চক্ষুগোচর

লিখেছেন লিখেছেন আসিফ নিক্সন ২৭ মে, ২০১৪, ১০:৫৯:৫৫ সকাল

—মিঞা ভাই, শ'খানেক টেহা ধার দিবেন? দেন না... ও মিঞা ভাই! - রহমত আলীর কন্ঠে অনুরোধ ঝরে পড়ে।

— ওই বেজন্মার পুত বেজন্মা, টেহা কি গাছে ধরে? টেহা নিবি ভালা কথা, দিবি ক্যামতে?

— সামনের মাসে চাষ কইরা দিয়া দিমু। দেন না মিঞাভাই, শ'খানেক টেহা। পোলাডার জন্ডিস অইছে। ডাক্তার দেহামু।

— অই হারামজাদা, পথ ছাড়। ফহিরের পুত, চাষ কইরা টেহা শোধ করব! পাঁচ টেহার মুরোদ নাই, একশ টেহা ! - ওসমান মিয়ার কন্ঠ থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো কথাগুলো বেরুলো।

— মিঞাভাই, দোহাই লাগে, একশোটা টেহা দ্যান না। পোলাডার খুব অসুখ। ভাল-মন্দ কিছু খাওয়ামু।

— পা ছাড়, হারামজাদা! জায়গা দে। হালা কুত্তার বাচ্চা।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে, গটমট করে গন্তব্যের দিকে পা বাড়ায় ওসমান মিয়া। রহমত আলী, ওসমান মিয়ার যাত্রাপথের দিকে চেয়ে থাকে। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে তার। অশ্রুর ফোয়ারা নামে দুচোখ ফুঁড়ে। দু-হাতে চোখ মুছে উঠে দাড়ায় সে। পেটের ভিতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে সে। দুদিন ধরে একটা দানা-পানিও পেটে পড়েনি। বাড়ির দিকে পা বাড়ায় রহমত আলী।

.

ছনের তৈরি বাড়িতে উঠোনের বালাই নেই। রাস্তার কিনারা ঘেষে অভদ্রভাবে গড়ে উঠা, বাড়িটাতে রহমত আলীর বাস। ওসমান মিয়ার জমিতে বর্গা চাষ করে সে। এবারের বর্ষায় সব ধান বানের জলে তলিয়ে গেছে। তাই, রহমত আলীর হাত একেবারে ফাঁকা। টাকা-কড়ি নেই। ছেলেটার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, ডাক্তার দেখানোর টাকা নেই। দু-বেলা দু-মুঠো ভাত খেতে যখানে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে ডাক্তার দেখানোর টাকা যোগাড়, অরণ্যে রোদনের মতো! ছেলেটার জ্বর, তাও দু-দিনের উপোস। রহমত আলীর বুকটা নিঃশব্দ আর্তনাদে চৌচির হয়ে যায়। একজন পিতা, কীভাবে তার ছেলের দুরবস্থা, অভুক্ত মুখ কিংবা জ্বরের ধাক্কায় জীর্ণশীর্ণ অবয়ব সহ্য করতে পারবে! রহমত আলী চোখ বুজে অনুভব করার চেষ্টা করে, পিতা হিসেবে সে কতটা ব্যার্থ!

দারিদ্রতার বেড়াজালে ছিন্নভিন্ন হয়ে রহমত আলীর মতো মানুষগুলো, একসময় কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। দারিদ্রতা বড় খারাপ জিনিস। বড় নিষ্ঠুর এই দারিদ্রতা!

রহমতের বউ জোলেখা, দাওয়ায় বসে ছিল। রহমত আলীকে দেখে, একটু নড়েচড়ে বসল সে। জিজ্ঞেস করল,

— মিরাজের বাপ, টেহা যোগাড় করবার পারছো?

- নাহ! পারিনাই। _ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, বিরস মুখে জবাব দেয় রহমত।

" গরীব মানুষেরে কেউ টেহা ধার দেয় না। বুঝলি মিরাজের মা! আমরা হইলাম বেজন্মার পোলা। বেজন্মাদের কেউ টেহা ধার দেয় না। " — বিড়বিড় করতে করতে ঘরে প্রবেশ করে রহমত আলী। তার একমাত্র পুত্র মিরাজ। কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। রহমত আলী মিরাজের পাশে বসে, কপালে হাত রাখে। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে ছেলেটার।

— "বাজান, এহন কিরাম লাগতাছে।" _ মৃদু স্বরে, পুত্রকে জিজ্ঞেস করে সে।

মিরাজ চোখ মেলে পিতার মুখের দিকে তাকায়। ফিসফিস করে কী যেন বলল ছেলেটা। রহমত আলী তার অর্থ বুঝতে পারল না। রহমতের চোখ দিয়ে কয়েকফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। বুকটা কেমন যেন মোচড়ে উঠে। না খেতে পেয়ে ছেলেটার অবস্থা করুণ। দূর্বল হয়ে পড়েছে। শরীরে এতটুকু শক্তি অবশিষ্ট নেই।

.

রহমত আলী, পুত্রের বিছানা থেকে উঠে দাড়ায়। ধীরে ধীরে পা বাড়ায়, প্রতিবেশী গণেশের বাসার দিকে।

— "ও গণেশ বাই! বাড়িত আছো?"

কিছুক্ষণ পর, সাড়া দেয় গণেশ।

— রহমত বাই, এ দুপুরে হঠাৎ কি মনে কইরা?

– "পোলাডার খুব অসুখ, দুইডা ভাত দিবা? পোলা আমার দুদিন না খাইয়া আছে।" _ বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে রহমত আলী।

— "ধুরু ভাই। বাচ্চা পোলার মতো কাঁনতাছেন ক্যান? খাড়ান, আমি আইতাছি।" - এই বলে, বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল গণেশ। কিছুক্ষণ পর, একটা থালায় সামান্য ভাত আর কচুশাক নিয়ে বেরিয়ে আসে সে। রহমত আলীর অশ্রুসিক্ত মুখে মৃদু হাসি ফোটে। কৃতজ্ঞতার হাসি।

.

থালা নিয়ে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছামাত্রই, নিজের বউয়ের বিলাপ শুনে রহমত আলীর বুকটা ধক করে উঠে। দৌড়ে বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করে সে। মিরাজ নিথর হয়ে শুয়ে আছে। ছেলেটার নিঃশ্বাস থমকে গেছে। আর কখনো সে এই মুক্ত পৃথিবীর সতেজ শ্বাস গ্রহণ করবে না। রহমত আলী মিরাজের শিয়রে বসে, নির্বাক চোখে ছেলের মৃত মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে। বুকটা ব্যথায় ভরে উঠে তার। ছুরির মতো কিছু একটা দিয়ে কেউ যেন প্রতিনিয়ত, রহমত আলীর বুকটা ফালা ফালা করে দিচ্ছে। ছেলেটার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। রহমত আলী স্তব্ধ হয়ে যায়। রহমতের বউ আহাজারি করছে। সন্তান হারানোর আহাজারি।

— "বাজান, তোর জন্য ভাত আনছি। খাবিনা? ও বাজান..." - বিড়বিড় করে বলতে বলতে মাথা দোলাতে থাকে রহমত আলী। মাঝে মাঝে, প্রিয়জনের মৃত্যু মানুষকে অস্বাভাবিক আচরণ করতে বাধ্য করে। কারণ, খুব সহজে তারা এ বাস্তবতা মেনে নিতে পারে না। রহমত আলীও ঠিক সেরকম আচরণ করছে। সে চোখ বড় বড় করে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে আর মাথা দোলাচ্ছে। তার হয়তো এই অদ্ভুত বাস্তবতা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। চারপাশের বাতাসটা কেমন যেন ভারী হয়ে উঠেছে। পুরো গ্রাম শোকের কালো চাদরে ঢেকে যাচ্ছে যেন! কাল থেকে মিরাজ নামের ছেলেটাকে আর দেখা যাবে না। পৃথিবীতে ছেলেটার কোন অস্তিত্বই নেই। মৃত্যু! কি অদ্ভুত ব্যাপার!

.

পুত্রের লাশ দাফন করে বাসায় ফেরে রহমত। তার চিরচেনা কুটিরের মধ্যে একটা অদ্ভুত শূন্যতা লক্ষ করে সে। রহমতের পেটটা ক্ষুধায় চো চো করছে। দুদিনের অভুক্ত সে। পুত্রের জন্য গণেশের কাছ থেকে আনা, ভাতের থালাটির দিকে জ্বলজ্বল চোখে তাকায় সে। গভীর বিষাদে মনটা ছেয়ে যায় তার।

মানুষের মন খুবই অদ্ভুতুড়ে! রহমত আলীর সকল ক্ষোভ জমা হয় ওসমান মিয়ার উপর। অদ্ভুত যুক্তিজালে, তার পুত্রমৃত্যুর জন্য ওসমান মিয়াকেই দোষারোপ করে সে। সন্তর্পণে বিছানার নিচ থেকে, ধারালো দা-টা বের করে রহমত। ধীরে ধীরে ওসমান মিয়ার বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। আজ রাতে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে বিদায় নিবে আরও একজন। খুব সম্ভবত, তার নাম ওসমান মিয়া।

.

[জন্মদিনের গল্প ২৫/০৫/২০১৪]

বিষয়: Contest_father

১২১৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File