সবর-ধৈর্য

লিখেছেন লিখেছেন সত্যের সন্ধানে আমি ১৫ মে, ২০১৪, ০৯:২২:৪৯ রাত

সবর বা ধৈর্যের সংজ্ঞা : সবর, আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হল আটকে রাখা। শরয়ী পরিভাষায় : তিনটি বিষয়ে নিজেকে আটকে রাখার নাম সবর বা ধৈর্য।

প্রথম : আল্লাহ তা’আলার আদেশ-নির্দেশ পালনে নিজেকে আটকে রাখা।

দ্বিতীয় : আল্লাহ তা’আলা যা নিষেধ করেছেন তার দিকে যেতে নিজেকে আটকে রাখা বা বিরত রাখা।

তৃতীয় : যে সকল বিপদ-আপদ আসবে সে সকল ব্যাপারে অসঙ্গত ও অনর্থক বা ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা থেকে নিজেকে আটকে রাখা।

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : হে ঈমানদানগণ! তোমরা ধৈর্য্য ধারণ কর এবং মোকাবেলায় দৃঢ়তা অবলম্বন কর। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক যাতে তোমরা তোমাদের উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পার। (সূরা আলে ইমরান-২০০)

আল্লাহ তা’আলা আরো ইরশাদ করেন : আমি তোমাদেরকে কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব। আর তুমি শুভ সংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের। (সূরা আল-বাকারা-১৫৫)

আল্লাহ তা’আলা আরো ইরশাদ করেন : নিশ্চয় ধৈর্যশীলদের অপরিমিত পুরস্কার দেয়া হবে। (সূরা যুমার-১০)

আল্লাহ তা’আলা আরো ইরশাদ করেন : অবশ্য যে ধৈযর্ ধারণ করে এবং ক্ষমা করে দেয়, নিশ্চয় এটা দৃঢ় সংকল্পেরই কাজ। (সূরা আশ-শুরা-৪৩)

আল্লাহ তা’আলা আরো ইরশাদ করেন : হে ঈমানদারগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। (সূরা বাকারা-১৫৩)

আল্লাহ তা’আলা আরো ইরশাদ করেন : আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব, যতক্ষণ না আমি জেনে নেই তোমাদের মধ্যে জিহাদকারী ও ধৈর্যশীলদেরকে এবং আমি তোমাদের ব্যাপারে পরীক্ষা করি। (সূরা মুহাম্মাদ-৩১)

আয়াতসমূহ থেকে শিক্ষণীয় বিষয় : (১) আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন ধৈর্য ধারণ করতে হুকুম দিয়েছেন।

(২) তিনি ধৈর্য ধারণে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করতে বলেছেন। তাই নিজেকে সকলের চেয়ে বেশী ধৈর্যশীল হিসেবে তৈরী করা প্রয়োজন।

(৩) ঈমানদার সকল প্রকার বিপদ-আপদকে আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা হিসাবে গ্রহণ করবে। আর এতে ধৈর্য ধারণ করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে থাকবে শুভ সংবাদ।

(৪) আল্লাহ ধৈর্যশীলদের পুরস্কার ও প্রতিদান দেবেন বিনা হিসাবে।

(৫) ধৈর্য ও ক্ষমাকে আল্লাহ দৃঢ় সংকল্পের কাজ বলে প্রশংসা করেছেন।

(৬) আল্লাহ তা’আলা বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণ ও সালাতের মাধ্যমে তারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন।

(৭) ধৈর্যশীলদের সাথে আল্লাহর সাহায্য থাকে।

(৮) আল্লাহ তা’আলা বিভিন্ন বিপদ-আপদ, বালা-মুসীবত, সমস্যা-সংকট দিয়ে পরীক্ষা করে প্রকাশ্যে প্রমাণ করতে চান যে, কে আল্লাহর পথে জিহাদ করতে প্রস্তত আর কে ধৈর্য ধারণ করতে পারে।

আবু মালিক হারেস ইবনে আসেম আল-আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : পবিত্রতা হল ঈমানের অর্ধেক। আর আল-হামদুল্লিাহ, আমলের পাল্লা পূর্ণ করে দেয়। ছুবহানাল্লাহ ওয়াল-হামদুলিল্লাহ, উভয়ে আকাশসমূহ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী স্থান পূর্ণ করে দেয়। নামাজ হল জ্যোতি। দান-সদকা হল প্রমাণ। সবর-ধৈর্য হচ্ছে আলো। আল-কুরআন তোমার পক্ষে অথবা বিপক্ষে প্রমাণ হবে। প্রত্যেক মানুষ সকালে উঠে নিজেকে বিক্রি করে দেয়। এরপর সে নিজেকে মুক্ত করে অথবা ধ্বংস করে। (মুসলিম)

হাদীসটি থেকে শিক্ষণীয় বিষয় : (১) পবিত্রতা মানুষের বাহ্যিক দিক। অন্তরের বিশ্বাস হল অপ্রকাশ্য বিষয়। বাহ্যিক ও অপ্রকাশ্য দুটো বিষয় নিয়েই ঈমান। সে হিসাবে পবিত্রতা হল ঈমানের অর্ধাংশ।

(২) তাসবীহ (ছুবহানাল্লাহ) ও তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ)-এর ফজীলত। আমলের পাল্লায় এর রয়েছে অনেক গুরুত্ব।

(৩) সালাত বা নামাজ ঈমানদারের অন্তরকে ও চেহারাকে উজ্জল করে। এমনিভাবে তা কবর ও হাশরে তার জন্য আলোকবর্তিকা হবে।

(৪) দান-সদকা ও আল্লাহর পথে ব্যয় করা সঠিক ঈমানের একটি প্রমাণ। মুনাফিকরা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না।

(৫) ধৈর্য-সবর হল ঈমানদারদের জন্য আলো স্বরূপ। এ আলো সুর্যের আলোর মত। যেমন এ হাদীসে এ আলোকে ‘জিয়া’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। আর ‘জিয়া’ বলতে আল কুরআনে সুর্যের আলোকে বুঝানো হয়েছে। যা মানুষকে আলো দেয় ও তাপের মাধমে শক্তি যোগায়। ধৈর্য-সবর এমন বিষয় যা মানুষকে আলোকিত করে ও শক্তিশালী করে। (হাদীসের এ অংশের সাথেই শিরোনামের সম্পর্ক রয়েছে)

(৬) যদি কেহ আল-কুরআনকে জীবনের পাথেয় হিসাবে গ্রহণ করে তাহলে আল-কুরআন তার পক্ষে প্রমাণ হবে। আর যদি কেহ আল-কুরআনকে বর্জন করে তাহলে বিচার দিবসে আল-কুরআন তার বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসাবে দাঁড়িয়ে যাবে।

(৭) সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রত্যেক মানুষই নিজেকে কাজ-কর্মের জন্য বিক্রি করে দেয়। কেহ ভাল কাজ করে নিজেকে মুক্ত ও স্বাধীন রাখে। আর কেহ খারাপ কাজ করে নিজের ধ্বংস ডেকে আনে।

আবু ইয়াহইয়া সুহাইব বিন সিনান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ঈমানদারের বিষয় নিয়ে আমি খুব আশ্চর্য বোধ করি। তার সকল কাজেই আছে কল্যাণ। ঈমানদার ছাড়া অন্য কোন মানুষের এ সৌভাগ্য নেই। তার যদি আনন্দ বা সুখকর কোন বিষয় অর্জিত হয়, তাহলে সে আল্লাহ শোকর করবে, ফলে তার কল্যাণ হবে, আর যদি তাকে কোন বিপদ-মুসীবত স্পর্ষ করে, তাহলে সে ধৈর্য ধারণ করবে, এতেও অর্জিত হবে তার কল্যাণ। (মুসলিম)

হাদীসটি থেকে শিক্ষণীয় বিষয় : (১) এ হাদীসে ঈমানদারের দুটো বড় গুণ ‘সবর’ ও শোকর’ এর আলোচনা এক সাথে এসেছে।

(২) সকল মানুষদের মধ্যে ইসলাম অনুসারীদের এ এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। মানুষ হয়তো সুখী হবে কখনো, অথবা কখনো থাকবে অসুখী, কোন অবস্থাতেই ঈমানদার ব্যক্তির ক্ষতি নেই। (৩) সুখ-সম্পদ, নেয়ামত পেয়ে আল্লাহর শোকর আদায় করতে এ হাদীস ঈমানদারদের নির্দেশ দেয়।

(৪) কোন ধরনের বিপদ মুসীবত আসলে তাতে ঈমানদার ভেঙ্গে পড়বে না, হতাশ হবে না। ধৈর্য অবলম্বন করে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে।

আবু সাঈদ খুদরী ও আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : মুসলিম ব্যক্তিকে যে কোন ক্লান্তি, ব্যধি, দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা, দুঃখ-কষ্ট ও অস্থিরতা আক্রান্ত করে এমনকি একটি কাঁটা বিধলেও এর বিনিময়ে আল্লাহ তা’আলা তার পাপসমূহ মিটিয়ে দেন। (বুখারী ও মুসলিম)

হাদীসটি থেকে শিক্ষণীয় বিষয় : (১) মুসলমানের যে কোন বিপদ-মুসীবত তা যত ছোট হোক কিংবা বড়, তা কখনো বৃথা যায় না।

(২) মুসলমানের প্রতিটি দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-মুসীবতকে আল্লাহ পাপসমূহের কাফফারা হিসাবে গ্রহণ করে থাকেন। এর বিনিময়ে আল্লাহ তার পাপরাশিকে ক্ষমা করে দেন।

(৩) প্রতিটি বিপদ-মুসীবতে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। তাহলেই তো এর আলোচ্য বিনিময় আল্লাহ তা’আলার কাছে থেকে লাভ করা যাবে। (হাদীসের এ অংশের সাথেই শিরোনামের সম্পর্ক রয়েছে)

(৪) এ হাদীসটি মুসলমানের মর্যাদা ও ফজীলতের একটি দিক প্রমাণ করে।

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : আল্লাহ তা’আলা যে ব্যক্তির কল্যাণ চান তাকে বিপদ আপদে লিপ্ত করেন। (বুখারী)

হাদীসটি থেকে শিক্ষণীয় বিষয় : (১) মুসলিম ব্যক্তির বিপদ-আপদ তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। বিপদাপদের কারণে ধৈর্য ধারণ করে সে প্রশিক্ষণ লাভ করে। অর্জন করে অভিজ্ঞতা। ফলে সে দুনিয়াতে যেমন কল্যাণ লাভ করে আখেরাতেও লাভ করে অফুরন্ত সওয়াব।

(২) যে কোন বিপদ-আপদে মুসলিম ব্যক্তির উচিত ধৈর্য ধারণ করা। ধৈর্য ধারণের কারণেই তার মর্যাদা বেড়ে যায়। সে প্রভূত কল্যাণের অধিকারী হয়ে থাকে।

(৩) মুসলমানদের উপর আপতিত বিপদ-মুসীবত তাদের জন্য সর্বদা গজব বা শাস্তি নয়। অনেক সময় তা তাদের কল্যাণ লাভের কারণ হয়ে থাকে।

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : মুমিন নর ও নারীর উপর, তাদের সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদের উপর সর্বদা বিপদ-মুসীবত আসতেই থাকে, অবশেষে সে আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাত করে যে, তার আর কোন পাপ অবশিষ্ট থাকে না। (তিরমিযী)

হাদীসটি থেকে শিক্ষণীয় বিষয় : (১) বিপদ-আপদ মুসলিমদের সাথী, তবে তা আজাব-গজব হিসাবে নয়। পরীক্ষা, উচ্চ মর্যাদা লাভ ও পাপ মুক্তির কারণ হিসাবে এসে থাকে।

(২) যদি বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণ করা হয় তাহলেই সেই বিপদ-আপদ মুসলমানের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে, গুনাহ মাফের কারণ হিসাবে গৃহিত হয়।

(৩) বিপদ-মুসীবত নিজের উপর আসুক বা নিজের সন্তান-সন্ততি, পরিবারের উপর আসুক কিংবা নিজের সম্পদের উপর আসুক সকল প্রকার বিপদে ধৈর্য ধারণ করলেই তা গুনাহের কাফফারা হিসাবে গ্রহণ করা হয়।

আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সব অবস্থায় ধৈর্য ধারণ করার তাওফীক দান করুন। আমীন...

বিষয়: বিবিধ

১৪০১ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

222088
১৫ মে ২০১৪ রাত ১০:২৮
হারিয়ে যাবো তোমার মাঝে লিখেছেন : বিপদ-মুসীবত নিজের উপর আসুক বা নিজের সন্তান-সন্ততি, পরিবারের উপর আসুক কিংবা নিজের সম্পদের উপর আসুক সকল প্রকার বিপদে ধৈর্য ধারণ করলেই তা গুনাহের কাফফারা হিসাবে গ্রহণ করা হয়।

সত্যি নাকি ভাই। তবে এখন থেকে বেশী বেশী ধৈর্য ধারণ করবো।
222093
১৫ মে ২০১৪ রাত ১০:৩৩
নিশা৩ লিখেছেন : অনেক ভাল লাগল। এ রকম বিষয় ভিত্তিক আরো লেখা চাই।
222118
১৫ মে ২০১৪ রাত ১০:৫৭
সন্ধাতারা লিখেছেন : অনেক অনেক ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
222171
১৬ মে ২০১৪ রাত ০১:১৮
মাটিরলাঠি লিখেছেন : Rose Rose Rose Rose
ভালো লাগলো। নিয়মিত লিখে যান।
222298
১৬ মে ২০১৪ বিকাল ০৫:১২
Mujahid Billah লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম! আমার এই ছোট্ট
ব্লগে আপনাকে স্বাগতম।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File