জীবন সংগ্রাম
লিখেছেন লিখেছেন আবু জান্নাত ০৪ মে, ২০১৫, ১১:৩৪:২৬ রাত
মুমতাহিনা প্রাইমারী শেষ করেছে মাত্র, বাৎসরিক ছুটিতে বাবা মায়ের সাথে বেড়াতে যাচ্ছে। সাথে দু'বছরের ছোট দুটি জমজ ভাই সায়েম ও সাজিদ, সবে মাত্র মোটামুটি হাটতে শিখেছে। এক মুহুর্তও মায়ের কাছে বসে থাকতে চায় না, সারাক্ষণ তরতর করে বাড়ীর আঙ্গিনায় ঘুরে বেড়ায়।
ভোলায় নানার বাড়ীর উদ্দেশ্যে রাওয়ানা হল। মুমতাহিনা দুই ভাইকে নিয়ে স্টীমারের ছাদে উঠলো, একব্যক্তি সেখানে ছেলেদের খেলনা বিক্রি করছে, দুই ভাইকে দুটি কাগুজে বানানো বাতাসে ঘুরা ফ্যান কিনে দিল। মাঝনদীতে স্টীমারের ছাদে বসে তিন ভাইবোন মিলে বাতাসে ফ্যানগুলো উঁচিয়ে ধরেছে, নিরবধি ফ্যানগুলো ঘুরে যাচ্ছে, ভাইদের সে কি আনন্দ।
হঠাৎ ঝড়ে স্টীমারটি ডুবে যেতে লাগলো, বাবা মা তাদের সন্তানদের খুজতে লাগলো, একবার বাইরে বেরিয়ে এসেও পুণঃরায় ভিতরে চলে গেলেন সন্তানরা ভিতরে রয়েছে ভেবে। মা বাবাকে আর ফিরতে দেয়নি মেঘনার পানি। জীবন তরী চিরতরে নিভে গেল। এদিকে তিন ভাইবোন যে মুহুর্তে ডুবতে যাচ্ছে, ঠিক সেই মুহুর্তে মাছ আহোরণকারী একটি ট্রলার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে তিন শিশুকেই জীবিত উদ্ধার করলেন।
মাঝিওয়ালা তাদেরকে নিজ বাড়ীতে নিয়ে যেতে চাইলেন, কিন্তু মুমতাহিনা চাচা ও দাদীর কাছে ফিরতে চান বলে রাজি হলো না। পরের ফিরতি স্টিমারে তাদেরকে ঢাকায় তাদের বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে মাঝি বিদায় নিলেন। এক ভদ্রলোক অসহায় বাচ্চাদের বাড়ী পর্যন্ত পৌছানোর দায়িত্ব নিলেন, বাড়ীতে এসে চাচার হাতে তাদের তুলে দিলেন।
অসুস্থ চাচা তাদের ভরণপোষনে হিমশিম খাচ্ছিলেন তাই কয়েকমাস পর মুমতাহিনাকে বললেনঃ তুই যদি সাহেবদের ঘরে ঝিঁয়ের কাজ করিস তাহলে আমার কিছুটা সহজ হবে। অসহায় মুমতাহিনা লিখাপড়া ছেড়ে ভাইদের জন্য কাজে লেগে গেল। বাবার রেখে যাওয়া একমাত্র ঘরটিই তাদের ভরসা।
মুমতাহিনা সকালে ভাইদের খাওয়া দাওয়া করিয়ে দাদির কাছে রেখে যায়। বিকালে তাড়াতাড়ি এসে ভাইদের কপালে চুমু দিয়ে বুকে টেনে নেয়। গোসল করিয়ে সকালের পাকানো খাবার খেয়ে ভাইদের নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এভাবেই চলছিল মুমতাহিনাদের জীবন। দেখতে দেখতে ছয় বছরে পা রাখলো সায়েম ও সাজিদ। পার্শের বাড়ীর এক শিক্ষকের সহায়তায় মুমতাহিনা ভাইদেরকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়।
ঝিঁয়ের কাজ করে যে কয়টি টাকা পায় তা দিয়ে শিক্ষার খরচসহ আর চলছেনা, তাই গার্মেন্টস এ চাকরি নিল। প্রতিদিন ডিউটিতে দেরিতে যাওয়া ও তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফেরার বিষয়টি সদ্যনিয়োগপ্রাপ্ত ম্যানেজারের চোখ এড়ায়নি। একদিন ম্যানেজার মুমতাহিনাকে নিজের রুমে ডেকে জিজ্ঞেস করলোঃ আচ্ছা তুমি প্রতিদিন দেরিতে এসো আবার তাড়াতাড়ি বাড়ী ফের কেন? বাড়তি সময় কাজ করলে তো তুমি কিছু টাকা বেশী পেতে।
অঝোরধরায় মুমতাহিনার চোখে বর্ষণ শুরু হয়ে গেল কিন্তু কোন জবাব দিতে পারে নি। পরেরদিন ম্যানেজার একই প্রশ্ন করলো। আজ মুমতাহিনা নিজেকে শক্ত করে বাবা মায়ের করুন কাহিনী ও ভাইদের অবস্থা শোনালেন। তাতে ম্যানেজারের অন্তর সদয় হলো ও মুমতাহিনাদের প্রতি ভাললাগা জন্ম হল। কয়েকদিন পর ম্যানেজার মুমতাহিনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন।
মুমতাহিনা সোজা উত্তর করলোঃ আমার ভাইদের ছেড়ে আমি আপনার বাড়িতে যেতে পারবো না। তাছাড়া বিয়ের পর আমি যদি আপনার সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমার ভাই সায়েম ও সাজিদের কি হবে? না না না আমি পারবো না। অতঃপর অস্রু সিক্ত করেই আজকের জন্য বিদায় নেয় মুমতাহেনা।
সাপ্তাহ খানেক পর ছুটির দিনে ম্যানেজার আব্দুর রশীদ নতুন নতুন জামাকাপড়, শাড়ী ও বিভিন্ন ফলমুল নিয়ে মুমহাতিনাদের আঙ্গিনায় উপস্থিত। মুমতাহিনা তো দেখে হতভাগ। ম্যানেজার সাহেব আমাদের বাড়িতে আসলেন অথচ কোন খবর পাঠালেন না। লজ্জিত মুমতাহিনা নিজের ওড়না দিয়ে চেয়ার মুছে আব্দুর রশীদ সাহেব কে বসতে দিলেন। ছোট দুই ভাইকে পাশ্বের দোকান থেকে ফ্লাক্সে করে চা ও বিস্কুট আনতে বললেন।
সায়েম ও সাজিদ দুইভাই বার বার আপুকে প্রশ্ন করেই যাচ্ছেঃ উনি কে আপু? মুমতাহিনা বললো পরে বলছি, আগে তাড়াতাড়ি নাস্তা নিয়ে আয়। দূর থেকে আব্দুর রশীদ সাহেব বললেনঃ আমি তোমাদের বড় ভাইয়া (রশীদ ভাইয়া)। দুই ভাইকে দেখেতো ম্যানেজার আব্দুর রশীদ পাগলপ্রায় হয়ে গেলেন, ইস! কি সুন্দর সুন্দর দুটি বাচ্চা রেখে মা বাবা বিদায় নিলেন।
চলবে.......
সাইয়ারার সৌজন্যে......
বিষয়: বিবিধ
১৪৪৫ বার পঠিত, ৩৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আর কিছু বলতে পারছি না ভাইয়া
জয়ের জন্য দৃষ্টিভঙ্গি অনেক গুরুত্বপূর্ণ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা আমরা দ্বীনের উপর থেকে সংগ্রামে যেন জয়ী হতে পারি।
জীবন সংগ্রাম যে কত কঠিন, পাঠক/পাঠিকাদের একটু অনুধাবন করার জন্যই ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র। অসহায় ও দরিদ্ররা নেটদুনিয়া থেকে অনেক অনেক দুরে, ধনীর দুলালীরাই কেবল এ জগতে বেশী, তাই গরীব ও অসহায়দের কথা স্বরণ করিয়ে দিয়ে মহান প্রভূর শোকরীয়া যাতে করতে পারে এটাই চাওয়া। আপনার কষ্ট হচ্ছে জেনে আমি অত্যান্ত দুঃখিত খালাম্মুনি। অনেক অনেক শুকরিয়া আঙ্কেলের উপর অভিমান করার জন্য।
আপনার লিখা দেখে বাংলায় মন্তব্য করার সুবিধা না থাকা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে ইংলিশে করেছি। ভুল বুঝাবুঝি নিরসনে তাও উল্লেখ করেছি আমার মন্তব্যে। আশাকরি কষ্ট নিবেন না বা অকারণে ভুল বুঝবেন না। গুরুত্বপূর্ণ লিখাটির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
মুমতাহিনার গল্প সাইয়ারার জন্য
জোসনা রাতে মুগ্ধ কেনো আমার এ নয়ন।
ম্মৃতি থেকে টাইপ করা- মূল ইমন জুবায়ের . . . . . . .
চলতে থাকুক!
সুন্দর লিখেছেন
ধন্যবাদ।
পড়লাম এবং আবারো উপলব্ধি করলাম আমাদের সমাজে এরকম মুমতাহিনাদের মতো বড় বোনদের অস্তিত্ব আছে বলেই অনেক পরিবার সামনে এগিয়ে যেতে পারে! জীবন মানেই সংগ্রাম! এই সংগ্রামী জীবনে নারী -পুরুষ সবাই যোদ্ধা! প্রয়োজন এবং পরিস্থিতির তারতম্যে সবাইকে মেধা এবং যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে হয় অন্তত বাসনা রাখতে হয়!
চমৎকার লিখা এবং সবার প্রিয় ছোট আপুটিকে উৎসর্গ করা দুটোই প্রচন্ড ভালোলাগাকে দোলা দিয়ে গেলো!
শুকরিয়া
মনের মত কথা বলেছেন আপু। আপনাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও সালাম। দোয়ার অনুরোধ রইল।
শেষের অংশটা লেখার দায়িত্ব আমার উপরে থাকলে আমি ম্যনেজারের আগমনে মধ্যেই গল্পের যবনিকার চেষ্টা করতাম, পাঠককে বেশী কষ্ট দিয়ে লাভ কি! ইতোমধ্যে 'আফরা' জানিয়েছেন, তিনি কেঁদেকুটে অস্থির!
গল্পকার ভাইকে অনেক ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন