যাযাবর থেকে হিরার টুকরো
লিখেছেন লিখেছেন আবু জান্নাত ৩০ নভেম্বর, ২০১৫, ০২:৩৫:৩৩ দুপুর
আগামী ২রা ডিসেম্বর ইউনাইটেড আরব আমিরাতের ৪৪তম ন্যশনাল ডে।
১৯৭১সালের এই দিনে ইউনাইটেড আরব আমিরাত নামক দেশটির আত্ম প্রকাশ হয়। এর আগে এই নামে কোন দেশ পৃথিবীর মানচিত্রে ছিল না।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ৭১ সালের আগে কেমন ছিলঃ
মরুভূমির এক যাযাবর এলাকা। যেখানে ৭টি জমিদারী শাষন প্রতিষ্ঠিত ছিল। যথা আবুধাবী, দুবাই, শারজাহ, আজমান, উম্মুল কায়উইন, রাস আল খাইমা, ফুজায়রাহ। এই ৭টি এলাকা ৭জমিদার (আমির) শাষণ করতেন। আবুধাবীতে উল্লেখযোগ্য জমিদার ছিলের নাহিয়ানের গোষ্ঠি, যারা মূলত ইয়েমেনের বাসিন্দা। দুবাইতে ছিলেন মাকতুম গোষ্ঠি, যারা ইরানের বাসিন্দা।
ইয়েমেনের বাসিন্দরা আবুধাবী এলাকায় উট পালন ও খেজুরের চাষ করার জন্য এখানে বসতি স্থাপন করে। নৌকা বানানো, খেজুরের ছট তৈরী করা, উট, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা পালন ও গাল্ফ সাগরে মাছ শিকার করা ছিল এদের প্রধান কাজ ও আয়ের উৎস।
এখানে শহর বলতে ছিল একমাত্র দুবাই। দুবাই এর কর্তৃত্ত ছিল ইরানীদের হাতে। প্রায় ৩হাজার বছরের পুরোনো বানিজ্য কেন্দ্র হিসেবে দুবাইয়ের প্রশিদ্ধি ছিল যুগ যুগ ধরে, কিন্তু দেশ হিসেবে নয়। শুধু বন্দর ও বানিজ্য এলাকা হিসেবে ব্যবহৃত হত এটি। আরব, পারস্য ও ভারত উপমহাদেশ সহ দক্ষিন এশিয়ার প্রাচিন ব্যবসার কেন্দ্রস্থল ছিল দুবাই (বর্তমানে বিশ্ব বানিজ্যিক কেন্দ্র বলা চলে)।
এদেশে আগে প্রায় সব দেশেরে মুদ্রার প্রচলন ছিল। বিশেষ করে মিশর, সৌদি ও ভারতের রুপি। আবুধাবী মেরিনা জাদুঘরে গেলে এর কিছুটা অনুমান পাওয়া যায়।
সংক্ষেপে বলছি: ১৯৭১ সালের এই দিনে আবুধাবীর প্রধান শেখ ও জমিদার শেখ জায়েদ এর এক মহতি প্রচেষ্টা ও উদ্যেগে এই সাতটি জমিদারী এলাকার সাত আমির (জমিদার) এক হয়ে একটি রাষ্ট্র গঠনের নিমিত্বে গুরুত্বপূর্ণ এক বৈঠকে মিলিত হন।
সেখানে তুলে ধরা হয়, একতা ও ঐক্যের সুফল। এই ঐক্যের ঘোর বিরোধী ছিলেন ততকালিন ইরান সরকার। কারণ তাদের কর্তৃত্ব এখানে আর টিকবে না। অনেক ছড়াই উৎরাই পার হয়ে শেষ পর্যন্ত দেশ গঠনের প্রক্রিয়াটি জয়ী হল।
তারই ধারাবাহিকতায় গঠিত হয় ইউনাইটেড (সংযুক্ত)। আমিরাত শব্দটি আমির (জমিদার) থেকে উদ্ভুত। ভাষা ও বংশগত দিক থেকে এরা আগ থেকেই আরব ছিলেন। সব মিলিয়ে তৈরী হল সংযুক্ত আরব আমিরাত।
আর ঠেকায় কে? যাযাবর থেকে হিরো হতে বেশিদিন লাগেনি। আল্লাহ প্রদত্ত তেলের ভান্ডার তাদের জন্য উন্মুক্ত হল। সত্যিই যারা আল্লাহর পথে পরিপূর্ণভাবে চলতে চায়, তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালা পথ প্রসস্থ করে দেন।
হাটি হাটি পা পা করে এই দেশটি ৪৪ বছর অতিক্রম করতে যাচ্ছে। বর্তমানে এরা জীবনের মান ও অার্থিক দিক দিয়ে পৃথিবীর দ্বিতীয় স্থানে আছেন।
কি হয় এদের ন্যশনাল ডে তে?
অফিস আদালত সহ সরকারী ও বেসরকারী সকল প্রতিষ্ঠানে ছুটি থাকে। আনন্দের জোয়ারে ভাসে পুরো আমিরাত বাসী। আরবরা সেদিন আজমীদের সাথে এমন ভাবে মিশে একাকার হয়ে যায়, যেন সারা পৃথিবীর মানুষগুলো আরবদেরই একজন।
গরীব মিসকিনদের জন্য বিভিন্ন খাবার বিতরণ থেকে শুরু করে দান সাদাকাহ পর্যাপ্ত পরিমানে করে। পুরো দেশ যেন জাতীয় পতাকার রঙ্গে রাঙ্গিয়ে যায়।
প্রতিটি প্রাসাদ যেন একএকটি জাতিয় মিনার। ২০, ২৫ তলা টাওয়ারগুলোতে এলইডি লাইট দিয়ে সাজানো হয় জাতিয় পতাকা।
আবরদের ঐতিহাসিক গান নাচ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।
সেনাবাহীনির কুচকাওয়াজ ও বিমান বাহিনীর আকাশ মহড়া ও নৌবাহীনির দেখার মত বহর সাজিয়ে পুরো দেশ কাঁপিয়ে তুলে।
সাধারণ আরবরা নিজেদের গাড়ি সাজিয়ে শহর এলাকাগুলো মাতিয়ে রাখে।
গাড়ী সাজানো বিভিন্ন নিয়ম অনুযায়ী করা হয়।
মরুভুমিতে চলে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগীত।
বড় বড় শায়েখরাও যার যার অবস্থান থেকে আনন্দে মেতে উঠে
ছেলেমেয়ারা পিছিয়ে নেই, তারাও আনন্দে আত্মহারা।
খারেজী মানে অন্যান্য দেশের মানুষরাও এ আনন্দ থেকে বাদ যায় না। প্রতিটি দোকানে মাসাধিক সময় পর্যন্ত ঝুলতে থাকে জাতিয় পতাকা। কিছু অসাধু বাঙ্গালী এই ফাঁকে বিভিন্ন ব্যবসায় মেতে উঠে, যেমন পথেঘাটে বেলুন বিক্রি, বিভিন্ন রঙ্গের স্প্রে সহ ফটকা ও আতশ বাজি বিক্রি করে। শুধু এই দিনের জন্য পুলিশ তাদের প্রতি তেমন একটা কঠোরতা দেখায় না। ধরপাকড় করলেও কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দেয়।
মাত্র একদিনের আনন্দে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতায় বিশ্বের চতুর্থ স্থানে থাকা শহরটিকে গুলশান বনানীর মত ময়লাযুক্ত করে ছাড়ে। অবশ্যই পরের দিন অপারেশন ক্লিনহার্ট দ্বারা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়।
ন্যশলান ডে' নিয়ে ছোট ভিডিও ক্লিপটি দেখতে পারেন।
এতো আনন্দের মাঝেও এবারের আনন্দে কিছুটা মলিনতার ছোঁয়া থাকবে। তা হলঃ ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী শিয়াদের দমনে জি.সি.সির অনেক সৈন্য খোয়া যাওয়া।
এতে আমিরাতের শতাধিক সৈন্য প্রাণ হারিয়েছেন। তাই আমিরাত সরকার এই এবছর থেকে ৩০ নভেম্বরকে জাতীয় শহীদ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রতি বছরই শহীদদের স্বরণে দান, সাদাকাহ, রুহের মাগফেরাত কামনা সহ বিভিন্ন আয়োজন করা হবে।
প্রতিটি জুম'আর খুৎবায় যাদের নাম উল্যেখ করে দোয়া করা হয়, তারা হলেন শেখ যায়েদ, শেখ মাকতুম। অতপর প্রেসিডেন্ট, গভর্ণরসহ সারাবিশ্বের মুসলিমদের জন্য বিশেষ প্রার্থনা। ইতিমধ্যে শহীদদের জন্য বিশেষভাবে খোৎবায় দোয়া করা হয়।
শহীদ দিবস ভিডিওতে সংক্ষেপে দেখার জন্য শর্ট ক্লিপটি দেখতে পারেন।
যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের সন্তানদের আজীবন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাখা হবে। সেনাবাহীনির মেজর জেনারেল ও আবুধাবীর প্রিন্স শেখ মুহাম্মাদ বিন যায়েদ প্রতিটি শহিদ পরিবারের জিম্মাদারী নিয়েছেন। নিজের সন্তানদের মত শহীদদের সন্তানদেরও যেন কোন প্রকারের মায়া মততা, শিক্ষ, চিকিৎসা, আর্থিক দিক দিয়ে ভাটা না পড়ে।
এই ক্লিপে শেখ মুহাম্মদ বিন যায়েদ শহীদের সন্তানদের খোজ নিচ্ছেন।
দুবাইয়ের শাইখ শহীদ পরিবারের সাথে
অন্যান্য শাইখগন শহীদ পরিবারের সাথে
আল্লাহ তায়ালা শহীদদের কবুল করুক। এই দেশকে ইসলামী সংস্কৃতির উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুক। পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ও দলাদলি সহ নোংরা গনতন্ত্র থেকে হেফাজত করুক।
বিষয়: বিবিধ
২২৭২ বার পঠিত, ২৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বিস্তারীত জানার জন্য কিছু লিংক দিলাম। আশাকরি বিস্তারীত জানতে পারবেন।
Click this link
Click this link
এই লিংক এ গিয়ে আবুধাবী শহরটি খুব কাছ থেকে দেখতে পারবেন।
Click this link
শারজাহ সম্পর্কে জানতে এখানে।
Click this link
আপনাকেও আল্লাহ তায়ালা উত্তম বিনিময় দান করুক।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
আপনাকেও আল্লাহ তায়ালা উত্তম বিনিময় দান করুক। শুকরিয়া।
তাই এদেশে মুসলিমদের জন্য যেমন মনেমুগ্ধকর অগনিত মসজিদ তৈরী করেছেন। তেমনি খৃষ্টানদের জন্য চার্চ/কানিচা তৈরীর অনুমোদন দিয়েছেন। গত কিছু দিন আগে নরেন্দ্র মোদির আগমনে মন্দির তৈরীর ও অনুমোদন দিয়েছেন।
যদিও সমালোচকদের উর্ধে কেউ নন। তবুও তাদের উদার নীতি এখনও বহাল। এদেশে অনেক হোটেলের অনুমোদন আছে, শেরাটন, হিলটন, মার্কারী, নভোটেল থেকে শুরু করে হাজার হাজার হোটেল বিদ্যমান। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোথাও পতিতার অনুমোদন নেই, যদিও গোপনে নোংরা লোকেরা এসব করে যাচ্ছে।
এদেশে মদ পান করতে হলে সরকার থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। বিশেষ করে ইউরোপিয়ান ও আমেরিকানদের সহজেই লাইসেন্স মিলে। তাদের জন্য ঝলমলে নর্তকী ও বার তৈরী করা আছে। কিন্তু কোন মুসলিম মদ পানের লাইসেন্স পেয়েছে এমন রেকর্ড নেই।
আইনের তোয়াক্কা না করে যারা সেচ্ছায় এগুলো করে যাচ্ছে, তাদেরকেও মাঝে মাঝে আইনের আওতায় আনা হয়। তবে একটি কথা হলঃ গ্লোবালাইজেশনের এ যুগে সবসময় এ ব্যপারে কঠোরতা করে না।
এগিয়ে যাওয়ার কারণ: তাদের মাঝে আছে আল্লাহ ভীতি, তাক্বওয়া, হারাম হালালের ভেদাভেদ, জুলুম ইনসাফের তফাৎ, আমানত ও দিয়ানাত, নীতি ও নৈতিকতা।
দূর্নীতির লেশমাত্র নেই কোন সরকারী ও বেসরকারী আমলাদের মাঝে, এমনকি সাধারণ মানুষের মাঝেও আছে উপরোল্লেখিত গুনগুলো।
আরো একটি কথা জেনেছি যে, ইউনাইটেড হওয়ার পূর্বে ডুবাই যার দখলে ছিল, তার নাকি দুই পুত্র ছিল। একজনের নাম বার, অন্যজনের নাম দেইরা।
ডুবাই শহরের মধ্য দিয়ে যে নদীটি মরুভূমির দিকে (বর্তমানে ডন টাউন পর্যন্ত) বয়ে গেছে, তাদের পিতার মৃত্যুর সময় দুই ছেলেকে নদীর দুই কুলের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সেখান থেকে আজো ডুবাইয়ের পুরাতন ও মূল শহরের দুই অংশের নাম বার দুবাই ও দেইরা দুবাই।
দুবাই শব্দটির পেছনেও রয়েছে আরেক ইতিহাস। কারো মতে এটা এক ব্যক্তি বিশেষের নাম, কারো মতে দুবা শব্দ থেকে এসেছে, ইউনানী ভাষায় নাকি দুবা অর্থ সম্পদে পরিপূর্ণ। ইউনানরা যখন ব্যবসার মালসামানা নিয়ে এখানে আসে, তখন দেখলেন যে ওদের ব্যবসাকেন্দ্র থেকেও এখানে অনেক গুন মালসামানা বেশি, তাই অবাক হয়ে বলেছিলেনঃ দুবা দুবা। কালের আবর্তে নাম ধারন করেছে দুবাই।
ধন্যবাদ
চমৎকার ইতিহাস নির্ভর পোস্টটির জন্য আন্তরিক শুকরিয়া।
জাযাকাল্লাহু খাইর।
মূল্যয়নপূর্ণ সুন্দর মতামতের জন্য অনেক অনেক শুকরিয়া।
জাযাকিল্লাহ খাইর।
আপনাকেও অনেক অনেক শুকরয়িা ভাই।
আসলে এ লেখায় অনেক সত্যকে গোপন করা হয়েছে। আপনি খোচা না দিলেও আমার জানা আছে। কিন্তু আমি এখানে আরবদের জীবনাদর্শ তুলে ধরার চেয়ে একটি দিবসতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র।
অনেক অনেক শুকরিয়া।
মন্তব্য করতে লগইন করুন