সেমুলী
লিখেছেন লিখেছেন আমির হোসেন ৩১ মে, ২০১৪, ১০:৩৬:৫০ রাত
আমি তখন ছোট। বয়স ছয় কি সাত হবে। মাঝে মাঝে স্কুলে যেতাম এবং দিনে একটা করে বই ছিঁড়তাম। আমি ছিলাম নিন্মবিত্ত পরিবারের সন্তান। আমার জন্মের পর থেকেই বাবার সংসারে অভাব অনটন দেখা দেয়। অথচ আমার জন্মের পূর্বে আমাদের সংসারে ছিল ঘোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু ও বালতি ভরা দুধ। দাদা যখন সংসার ছেড়ে দিলেন, তখন থেকেই আমাদের সংসারে অবনতি ঘটতে থাকে। এখন বাবা একদম নিঃস্ব হয়ে গেছেন। আগের মত জমিজমা নেই। সব বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন বাবা পরের জমিতে কাজ করে। এই রোজগার দিয়ে কোন মতে সংসার চালায়। আমরা পর পর চারটি ভাই ও একটি বোন জন্ম নিলাম। আমি হলাম বড় সন্তান। আমি পশু-পাখিকে খুব ভালোবাসতাম। মাঝে মাঝে টুনটুনি, বাবুই, বক ও চড়ুই পাখির বাসা ভেঙ্গে ছানা চুরি করে নিয়ে আসতাম। এসব পাখি ছানা বাড়িতে এনে খুব যত্ন করে লালন পালন করতাম। আমার এই পাখি প্রেম স্বভাব দেখে মা আমাকে একটি ছাগি ছাগল এনে দেন। ছাগলটি ছিল কুচ কুচে কালো। ছাগলটি পেয়ে আমি খুব খুশী হলাম। মনে মনে মাকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম। সেই থেকে আনন্দের সহিত ছাগলটি লালন পালন করতে লাগলাম। সারা দিন টো-টো করে এই ছাগটির পিছনে লেগেই থাকতাম। কয়েক মাসের মধ্যেই ছাগলটি বড় হয়ে গেল।
এক মাস, দুই মাস, তিন মাস এভাবে কেটে গেল ছয়টি মাস। ছাগলটি কিছুদিনের মধ্যে সুন্দর ফুটফুটে একটি বাচ্চা জন্ম দিল। যেদিন বাচ্চাটি জন্ম নিল সেদিন ছিল সোমবার। তাই আমি বুদ্ধি করে সোমবারের সাথে মিল রেখে ছাগল ছানাটির নাম রাখলাম ‘সেমুলী’। আমার এই বুদ্ধি দেখে মা-বাবা খুব খুশী হলেন।
সেমুলী যখন জন্ম নিল তখন হাঁটতে পারছিলনা। আমি তাকে ধরে হাঁটালাম। সেমুলী আমার দিকে লক লক করে তাকিয়েছিল। আমি তাকে আলতো করে ধরে দুধ খাওয়ালাম। সেমুলী যখন হাটা শিখল তখন থেকেই সে তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছে। কখনো বা পাক ঘরে চলে যায়। মায়েরর আঁচল গিয়ে কামড়ে ধরে। আবার কখনো বা ঘরের পিড়ায় উঠে উঠে লাফায়। একবার আমার কাছে আসে আবার তার মায়ের কাছে যায়। মনে হয় যেন আমি তার বাবা। আমি ডাকি, ‘সেমুলী কাছে এসো।’ অমনি সে লাফ দিয়ে আমার কোলে এসে বসে। আমি ওকে আদর করি। ও তখন শান্ত হয়ে যায়। তখন আমি ওর শরীরে সুর সুরি দেই। সেমুলী সারাক্ষণ আমার পাশে থাকে। কিছুক্ষণের জন্য আমাকে না দেখলে ভ্যা ভ্যা করে চিৎকার করে। তখন আমি ছুটে এসে ওর মসৃণ গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করি। আমার ভালোবাসার আদর পেয়ে সে আনন্দে চোখ বুঝে থাকে কিছুক্ষণ।
সেমুলী রাতে আমার পাশে থাকে। সারাক্ষণ আমায় জ্বালাতন করতো। আমি মাঝে মাঝে রাগে ওকে কানমলি দেই। কানমলি খেয়ে সে আরো বেশী করে আমার গা ঘেষে বসে। তবে সে একদিক দিয়ে ভাল ছিল। কখনো সে রাতে বিছানায় প্রস্রাব করে না। আমি তাকে রুটি, ভাত, খাস সবই খাওয়াতাম। আদরে আদরে সেমুলী এতদিনে খুব বাদর হয়ে গেছে। বাড়ির আশে পাশের যা কিছু পায় তা খেয়ে সাবাড় করে। এজন্য মাঝে মাঝে পাক ঘরে গিয়ে তরিতরকারি খেয়ে ফেলে। কখনো লবণের কোটা ফেলে দেয়। ওর এসব কাণ্ডকারখানা দেখে মা কখনো রেগে ওকে এক থাপ্পর মারে। তখন সেমুলী থাপ্পর খেয়ে দৌঁড়ে আমার কাছে এসে মায়ের বিরুদ্ধে নালিশ করে। তখন আমি খুব ব্যথা পাই। আমি তাকে মায়ের নিকট যেতে নিষেধ করি। কিন্তু কে শুনে কার কথা!
আমি মাকে বলি, ‘তুমি আর সেমুলীকে মের না।’
মা রেগে গিয়ে বলেন, কি করব বল, এত দুষ্টু কি ছাগল ছানা হয়!
দিন যায় সপ্তাহ আসে। এভাবে কেটে যায় মাসের পর মাস। সেমুলী আস্তে আস্তে তাজা হতে লাগল। তার সমস্ত শরীর কালো কুচকুচে লোমে ছেয়ে গেল। নাদুস-নুদুস শরীর। আমার ভালোবাসা ও আদর পেয়ে সে যেন অল্প কয়েকদিনেই মোটা হয়ে গেল। এখন সেমুলী আমার এতই ভক্ত হয়ে গেল যে, আমি যা বলি সে তাই করে। আমার মনে হয় সে আমার ডাক শুনতে পায় এবং বুঝতে পারে। মাঝে মাঝে আমার কুলে এসে যখন বসে তখন আমি ওকে চুমো দেই। তার শরীরের চুল চিরুনী করে আঁচড়ে দেই।
আমি যখন সেমুলী’র মাকে চকে নিয়ে যাই ঘাস খাওয়াতে, তখন সে পেছনে পেছনে লাফিয়ে যায়। দু’একটি ঘাসে কামড় দিয়ে আবার দ্রুত আমার কাছে চলে আসে। এভাবে চলছে প্রতিদিন। আমিও সেমুলীকে খুব বেশী ভালোবাসি। ওকে ছাড়া যেন আমার এখন আর কোন কিছু ভালো লাগে না। কোথাও বেড়াতে গেলে একেদিনের বেশী থাকতে পারি না। এভাবে কেটে গেল একটি বছর। এখন সেমুলী অনেক বড় হয়ে গেছে।
একদিন আমার বাবা মায়ের সাথে আলাপ করছে। বাবা বললো, ‘আমাদের সেমুলী তো এখন অনেক বড় ও মোটা তাজা হয়ে গেছে। ওকে এখন বিক্রি করে দেই। তাছাড়া আমার হাতে এখন কোন টাকা পয়সা নেই যে সংসার চালাব।’
মাতো রীতিমত অবাক। ‘একি বলছেন আপনি! রাজুতো ওকে বিক্রি করতে দেবে না। সেতো কেঁদে সারা বাড়ি মাতিয়ে তুলবে।’
‘কাঁদলে কি হবে? আজ হোক কাল হোক একদিন তো ওকে বিক্রি করতেই হবে।’
মায়ের মুখে সেমুলীর বিক্রির কথা শুনে আমিতো হতবাক। মনে হয় যেন আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। আমি মাকে বললাম, ‘মা তুমি বাবাকে বলো সেমুলীকে যেন বিক্রি না করে।’
মাও সেমুলীকে খুব ভালোবাসে। মায়ের মুখে কষ্টের ছাপ লক্ষ করলাম। মা বললেন, ‘তোর বাবাতো আমার কথা শুনবে না। যা মুখে একবার বের করবে তা আর ফেরানো যাবে না।’
আমি এত কষ্ট করে সেমুলীকে লালন পালন করছি। তাছাড়া তার প্রতি আমার অন্য এক ধরনের ভালোবাসাও জন্মালো। সেই আদরের সেমুলীকেকে বাবা বিক্রি করে দিবে তা আমার ভাবতে অবাক লাগে। এ হতে পারে না। আমি কিছুতেই সেমুলীকে বিক্রি করতে দিব না।
আজ শনিবার। বাবা সেমুলীকে বিক্রি করার জন্য হাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। বাবা যেন আজ পাষান হয়ে গেলেন। আমি কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলাচ্ছি। বাবা সেদিকে কোন দৃষ্টিই দিচ্ছেন না। আমি একবার মায়ের নিকট যাই আবার সেমুলীর নিকট যাই। সেমুলী’র দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই তার চোখের কোণায় পানি জমে আছে। আমাকে দেখে ফ্যাফ্যাল করে আমার দিকে তাকাল। মনে হয় যেন সে বলছে, ‘রাজু তোমাকে ছাড়া আমি পরের বাড়িতে কেমন করে থাকব। তোমার বাবা এত পাষান কেন?’ কিন্তু কে শুনে এই বোবা সেমুলীর ভাষা।
বাবা যখন সামনের দিকে সেমুলীকে নিয়ে যাচ্ছেন তখন সেমুলী ঘাড় ফিরিয়ে ভ্যা-ভ্যা করে ডাকছে। তার এই ডাক আমি সহ্য করতে না পেরে বাবার পিছনে ছুটলাম। বাবা আমাকে বাজারে যেতে বারণ করা সত্ত্বেও বাবার পিছে পিছে সারাটা পথ কেঁদে কেঁদে বাজারে পৌঁছলাম। এরি মধ্যে বাবার একটুও মন পরিবর্তন হলো না। তবে একটি কথা বলে বার বার সান্ত্বনা দিল, ‘রাজু আর কাদিস না। তোকে অন্য একটি বাচ্চা কিনে দিব। কিন্তু আমি কি তা আর মানি। আমি যে নাছোড় বান্দা। চোখের পানি মুছে বললাম, ‘আমি অন্য ছাগল চাইনা। আমি শুধু সেমুলীকে চাই। ওকে আমি বেঁচতে দিব না।’ এদিকে সেমুলী কিছু দুর গিয়ে আর যাচ্ছে না। বার বার বাড়ির বাড়ির দিকে ফিরে আসতে চাচ্ছে। এক পর্যায়ে বাবা তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে করতে বাজারে নিয়ে আসল। বাজারে শত শত ছাগল বিক্রেতারা তাদের ছাগল নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বাবাও একটি গাছের ছায়ায় গিয়ে সেমুলীকে নিয়ে দাঁড়ালেন।
অনেক্ষণ বসে থাকার পর এক ক্রেতা আসল। সে সেমুলীকে ১০০০ টাকা দিয়ে কিনে ফেলল। তখন আমার কান্নার মাত্রা বেড়ে গেল। এ বুঝি সেমুলীকে জীবনের জন্য হারিয়ে ফেললাম। ক্রেতা আমার কান্না দেখে আশ্চার্য হয়ে বাবাকে জিজ্ঞেসা করলেন, ‘ছেলেটি কে হয় আপনার?’
বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘ও আমার ছেলে।’
‘কাঁদছে কেন?’
বাবা আমার কান্নার করণ ক্রেতা লোকটিকে বিস্তারিত ঘটনা বললেন। ক্রেতা এ ঘটনা শুনে খুব মর্মাহত হলেন। তার মনটা নরম হয়ে গেল। তিনি বাবাকে বললেন, ‘আমি ছাগলটি অবশ্য ভাগি দিতাম। এখন যেহেতু আপনার ছেলে ছাগলটির জন্য কাঁদছে সেহেতু আমার মনে হয় আপনিই ছাগলটি ভাগি নিয়ে গেলে ভাল হবে।’
একথা শুনে আমি ও বাবা খুব খুশী হলাম। আমি তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলাম। সেমুলী মনে হয় একথা শুনছে তাই সে আনন্দে লেজ দোলাচ্ছে। আমি তার শরীরে হাত বুলালাম। লোকটিকে বাবা আমাদের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দিলেন। পরে আমি সেমুলীর রশি ধরে খুশীতে বাবার আগে বাড়িতে চলে আসলাম।
মা সেমুলীকে দেখে আশ্চার্য হয়ে গেলেন। পরে মাকে আমি বিস্তারিত বললাম। মা একথা শুনে খুব খুশী হলেন।
সেদিনের পর থেকে আমি আবার আগের মতো সেমুলীকে লালন পালন করতে লাগলাম। এভাবে কয়েক মাস অতিবাহিত হয়ে গেল। একদিন সেমুলী ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। সে আগের মতো আর ঘাস খায় না। আর দুষ্টামি করে না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। চোখ দিয়ে জল পড়ে। পশু ডাক্তার দিয়ে সেমুলীকে চিকিৎসা করানো হলো। কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হচ্ছে না। দিন দিন সেমুলী শুকিয়ে যাচ্ছে। যিনি সেমুলীকে কিনলেন ওনাকে খবর দেয়া হল। তিনি আসলেন। সেমুলীকে দেখে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘রাজু এর জন্য মন খারাপ কর না। আল্লাহর নিকট দোয়া কর যাতে তিনি তোমার সেমুলীকে ভাল করে দেন।’
লোকটি চলে গেলেন। যতই দিন যাচ্ছে ততই সেমুলীর শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি তখন সেমুলীকে আদর করে বলি, ‘তুমি একদিন ভাল হয়ে যাবে।’ কিন্তু সেমুলী যেন আমাকে বলছে, ‘আমি আর বেশী দিন বাঁচব না।’
বেশী ভালোবাসার জিনিস বেশি দিন থাকে না। সেমুলীকে আমি বেশী ভালবেসেছিলাম তাই খোদা সেমুলীকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলেন। সেমুলীর মৃত্যুর পর আমি তার উপর পরে কাঁদতে লাগল লাগলাম। আমার কান্না দেখে আশেপাশের সবাই আমাকে বুঝালো, কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হয়নি।
রচনাকাল- ১৫ মার্চ ২০০০ খ্রিস্টাব্দ।
বিষয়: সাহিত্য
১০২৭ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন