ইসলামে রাজনৈতিক স্বাধীনতা (পর্ব:-৬)
লিখেছেন লিখেছেন কাজী মুহিব্বুল্লাহ ২২ মে, ২০১৪, ০৮:১০:২৩ সকাল
মূল: ড আহমদ শাওকি আল-ফাঙ্গারী
এ বইটির রচনা পদ্ধতি:-
ইসলামের নামে প্রচলিত ভ্রান্ত চিন্তা সম্পর্কে আরও অনেক বিষয় বলার ছিল ,আমি সর্বদাই অনুভব করি ইসলাম তার শত্রুদের অন্যায় অবিচার এবং তার নিজ অনুসারীর মূর্খতার শিকার,আমাদের উচিৎ এ উভয় শ্রেণীর ভ্রান্তির জবাব দেয়া। আর সে জবাব হওয়া উচিৎ যুক্তি,বুদ্ধি এবং দলিল প্রমাণ সহ ,যার উপস্থাপন ভঙ্গিও হোয়ায়া উচিৎ বিশ শতকের উপযোগী পরিভাষায়। সমস্ত ইসলামি সাহিত্যর ভাণ্ডার খুজেও "ইসলামে রাজনৈতিক স্বাধীনতা" এই বিষয়ের উপর একটি পূর্নাংগ বই আমি খুজে পাইনি।একই ভাবে 'ইসলামি সাংবিধানিক আইনের উপর মাণসম্মত একটি বই।
"ইসলামি রাষ্ট্র ব্যবস্থা,ইসলামি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি,ইসলামে মানবাধিকার ,ইসলামে ও স্বাধীনতা " এ সকল বিষয়ে শত শত বই লিখিত হয়েছে,সে বইগুলির একটি লিস্ট আমি এই বইয়ের শেষ অংশে সংযুক্ত করে দিয়েছি,যা থেকে পাঠক বৃন্দ অনেক উপকার লাভ করতে পারবেন। এ সকল বইয়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতা বিষয়ে প্রসঙ্গক্রমে সামান্য আলোচনাই এসেছে , বিষয়ের গভীরে যাওয়ার কোন প্রয়োজন লেখকরা তেমন একটা অনুধাবন করেন নি। স্বভাবিক ভাবে ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা বা অধিকারের বিষয়ে লিখিত বই গুলিতে মোট যে ছয়টি মৌলিক বিষয়ে আলোচনা করা হয় । যেমনঃ-
১। ব্যক্তি স্বাধীনতা অর্থাৎ ব্যক্তির সকল প্রকার দাসত্ব থেকে মুক্ত থাকার অধিকার ।
২। নারী স্বাধীনতা বা পুরুষ বা সমাজকে ঘিরে তাদের যে অধিকার তার আলোচনা।
৩। চিন্তার স্বাধীনতা বা জ্ঞান,বিজ্ঞান গবেষণার স্বাধীনতা।
৪।অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বা জীবিকা অর্জনের স্বাধীনতা,অথবা তার জীবন জীবিকায় রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ না করার বপারে স্বাধীনতা।
৫। ধর্মীয় স্বাধীনতা বা অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা।
৬। আর সর্বশেষ বিষয়টি হল রাজনৈতিক স্বাধীনতা,যা রাষ্ট্রের শাসক এবং নাগরিক দের মাঝে সম্পর্কের বিষয়।
রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিষয়টি এ বইগুলির লেখকরা শুধু মাত্র আংশিক ভাবেই আলোচনা করেছেন,প্রাচীন ইসলামী বইয়ে এ বিষয়ের আলোচনা আরও অনেক কঠিন ব্যাপার।
রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিষয়ে আল-কোরান এবং রাসুল (সাঃ) এর সুন্নায় অনেক আলোচনা এসেছে কিন্তু সে আলোচনা এসেছে ভিন্ন নামে এবং ভিন্ন ভিন্ন পরিভাষায় ,বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে ,যেহেতু আপনি কোরান অধ্যয়নের সময় আপনার উদ্দেশ্য থাকে ুঅন্যন্য বিষয়ের জ্ঞান অন্বেষণ এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিষয়টি আপনার মাথায় তখন কাজ করেনা ,তাই এ বিষয়ে আলোচনা আসলেও আপনি তা উপলদ্ধি করেন না ।
যেমন একটা সহজ উদাহরণ হচ্ছে ,কালেমা {لَا إِلَهَ إِلَّا اَلله} (আল্লাহ ছাড়া আর কোণ ইলাহ নেই) এটি আল-কোরানে এসেছে , এ কালেমাটি প্রতিদিন ঘুরে ফিরে অনেকবার আমরা পাঠ করে থাকি কোন প্রকার গভীর উপলব্ধি বা চেতনা ছাড়াই,এ কালেমাটি তার ভাবার্থের দিক থেকে একটি শ্রেষ্ঠ স্লোগান এবং মূলনীতি পেশ করে যার মাধ্যমে ইসলাম সমস্ত মানবতাকে চির মুক্তির দিকে আহবান জানায়,আর এ বিষয়টি বুঝার জন্য ইসলাম পূর্বযুগে মানবতার কি দুরবস্থা ছিল সেবিষয়ে আমাদেরকে কিছু আলোকপাত করা দরকার ,তৎকালীন সময়ে যে কোন ব্যক্তি নিজেকে ইলাহ দাবী করতে পারত এবং অন্যর উপর নিজের প্রভুত্ব এবং আনুগত্য যেভাবে খুশি সেভাবে চাপিয়ে দিতে পারত।
১।{كِسرَى} কিসরা (প্রাচীন ইরানী সম্রাট) নিজেকে ইলাহ বা ঈশ্বরদের বংশধর মনে করত,মানুষের জীবন এবং মৃত্যুর সমস্ত ফয়সালা তার নিজের অধিকার বলে মনে করত।
২। {قَيصَر} সিজার (প্রাচীন রোম সম্রাট) নিজেকে অর্ধেক ইলাহ মনে করত ,আর তার হুকুমের বিরোধিতা করাকে আল্লাহর বিরোধিতা বলে বিবেচিত হত।
৩। {الكَهَنُوتْ}(মধ্য যুগের খৃষ্টান ধর্মীয় পুরোহিতরা) নিজেদেরকে আল্লাহ এবং তার বান্দাদের মধ্যবর্তী যোগাযোগ এর মাধ্যম মনে করত,এবং তাদের হাতেই জান্নাত এবং জাহান্নামের সনদ আছে বলে মানুষকে বলত।
৪। এমন কি ,আরবরা পাথরের মাঝেও ইলাহ এর গুন আরোপ করে অন্ধভাবে তাদের পূজা উপাসনা করত।
৫। বাতিল বিশ্বাসের নির্বোধ অনুকরণও সেকালের মানুষের উপর একপ্রকার শক্তি এবং দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছিল।
এরকম হাজারো প্রকৃতির দাসত্ব তাদেরকে আঁশটে পুষ্টে ধরে রেখেছিল।
যখন আল-কোরান আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই বলে ঘোষণা করল ,তখন তা ছিল এ ধরনের সকল প্রকার, ভণ্ড বাতিল ইলাহদের বিরুদ্ধে এক প্রচণ্ড বিপ্লব যা সর্বরুপী দাসত্বের বন্দনকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলল। আর এ শ্লোগানের মাধ্যমেই ইসলাম মানবতাকে সকল দাসত্বের হাত থেকে মুক্ত করে শুধু মাত্র এক রবের দিকে সংযুক্ত করল। আর সে সংযুক্তিতে কোন মধ্যস্থতা কারি বা অংশীদারি-ত্বের অবকাশ স্থান রাখল না।
আর সে কারণেই আল-কোরানের অনেক আলোচনায় এবং আয়াতে স্বৈরাচারী এবং তাগুতীকে একপ্রকার কুফরি হিসেবে উল্লেখ পাই। এবং কোন স্বৈরাচারীর আনুগত্য করা বা তার মাঝে কোন প্রকার পবিত্রতা আরোপ করকে আল্লাহর প্রতি শিরক করার শামিল বলা হয়েছে।আর তাগুতের অস্বীকার এবং পরিত্যাগ করকে ইমান বলা হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরানে বলেন
{ فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِن بِاللّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىَ لاَ انفِصَامَ لَهَا وَاللّهُ سَمِيعٌ عَلِيم}( যে তাগুতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ্তে ঈমান আনে সেই তবে ধরেছে একটি শক্ত হাতল, -- তা কখনো ভাঙবার নয়। আর আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা)(সুরা আল-বাক্বারা ,আয়াত ২৫৬)
{ وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ}( আর যারা অবিশ্বাস পোষণ করে তাদের পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে তাগুত, ) আল-বাক্বারা ২৫৭
এখানে তাগুত বলতে শুধু মূর্তি পূজারীদেরকেই বুঝানো হয়নি,মানুষের উপাসনা করাকেও বুঝানো হয়েছে।
আজকের যুগের মানুষেরা পাথরের পূজা ছেড়ে মানুষের পূজা শুরু করেছে,যদিও তারা নামে এবং কথায় মুসল মান কর্মের দিক থেকে এবং বাস্তবতায় জাহিলিয়াতের কাফেরদের সাথে তাদের তফাত খুব বেশি নয়।
এই আয়াতগুলিকে যদি আমরা ব্যাপক অর্থে আলোচনা করি তাহলে দেখতে পাই এ আয়াত সমূহ মানুষকে সকল প্রকার দাসত্ব থেকে মুক্ত করে একমাত্র আসমান এবং জমিনের স্রষ্টার দাসত্বে আবদ্ধ করেছে। একই ভাবে ব্যাপক এবং পরিপূর্ণ ,গভীর দৃষ্টি সহকারে আল-কোরানের আয়াতসমূহ আমাদেরকে অধ্যয়ন করতে হবে ,যাতে করে রাজনৈতিক স্বাধীনতা সংক্রান্ত কোরানের শিক্ষাকে আমরা তার সরুপে উপলব্ধি করতে পারি।
আর যারা আল-কোরান কে শুধু শব্দ এবং অর্থের দিক থেকে অধ্যয়ন করে থাকে ,তার আত্মা এবং সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিটা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়,তাদের কাছ থেকে সর্বদাই এধরনের প্রশ্ন আসতে পারে যে , আল-কোরানে কি সত্যিই কোন স্বাধীনতার আলোচনা করা হয়েছে? সেখান থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা সংক্রান্ত কোন দলিল প্রমান কি পাওয়া যেতে পারে?
কেউ যদি ব্যক্তিগত ভাবে কোরান অধ্যয়ন করেন এবং প্রাচীন তাফসীর যেমন "তাফসিরে ক্বুরতূবী ,তাফসীরে তাবারি অথবা তাফসীরে ইবনে কাছীর অধ্যয়ন করেন তাহলে সেখানে তারা রাজনৈতিক স্বাধীনতা খুঁজে পাবেন না ,কারণ সে সময় এ পরিভাষাটির কোন অস্তিত্ব ছিলনা।
একই জটিলতায় পরতে হবে প্রাচীন আইন বিজ্ঞান এবং ফিকাহর কিতাবগুলি অধ্যয়ন করলেও । ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংক্রান্ত কিতাব যেমন "সিয়া-সাত আল-শরিয়াহ ,মানহাজ আল-মূলক,সিয়া-সাত আল-মুলুক,অথবা মায়ালিম আল-মুলুক ইত্যাদি বইতেও রাজনৈতিক স্বাধীনতা সংক্রান্ত আলোচনা পাওয়া যাবেনা।
সবকথার সারমর্ম হচ্ছে ঃ রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিষয়ে ভবিষ্যৎ কোন পুস্তক রচনা অনেক দুরূহ এবং কষ্টসাধ্য একটা কাজ, এবং প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি ও কর্মসাধনা দরকার। একি সাথে এ বিষয়ে একটি পুস্তক রচনা একটি পবিত্র দায়িত্ব ।
।
বিষয়: বিবিধ
১৪৪১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন