নব জীবন
লিখেছেন লিখেছেন আমির হোসেন ২৫ জুলাই, ২০১৪, ০৩:৩৪:২১ দুপুর
কলেজে ভর্তি হবার পূর্বে কলেজকে নিয়ে রবিন কতনা রঙিন স্বপ্ন দেখেছে। যেখানে আছে স্বাধীনতা। নেই কোন শাসন। ইচ্ছে হলে ক্লাশ করবে, ইচ্ছে না হলে ক্লাশ করবে না। কোন শিক্ষক কিছু বলবে না। এই হল কলেজের নিয়ম। আর পড়ার জন্য স্যারের পিটুনি খেতে হবে না। সেই সঙ্গে পারিবারিক দিক দিয়েও সে এখন স্বাধীন। কারণ সে এখন বড় হয়েছে। ভাল মন্দ বুঝার বয়স হয়েছে। স্কুল পাশ করে কলেজে এসেছে। কাজেই ছেলেকে আর পূর্বের মত তার পিতা-মাতা শাসন করতে পারবে না। বন্দী পাখী খাচা থেকে মুক্তি পেলে যেমন মহানন্দে আকাশে বিচরণ করে, ঠিক তেমননি রবিন কলেজে ভর্তি হবার পর অনাবিল আনন্দে স্বাধীনতা ভোগ করছে। এ যেন এক নব জীবন।
সবে মাত্র রবিন কলেজে মানবিক বিভাগে ভর্তি হলো। রবিন খুব মিশুক ছেলে। তাই তার স্কুল জীবনে অনেক বন্ধু জুটে গেল। কিন্তু আজ তার সেই সব বন্ধুদের কথা মনে পড়ছে যাদের সাথে দীর্ঘ ১০ বছর এক সাথে লেখাপড়া করেছে। যাদের সাথে মিশে আছে শৈশবের স্মৃতি। রবিন গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করত। বন্ধুদের মধ্যে সে ছিল মেধাবী। তাই সে নরসিংদী সরকারি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট এ ভর্তি পরীক্ষায় টিকে গেল। কিন্তু অন্য বন্ধুরা ভর্তি পরীক্ষায় টিকেনি। এই জন্য কলেজে এসে রবিন একা হয়ে গেল। তার চারপাশে এখন অসংখ্য নতুন বন্ধু। এত বন্ধুর পরও তার সেই শৈশবের সেই বন্ধুদের কথা আজ বার বার মনে পড়ছে।
মিশুক রবিন অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই কলেজে এসে বন্ধু হিসেবে পেয়ে গেল হৃদয়, দেলোয়ার, তাদের ক্লাশের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে খাদিজা ও মনিরাকে। হৃদয় খুব বুদ্ধিমান ও মেধাবী ছেলে। দেলোয়ার খুব রসিক মানুষ। অতি সহজেই মেয়েদের সাথে আড্ডা জমাতে পারে। কিছুদিনের মধ্যে ক্লাশের সবাই যেন রবিনের আপন হয়ে গেল। রবিন লক্ষ্য করে দেখল কলেজে পড়ার চেয়ে প্রেম বিষয়ে আলোচনা হয় বেশী। কিন্তু রবিনের প্রেম নিয়ে মুঠেও আলোচনা করতে ইচ্ছে করে না। সে শুধু লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে সারাক্ষণ।
ছাত্র হিসেবে বেশ ভাল রবিন। এস.এস.সিতে দুটো লেটারসহ প্রথম বিভাগ পেয়েছিল রবিন। কলেজ যতই স্বাধীন হউক না কেন কিন্তু নিজেকে স্বাধীন ভাবে না রবিন। সে নিয়মিত ক্লাশ করে। বছরের প্রথম থেকেই প্রাইভেট পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। হৃদয়, দেলোয়ার, খাদিজা ও মনিরাকে প্রাইভেট সঙ্গী করে নিল। সিদ্ধান্ত হল শফিক স্যারের নিকট ইংরেজি পড়বে। পাঁচজন এক সাথে যাতায়াত, পাশাপাশি বসা, একে অপরের বাসায় আসা যাওয়া করে। এভাবেই প্রতিটি দিন চলছে তাদের। যতই দিন যাচ্ছে ততই তাদের সর্ম্পক আরো গভীর হচ্ছে।
প্রাইভেট পড়তে গিয়ে রবিন সুন্দরী রমণী খাদিজার সঙ্গ পেয়ে সে তার প্রতি দুর্বল হয়ে গেল। যে রবিন প্রেমালোচনা পছন্দ করতোনা, সে রবিন যেন অন্য রবিন হয়ে গেল। এদিকে খাদিজাও রবিনের প্রতি দুর্বল হয়ে গেল। তার সঙ্গ, কথাবার্তা সবই যেন তার কাছে ভাল লাগে। রবিন যতই চাচ্ছে বিষয়টাকে হালকা করতে ততই যেন সে কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তার এ পরিবর্তন হৃদয় ও দেলোয়ার লক্ষ্য করল। রবিন খাদিজাকে নিয়ে সারাক্ষণ ভাবে। ক্লাশেও এক সাথে পাশাপাশি বসে। কেউ কারো প্রতি কোন বিরক্তবোধ করে না। কিন্তু তাদের ভালোলাগা ভালোবাসার কথা কেউ কাউকে বলতে পারছে না। প্রেমের আগুনে নিজেরাই জ্বলে পুড়ে মরছে। এযেন আগুন আর মোম এক সাথে থাকলে যেমন অবস্থা হয়, তাদের অবস্থাও ঠিক তেমনই।
বসন্তের হাওয়া লাগলে কোকিল যেমন নেচে উঠে কুহু... কুহু... করে ডাকে, ঠিক খাদিজাও আজ যেন ভালোবাসার বসন্তে নেচে উঠল। তার মনটা আজ অন্যান্য দিনের চেয়ে ফ্রেশ। কারণ সে আজ রবিনকে তার মনে জমানো কথাগুলো বলবে। গতরাতে সে খুব চিন্তা করেছে। তাই তার তেমন ঘুম হয়নি। চোখ দুটো যেন লাল হয়ে আছে।
রবিন আজ কলেজ চত্বওে পা রাখতেই খাদিজার সাথে দেখা হল। খাদিজা সাজগোজ করে কলেজে এসেছে। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ তাকে খুব সুন্দর লাগছে। খাদিজা রবিনের চেহারার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
রবিন তার এমন চাহনী দেখে বললো, কি ব্যাপার এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন? কিছু বলবে?
খাদিজা মাথা নিচু করে বললো, হ্যাঁ।
বল।
এখানে নয়।
তাহলে কোথায়?
আঙ্গুল দিয়ে সামনের রুমটা খাদিজা দেখিয়ে বললো, ঐ রুমটায় চল।
ঠিক আছে চল।
বেঞ্চের উপর দু’জন পাশাপাশি বসল।
রবিন এতক্ষণ খাদিজার দিকে ভাল করে লক্ষ্য করেনি। এবার তার চোখে চোখ পড়তেই জিজ্ঞেস করল, তোমার চোখ লাল কেন? ঘুমাওনি?
খাদিজা মাথা নেড়ে বললো, না।
কেন?
তোমাকে নিয়ে অনেক ভেবেছি তাই।
আমাকে নিয়ে! আমি আবার কি করলাম?
তুমি আমার মন চুরি করেছ।
এসব কি বলছ? আমি তো তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু বুঝিয়ে বল।
কেন? তুমি কি কচি খোকা যে, কিছুই বুঝনা।
হ্যাঁ আমি কচি খোকা।
সব কথা কি বুঝিয়ে বলা যায়। কিছু কথা আছে এমনতিইে বুঝে নিতে হয়। তুমি কেন নিজেকে লুকাচ্ছ? তুমি কি অস্বীকার করতে পারবে তুমি আমাকে নিয়ে ভাবনি? আমাকে ভালোবাসনি?
এতক্ষণ রবিন নীরব থেকে খাদিজার আবেগের কথাগুলো শুনল। এবার রবিন তার সমস্ত আবেগ উজাড় করে বললো, হ্যাঁ খাদিজা। আমি তোমাকে ভালোবাসি। প্রাণের চেয়েও বেশী ভালোবাসি।
প্রেমের সূচনা হল। রবিন এখন আর আগের রবিন নেই। সে একজনের প্রেমিক। অন্য দশটি প্রেমিক যুগলের মতো সেও ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে পুকুর পাড়ে, খেজুর তলায়, বেঞ্চের উপর বসে আড্ডা দেয়। তার এখন পাঠ্যপুস্তকের দিকে খেয়াল নেই। তার চিন্তা চেতনায় এখন শুধু খাদিজা থাকে। ভাবে কিভাবে সে আরো ভালোবেসে তাকে জীবন সঙ্গীনি বানাবে। মাঝে মাঝে চলে যায় আরশীনগর পার্কে। কখনো চলে যায় মিতালী, সুরভী ও সঙ্গীতা সিনেমা হলে। এভাবেই তাদের মাঝ থেকে চলে যাচ্ছে সোনালী দিনগুলো। দেখতে দেখতে চলে গেল একটি বছর। বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে দ্বাদশ শ্রেণীতে দু’জনই উত্তীর্ণ হল। রেজাল্ট তেমন ভাল হয়নি। কোন মতে পাশ করেছে।
আজ কয়েকদিন যাবত কলেজে খাদিজাকে দেখা যাচ্ছে না। কি হল সে কলেজে আসছে না কেন? কোন অসুখ হয়নিতো? অসুখ হলে নিশ্চয় খবর দিত। এসব ভাবছে রবিন কলেজের মাঠে বসে। হৃদয় এসে রবিনের হাতে এক টুকরা ভাঁজ করা কাগজ দিল। উপরের লেখা দেখে এটা যে খাদিজার হাতের লেখা তা আর বুঝার বাকী রইলনা রবিনের। রবিন ভাঁজ করা কাগজখানা খুলে পড়তে লাগল।
রবিন,
প্রথমে তুমি আমাকে ক্ষমা কর। কারণ আমি আজ স্বার্থপরের মতো তোমাকে ভুলে গেলাম। আমি যদি আগে জানতাম যে আমার মামাত ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক আছে তাহলে তোমার সাথে আমি সর্ম্পক করতামনা। তাই আজ জানার পর মা-বাবাকে কষ্ট দিতে পারলাম না। রবিন তুমি আমাকে ভুল বুঝনা। আশা করি তুমি আমার চেয়ে সুন্দর মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে। কারণ তোমার মতো ছেলে হয় না।
ইতি খাদিজা।
চিঠিটা পড়ে যেন রবিনের মাথায় আগুন ধরে গেল। এ কেমন ছলনা করল খাদিজা। রবিন ফিস ফিস করে বললো, তুমি আমাকে বলছো সুন্দর মেয়ে বিয়ে করতে। আমি কি তোমার মত স্বার্থপর যে, অন্য মেয়েকে বিয়ে করবো?
এখন রবিন যেন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। যে রবিন সারাক্ষণ হাসিখুশি খাকত, সেই রবিনের মুখে হাসি নেই। কলেজে ঠিকমত যায় না। নাওয়া খাওয়াও ঠিক মত করে না। ঠিকমত সেভ হয় না। যেন অর্ধ পাগলের মতো সে। এখন সে খাদিজাকে মনে প্রাণে ঘৃণা করে। সে খোদার কাছে প্রার্থনা করে, হে খোদা আমার মত অন্য কোন পুরুষকে এমন ছলনাময়ী নারীর ফাঁদে ফেলিও না। মেয়েরা যে সত্যিই ছলনাময়ী একথা ধ্রুব সত্য হয়ে গেল তার কাছে। যা এতদিন সে বিশ্বাস করত না।
বাবা আলতাব হোসেন ছেলের এ পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন। তিনি আস্তে আস্তে ছেলের সব খবর নিলেন। একদিন রাতে তাকে ডেকে এ সর্ম্পকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে খুব বকাঝকা করলেন। বাবার বকা খেয়ে রবিন আবার আগের মত হয়ে গেল। এখন সে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে। কলেজে নিয়মিত আসা যাওয়া করে। এখন আর কোন মেয়েদের সাথে কথা বলে না। এ যেন আবার এক নব জীবনের সূচনা করল।
রচনাকাল: ১৭ ডিসেম্বর ২০০০
বিষয়: সাহিত্য
১৩২৪ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন