বন্ধু

লিখেছেন লিখেছেন আমির হোসেন ০১ জুন, ২০১৪, ১১:৫২:০৭ রাত



মোহতেশাম ছোট শিশু। বয়স আট কি নয়। সে তার বাবা-মায়ের সাথে ঢাকায় থাকে। এবার সে তার দাদার বাড়ীতে এসে ঈদ করবে। সামনে কোরবানীর ঈদ। তাই এ উপলক্ষে সে ঈদের দু’দিন পূর্বেই গ্রামের বাড়ীতে চলে আসল। মেঘনার তীর ঘেষে তার দাদার গ্রামের বাড়ী।

মোহতেশামের গ্রাম দেখতে খুব ভাল লাগে। মাঝে মাঝে স্কুল বন্ধ হলে যে চলে আসে দাদার কাছে। তখন আর যেতে ইচ্ছে করে না তার। শহরের মত যানজট নেই এখানে। মুক্ত আবহাওয়ায় ছুটাছুটি করতে পারে। নেই কোন বাঁধা। নদীতে সাঁতার কেটে গোসল করতে পারে। আরও কত্ত কি! তাইতো তার গ্রাম এত ভাল লাগে।

শনিবার দিন শ্রীঘর বাজার থেকে তার দাদা একটা কুরবানীর গরু কিনে আনল। দাদা যখন বাজারে যায়, তখন মোহতেশাম তার সাথে গিয়েছিল। সে গরুটি পছন্দ করেছে। কুচকুচে কালো ষাড়। নাদুস-নুদুস শরীর তার। গরু যখন বাড়ীতে আনল তখন তার দাদাকে দিয়ে একটা ছবি তুলে রাখল।

ঈদের দিন সকাল বেলা চারদিকে হৈ চৈ পড়ে গেল। ছেলে-মেয়েদের কোলাহল। কেউতো এ মূহুর্তে বিছানায় নেই। সবাই মেঠে উঠল ঈদের আনন্দ উপভোগ করার জন্য। সবার মনে আজ শুধু আনন্দ আর আনন্দ। মোহতেশাম তার দাদাকে সাথে নিয়ে মেঘনা থেকে গোসল সেরে আসল। মা সেমাই পাক করছে। বাবা-মা, দাদা সবাই এক সাথে মিলে সেমাই খেল।

মা পরিপাটি করে মোহতেশামকে কাপড় পড়িয়ে দিলেন। সুন্দর করে চিরুনী দিয়ে মাথা আচরিয়ে দিলেন। তারপর মোহতেশাম দাদুর কাছে এসে বললো, দাদা!

দাদা বললেন, কি দাদা ভাই।

চল আর দেড়ী কেন? ঈদগাহে যায়।

হ্যাঁ চল দাদা ভাই।

তাড়াতাড়ি চল্ দাদা নামাযের সময় হয়ে যাচ্ছে।

দাদা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, হ্যাঁ তাইতো!

মোহতেশাম নামাযের বিছানা হাতে নিল। দাদা-নাতী দু’জনে ঈদগাহের দিকে রওয়ানা হলো। নানা রঙের পোশাক পড়ে কচি কচি ছেলে-মেয়েরা ঈদগাহে যাচ্ছে। মোহতেশাম পড়েছে পাঞ্জাবী ও পায়জামা। দাদা-নাতী যখন ঘর থেকে বের হচ্ছিল তখন একটি গরীব ছেলে এসে মোহ্তেশাম বললো, আমারে একটা ট্যাহা দাও।

ছেলেটির পড়নে একটা অর্ধময়লা শার্ট ও একটা ছেঁড়া হাফপ্যান্ট। মুখটা শুকনা। তাকে দেখে মোহতেশামের মায়া লেগে গেল। সে ছোট থেকেই গরীব দু:খিকে ভালোবাসে। গরীবের দু:খ দেখলে তার চোখ দিয়ে জল এসে যায়।

মোহতেশাম ছেলেটিকে লক্ষ্য করে বললো, আচ্ছা তোমার নাম কি?

ছেলেটি বললো, আমার নাম রফিক।

তোমার মা-বাবা নেই?

ছেলেটির চোখ অশ্রুসজল হয়ে গেল। কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, আজ দু’বছর হয় আমার বাবা নৌকা ডুইব্বা মারা গেছে।

আর তোমার মা?

মা আমারে ছেড়ে আর এক বেডার লগে বিয়া বইয়া গেছে।

এখন তোমার বাড়ীতে কে আছে?

আমার বুবু আছে। সাথে আমি থাকি। বুবু সারাদিন ভিক্ষা কইরা যা আনে তাই দিয়ে আমরা চলি।

ছেলেটি মোহতেশামের কথার জবাব দিতে দিতে চোখে জল এসে গেল।

দাদা এসব দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখছেন।

মোহতেশাম ছেলেটির গায়ে ময়লা জামাটার দিকে তাকিয়ে বললো, তোমার কি কোন ভাল জামা নেই?

না। ভাল জামা কত্তে আনমু। ঠিকমত তো খাইতেই পারি না।

মোহতেশামের এ দৃশ্য দেখে দাদা ভাবছে, এতোটুকু ছেলের গরীবের প্রতি কত দরদ।

মোহতেশাম তার বাবার কাছে এসে বললো, বাবা আমারতো অনেক জামা। একটা জামা ঐ গরীব ছেলেটাকে দিয়ে দেই?

ছেলের মুখে এ কথা শুনে বাবাতো রীতিমতো অবাক! তারপর বললেন, তুমি যদি দিতে চাও, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই।

মোহতেশাম ছেলেটিকে তার একটা শার্ট দিয়ে দেয় ও দশটা টাকা দেয়। ছেলেটি টাকা ও জামা পেয়ে খুশীতে বাহ্ বাহ্। সে তার দু’হাত দিয়ে দু:খ ভরা অশ্রু মুচলো। তারপর বললো, আল্লাহ তোমাকে অনেক বড় করুক। এ বলে ছেলেটি চলে গেল। পরে দাদা-নাতী দু’জনে ঈদগাহে রওয়ানা হল।

সারি বেঁধে মানুষ ঈদগাহে যাচ্ছে। রাস্তায় যেন আজ লোক জনের ঢল নেমেছে। ধীরে ধীরে ঈদগাহ ময়দান কানায় কানায় পরিপূর্ণ হলো। দাদা-নাতী দু’জনে পাশাপাশি নামাযে দাঁড়ালো। নামায শেষে যখন ইমাম সাহেব খুৎবাহ পড়ছেন মোহতেশাম তা মনযোগ দিয়ে শুনছে। মুনাজাতের পর শুরু হলো কুলাকুলি পর্ব। সমবয়সী ছেলেরা পরপস্পরের সাথে কুলাকুলি করছে। মোহতেশামের ইচ্ছে দাদার সাথে কুলাকুলি করতে কিন্তু ছোট বলে তার দাদার বুক নাগাল পাচ্ছে না। তাই সে লাফ দিয়ে তার দাদার কোলে উঠে কুলাকুলি করলো। দাদাতো নাতীর বুদ্ধি দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।

ঈদগাহ থেকে এসেই ইমাম সাহেব গরু জবেহ করার জন্য প্রস্তুত হলেন। মোহতেশামের সমবয়ী ছেলে-মেয়েরা গরু জবেহ দেখার জন্য ইমাম সাহেবের পিছে পিছে ছুটল। মোহতেশামও ইমাম সাহেবের পিছনে ছুটল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আল্লাহু আকবার বলে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। গরুকে যখন মাটিতে শুয়ানো হল তখন সবাই গরুর কাছাকাছি চলে গেল। যখন আল্লাহু আকবার বলে ছুরি চালানো হল; তখন লাফিয়ে দৌঁড়ে চলে আসল মোহতেশাম।

যখন মোহতেশামদের গরুটি জবেহ করার জন্য ইমাম সাহেব আসলেন তখন তার মায়া লেগে গেল গরুটির প্রতি। নিরীহ প্রাণীটি আল্লাহর রাস্তায় কুরবানী হয়ে যাবে তা ভাবতেও পারে না মোহতেশাম। গরু জবেহ হয়ে গেল। গোস্ত কাটার কাজে লেগে গেল মোহতেশাম। গোস্ত কাটা শেষে মোহতেশাম বেড়িয়ে পড়লো ঐ এতিম ছেলেটির সন্ধানে। ছেলেটিকে খুঁজে বের করলো। তাদের গোস্ত রান্না হলে তাকে গোস্ত দিয়ে ভাত খাওয়ালো। তারপর তাকে বললো, আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু।

এরপর থেকে যখনই মোহতেশাম গ্রামের বাড়ীতে আসত তখনই ছুটে যেত ঐ এতিম ছেলেটির কাছে। হাত বাড়িয়ে দিত বন্ধুত্বের।

রচনাকাল- মার্চ-২০০০খ্রি:

বিষয়: বিবিধ

১১৮৯ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

229282
০১ জুন ২০১৪ রাত ১১:৫৫
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
০৫ জুন ২০১৪ রাত ১০:৪৫
177874
আমির হোসেন লিখেছেন : ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File