শবে বরাত সম্পর্কে দালিলিক পর্যালোচনা।
লিখেছেন লিখেছেন আবু জান্নাত ১৭ মে, ২০১৬, ০৭:২৯:৩০ সন্ধ্যা
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
সম্মানীত দ্বীনি ভাইয়েরা, আমাদের সামনে শাবান মাসের ১৫ তারিখে শবে বরাত বলে একটা রাত আসতেছে। সে রাতকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে অনেক ধরনের কথা শুনা যায়।
প্রথমে বলে নেই শবে বরাত শব্দটা কুরআন-হাদীসের কোথাও নাই। কুরআন হাদীসের ভায়া হলো “লাইলাতুন নিছ্ফ মিন শাবান”। শবে বরাত সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে কোন আলোচনা নাই। হাদীসে এই রাত সম্পর্কে আলোচনা আসছে। তবে সেখানে শবে বরাত শব্দ নাই। সেখানে আছে “লাইলাতুন নিছ্ফ মিন শাবান”।
আর “লাইলাতুন নিছ্ফ মিন শাবান”কে এই জন্য শবে বরাত বলা হয় যে, শব অর্থ হলো রাত আর বরাত অর্থ হলো নাজাত তথা মুক্তি। হাদীস দ্বারা যখন প্রমানীত এই রাতে আল্লাহ তায়ালা অনেক লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন তাই এই রাতকে মুক্তির রাত তথা শবে বরাত বলা হয়।
এবার মূল কথায় আসা যাক,
আমাদরে সমাজে এক শ্রেনীর লোক এতদিন পর্যন্ত শবে বরাতকে কেন্দ্র করে বাড়াবাড়িতে লিপ্ত ছিল। তারা এ রাতটি উপলক্ষে অনেক ধরনের বিদআত আমল সমাজে চালু করেছেন। হক্কানী উলামায়ে কেরাম সব সময়ই তাদের এসব বেদয়াতের প্রতিবাদ করে আসছেন। ইদানিং আমরা লক্ষ করতেছি, আবার এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ছাড়াছাড়ির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তাদের দাবী হল ইসলামে শবে বরাতের কোন রাত নেই। এ ব্যাপারে যত হাদীস আছে সব জাল বা যয়ীফ। তাই এই রাতে আমল করা এবং শবে বরাতকে বিশেষ কোন ফযীলতপূর্ণ রাত মনে করা নাজায়েয তথা বিদআত।
বাস্তব কথা হল, আগেকার সেই বাড়াবাড়ির পথটিও যেমন সঠিক ছিল না, এখনকার এই ছাড়াছাড়ির মতটিও শুদ্ধ নয়।
শবে বরাত সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অভিমত
শবে বরাত সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মত হলো, এ রাতের ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সম্মিলিত কোন রূপ না দিয়ে এবং এই রাত উদযাপনের বিশেষ কোন পন্থা উদ্ভাবন না করে বেশি ইবাদত করাও নির্ভরযোগ্য রেওয়াত দ্বারা প্রমাণিত। এই রাতকে অন্য সব সাধারণ রাতের মতো মনে করা এবং এই রাতের ফযীলতের ব্যাপারে যত হাদীস এসেছে, তার সবগুলোকে মওযু বা যয়ীফ মনে করা ভুল। যেমনভাবে এ রাতকে শবে কদরের মত বা তার চেয়েও বেশি ফযীলতপূর্ণ মনে করাও ভুল ধারণা।
সম্মানীত দ্বীনি ভাইয়েরা আসুন আমরা আর দেরী না করে শবে বরাত উপলক্ষে যে সব হাদীস বর্ণিত হয়েছে সে সব হাদীস নিয়ে আলোচনা করি।
শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কে কয়েকটি ছহীহ হাদীস পাওয়া যায়।
ছহীহ ইবনে হিব্বানের হাদীসে আছে রাসূল সাঃ বলেন,
أخبرنا محمد بن المعافى العابد بصيدا و ابن قتيبة وغيره قالوا : حدثنا هشام بن خالد الأزرق قال : حدثنا أبو خليد عتبة بن حماد عن الأوزاعي و ابن ثوبان عن أبيه عن مكحول عن مالك بن يخامر عن معاذ بن جبل عن النبي صلى الله عليه و سلم قال يطلع الله إلى خلقه في ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن
অর্থ, মুআয ইবনে জাবাল রাঃ থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাঃ ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে তথা শবে বরাতে) সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।
(সহীহ ইবনে হিব্বানঃ ১২/৪৮১ হাদীস নং-৫৬৬৫)
হাদীসটি আরো যে সব কিতাবে আছে।
ছহীহ আত তরগীব ওয়াত তারহীব লিল আলবনীঃ ১/২৪৮ হাদীস নং ১০২৬।
মুসনাদুল বাজ্জারঃ হাদীস নং ২৭৫৪।মুসনাদুশ শামীনঃ হাদীস নং ২০৩।
মুসন্নাফে ইবনে আবী শাইবাঃ হাদীস নং ৩০৪৭৯।
মুসনাদে ইসহাক বিন রাহওয়াইঃ হাদীস নং ১৭০২।
আল মুজামুল আওসাতঃ হাদীস নং ৬৭৭৬।
আল মুজামুল কাবীরঃ হাদীস নং ২১৫।
শুয়াবুল ঈমানঃ হাদীস নং৬২০৪।
হাদীসটি কি ছহীহ না যয়ীফ?
সম্মানীত দ্বীনি ভাইয়েরা আসুন এখন আমরা আলোচনা করবো হাদীসটি কি ছহীহ না যয়ীফ?
জুমহূরে মুহাদ্দিসীনে কিরামরে মত হলো, হাদীসটির সনদ সহীহ। এজন্যই ইমাম ইবনে হিব্বান রহঃ হাদীসটিকে তার ছহীহ হাদীসের কিতাবে বর্ণনা করেছেন। কেউ কেউ হাদীসটিকে পারিভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে হাসান বলেছেন। কিন্তু হাসান হাদীসও আমল যোগ্য।
ইমাম মনযিরী, ইবনে রজব, নূরুদ্দীন হাইসামী, কাস্তাল্লানী, যুরকানী এবং অন্যান্য হাদীস বিশারদগণও এই হাদীসটিকে আমলযোগ্য বলেছেন।
দেখুন আততারগীব ওয়াততারহীব ২/১৮৮, ৩/৪৫৯. লাতায়েফুল মাআরিফ ১৫১,
মাজমাউয যাওয়ায়েদঃ ৮/৬৫, رواه الطبراني في الكبير والأوسط ورجالهما ثقات ।
বর্তমান সময়ের প্রসিদ্ধ শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী রহঃ সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহা-এ এই হাদীসের সমর্থনে আরো কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করার পর বলেন:
وجملة القول أن الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح بلاريب. والصحة تثبت بأقل منها عددا، مادامت سالمة من الضعف الشديد، كماهو الشأن فى هذاالحديث
অর্থ, সারকথা হল এই যে, নিশ্চয় এই হাদিসটি এই সকল সূত্র পরম্পরা দ্বারা সহীহ, এতে কোন সন্দেহ নেই। আর সহীহ হওয়া এর থেকে কম সংখ্যক বর্ণনার দ্বারাও প্রমাণিত হয়ে যায়, যতক্ষণ না মারাত্মক কোন দুর্বলতা থেকে বেঁচে যায়, যেমন এই হাদিসটি হয়েছে।
(সিলসিলাতুল আহাদসিস সাহীহাঃ ৩/২১৮, ১১১৪ নং হাদীসের আলোচনায়)
তারপর আলবানী রহঃ ওই সব লোকের বক্তব্য খন্ডন করেন যারা কোন ধরণের তাহকীক ছাড়াই বলে দেন যে, শবে বরাতের ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস নেই।
আহলে হাদীসের ভাইয়েরা এখন কি বলবেন? নাসীর উদ্দীন আলবানী হাদীসটাকে ছহীহ বলার পরও কি এখনো বলবেন হাদীসটি ছহীহ না? শবে বরাতের কোন ফযীলত নাই?
সম্মানীত দ্বীনি ভাইয়েরা, যদি শবে বরাতের ফযীলতের ব্যাপারে এই হাদীস ছাড়া অন্য কোন হাদীস না থাকত, তাহলেও এই হাদীসটিই এ রাতের ফযীলত সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এবং এ রাতে মাগফেরাতের উপযোগী নেক আমলের গুরুত্ব প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট হত। অথচ হাদীসের কিতাবসমূহে নির্ভরযোগ্য সনদে এ বিষয়ক আরো একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
এই হাদীস বুঝা যায় যে, শবে বরাতে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফেরাতের দ্বারা ব্যপকভাবে উন্মুক্ত হয়। কিন্তু শিরকি কাজ-কর্মে লিপ্ত ব্যক্তি এবং অন্যের ব্যাপারে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী মানুষ এই ব্যপক রহমত ও সাধারণ ক্ষমা থেকেও বঞ্চিত থাকে।
একই ধরনের হাদীস সুনানে ইবনে মাজাতে আবূ মুসা আশআরী রাঃ থেকে কিছু শব্দের পরিবর্তনে অন্য সনদে বর্ণিত আছে । ইবনে মাযার হাদীস।
حدثنا راشد بن سعيد بن راشد الرملي . حدثنا الوليد عن ابن لهيعة عن الضحاك بن أيمن عن الضحاك بن عبد الرحمن بن عرزب عن أبي موسى الأشعري عن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال إن الله ليطلع في ليلة النصف من شعبان . فيغفر لجميع خلقه . إلا لمشرك أو مشاحن
(সুনানে ইবনে মাযাঃ ১/৪৪৫ হাদীস নং ১৩৯০)
হাদীসটি কি যয়ীফ?
আহলে হাদীস ভাইদের নয়নমণী শায়েখ নাসীর উদ্দীন আলবানী রহঃ তার রচিতগ্রন্থ ছহীহ ইবনে মাযাতে বলেন হাদীসটি হাসান।
(ছহীহ ইবনে মাযাঃ ১/২৩৩ হাদীস নং ১১৪০)
আরো যে সব কিতাবে হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
ছহীহ ওয়া যয়ীফ ইবনে মাযায় উল্লেখ আছে,
تحقيق الألباني حسن
অর্থাৎ, নাসীর উদ্দীন আলবানির গবেষনা অনুযায়ী হাদীসটির মান হাসান।
(ছহীহ ওয়া যয়ীফ ইবনে মাযায়ঃ ৩/৩৯০ হাদীস নং ১৩৯০)
ছহীহ জামেউস সগীরঃ ১/১৭০।
ছহীহুল জামে লিল আলবানীঃ ২/১৭০।
এছাড়াও তিনি আরো কিছু জায়গায় হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। আমরা সকলেই জানি যে হাসান হাদীস আমলযোগ্য।
এই হাদীস দ্বারাও প্রমানীত হয় যে, এই রাতে আল্লাহ তায়ালার রহমতের দ্বার উন্মুক্ত থাকে। অনেক গুনাহগারকে ক্ষমা করে দেন।
শবে বরার সম্পর্কে আহলে হাদীসের শায়েখ মোবারকপূরির অভিমত
আহলে হাদীসের উল্লেখযোগ্য ইমাম শায়েখ মুহাম্মদ আব্দুর রহমান ইবনে আব্দুর রহীম মুবারাকপূরী রহঃ শবে বরাত সম্পর্কে অনেকগুলো হাদীস উল্লেখ করার পর বলেন,
فهذه الأحاديث بمجموعها حجة على من زعم أنه لم يثبت في فضيلة ليلة النصف من شعبان شئ والله تعالى أعلم
অর্থ, এই সকল হাদীস সমষ্টিগতভাবে তাদের বিরুদ্ধে দলীল যারা বলে, লাইলাতুন নিছফে মিন শাবানের তথা শবে বরাতের কোন ফযীলত নাই।
অর্থাৎ, এই রাতের ফযীলত আছে। যারা বলে এই রাতের ফযীলত নাই তারা ভুলের উপর আছে।
(তহফাতুল আহওয়াযী শরহে তিরমিযীঃ ১/৪৬৯)
সম্মানীত দ্বীনি ভাইয়েরা, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের উলামায়ে কিরাম এই সব হাদীসকে সামনে রেখে বলে থাকেন, “লাইলাতুন নিছ্ফ মিন শাবান” তথা শবে বরাতে ইবাদত করা দেবয়াত নয়। বরং তা অনেক নেক কাজ। তবে সেখানে কোন ধরনের বেদয়াতের সুযোগ দেয়া হবে না। সে সব আলোচনা সামনে আসতেছে।
এই রাতে করনীয় আমল
আমরা উপরের আলোচনা থেকে বুজতে পারলাম যে, শবে বরাত অনেক ফযীলতের রাত। এই রাতে সবাইকে আল্লাহ তায়ালার ইবাদতে মাশগুল থাকতে হবে।
আসুন আমরা এখন আলোচনা করবো, এই রাতে আমরা কোন ধরনের আমল করতে পারি।
এই রাতে আমরা বেশী বেশী নফল নামায পড়বো।
হযরত আয়েশা রাঃ থেকে একটি হাদীস বর্ণিত আছে, রাসূল সাঃ এর এই রাতে বেশী বেশী নফল নামায পড়তেন। নামাযের অবস্থা অন্য নামায থেকে অনেক লম্বা হতো। আসুন আমরা প্রথমে সে হাদীসটি উল্লেখ করি।
ইমাম বাইহাকী রহঃ তার কিতাবে হাদীসটি উল্লেখ করেন।
হাদীসটি হলো,
أخبرنا أبو نصر بن قتادة أنا أبو منصور محمد بن أحمد بن الأزهري الهروي نا الحسين بن إدريس نا أبو عبيد الله ابن أخي ابن وهب نا عمي نا معاوية بن صالح عن العلاء بن الحارث أن عائشة قالت قام رسول الله صلى الله عليه و سلم من الليل يصلي فأطال السجود حتى ظننت أنه قد قبض فلما رأيت ذلك قمت حتى حركت إبهامه فتحرك فرجعت فلما رفع إلي رأسه من السجود و فرغ من صلاته قال : يا عائشة أو يا حميراء أظننت أن النبي قد خاس بك قلت : لا و الله يا رسول الله و لكنني ظننت أنك قبضت لطول سجودك فقال : أتدرين أي ليلة هذه ؟ قلت : الله و رسوله أعلم قال : هذه ليلة النصف من شعبان إن الله عز و جل يطلع على عباده في ليلة النصف من شعبان فيغفر للمستغفرين و يرحم المسترحمين و يؤخر أهل الحقد كما هم
অর্থ, হযরত আলা ইবনুল হারিস (রহঃ) থেকে বর্ণিত। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাঃ রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হল তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, ওহে আয়েশা অথবা বলেছেন, ওহে হুমাইরা, তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম,না,ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার এই আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। তখন নবী সাঃ জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসূলই ভাল জানেন। রাসূলুল্লাহ সাঃ তখন ইরশাদ করলেন, ‘এটা হল অর্ধ শাবানের রাত (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত তথা শবে বরাত)। আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।
ইমাম বাইহাকী (রহঃ) এই হাদীসটি বর্ণনা করার পর এর সনদের ব্যাপারে বলেন,
قلت : هذا مرسل جيد و يحتمل أن يكون العلا بن الحارث أخذه من مكحول و الله أعلم
অর্থ, আমি বলি এই হাদীসটি উত্তম মুরসাল।
(শুআবুল ঈমান লিল বাইহাকী ৩/৩৮২ হাদীস নং ৩৮৩৫, আদ দুয়া লিত তাবরানীঃ ১/১৯৪ হাদীস নং ৬০৬, )
আমরা সকলেই জানি নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের মুরসাল হাদীস দ্বারা দলীল দেয়া জায়েয আছে। তাই হাদীসটি মুরসাল হলেও আমলযোগ্য।
সম্মনীত দ্বীনি ভাইয়েরা,এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়, এ রাতে দীর্ঘ নফল নামায পড়া, যাতে সেজদাও দীর্ঘ হবে।
শবে বরাতে কি নির্দিষ্ট কোন নামায আছে?
আমদের সমাজে অনেক অনির্ভরযোগ্য বইপুস্তকে এই রাতের নামাযের যে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন লেখা আছে অর্থাৎ এত রাকআত হতে হবে, প্রতি রাকআতে এই সূরা এতবার পড়তে হবে এগুলো ঠিক নয়। হাদীস শরীফে এর কোন প্রমান নাই। এমন কি কোন ফাতওয়ার কিতাবেও এই বিষয়ে উল্লেখ নাই। এগুলো মানুষের মনগড়া বানানো ইবাদত ছাড়া আর কিছু নয়।
সঠিক পদ্ধতি হল, নফল নামাযের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী দুই রাকআত করে যত রাকআত সম্ভব হয় পড়তে থাকা। কুরআন কারীম তেলওয়াত করা। দরূদ শরীফ পড়া। ইস্তেগফার করা। দুআ করা এবং কিছুটা ঘুমের প্রয়োজন হলে ঘুমানো।
আবার অনেককে দেখা যায় রাত জেগে ইবাদত করে আর তাদের ফযরের নামায কাযা হয়ে যায়। আবার অনেক এমন আছেন, যারা ফযরের নামাযই পড়েন না।
তাই লক্ষ রাখতে হবে এমন যেন না হয় যে, সারা রাতের দীর্ঘ ইবাদতের ক্লান্তিতে ফজরের নামায জামাআতের সাথে পড়া সম্ভব হল না।
আমরা এই রাতে বেশী বেশী করে আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া চাইবো।
আমারা এই রাতে নফল নামাযের সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালার কাছে বেশী বেশী দোয়া করবো।
ইমাম শাফী রহঃ তার রচিতগ্রন্থ কিতাবুল উম-এ বলেন,
إن الدعاء يستجاب في خمس ليال في ليلة الجمعة و ليلة الأضحى و ليلة الفطر و أول ليلة من رجب و ليلة النصف من شعبان
অর্থ, নিশ্চয় পাঁচ রাতে দোয়া কবুল হয়। এক, জুমার রাত। দুই, কুরবানির ঈদের রাত। তিন, ঈদুল ফিতরের রাত। চার, রযব মাসের প্রথম রাত। এবং পাঁচ নম্বার রাত হলো লাইলাতুন নিছ্ফ মিন শাবান তথা শবে বরাতে।
(ইমাম শাফী রহঃ এর রচিতগ্রন্থ কিতাবুল উমঃ ১/২৬৪, আল-মাজমূ লিল ইমাম নববীঃ ৫/৪৩ , তলখীসুল হাবীর লিল ইবনে হযর আসকলানীঃ ৮/৬)
একই ধরনের কথা ইমাম বাইহাকী রহঃ তার রচিতগ্রন্থ শুআবুল ঈমান-এর ৩৭১১ হাদীস নং হাদীসের আলোচনায় উল্লেখ করেছেন ৩/৩৪১।
হযরত ইবনে ওমর রাঃ বলেন:
عن ابن عمر قال خمس ليال لا يرد فيهن الدعاء ليلة الجمعة و أول ليلة من رجب و ليلة النصف من شعبان و ليلتا العيد
অথর্, পাঁচ রাত এমন আছে যে সব রাতে দোয়া ফেরত দেয়া হয় না তথা দোয়া কবুল করা হয়। এক, জুমার রাত। দুই, রযব মাসের প্রথম রাত।তিন, লাইলাতুন নিছ্ফ মিন শাবান তথা শবে বরাতে। চার এবং পাঁচ নম্বার রাত হলো দুই ঈদের রাত।
(শুআবুল ঈমান লিল বাইহাকী ৩/৩৪২ , হাদীস নং ৩৭১৩)
এই সব বর্ণনা সামনে রেখে উলামাগণ বলে, এই রাতে বেশী বেশী আল্লাহর কাছে দোয়া করা । কারন, এই রাতে আল্লাহ তায়ালা দোয়া কবুল করেন। কারো দোয়া ফেরত দেন না। তাই সকলে আল্লাহ তায়ালার কাছে বেশী বেশী দোয়া করা, আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের সবাইকে মাফ করে জান্নাতীদের খাতায় নাম লিখান।
উল্লিখিত বিস্তারিত আলোচান থেকে এটাই প্রমানীত হয় যে, শবে বরাতের ফযীলত ছহীহ হাদীস দ্বারা প্রমানীত। রাসূল সাঃ এই রাতে বেশী বেশী নফল নামায পড়েছেন। তাই আমরাও এই রাতে বেশী বেশী নফল নামায পড়তে পারি। এই রাতে দোয়া কবুল হয়। তাই আমরা এই রাতে বেশী বেশী আল্লাহ তায়ালার কাছে আমাদের যে কোন প্রয়োজনের জন্য দোয়া করতে পারি। বেশী বেশী কুরআন তিলাওয়াত করতে পারি। আরো যত ধরনের নফল ইবাদত আছে আমরা সে সব ধরনের নফল ইবাদত এই রাতে করতে পারি।
এই রাতে কি কোন সম্মেলিত আমল আছে?
শেষ কথা হলো, আমাদের সমাজে দেখা যায় যে, কিছু এলাকায় শবে বরাতকে কেন্দ্র করে কিছু সংখ্যক লোক সম্মেলিত অমল করে থাকে। আমাদের এ বিষয়টি মনে রাখতে হবে যে, এ রাতের নফল আমলসমূহ, বিশুদ্ধ মতানুসারে একাকীভাবে করণীয়। এখানে কিছুতেই সম্মেলিতভাবে কিছু করার সুযোগ নাই।
এশার নামায তো অবশ্যই মসজিদে জামাতের সহিত আদায় করতে হবে। এরপর যা কিছু নফল পড়ার তা নিজ নিজ ঘরে একাকী পড়বে। এসব নফল আমলের জন্য দলে দলে একে অপরকে ডেকে ডেকে মসজিদে নিয়ে এসে সমবেত হওয়ার কোন প্রমাণ হাদীস শরীফেও নেই আর সাহাবায়ে কেরামরে যুগেও এর রেওয়াজ ছিল না।
(মারাকিল ফালাহ ২১৯)
অবে হ্যাঁ কোন আহবান ও ঘোষণা ছাড়া এমনিই কিছু লোক যদি মসজিদে এসে যায়, আর তারা সবাই নিজ নিজ আমলসমূহ একা একা আদায় করে তাহলে কোন সমস্যা নাই।
কোন কোন জায়গায় এই রেওয়াজ আছে যে, এ রাতে মাগরিব বা ইশার পর থেকেই ওয়াজ-নসীহত আরম্ভ হয়। আবার কোথাও ওয়াজের পর মিলাদ-মাহফিলের অনুষ্ঠান হয়। কোথাও তো সারা রাত খতমে-শবীনা হতে থাকে। উপরন্তু এসব কিছুই করা হয় মাইকে এবং বাইরের মাইকও ছেড়ে দেওয়া হয়। মনে রাখতে হবে, এসব কিছুই ভুল। তবে হ্যাঁ কেউ রাতে আমল করতে আসলে ইমাম সাহেবকে কিছু প্রশ্ন করলে ইমাম সাহেব সে বিষয়ে কিছু বললে তখন যদি তা শুনার জন্য কয়েক জন লোক একত্রিত হয়ে যায় তাতে কোন সমস্যা নাই।
শবে বরাতে বর্জনীয় কাজঃ
আমাদের শবে বরাতে সে সব কাজ বর্জন করতে হবে তা হলো,
এক, হালুয়া রুটির আয়োজন করা।
দুই, মসজিদে মসজিদে আলোকসজ্জা করা।
তিন, হিন্দুদের মত আতশবাজি পুটানো।
চার, দলবদ্ধ ইবাদতকে আবশ্যক মনে করে মসজিদে বা কোথাও একত্র হওয়া এবং এবাদত করা।
পাঁচ, মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা।
এবং ছয়, দলবদ্ধ হয়ে কবর যেয়ারত করা। শবে বরাতে রাসূল সাঃ এর কবর যেয়ারত করার যে হাদীসটি আছে তা যয়ীফ হাদীস। তাই এই রাতে বকর যেয়ারত করাকে আলাদা ফযীলতের মনে করে কবর যেয়ারত করা জায়েয হবে না।
সম্মানীত ভাইয়েরা, আসুন আমরা এই রাতে বাড়াবাড়ি এবং ছাড়াছাড়ি না করে সঠিক মতটা গ্রহন করে আল্লাহ তায়ার ইবাদতে মশগুল হই।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সঠিকভাবে যথাযথ মর্যাদায় শবে বরাতে সঠিক নিয়মে আমল করার তৌফিক দান করুন।
আমীন।
(বিঃদ্রঃ আরবদেশের আমল আমাদের জন্য দলিল না, উল্লেখিত হাদিসগুলোর মান যাচাই করে আমল করার আহবান করছি, অন্যরা কে কি বলল তা দেখার বিষয় নয়, কুরআন হাদিসই হোক আমাদের হাতিয়ার)
বিষয়: বিবিধ
২৯৯৬ বার পঠিত, ১৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সিষ্টেমের কথা তো বলিনাই, বলেছি এ রাতের আমলের গুরুত্বের কথা। ধন্যবাদ
আমরা জানি, বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থ ৬টি, এগুলোকে একসাথে ছিয়া ছিত্তা বলা হয়।
সহীহ বুখারী/বুখারী শরীফ
সহীহ্ মুসলীম/মুসলিম শরীফ
সুনানু নাসাঈ/নাসাঈ শরীফ
আবু দাউদ শরীফ/সুনানে আবু দাউদ
সহীহ আত্-তিরমিযী/তিরমিযী শরীফ
সুনানু ইবনে মাজাহ্/ইবনে মাজাহ শরীফ
সকল ইসলামি চিন্তাবীদগন এই ছয়টি গ্রন্থে উল্লেখিত হাদিস গুলোকে ছহি বলেছেন, এই ৬টির বাহিরে যতগুলো হাদিসের গ্রন্থ আছে সেগুলোর ব্যাপারে সন্দেহ পোষন করেছেন।সিহাহ্ সিত্তার বা বিশুদ্ধ ৬টি গ্রন্থের মধ্যে বুখারী ও মুসলিম সবচেয়ে বিশুদ্ধ যার ১টি হাদিস ও কেউ প্রমান করতে পারে নাই যেটি কুরআনের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু আপনি যে হাদিস গ্রন্থের নামগুলো উল্লেখ করেছেন তা ছিয়া ছিত্তার মধ্যে নাই!! যদিও আপনি "(সুনানে ইবনে মাযাঃ ১/৪৪৫ হাদীস নং ১৩৯০)" রেপারেন্স দিয়ে একটি হাদিসের উল্লেখ করেছেন কিন্তু ঐ হাদিসটার বাংলা তরজুমা করেন নি!!!!
আমার প্রশ্ন হলো, যদি শবে বরাত এতটাই আমলযোগ্য হতো, তাহলে কেন বুখারী শরিফ ও মুসলিম শরিফে আসলোনা? কেন ছিয়া ছিত্তার অন্য গ্রন্থ গুলোতেও আসলোনা??
আর এই রাতকে ভাগ্য রজনীর রাত বলা হয়, এই রাতেই নাকি মানুষের ভা্গ্য নিররধারিত হয়! আস্তাগফিরুল্লাহ!! যেটা টোটালি কোরান বিরোধী! কোরানে বলা হয়েছে মানুষকে দুনিয়াতে পাঠানোর আগেই তার ভাগ্যে কি আছে সব একটা সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এখানে প্রতিবছর নতুন করে ভাগ্য লিখার কোন প্রয়োজন আছে কি??
শবে বরাতের ব্যাপারে কোরানের কোনো দলিল নাই যেখানে শবে কদরের ব্যাপারে পুরা ছুরা নাযিল করা হয়েছে। ধন্যবাদ আপনাকে
প্রথমত আপনার উপরের চিন্তাটি সম্পূর্ণ ভূল, কোন ইসলামী চিন্তাবিধই একথা বলেননি যে, সিহাহ সিহাহ সিত্তাহ ব্যাতিত হাদিসের যত গ্রন্থ আছে সেগুলোর ব্যাপারে সন্দেহ পোষন করেছেন।
বরং সিহাহ সিত্তার মাঝেও অনেক দূর্বল ও জাল জাতিস আছে, সিহাহ সিত্তার বাইরেও হাজার হাজার সহীহ হাদিস আছে, যা কেবল একমাত্র হাদীস বিশারদগনই বলতে পারবেন।
আপনি বলেছেন এব্যপারে বোখরীতে কোন হাদিস নেই কেন? দেখুন নামাযে হাত বাঁধার হাত সহীহ বোখারী ও মুসলিমে নেই, তাই বলে কি হাত বাঁধা যাবে না? ইমাম বুখারীর ৬লক্ষ হাদিস মুখস্ত ছিল, বুখারীতে মাত্র তাকরার সহ ৭হাজার প্লাস হাদিস এনেছেন, বাকিগুলো কি হাদিস ছিলনা? তাহলে লিখলেন না কেন? সবই জাল?
ভাগ্য রজনী আমার লিখাতে নেই, আপনি কোত্থেকে বলেছেন আর মন মত ব্যখ্যা দিয়েছেন আপনিই ভালো জানেন।
গতকাল জুমআর খুৎবাহতে শবে বরাত বা অর্ধ শাবানের রাতের যে কোন নফল ইবাদাতের ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, বিশ্বাস না হলে http://www.awqaf.ae এই ওয়োবসাইটে গিয়ে ইংরেজী ভার্সনে দেখে আসতে পারেন।
আশা করি আপনার ভূল ভাঙ্গবে। অনেক অনেক শুকরিয়া, অস্পষ্ট কিছু ফেলে জানাবেন, পুণঃরায় ব্যখ্যা দেওয়া হবে ইন শা আল্লাহ।
এই গ্রন্থটি সম্পর্কে ইমাম শাফেই (রহ.) বলেছেন কুরআনের পরে সবচেয়ে বিশুদ্ধ গ্রন্থ। (তখনও বোখারী লেখা হয় নি)।
মুয়াত্তা মালেক বোখারী, মুসলিম এর মত শক্তিশালী।
উনি যুুক্তি দিয়ে কিছু বুঝাতে চেয়েছেন, যেমন "শব ফার্সি হলে বরাত ও ফার্সি হবে এটাই স্বাভাবিক"
আমরাতো রামাদানের বিশেশ রাতকে "শবে ক্বদর" বলি, তাই বলেকি ক্বদরও ফার্সি শব্দ হয়ে যাবে?
আসলে সবাই যে যার মত করে ব্যখ্যা দিচ্ছে, এটাই বাস্তব।
তাই আমি নিজের কোন মতামত না দিয়ে শুধু হাদিস উল্লেখ করে হাদিনের তাহকিক দিলাম।
আরো কিছু কথা সংক্ষেপে এখানে লিখেছি. দেখতে পারেন। Click this link
নফল ইবাদাত সারা জীবন না করলেও গুনাহ হবে না, অতিরিক্ত ছাওয়াব থেকে দূরে থাকা ছাড়া।
নিসফে শাবানে ইবাদাত নফল, তাই নফল হিসেবেই গন্য হতে দেওয়া চাই। একেবারে অস্বীকার করলে তো উল্লেখিত হাদিসগুলোর ব্যপারে কি উত্তর দেব।
তাই ছাওয়াবের আশায় নফল ইবাদাত করতে হবে, বিদআত ও বদ আমল অবশ্যই পরিত্যহ্য।
এ রাতে কি করা যাবে না এবং কি করতে হবে, কিভাবে করতে হবে, সে ব্যাপারে ছোট একটি লিখা আছে-Click this link পড়ে দেখতে পারেন, ভালো লাগবে। শুকরিয়া ভাই।
এখন এর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে যে মানুষগুলো অন্তত বছরে দুই ওয়াক্ত ফরজ পড়তো (এশা এবং ফজর) এখন সেটা পড়াও বাদ দিয়ে দিয়েছে।
যাক পর্দার আড়ালে আমাদের কার্যক্রমে শয়তানও দাঁত কেলিয়ে হাসছে।........
ইস! কত মানুষের অন্তত দুই ওয়াক্ত নামায ফউত হচ্ছে।
সুন্দর মতামতের জন্য শুকরিয়া
এখন এর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে যে মানুষগুলো অন্তত বছরে দুই ওয়াক্ত ফরজ পড়তো (এশা এবং ফজর) এখন সেটা পড়াও বাদ দিয়ে দিয়েছে।
যাক পর্দার আড়ালে আমাদের কার্যক্রমে শয়তানও দাঁত কেলিয়ে হাসছে।........
ইস! কত মানুষের অন্তত দুই ওয়াক্ত নামায ফউত হচ্ছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন