প্রান্তিক মানুষের জাগরণ

লিখেছেন লিখেছেন সুষুপ্ত পাঠক ১০ জুন, ২০১৪, ১০:৩৭:১৭ রাত

খুব সাধারণ মানুষ যেমন ঠেলাঅলা, রিকশাঅলাদের নিয়ে আমাদের ধারনা যে এরা বুঝি ভাবতে পারে না, চিন্তা করার কোন ক্ষমতা নাই। আমরা যারা লেখাপড়া করেছি, প্যান্ট-শার্ট পরে ফ্যানের তলায় বসে অফিস করি, সংবাদপত্র পড়ি আর রাতে টেলিভিশনের টক শো দেখি তারা এই প্রান্তিক মানুষগুলোকে হেয় করি চিন্তার জায়গা থেকে সবচেয়ে বেশি।অথচ জাকির নায়েকের জনপ্রিয়তা আমাদের মধ্যেই বেশি। তারা না হয় আল্লামা শফি আর সাঈদীর ওয়াজের ভক্ত, কিন্তু কোনদিন ভেবে দেখেছি জাকির আর শফির মধ্যে তফাত কতটুকু? বরং চিন্তা করলে দেখা যাবে এই অশিক্ষিত (একাডেমিক শিক্ষার কথা বুঝানো হচ্ছে) মানুষগুলো বাউলদের গভীর জীবন ও আধ্যাতিক দর্শনের একান্ত অনুরাগী। কুষ্টিয়ার একজন ভ্যান চালকের মুখে লালনের গানের ভিন্ন অর্থ শুনে আমি থ বনে গিয়েছিলাম। এই মানুষগুলো যে একদিন জেগে উঠবেই এ বিষয়ে আমার কখনোই সন্দেহ হয়নি। আজ একটা চায়ের দোকানে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার কথা বলি।

রাস্তার এপাড় ওপাড় কয়েকটা চায়ের দোকান। ওপাড়ের একটা চায়ের দোকানে রাতদিন ওয়াজের ক্যাসেট বাজে।এ পাড়ে যে দোকানে আমি দাঁড়ানো সেখানে একজন বুড়ো রিকশাঅলা আগে থেকে বসে রুটি-কলা খাচ্ছিল। হঠাৎ সে বলে উঠলো, ওয়াজে মাঝে মধ্যে যা কয়, মাথামুথার তার ছিড়া যায়!

দোকানদার বলল, ক্যামনে?

-ঐদিন ওয়াজে শুনতাছি হুজুরে কয়, উম্মদে মহাম্মদী যত পাপই করুক, আকাশ-জমিন পর্যন্ত পাপ জমুক, শেষ নবীর উম্মদ বেহেস্তে যাইবোই! -এইটা একটা কথা হইল?

অন্য একজন বলল, একজন মুসলমানও দোজগে যাইবো না।

-ভালই তা! রিকশাঅলা বলল, তাইলে আমি অখন ডাকাতি করতে বাইর হই? মানুষ ধইরা ধইরা মারতে থাকি? নবী বলে কইছে, আল্লা আর তার নবীরে যে বিশ্বাস করছে, ইসলামরে যে স্বীকার করছে সে কোনদিন দোজগে যাইবো না। নবী তারে যাইতে দিবো না। হাশরের ময়দানে নবী খালি ইয়া উম্মদি ইয়া উম্মদ কইরা বিলাপ কররো। একজন মুসলমানরেও না নিয়া তিনি বেহেস্ত যাইবো না। তাইলে তো ভালই, যারা লুট করতাছে, খাওয়নে বিষ দিতাছে, মাইয়ালোকরে বেইজ্জত করতাছে হেরাও বেহেস্তে যাইবো, তাইলে আর ভালা কাম করনের দরকার কি! সবতে তো বেহেস্তে যাইবোই!

আরেকজন বলল, ঐ ব্যাটা, শাস্তি ভোগ কইরা বেহেস্তে যাইবো।

-কথা তো ঐটাই, শাস্তি ভোগ কইরা বেহেস্তে যাইবো, তাইলে সমস্যা কি, আমি অখন যা খুশি তাই করি, শাস্তি কোন হালায় ভোগ করবো না? হোন, ওয়াজে অনেক কথা হুজুরে বানায় বানায় কয়। সব কথাই হাছা না!

দোকানদার বলল, উল্টা কথা কও ক্যা। এগুলি ইসলামের কথা। জাইনা কথা কও।

-তাইলে হোন, এই কথার লগে আমি নাই। এইটা কেমুন বিচার? পাপ কইরা যদি বেহেস্তে যাওন যায় তাহলে আমি দুনিয়ায় হুদাহুদি কষ্ট করুম ক্যা? এইগুলি নাকি ধর্মের কথা!

বুড়ো ক্ষেপে গেছে। এবার সবাই তাকে নিয়ে কৌতুক করতে লাগলো। ঐ পাগলা, রইদের মধ্যে তোমার মাথা গরম হইছে। আরেকজন বলল, পাগলায় ক্ষেপছে কেরে?...

হ্যাঁ, যারা চিরকাল এইরকম উচিত কথা তুলেছে তারা পাগল, ছাগল, অজ্ঞানী বলে চিহ্নিত হয়েছে। আমার মনে পড়ছিল আরজ আলী মাতুব্বরের কথা। তিনি এইরকম অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলে তথাকথিত সুস্থ, জ্ঞানী লোকদের অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষিত অধ্যাপকদের নাস্তানাবুদ করেছিলেন। এক ডিসি সাহেবকে ১০টি প্রশ্ন লিখে বলেছিলেন এর উত্তর নিয়ে আসতে। ডিসি সাহেব ১ মাসের সময় নিয়ে সেই যে গিয়েছেন এতগুলো বছর কেটে গেছে আর ফিরে আসেননি। না, তারা কোনদিন উত্তর দিতে ফিরে আসে না। এ জন্যই পাগল, মূর্খ, ধর্ম বিদ্বেষী বলে আর কুসিৎ গালাগালি করে নিজেদের দৈন্যতাকে ঢাকার চেষ্টা করে। আমি বুড়ো রিকশাচালকের মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম। ভেঙ্গে যাওয়া মুখে কষ্টের শুধু বলিরেখা। জীবন তাকে সুদে আসলে হিসেবে বুঝিয়ে দিচ্ছে। আমি জানি না এরকম চিন্তা করার সাহস তার হলো কি করে? তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ দাবীদারদের চিন্তার অসুস্থতা দেখে রোজ হতাশ আর ক্ষুব্ধ হই। আজ সকালবেলাটা এই “অশিক্ষিত” বুড়া রিকশাঅলাটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে আরো একবার দেখিয়ে দিল, আমাদের শিক্ষার গর্ব কত ঠুনকো। এই চিন্তার স্বাধীনতা তার স্বর্পাজিত। তারা কিছু বুঝে না, চিন্তা করতে পারে না এই প্রচারণাটি সম্ভবত কোন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ছড়ানো অপপ্রচার। তারা জাগবে, একটু অনুকূল পরিবেশ পেলে তারা জাগবে।…

বিষয়: বিবিধ

১২৪৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File