ভিক্ষুক

লিখেছেন লিখেছেন আমির হোসেন ০২ জুন, ২০১৪, ১০:৫৩:৩৮ সকাল



সবুজ গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মেঘনা। বাংলাদেশের অন্যতম নদীগুলোর মধ্যে মেঘনা একটি বৃহৎ নদী। এই গ্রামেই বসবাস করে সুসানের দাদা। এখানেই তার বাবার জন্ম। সুসান তার বাবার সাথে ঢাকায় বসবাস করে। সে মাঝে মাঝে বাবা-মায়ের সাথে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে আসে।

গত দুইদিন হয় গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে সুসান গ্রামে এসেছে। এখন সুসানের বয়স ১১ বছর। এ বছর পঞ্চম শ্রেণী পড়ছে। ছাত্র হিসেবে সুসান খুবই ভাল। ক্লাশ রোল নং-১। প্রতি ক্লাশেই তার রোল ১ ছিল। কেউ তার সাথে প্রতিযোগিতা করে ঠিকে থাকতে পারেনি। প্রতিবারই সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রথম স্থান দখল করে নেয়। সুসান গ্রামে এসে দেখে তার সমবয়সী অনেক ছেলে-মেয়ে এখনও স্কুলেও যায়নি। সুসানকে নিয়ে তার দাদা-দাদীর খুব গর্ববোধ করেন। পাড়ার সকলের সাথে নাতীর সুনাম বয়ে বেড়ায়।

একদিন সকাল বেলা সুসান লক্ষ করল এক ভিক্ষুক তাদের বাড়ীর গেইটে এসে ধাক্কাচ্ছে আর বলছে, আল্লাহ্রওয়াস্তে ভিক্ষা দিবেন। পরনে ময়লা ছেঁড়া পোশাক। পায়ে জুতা নেই। মুখভর্তি সাদাপাকা দাড়ি। ইয়া বড় গ্রোফ। মাথায় ঝটপাকানো এলোমেলো চুল। সাদা পাকা চুলের মিশ্রন। মনে হয় যেন চুল, দাড়ি গ্রোফের সাথে ব্লেডের কোন সর্ম্পক নেই। তার কাদে একটি ব্যাগ। সারাদিন ভিক্ষা করে যা পায় তা এই ব্যাগে রাখে।

ভিক্ষুকের ডাক শুনে সুসান গেইট খুলে ভিক্ষুকের সামনে আসল। সাথে সাথে তার দাদাও আসল। দাদা ভিক্ষুককে লক্ষ্য করে বললেন, কি চায়?

ভিক্ষুকটি মলিন মুখে বললো, আল্লাহ্রওয়াস্তে ভিক্ষা চাই।

না না ভিক্ষা দেয়া যাবে না। মাফ করেন।

ক্যান ভিক্ষা দেয়া যাবে না? মাফ করব ক্যান? আমি যতবারই আসি ততবারই বলেন মাফ করেন। আপনি ভিক্ষা না দিলে খামু কি?

কেন কাজ করে খেতে পার না। হাত, পা, মুখ সবইতো ভাল দেখছি।

জানেতো কুলাই না সাব।

তুমি যে কাজ করতে পার সে কাজ কর।

সুসান এতক্ষণ দাদা ও ভিক্ষুকের কথা মনযোগ দিয়ে শুনছে। এবার সুসান ভিক্ষুককে লক্ষ্য করে বললো, হ্যাঁ দাদা ঠিক বলেছে, ভিক্ষা করেন কেন? কাজ করে খান। নবীর শিক্ষা করো না ভিক্ষা। ভিক্ষা করা ভাল না। অন্যের করুণা নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়।

ভিক্ষুক বললো, কাজ কোথায় পাব? কে দিবে কাজ?

আমাদের বাড়ীতে থাকবে? দাদা দিবে কাজ।

দাদা ভিক্ষুককে লক্ষ্য করে বললেন, হ্যাঁ তুমি কি কাজ করতে চাও বল। আমি তোমাকে কাজ দেব। তবুও ভিক্ষা করো না।

ভিক্ষুক কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো, আপনি যা কাজ দিবেন তাই করব।

ঠিক আছে তোমার কাছ হচ্ছে আমাদের বাড়ী দেখাশুনা করা, বাজার সদায় করা।

কত টাকা দিবেন সাব।

তিন বেলা খাবার ফ্রি। মাসে ৫,০০০/- টাকা দিব। কি চলবে?

হ্যাঁ চলবে।

তোমার বাড়ীতে কে কে আছে?

এ কথা বলার সাথে সাথে ভিক্ষুকের চোখ বেয়ে জল বেয়ে পড়তে লাগল।

কি হলো কাঁদছ কেন? কি হয়েছে তোমার?

ভিক্ষুক চোখের জল মুছে বললো, সাব আমার কেউ নেই। গত বছর লঞ্চ দুর্ঘটনায় ডুইবা আমার ছেলে-মেয়ে ও বউ সবাই মইরা গেছে। সে সময় আমিও ঐ লঞ্চে ছিলাম। কিন্তু আমি পারিনি তাদেরকে বাঁচাতে। সেই থেকে আমি কাজ কর্ম বাদ দিয়ে পাগলের মতো ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করছি।

ভিক্ষুকের দুঃখের কথা শুনে সুসানের দাদারও চোখে জল এসে গেল। তিনি চোখ মুছে বলনে, আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করেন। তুমি এখন থেকে আমার বাড়ীতে থাকবে। তোমার সব দায়-দায়িত্ব আমার।

ভিক্ষুক বললো, তয় সাব আপনি আমাকে কাম দিয়া বড়ই উপকার করছেন। এখন থেকে আর আমি ভিক্ষা করুম না।

দাদা পকেট থেকে ৫০০ টাকার একটি নোট বের করে বললেন, এই নাও। এই টাকা দিয়ে চুল, দাড়ি, গ্রোফ কেটে পরিষ্কার করবে এবং একটি ভাল শার্ট কিনবে। এখন যাও, কাল আসিও।

ভিক্ষুক টাকাটা নিয়ে চলে গেলেন।

সুসানের মনে পড়ে গেল কয়েক মাস আগের এক ভিক্ষুকের কথা। একদিন সকাল বেলা সুসান পড়ার টেবিলে পড়ছিল। তখন এক ভিক্ষুক তাদের ঢাকার বাসায় এসে কলিং বেল চাপল।

সুসানের মা রাত একটার আগে ঘুমাতে যায় না। প্রায় প্রতি রাতেই টিভি দেখে গভীর রাতে ঘুমাতে যায়। তাই সকাল বেলা তার উঠতে দেড়ী হয়। নয়টার আগে ঘুম ভাঙ্গে না। আজ হঠাৎ এত সকালে ভিক্ষুকের কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে তার মন বিগরে গেল। ঘুম ঘুম চোখে এসে দরজা খুলল। সাজ সকালে ভিক্ষুককে দেখে তার রাগ চরমে উঠলো। কি চাই?

ভিক্ষুকটি ভয় পেয়ে গেল। ভেজা কণ্ঠে বললো, মাগো সারা রাত কিছু খায় নাই। তই এত সহালে আইছি। কিছু ভাত দেবে।

তুর ছাই ভিক্ষুক আসার সময় পাইলিনা। আমার কাচা ঘুমটা ভেঙ্গে এখন বলছিস ভাত খায় না। যা যা পরে আসিস। এই বলে দরজাটা লাগিয়ে দিল। সুসান তখন পড়ার টেবিলে বসে সব লক্ষ করল। তখন সুসান বললো, মা তুমি এত সকালে ভিক্ষুকটাকে বকাঝকা করলে কেন? ভিক্ষা দিলে কি হতো?

চুপ তুই কোন কথা বলবি না। বলেই আবার ঘুমাতে চলে গেল।

অথচ আজ তার দাদা এই ভিক্ষুকের সাথে কত ভদ্র ভাষায় কথা বললেন। আবার তাকে কাজ করার ব্যবস্থাও করে দিলেন।

পরেদিন ভিক্ষুক লোকটি চুল, দাড়ি, গ্রোফ কেটে সুন্দর একটি শার্ট গায় দিয়ে আসলো। ভিক্ষুককে দেখে প্রথমে দাদা চিনতে পারে নি। পরে পরিচয় দেওয়ার পর চিনতে পারলো। ভিক্ষুকটি দাদার পায়ে ধরে সালাম করে বললো, সাব এখন থেকে আমি আপনার বাড়িতে কাজ করুম।

দাদা বললেন, ঠিক আছে। দেখেছো একদিনে তোমার কি পরিবর্তন হয়েছে।

হ্যাঁ সাব সব আপনার দোয়ায়।

সেই থেকে ভিক্ষুকটি সুসানের দাদার বাড়ীতে নিয়মিত কাজ করতে লাগলো। আর কোন দিন ভিক্ষা করেনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ বাড়িতেই কাঠিয়েছে।

আজ সুসান অনেক বড় হয়েছে। তার দাদা-দাদী কেউ আজ বেঁচে নেই। নেই সেই ভিক্ষুকটি। যার সাথে সুসানের ছিল বন্ধুত্ব। যতবারই বাড়িতে যেত সেই ভিক্ষুকটির কাছ থেকে গল্প শুনতো। জীবনের গল্প। জীন-পরীর গল্প।

রচনাকাল-১৬ মে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ।

বিষয়: সাহিত্য

৯৮৬ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

229455
০২ জুন ২০১৪ দুপুর ১২:৪৫
egypt12 লিখেছেন : ভালো লাগলো... Rose
229528
০২ জুন ২০১৪ দুপুর ০২:২৮
আমির হোসেন লিখেছেন : ধন্যবাদ
229979
০৩ জুন ২০১৪ দুপুর ০২:৫৪
ধন্যবাদ লিখেছেন : Thumbs Up





চমত্কার গল্প
230668
০৪ জুন ২০১৪ রাত ১০:১২
আমির হোসেন লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File