প্রত্যেকে তার বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও অন্যদের জন্য একজন মিডিয়াকর্মীর ভূমিকা পালন করে। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মতো এখানেও একজন সদস্য তার নিজস্ব পরিমণ্ডলে বিভিন্ন সংবাদ জানিয়ে থাকে, এবং অন্য আরো অনেক কিছু তুলে ধরে। বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয়ে নিজের মতামতও প্রকাশ করে থাকে।

গতানুগতিক প্রায় সকল মিডিয়া কর্পোরেট জগতে প্রবেশ করায়, এবং এতে সত্য প্রকাশের ব্যাপারে জনসাধারণের অনাস্থা বাড়ায়, সোশাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। এখানে সংবাদ উপস্থাপনে সাধারণত কোনো স্বার্থ থাকে না, উপরন্তু সংবাদ ও অন্য সকল বিষয়ে উন্মুক্ত মতামত প্রকাশের সুযোগ থাকে। ফলে সত্য-মিথ্যা সহজেই উন্মোচিত হয় এবং বিভ্রান্তির সুযোগ কম থাকে। এছাড়া বন্ধু-বান্ধব ও সামাজিকতার একটি আবহ থাকায় নতুন প্রজন্মের কাছে এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।

নানা কারণে ফেইসবুক ও অন্য সব সোশাল মিডিয়াতে আমরা এখন অনেক সময় দিয়ে থাকি। অনেকের ক্ষেত্রে দিনের একটি বড় অংশই এতে চলে যায়। সোশাল মিডিয়া বর্তমানে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়া হওয়ায় আমাদের প্রতিটি পোস্ট, মন্তব্য, লাইক ও শেয়ার অন্যসব মিডিয়ায় প্রদত্ত বক্তব্যের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এ মিডিয়া ব্যবহারে আমাদের বেশ কিছু বিষয় লক্ষ্য রাখা উচিৎ।

ইন্টারনেট ও সোশাল মিডিয়া সঠিকভাবে ব্যবহারের কিছু টিপস উল্লেখ করা হলো।

ইন্টারনেটকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা:

১. ইন্টারনেট ব্যবহার করার আগে ব্যবহারের লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট করা উচিৎ। ইন্টারনেট একটি উন্মুক্ত জগত। নানা বিষয় এসে সময় নষ্ট করতে পারে। তাই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করলে সময় সাশ্রয় হবে।

২. যে কোনো বিষয় গুগলে (google.com) খোঁজ করা। এ ছাড়া আরো অনেক সার্চ ইঞ্জিন রয়েছে, তবে সেগুলো নানা রকম বিজ্ঞাপনে মূল বিষয় থেকে সরিয়ে দিতে পারে।

৩. নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করা। ইন্টারনেটে প্রায় সকল বিষয়ে অসংখ্য তথ্য ছড়িয়ে আছে। শেখার আগ্রহে ব্রাউজ করলে এর কার্যকর ব্যবহার হবে।

৪. গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট বুকমার্ক করে সংরক্ষণ করা। এতে পরবর্তীতে সহজেই সেসব সাইট খুঁজে পাওয়া যাবে।

৫. ব্রাউজারে এড-ব্লক (Adblock) ব্যবহার করা। এতে সকল ওয়েবসাইটের বিজ্ঞাপনসমূহ ব্লক হয়ে যাবে। ফলে অযাচিত বিষয় সামনে আসবে না।

৬. শিশু-কিশোর ও ছাত্রদের কম্পিউটারে কাস্টোডিও (Qustodio) সফটওয়্যারটি ব্যবহার করা উচিৎ। এটি তাদের বয়সের জন্য ক্ষতিকর সকল ওয়েবসাইট ও কন্টেন্ট ব্লক করে দিবে।

ইন্টারনেটে নিরাপদ থাকা:

১. শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা। নাম, মোবাইল নম্বর, পরিচিত শব্দ ইত্যাদি পাসওয়ার্ডের ক্ষেত্রে পরিহার করা। ছোট-বড় অক্ষর, সংখ্যা, বিভিন্ন সিম্বল ইত্যাদি ব্যবহারে ১২-১৬ অক্ষরের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা।

২. ডাবল ভেরিফিকেশন ব্যবহার করা। এখন প্রায় প্রতিটি ইমেইল সেবা-দানকারী ওয়েবসাইট ও সোশাল মিডিয়াতেই এ ব্যবস্থা আছে। এতে কেউ পাসওয়ার্ড জেনে গেলেও লগইন করতে পারবে না, মোবাইলে নিশ্চিতকরণ কোড আসবে।

৩. অপরিচিত কারো সাথে পূর্ণ ঠিকানা শেয়ার করা উচিৎ নয়, এতে নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা থাকে।

৪. ই-মেইল বা সোশাল মিডিয়ায় ব্যক্তিগত বার্তায় অপরিচিত বার্তা খোলা থেকে বিরত থাকা উচিৎ। বিশেষ করে কোনো লিংক থাকলে তাতে ক্লিক করা ঠিক নয়।

৫. ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ না করা। অনলাইনে এমন কিছু প্রকাশ করা উচিৎ নয়, যা অফলাইনে প্রকাশ করা যায় না।

সোশাল মিডিয়ায় আচরণবিধি:

১. এমন স্ট্যাটাস বা বক্তব্য প্রকাশ করা উচিৎ, যা সবার কাছে প্রকাশ করা যায়। ইন্টারনেট একটি উন্মুক্ত গণমাধ্যম। নানা শ্রেণীর মানুষ, বিশেষ করে পরিবার, শিক্ষক, ক্লায়েন্ট, কর্মক্ষেত্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রাষ্ট্র – সকলের কাছেই তা প্রকাশিত থাকবে। কাজেই সবার কাছে প্রকাশ করা যায়, এমন বিষয়ই প্রকাশ করা উচিৎ।

২. যে কোনো পোস্ট বা মন্তব্য প্রকাশের আগে ভেবে দেখা উচিৎ, অন্য কেউ পড়লে তা কীভাবে গ্রহণ করবে।

৩. সব রকম অভদ্র-অশালীন ভাষা, গালিগালাজ পরিহার করা উচিৎ। ইসলামে হারাম হওয়ার পাশাপাশি এগুলো সমাজের মানুষের কাছে ব্যক্তির মর্যাদা শূন্যে নামিয়ে দেয়। এমনকি ব্যক্তির চরিত্রও মানুষের কাছে সন্দেহজনক হয়ে ওঠে। বিশেষ করে কোনো আলেম, মাদ্রাসার ছাত্র বা সমাজের নেতৃস্থানীয় কেউ হলে তার সকল কথা অগ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য এমন একটি পোস্ট বা মন্তব্যই যথেষ্ট।

৪. রাজনৈতিক পোস্টে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় সুন্দরভাবে মোকাবিলা করতে না পারলে এ ধরণের পোস্ট পরিহার করাই উত্তম। এতে সমাজের একটি বড় শ্রেণীর সাথে দূরত্ব তৈরি হয়, ফলে ব্যক্তির অনেক সাধারণ স্বীকৃত বিষয়ক মতামতও তারা গ্রহণ করতে পারে না।

৫. দ্বীনী বিষয়ে পোস্ট দেয়ার ক্ষেত্রে পাঠককে সাধারণ দ্বীনদার মুসলিম ভেবে লেখা উচিৎ। একেবারে সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পোস্টটিকে দেখলে আক্রমণাত্মক মনে হয় কিনা, বা এর কারণে কেউ দ্বীন পালনে অনাগ্রহী হবে কিনা -এসব বিষয়ে ভেবে দেখা উচিৎ। দ্বীনের ইখতিলাফী মাসায়েলের বিতর্কের ভার অভিজ্ঞ আলেমদের ওপরই ছেড়ে দেয়া উচিৎ। পর্যাপ্ত জ্ঞান ছাড়া এসব বিষয়ে কথা বলতে গেলে ইখতিলাফ খিলাফে পরিণত হয়, ফলের মতবিরোধ রূপ নেয় পরস্পরিক বিরোধিতা ও ব্যক্তি দ্বন্দ্বে।

৬. কর্মস্থলের অভ্যন্তরীণ সমস্যার ব্যাপারে অনলাইনে মন্তব্য করা উচিৎ নয়। এতে শুধু কর্মস্থলের কর্তৃপক্ষের বিশ্বাস হারাতে হবে তা-ই নয়, বরং সাধারণ মানুষও ব্যক্তিকে অবিশ্বাসযোগ্য মনে করে। হ্যাঁ, সহকর্মীকে উৎসাহ দেয়া বা শুভেচ্ছা জানানো যেতে পারে, তবে তার দুর্নাম প্রকাশ নয়।

৭. স্ট্যাটাস ও মন্তব্য শুদ্ধ বানানে ও ব্যাকরণে লেখা উচিৎ। নতুবা খুব সিরিয়াস বিষয়ও মানুষ হালকাভাবে নিতে পারে।

৮. যে কোনো ছবি অত্যন্ত সতর্কভাবে প্রকাশ করা উচিৎ। মিথ্যা, অশ্লীল, ভয়ঙ্কর, অমানবিক – এসব ছবি পরিহার করা উচিৎ। যে কোনো ছবি প্রকাশের পূর্বে সত্য-মিথ্যা যাচাই করে নেয়া উচিৎ।

৯. অনেক সময় অন্য কেউ ওয়ালে ছবি পোস্ট করে থাকে, বা ট্যাগ করে থাকে। অপ্রাসঙ্গিক ছবি থেকে নিজেকে আন-ট্যাগ করে নেয়া ভালো। সবচেয়ে ভালো হয়, ব্যক্তিগত ওয়ালে অন্য কারো পোস্ট প্রকাশের পথ বন্ধ করে দেয়া। এবং অনুমোদন ব্যতীত ট্যাগ প্রকাশ বন্ধ রাখা। এতে ওয়াল নিরাপদ থাকবে। প্রত্যেকের ওয়াল তার নিজস্ব আঙিনার মতো, কাজেই এর ভালো-মন্দ তার ওপরই বর্তায়।

১০. অন্যের লিংক, ছবি, সংবাদ ইত্যাদি শেয়ার করার ক্ষেত্রেও একইভাবে সতর্ক থাকা উচিৎ। মিথ্যা সংবাদ, বাজে বিষয় ইত্যাদি শেয়ার করা উচিৎ নয়।

১১. কারো পোস্টে বা মন্তব্যে লাইক দেয়ার ক্ষেত্রেও সকল বিষয় খেলায় রাখা উচিৎ। কারণ প্রোফাইল একটিভিটিতে সকল লাইকের লগ সংরক্ষিত থাকে।

১২. অনেকে ভুলবশত কোনো লিংক বা এ্যাপে লাইক দিয়ে থাকেন। বা পছন্দনীয় মুভি, বই, সেলিব্রেটি ইত্যাদিতে লাইক দিয়ে থাকেন। এসব বিষয় ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব যাচাইয়ে ভূমিকা রাখে, তাই সতর্ক থাকা উচিৎ।

১৩. নিজের ওয়ালে বা পোস্টে বিতর্কিত কোনো মন্তব্য রাখা উচিৎ নয়। এক্ষেত্রে তা মুছে দিয়ে মন্তব্যকারীকে ব্যক্তিগত বার্তায় বা ফোনে জানিয়ে দেয়া যেতে পারে।

১৪. এমন ব্যক্তি/পেইজকেই লাইক/ফলো করা উচিৎ, যেগুলোকে বিশ্বাস করা যায়।

১৫. মন্তব্যে আলোচনার ক্ষেত্রে ভদ্রতা ও শালীনতা বজায় রাখা উচিৎ। আলোচনা যত উত্তপ্তই হোক না কেন, কোনোভাবেই অশালীন মন্তব্য প্রদান করা উচিৎ নয়। একটি অশালীন মন্তব্য ব্যক্তির সকল পোস্ট ও মন্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করে দিতে পারে।

১৬. অন্যের পোস্টে মন্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে এমন মন্তব্য দেয়া উচিৎ নয় যা তার সম্মানহানি করতে পারে। পোস্টের সাথে প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্ববহ মন্তব্য করা উচিৎ।

শেষকথা:

এক কথায়, সোশাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একটি গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়া। এতে প্রকাশিত প্রতিটি বিষয়ই সংরক্ষিত থাকে। স্বাভাবিক জীবনে বন্ধু-বান্ধব ও আশ-পাশের মানুষের সাথে যে আচরণ করা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক আচরণ এ মিডিয়ায় করা উচিৎ।

ইসলাম অন্যের সাথে ওঠা-বসার ক্ষেত্রে সম্মান, সহনশীলতা, ইনসাফ, নম্রতা, শালীন ব্যবহার ইত্যাদি মেনে চলতে পরামর্শ দেয়। অফলাইনে যেমন, অনলাইনেও তেমনি এসব গুণাবলী বজায় রাখা উচিৎ। একজন মুসলিম অফলাইনে যেমন, অনলাইনেও তেমন, ভেতরে যেমন, বাহিরেও তেমন।

ভেতর-বাহিরের ভিন্নতা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে, আল্লাহর বান্দা-মানুষকেও অসন্তুষ্ট করে। তাই সকল ক্ষেত্রে সুন্দর ব্যবহার বজায় রেখে চলাই হবে একজন মুসলিম সোশাল মিডিয়াকর্মীর আদর্শ।

মূলসূত্র: ইসলাম বার্তা।

বিষয়: বিবিধ

৯৪০ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

238700
২৫ জুন ২০১৪ দুপুর ১২:৪৮
জাগো মানুস জাগো লিখেছেন : good advise.

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File