প্রবাসী জীবন, মা তোমায় মনে পড়ে। পর্ব-৩
লিখেছেন লিখেছেন আবু জান্নাত ১০ আগস্ট, ২০১৪, ১১:৩৮:৪৭ রাত
দুপুর ১২টা, আবুধাবী শহরে টেক্সী থেকে নামলাম, সাথে সাথে চোখ মুখ জ্বালা আরম্ভ করল, হাত দিয়ে মুছতে লাগলাম, আফসার ভাই বললেন আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে, নতুন নতুন এমনই হয়। দিনটি ছিল ১০ জুলাই ২০১১ইং, বুঝতেই পারছেন জুলাইয়ের গরম, আবার মরুভুমির দেশ। আমার স্পন্সরকে ফোন দিলাম : আহলান কেইফ হা'লাক ? যেইন ? বাবা মামা কেইফ ? কুল্লু তামাম ?: তেমন আরবী জানতামনা তখন, কেবল বললাম আলহামদুলিল্লাহ তায়্যিব, তিনি বললেন বা'দাল মাগরিত তা'আল মাকতাব, মাগরিবের পর অফিসে আসলে বললেন। অতপর আফসার ভাইদের রুমে গেলাম, দুপুরের খানা হোটেলে খেলাম বিকালে ইচ্ছে মত ঘুমালাম। বিকেল ৫টায় উঠে আসরের নামাজ শেষে বাড়িতে ফোন দিলাম, মাগো......... কেমন আছেন ? মা! .......বাবা কখন পৌছলি, কি অবস্থা তোর........চোখে তখন বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ার, অনেক কষ্টে মাকে বুঝালাম, মা কেঁদোনা আমি ভালোয় ভালো পৌছেছি, আমার জন্য দোয়া করবেন। আব্বু কই, আমার জান্নাত কই, সবার সাথে ১০ মিনিট কথা হল, তন্মধ্যে ৮মিনিটই কান্নাকাটি। যাক ফোন রেখে কিছুক্ষণ রোডের পাশে খেজুর গাছের নিচে বসে বাড়ির জন্য ইচ্ছে মতে কাঁদলাম, না জানি আমার অসহায় অর্ধাঙ্গিনীর কি অবস্থা, হয়তো সে ও আমার মত কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। অমনিতেই মাগরিবে আযান, খুব মধুর মনে হল আযানের সূর, মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম আরব মুসলমানদের এই শহরে কি একটি মাত্র মসজিদ ? দ্বিতীয় কোন আযান শুনলাম না কেন ? অনেক প্রশ্ন মনে, মসজিদে গেলাম নামায পড়লাম, অতপর জানতে পারলাম, শেখ যায়েদ মসজিদে আযান হয়, বাকি সকল মসজিদে সেটেলাইট রিসিবারের সাহায্যে একযোগে প্রচার করা হয়। যাই হোক এখন কর্মস্থলের অফিসে যাওয়ার পালা। ৩জন বাঙ্গালী ভাইয়ের সাথে অফিসে গেলাম, দরজায় দাড়িয়ে দেখতে পেলাম আমার স্পন্সর, ওনার স্ত্রী ও আরেক জনসহ ৩জন কম্পিউটারে কাজ করতেছে। সালাম দিলাম, আহলান বলে স্বাগতম জানালো, মুসাফাহা করলাম, বললেন তারা সবাই মিসরী, একমাত্র আমিই বাঙ্গালী। হটাৎ করে মেডাম বলে উঠলেন এই পোশাক চলবে না, দাড়ি ছোট করতে হবে, সু-মুজা, টি-সার্ট, প্যান্ট পরতে হবে, এখন যাও কাল থেকে সব ঠিক করে আসবা, ইত্যাদি। মাথার উপর যেন আসমান ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা, বুঝ হওয়ার পর জীবনে কোনদিন শার্ট প্যান্ট পরিনি, দাড়িতো দূরে থাক মুখেও কোন দিন ক্ষুর লাগাইনি, হায় আল্লাহ এখন কি হবে ? চলে গেলাম রুমে, বাড়িতে ফোন দিলাম এখন কি করা ? সবাই পরামর্শ দিল ডিউটি পোশাক হিসাবে শার্ট প্যান্ট পরতে কোন সমস্যা নেই কিন্তু দাড়ির ব্যাপারে কালকে একটু রিকুয়েস্ট করে দেখ, ঠিক আছে পরদিন সকালে আবার গেলাম, কিন্তু মেডাম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল, বলল এখনো তোমার পোষাক চেঞ্জ হয়নি? বললাম মেডাম এখন হাতে টাকা নাই, ২/৩ দিনের মধ্যে সব ঠিক করব, কিন্তু মেডাম আমাকে অফিসে বসতেই দিল না, বলল আগে সব ঠিক করে এসো তারপর ডিউটি। কি আর করব আজকেও ফিরে গেলাম, সারা দিন আর শান্তি নেই, প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা করজ করে বিদেশ এলাম, যদি ফিরে যাই তাহলে জমি বিক্রি করে ঋণ শোধ করা ছাড়া আর কোন পথ নেই। আল্লাহর কাছে অনেক প্রার্থনা করলাম, আমার সম্মানিত উস্তাদজীর পরামর্শ নিলাম, পোশাক চেঞ্জ কর কিন্তু দাড়িতে হাত দিবে না, আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহ রিযিকের মালিক। ডুবাই থেকে আমার কাযিন এলো, ২টি প্যান্ট, ২টি শার্ট, ২ জোড়া মুজা ও ১জোড়া সু কিনে দিল। সেলুন দোকানে গিয়ে দাড়ির আশপাশের লোমগুলো জীবনে প্রথমবারের মত সেভ করালাম, (এমনিতে দাড়ি অনেক কম) তাতে দাড়ি অনেক হালকা মনে হতে লাগলো। পরের দিন অফিসে গেলাম, তখন সবাই খুশি, শুধু আমি মনে মনে কাঁদতে ছিলাম একে তো দেশের জন্য, বাড়ির সবার জন্য মন কাঁদছে, তারপর আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন পোষাকে ডিউটি। কিছুক্ষণ পর মিসরী যুবককে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কি মুসলিম ? সে বলল না, আমরা সবাই খৃষ্টান। বুঝতে বাকি রইলো না, এত নিষ্ঠুর আচরণ কেন করা হল, কিন্তু করার কিছু নাই, যেহেতু অনেক টাকার বোঝা মাথার উপর, তাই সব কিছু মেনে নিলাম। প্রথম প্রথম অনেক কষ্ট হত, কারণ ভাষা বুঝা কঠিন, নতুন নতুন কাজ, কাজ বুঝানোর মত কেউ নেই, মিসরীদের ব্যবহার এমনিতেই গোলামের মত (এটা সব প্রবাসী ভালো করে জানে) তারপর আবার খৃষ্টান, ডিউটিতে যেতাম মানে রিমান্ডে যেতাম, মানসিক যন্ত্রণা সবচেয়ে বেশি ছিল। সবমিলিয়ে দুনিয়ার জাহান্নামে জ্বলছিলাম প্রায় ১ বছর। সামান্য বেতন, থাকা খাওয়া নিজের, মাসে দশ হাজারের বেশি টাকা দেশে পাঠানো সম্ভব হত না। এখন আলহামদু লিল্লাহ মোটামুটি ভালই আছি।
বিষয়: বিবিধ
১২৮৯ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপুকে অনেক ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন