গল্প- মা
লিখেছেন লিখেছেন আমির হোসেন ০৪ জুন, ২০১৪, ১০:০০:১৭ রাত
আমার নানার চার মেয়ে ও দু’ছেলের মধ্যে আমার মা ছিলেন সবার বড়। নানা আমার মাকে খুব ভালোবাসতেন। আমাদের বাড়ি থেকে নানার বাড়ি প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে। গ্রামের নাম চরবাড্ডা মির্জাচর। সবুজ গাছপালা বেষ্টিত গ্রামটি খুবই চৎমকার। মাঝে মাঝে আমার মাকে দেখার জন্য নানা আমাদের বাড়িতে আসতেন। আসার সময় নানা মায়ের জন্য কাঁঠাল, আম, কলা, আনারস, বেদানা, আঙুর আরো কত কি যে নিয়ে আসতেন তার কোন হিসেব নেই। নানা যখন চলে যেতেন, তখন মা প্রায়ই কাঁদতেন আর আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতেন। তখন প্রিয় বাবা চলে যাওয়ায় নিজের মধ্যে শূন্যতা অনুভব করতেন।
নানাকে দেখার সুভাগ্য আমার হয়নি। আমি দুনিয়াতে আসার পূর্বেই আমার নানা এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। নানার মৃত্যুতে আমার মা একদম পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। সেই মৃত্যুর শোক আজও আমার মা ভুলতে পারেননি। এখনও নানার কথা মনে হলে কেঁদে কেঁদে চোখ ফোলায়। নানার কথা চিন্তা করে আমিও মাঝে মাঝে কাঁদি। আমি দুনিয়াতে এসে নানার স্নেহ, ভালোবাসা হতে বঞ্চিত হলাম। মনভরে নানাকে ডাকতে পারলাম না। তবে নানীর কাছ থেকেই নানার সমস্ত আদর ভালোবাসা পেয়েছি।
আমার বাবা একজন সাধারণ শ্রমিক। আমার জন্মের পরই আমাদের সংসারে অভাব অনটন দেখা দেয়। তখন মা মাঝে মাঝে নীরবে বসে কী যেন চিন্তা করতেন। আর দুচোখের জল ফেলতেন।
আমরা তিন ভাই, এক বোন। এর মধ্যে আমি বড় সন্তান। বাড়ির সমস্ত কাজ আমার মায়ের একা করত হতো। কারণ মায়ের কোন জা ছিল না। বাবা সারাদিন কাজ করার পর রাতে বাড়িতে ফিরতেন। তখন আমার মা বাবার পাশে বসে তাল পাতার পাখায় বাতাস করে ভাত খাওয়াতেন। আর তখন সংসারের সুখ দুঃখ নিয়ে আলোচনা করতেন। কিভাবে আমাদেরকে বড় করবেন তা নিয়ে ভাবতেন। রাতে খাওয়ার পর মা আমাকে সুন্দর সুন্দর গল্প বলে ঘুম পড়াতেন। আমি অসুস্থ্য হলে মায়ের চিন্তার শেষ থাকত না। আমার রোগ মুক্তির জন্য সারাক্ষণ খোদার কাছে প্রার্থনা করতেন। সারা রাত আমার পাশে বসে আমার সেবা যত্ন করতেন। আমার প্রতি একটুও বিরক্ত দেখাতেন না।
আমি যখন একদম ছোট, তখন এক কান্ড ঘটেছিল। আমার মা বাহিরে চুলোয় রুটি খোলা দিচ্ছেন। তখন বাবা ও আমরা চার ভাই-বোন পিঁড়ি নিয়ে চুলোর পাশে বসলাম। মা একে একে সবাইকে ভাগ করে তিনটি করে রুটি দিলেন। আমি তখন রুটি নিয়ে একটু দূরে বসেছিলাম। আমি একটি রুটি খেয়ে অন্য একটি রুটি খেতে যাব এমন সময় একটি কুকুর এসে আমার বাকী রুটিটা নিয়ে দিল দৌঁড়। আমি তখন রুটি আনার জন্যে দৌঁড়ে গিয়ে কুকুরের গলায় জড়িয়ে ধরলাম। ভাগ্যিস কুকুর তখন আমাকে কামড় দেয়নি। কুকুর তৎক্ষনাত রুটি ফেলে চলে গেল। আর তখন আমি কুকুরের কাছ থেকে রুটিটি উদ্ধার করে মায়ের ভয়ে কাঁদতে লাগলাম। আমি ভাবছি মা বুঝি আমাকে মারবে। কিন্ত না আমার মা লক্ষী আমাকে মারেনি বরং আদর করে বুকের কাছে টেনে নিয়ে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে বললেন, ‘তুই আমার লক্ষী ছেলে কাঁদিস না। এটা তোর দোষ না। আর এ রুটি খাসনে। মুরগীকে দিয়ে দে। আমি এক্ষুনি আবার রুটি বানিয়ে দিচ্ছি।’
মা আমাকে তখন আবার রুটি বানিয়ে দিলেন।
সারাদিন কাজ করার পর সন্ধ্যা হলে মা আমাকে পড়াতেন। আমি মায়ের সাথে বসে অ, আ, ক, খ পড়তাম আর মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকতাম। আমি যখন ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম তখন থেকেই মায়ের কাজে একটু একটু সাহায্য করতাম।
ঈদ এলে আমাদের এলাকায় পিঠা বানানোর ধুম পড়ে। বিশেষ করে ঈদ-উল ফিরত এর সময় চাঁদ উঠার একদিন পূর্বে প্রতি ঘরে ঘরে পিঠা বানানো হতো। বাড়ির আশের সবার মতো আমার মাও পিঠা বানাতেন। মা গায়িল, সায়িট দিয়ে গুড়ি কুড়তেন। তারপর পানি সিদ্ধ করে মাধা তৈরি করতেন। পরে পিঠা বানাতেন। আমি তখন আমার মাকে পিঠা বানানোর কাজে সাহায্য করতাম। আমি লতি বানিয়ে দিতাম। মা তখন নিপুণ হাতে সুন্দর করে পিঁড়ির উপর হাত ঘুরিয়ে সেয়ুই বানাতেন। মায়ের সব কাজই আমার খুব ভাল লাগে। মা ঈদের দিন সকালে গুড় দিয়ে সেয়ুই পাক করতেন। ভাই-বোন সবাই মিলে সেয়ুই খেতাম। ঈদগাহে যাওয়ার সময় বাবা আমাকে টাকা দিতেন। মা আদর করে আমাকে জামা কাপড় পড়িয়ে দিতেন। সুন্দর করে আমার চুলগুলো আঁচড়িয়ে দিতেন।
আমি পরিবারের বড় ছেলে তাই বাবা-মার অনেক স্বপ্ন আমাকে নিয়ে। লেখাপড়া করে একদিন অনেক নামি-দামী ব্যক্তি হব। সেই স্বপ্নে বিভোর আমার পিতা-মাতা। মাঝে মাঝে দেখতাম আমার মা পাক ঘরে বসে কাঁদতেন আর কি যেন এক শূন্যতা অনুভব করতেন। আমি তখন মাকে বলতাম, ‘মা তুমি কাঁদছ কেন?’
মা আমাকে দেখে সাথে সাথে আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে মুখে হাসির রেখা টেনে বলতেন, ‘কৈ কাঁদিনাতো।’
আমার জন্মের পর থেকেই আমার মায়ের দুঃখ বেড়েছ। প্রায়ই মা আমাকে দুঃখের কাহিনী শুনাতেন। মাঝে মাঝে মা আমাকে নিয়ে নানার পুরানো ইতিহাস বলতেন। এত কষ্টের পরও আমার লক্ষী মা আমার বাবা ও ভাই-বোনদের প্রতি একটুও বিরক্তবোধ করতেন না। শত কাজের মাঝেও পাঁচ ওয়াক্ত নামায ঠিকমত আদায় করতেন।
মমতাময়ী মা তাঁর সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে আমাকে বড় করছেন। তাইতো আমার মাকে দেখলে মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত দুঃখ, কষ্ট ভুলে যাই। জগতের শ্রেষ্ঠ মায়েদের মধ্যে আমার মা একজন। আমার মায়ের মত এমন মা কয়জন আছে এ পৃথিবীতে? মাগো, তুমিই আমার প্রাণ লক্ষী মা তুমি।
রচনাকাল-জুন-১৯৯৯খ্রিস্টাব্দ।
[জলছবি বাতায়ন নববর্ষ সংকলন ১৪২১ বাংলা এ প্রকাশিত]
বিষয়: সাহিত্য
১৫২০ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ।
অপমান করলেন একটি বাস্তব চিত্রকে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন