মরুর বুকে মাথা গোঁজার ঠাই -৪
লিখেছেন লিখেছেন আবু জান্নাত ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ১১:৩৩:১০ রাত
লাভাজেট কোম্পানী। আবুধাবী ক্লিনার কোম্পানীগুলোর মধ্যে সমচেয়ে বড় ও প্রসিদ্ধ কোম্পানী, এই কোম্পানীতে প্রায় ২৫ হাজার বাঙ্গালী কাজ করে, এদের ডিইটি ১২ঘন্টা করে, ২৪ ঘন্টা এরা পুরা শহর এলাকা ও আবাসিক এলাকায় ডিউটি করে, এই কোম্পানীই কেবল শ্রমিকদের ৬শ দিরহাম বেতন দেয়, বাঙ্গালী সুপার ভাইজারদের বেতন ১৫শ দিরহাম। ভারতীয় ও পাকিস্তানি সুপার ভাইজার দের বেতন ২ থেকে আড়াই হাজার। যারা এ কোম্পানির অফিসিয়াল ম্যান, বাঙ্গালী হলে ২ হাজার, ভারতীয় বা পাকিস্থানী হলে ৩ থেকে ৫ হাজার। ক্লিনার কিন্তু সবাই বাংলাদেশী, কারণ মাত্র ৬শ দিরহামে আমিরাতে আর কোন 'যব' নেই। একমাত্র সাধারণ মানুষের দয়ায় এরা বেচে আছে, ২য় পর্বে এ বিষয়ে আলোচনা করেছি।
সারাদিন এরা বাস্কেট ঝাড়ু দেওয়ার ব্রাশ ও বেলচা নিয়ে সড়ক ও অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে কর্তব্য পালন করে। গমরকালে এদের দেখলে অনেক মায়া হয়, কারণ সবাই এসির বাতাসে নিমগ্ন, কিন্তু এই হতভাগাগুলো ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রি অগ্নিতাপের মধ্যেও জীবন সংগ্রাম করে বেড়ায়, যেখানে আমাদের দুপুরে অফিস থেকে রুমে ফিরতে মাত্র ১৫ মিনিটে চামড়া জ্বলে যায়, সেখানে ক্লিনার ভাইদের অবস্থা বুঝা বড় দায়। ময়লায় যখন নিজের বাস্কেট ভর্তি হয়ে যায় তখন বড় টাংকির মধ্যে ফেলতে হয়।
বড় টাংকি ভর্তি হলে বড় ট্যাংকার লরি এগুলো নিয়ে যায়, শহর থেকে ১০০ কিঃমিঃ দূরে এসকল ময়লা আবর্জনা প্রক্রিয়াজাত করে সার বানানো হয়, অতঃপর খেজুর বাগানের জন্য জৈব সার হিসাবে বিক্রয় করা হয়।
কোম্পানীর কর্ণধারগণ বিলিয়ার হলেও বাংলাদেশী শ্রমিকরা অবহেলিত, শুক্রবার তো দূরে থাক ঈদের ছুটিও এদের নসীবে জুটে না। হাফ লিটারের পানির বতল এদের নিত্য সঙ্গি, পানি পুরিয়ে গেলে আশপাশের মসজিদের কুলার থেকে ঠান্ডা পানি সংগ্রহ করে। নামাজের সময় মসজিদের বাথরুম ছাড়া এদের ভাগ্যে প্রাকৃতিক কর্ম সারারও কোন ব্যাবস্থা নেই। রেস্টুরেন্টে গেলেও আগে কিছু খেতে হয়, অতঃপর কর্ম সারার অনুমতি।
এবার আসা যাক যারা অফিসে কাজ করে তাদের কি হালাতঃ
বাংলাদেশীরা সব জায়গাতেই অবহেলিত, কারণ বাঙ্গালিরাই বাঙ্গালীদের মূল্যায়ন করে না। বাঙ্গালী কোম্পানী একজন সিভিল ইঞ্জিয়ারকে বেতন দেয় মাত্র ১৫শ থেকে ২ হাজার, অথচ এই ইঞ্জিয়ার অন্য কোন কোম্পানিতে গেলে সর্বনিম্ন বেতন হবে ৫হাজার, কিন্তু বাঙ্গালী কোম্পানী তাকে তো কেন্সেল করবেই না, কেন্সেল চাইলে ডাইরেক্ট বিমানে উঠিয়ে চিরতরে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। যারা অন্যান্য কোম্পানীর অফিসে চাকরী করে তাদের একই পজিশনের অন্য কান্ট্রির লোক থেকে অর্ধেক অথবা এক তৃতীয়াংশ বেতন হয়, কারণ একটাই যে, এরা বাংলাদেশী। এনেক সময় পরিস্থিতি এমন দাড়ায় যে নিজেকে বাঙ্গালী বলে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করি। কি যে আমাদের অপরাধ, কেন যে বাংলাদেশে জন্ম নিলাম। আমি মাঝে মাঝে কল্পনা করি, জন্ম যদি নিজের ইচ্ছায় হওয়া যেত, আমি অন্য যে দেশে হোক, অন্তত বাংলাদেশে জন্ম নিতাম না। অনেক আরবী আছে যারা নিজের ছেলেদের অন্যায়ের জন্য "বাঙ্গালী" বলে গালি দেয়।
বাঙ্গালীরা হাতে গোনা কয়জন অফিস আদালতে কাজ করলেও উচু পদে নেই বললেই চলে, হয়তো পিয়ন, মেসেঞ্জার, ক্লিনার, অফিস বয়, অথবা কেরাণী পদে। বড় ও প্রশিদ্ধ কোম্পানীগুলোতে সামান্য কয়জন বাঙ্গালী ভালো পজিশনে আছেন যেমন ইঞ্জিনিয়ার, ম্যনেজার, সুপারভাইজার, হিসাব রক্ষক ইত্যাদি, এদের সংখ্যা বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর মত। ১শ কোম্পানীতে খোঁজ করলে হয়তো দু-একজন পাওয়া যাবে। মিশরীয় কোম্পানীগুলোতে বাংলাদেশীদের চাহিদা অনেক বেশী, কারণ বাঙ্গালীদের অল্প বেতনে বেশী খাটানো যায়, ৩-৪ বছর পরপর ছুটিতে যায়।
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১১২৭ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জনের প্রতি দয়ামায়াহীন। পারলে ঠকায়।
আমরা যদি সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করতে পারি তা হলে হয়তো এই শ্রমিক দের মানবিক অধিকারটুকু আদায় করে নিতে পারতাম।
মন্তব্য করতে লগইন করুন