ঈদ উৎসব : ধর্মে ও কাব্যে

লিখেছেন লিখেছেন এ এম এম নিজাম ২২ জুলাই, ২০১৪, ০৫:১৩:২১ সকাল



মুসলিম জাতির অন্যতম প্রধান ধর্মীয় ও জাতীয় উৎসব ঈদুল ফিতরের দিনটি খুবই তাৎপর্য ও মহিমার দাবিদার। এক মাস রোজা পালন শেষে শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ নিয়ে আসে পরম আনন্দ ও খুশির ঈদ। রোজাদার যে পরিচ্ছন্নতার ও পবিত্রতার সৌকর্য দ্বারা অভিষিক্ত হন, যে আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, উদারতা, বদান্যতা, মহানুভবতা ও মানবতার গুণাবলি দ্বারা উদ্ভাসিত হন, এর গতিধারার প্রবাহ অক্ষুন্ন রাখার শপথ গ্রহণের দিন হিসেবে ঈদুল ফিতর সমাগত হয় । এদিন যে আনন্দধারা প্রবাহিত হয় , তা অফুরন্ত পুণ্য দ্বারা পরিপূর্ণ। নতুন চাঁদ দেখা মাত্র রেডিও-টেলিভিশন ও পাড়া-মহল্লার মসজিদের মাইকে ঘোষিত হয় খুশির বার্তায় ‘ঈদ মোবারক’। সেই সঙ্গে চারদিকে শোনা যায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত রোজার ঈদের গান: ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ। তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ...’

ঈদ মানেই আনন্দ ও খুশির উৎসব। ‘ঈদ’ শব্দটি আরবি, শব্দমূল ‘আউদ’, এর অর্থ এমন উৎসব, যা ফিরে ফিরে আসে, পুনরায় অনুষ্ঠিত হয় , রীতি হিসেবে গণ্য হয় প্রভৃতি। এর অন্য অর্থ খুশি-আনন্দ। উচ্ছল-উচ্ছ্বাসে হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্ত। ঈদ প্রতিবছর চন্দ্র বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী নির্দিষ্ট মাসের নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট রীতিতে এক অনন্য আনন্দ-বৈভব বিলাতে ফিরে আসে। এক মাস কঠোর সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নানা নিয়ম কানুন পালনের পর উদ্যাপিত হয় ঈদুল ফিতর; অন্য কথায় রোজার ঈদ। ‘ফিতর’ শব্দের অর্থ ভেঙে দেওয়া। আরেক অর্থে বিজয় । দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পর যে উৎসব উদ্যাপন করা হয়, তা-ই ঈদুল ফিতরের উৎসব। বিজয় শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহূত হয়েছে। গোটা রমজান মাস রোজা রেখে আল্লাহভীরু মানুষ তাঁর ভেতরের সব রকমের বদভ্যাস ও খেয়ালখুশিকে দমন করার মাধ্যমে একরকমের বিজয় অর্জন করেন। সেই অর্থে এটি বিজয় হিসেবেও দেখা যায় । সব মিলিয়ে ঈদুল ফিতরকে বিজয় উৎসব বলা যেতে পারে। ঈদুল ফিতরের প্রতিটি অনুশাসনে ইবাদতের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় । তাছাড়া এদিন প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে সত্যনিষ্ঠ জীবনযাপনের তাগিদ এবং মানবতার বিজয় বার্তা। তবে প্রচলিত নিয়মে দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পর আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে দিনটিকে স্মরণীয় করার নাম ঈদ উৎসব। ‘ঈদুল ফিতর’ শব্দ দুটিও আরবি, যার অর্থ হচ্ছে উৎসব, আনন্দ, খুশি, রোজা ভঙ্গকরণ ইত্যাদি। সুদীর্ঘ একটি মাস কঠোর সিয়াম সাধনা ও ইবাদত-বন্দেগির পর বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ রোজা ভঙ্গ করে আল্লাহর বিশেষ নিয়ামতের শুকরিয়া স্বরূপ যে আনন্দ-উৎসব পালন করেন, সেটিই ঈদুল ফিতর।

প্রতি বছর ঈদকে সামনে রেখে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় দেখা যায় নানা আয়োজন। প্রবন্ধ, গান, ছড়া-কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান কোন কিছুই বাদ যায় না। ঈদকে কেন্দ্র করে কবি- সাহিত্যিক, লেখক, শিল্পী, অভিনেতাদের ব্যস্ত সময় কাটে। সত্যি বলতে কী, এমন কোন মুসলিম কবি-সাহিত্যিক কিংবা লেখককে হয় তো পাওয়া যাবে না যিনি ঈদ নিয়ে কোন লেখা লিখেননি। এক্ষেত্রে বাংলা ভাষাভাষী কবি-সাহিত্যিকরাও পিছিয়ে নেই।

যতটুকু জানা যায় , বিশশতকের গোড়ার দিকে বাংলা কবিতায় ঈদ নিয়ে লেখালেখি শুরু হয় । সৈয়দ এমদাদ আলীর ‘ঈদ’ কবিতাটিই সম্ভবত বাংলাভাষায় রচিত প্রথম ঈদ-বিষয়ক কবিতা। ১৯০৩ সালে তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক নবনূর পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় কবিতাটি ছাপা হয়। তিনি লিখেছেন-

“ধর্ম ও কর্মরে জীবনের মাঝে

প্রতিষ্ঠিত করি আজ জীবনের আবহে হও অগ্রসর,

নাহি তাতে কোন লাজ।

যে চেতনা থাকে একদিন জাগি,

দীর্ঘ নিদ্রা তার পরে,

সে তো আনে শুধু ঘন অবসাদ

জীবনে ঢালে অনন্ত বিষাদ

দেও তারে দূর করে। ”

মানবজাতির তথা মুসলমানদের মহামিলনের উৎসব ঈদকে নিয়ে কবি কায়কোবাদ ‘ঈদ আবাহন’ নামে একটি কবিতা লিখেছেন। কবিতাটি এ রকম-

“এই ঈদ বিধাতার কি যে শুভ উদ্দেশ্য মহান,

হয় সিদ্ধ, বুঝে না তা স্বার্থপর মানব সন্তান।

এ ত নহে শুধু ভবে আনন্দ উৎসব ধুলা খেলা।

এ শুধু জাতীয় পুণ্যমিলনের এক মহামেলা। ”

কবি কায়কোবাদ ঈদকে পুণ্যমিলনের মহামেলা হিসেবে অভিহিত করলেও ইসলামের নির্দেশনা সঠিকভাবে অনুসরণ না করার কারণে ঈদের দিনেও গরিব-দুঃখী ও অসহায় দের কষ্টের যেন শেষ থাকে না। এ দিকটি ফুটে ওঠেছে শাহাদাত হোসেনের ‘বাংলার ঈদ’ কবিতায় । কবি লিখেছেন,

“বাংলার মুসলমান

শুধু চেয়ে রয় -

মৌন ম্লান ক্লিষ্ট মুখ নির্বাক নিশ্চল।

ফিত্রার খুশী কোথা তার?

কি দান সে দিবে ক্ষুধিতেরে?

নিজেই কাঙাল রিক্ত-

ভিক্ষা মাগি ফিরে দ্বারে দ্বারে।”

এ কবিতায় কবি ফিতরা আদায়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ঠিকমত ফিতরা ও যাকাত দেয়া গেলে অসহায় , দরিদ্ররাও ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারবে। সমাজে নেমে আসবে শান্তি-সুখের ফল্গুধারা। এ দিকটির প্রতি ইঙ্গিত করেই সম্ভবত কবি গোলাম মোস্তফা ঈদকে মানবতার বিরাট প্লাটফর্ম হিসেবে কল্পনা করেছেন। ঈদ উৎসব কবিতায় তিনি লিখেছেন-

“কণ্ঠে মিলনের ধ্বনিছে প্রেম-বাণী, বক্ষে ভরা তার শান্তি,

চক্ষে করুণার স্নিগ্ধ জ্যোতি ভার, বিশ্ব-বিমোহন কান্তি

প্রীতি ও মিলনের মধুর দৃশ্যে

এসেছে নামিয়া যে নিখিল বিশ্বে

দরশে সবাকার মুছেছে হাহাকার বিয়োগ-বেদনার শ্রান্তি।”

ঈদ নিয়ে সবচেয়ে বেশি কবিতা ও গান লিখেছেন, কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার লেখা –

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে

এল খুশীর ঈদ

তুই আপনাকে আজ বিলিয়েদে

শোন আসমানি তাকিদ।।

তোর সোনাদানা বালাখানা

সব রাহে লিল্লাহ

দে জাকাত মুর্দা মুসলিমের আজ

ভাঙ্গাইতে নিঁদ।।

তুই পড়বি ঈদের নামাজ রে মন

সেই সে ঈদগাহে

যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম

হয়েছে শহীদ।।

আজ ভুলে গিয়ে দোস্ত- দুশমন

হাত মিলাও হাতে,

তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল

ইসলামে মুরিদ।।

যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা

নিত- উপবাশী

সেই গরীব এতিম মিসকিনে দে

যা কিছু মফিদ।।

ঢাল হৃদয়ের তোর তশতরীতে

শিরণী তৌহিদের,

তোর দাওত কবুল করবেন হজরত,

হয় মনে উমীদ।।

তোরে মারল ছুঁড়ে জীবন জুড়ে

ইঁট পাথর যারা

সেই পাথর দিয়ে তোল রে গ'ড়ে

প্রেমেরি মসজিদ।।

বাংলা সাহিত্যের প্রায় সকল কবিই তাদের প্রতিভা দিয়ে ঈদ নিয়ে কবিতা লেখার চেষ্টা করেছেন। তাদের কবিতা গুলো পাঠকের কাছে জনপ্রিয়তাও লাভ করেছে। কিন্তু যদি তাদের এই কবিতা গুলো খুব ভালোভাবে বিশ্নেষন করার চেষ্টা করি তাহেল দেখা যাবে সেখানে ঈদের যে কোন একটি দিক আলোচিত হয়েছে। তবে এককভাবে যদি কোন কবির ঈদ কবিতা নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে এটি সবাই নির্দিধায় স্বীকার করে নিবেন যে, নজরুলের এই কবিতাটি যেমনি পাঠকের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে তেমনি এতে ফুটে উঠেছে ইসলামী দৃষ্ঠিভঙ্গির সবগুলি দিক। তাই বলা যায় কবিতাও যেমনি পূর্ণতা পেয়েছে তেমনি কবির এই গানটি না শুনলে ঈদ যে পূর্ণতা হারিয়ে পেলে।

এছাড়া, ‘ঈদ মোবারক’ ও ‘কৃষকের ঈদ’ ও ‘ঈদের চাঁদ’ কবি নজরুলের বহুল আলোচিত কবিতা। ‘ঈদ মোবারক’ কবিতায় কবি লিখেছেন,

“শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গো,

কত বালুচরে কত আঁখি-ধারা ঝরায়ে গো,

বরষের পরে আনিলে ঈদ! ”

এ কবিতায় নজরুল দেখেছেন অসংখ্য মরুভূমি, বালুচর আর অনাবিল আঁখিজল পেরিয়ে এসেছে ঈদ। তিনি বলতে চেয়েছেন, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে সুখ-দুঃখের সমভাগী হয়ে অধিকার ভোগ আর দায়িত্ব পালনের মধ্যে যে প্রকৃত আনন্দ, সে শিক্ষা যেন রয়েছে ঈদের মাহাত্ম্যে।

ঈদের মহান শিক্ষাই হচ্ছে সব ভেদাভেদ-হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে ঈদের জামায়াতে দাঁড়িয়ে ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতার বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। কিন্তু ধর্মীয় অনুশাসন না মানার কারণে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ঈদ সচরাচর দেখা যায় না। এ দিনও দেখা যায় গ্রামের দরিদ্র কৃষকরা শীর্ণ গরুর পাল নিয়ে মাঠে যায় জমিতে লাঙল দিতে। এদিকে ইঙ্গিত করে তিনি রচনা করেছেন তার কৃষকের ঈদ কবিতাটি। কবির ভাষায় -

“জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসেনা নিদ

মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?

একটি বিন্দু দুধ নাহি পেয়ে যে খোকা মরিল তার

উঠেছে ঈদের চাঁদ হয়ে কি সে শিশু-পুঁজরের হাড়?”

কবি নজরুলের কবিতা ও গানে ঈদের তাৎপর্য্য, এ দিনের করণীয় ও সমাজে এর প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। অন্যদিকে মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ পুরো দুনিয়াকে ঈদগাহ্‌র সাথে তুলনা করেছেন । ‘ঈদগাহ হবে দুনিয়াটাই’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-

আজকে এল খুশীর দিন

দেখ না চেয়ে খুশীর চিন

দেখ না চেয়ে আজ রঙিন

খুশীর ঝলক ঈদগাহে।

জামাত ছেড়ে থাকবে যে

ঘরের কোণে রইবে সে

রইবে হয়ে একপেশে

একলা থাকায় দুঃখ তাই।

সবাই মিলে একদলে

এক আশাতে যাই চলে

এক আশাতে যাই বলে

ঈদগাহ হবে দুনিয়াটাই।

শাওয়ালের রূপোলী চাঁদ পশ্চিমাকাশে মুচকি হেঁসে জানিয়ে দেয় যে, ঈদ এসেছে। দীর্ঘ প্রতিক্ষিত এ দিন নিয়ে কবি বেগম সুফিয়া কামাল তাঁর ‘ঈদের চাঁদ’ কবিতায় লিখেছেন-

“চাঁদ উঠিয়াছে, ঈদের চাঁদ কি উঠেছে? শুধায় সবে।

লাখো জনতার আঁখি থির আজি সুদূর সুনীল নভে।

এই ওঠে,ওই উদিল গগনে

সুন্দর শিশু চাঁদ—

আমিন। আমিন। রাব্বুল আলামিন

করে সবে মোনাজাত।”

আগেই বলেছি, ঈদের নতুন চাঁদ সবার জন্য আনন্দ বয়ে আনে না। এদিন গরীব-দুঃখী ও অসহায়দের মনের আকুতি প্রকাশিত হয়েছে কবি তালিম হোসেনের ‘ঈদের ফরিয়াদ’ কবিতায় । কবির ভাষায় -

‘ঈদ মোবারক, সালাম বন্ধু, আজি এই খোশরোজে

দাওয়াত কবুল কর মানুষের বেদনার মহাভোজে।

কহিব কি আর, চির-মানুষের ওগো বেদনার সাথী,

ঈদের এ দিন শেষ হয়ে আসে, সমুখে ঘনায় রাতি।’

কবি সিকান্দার আবু জাফর প্রায় একই বিষয়ে একটি কবিতা লিখেছেন। ঈদ উপলক্ষে দোয়া চেয়ে পিতার কাছে লেখা ‘ঈদের চিঠি’-তে তিনি লিখেছেন-

“ঈদের সালাম নিও, দোয়া করো আগামী বছর

কাটিয়ে উঠতে পারি যেন এই তিক্ত বছরের

সমস্ত ব্যর্থতা।

অন্ততঃ ঈদের দিন সাদাসিধে লুঙ্গি একখানি,

একটি পাঞ্জাবী আর সাদা গোলটুপি

তোমাকে পাঠাতে যেন পারি;

আর দিতে পারি পাঁচটি নগদ টাকা।”

অন্যদিকে সৈয়দ আলী আহসান ঈদের চাঁদের হাসিতে দেখতে পেয়েছেন নতুন দিনের বারতা। লিখেছেন-

“এসেছে নুতন দিন

আলো শতদল পাপড়ি মেলেছে, কুয়াশা হয়েছে ক্ষীণ।

জরির জোব্বা, শেরোয়ানী আর আমার সজ্জায়

আতরের পানি, মেশেকর রেণু খোশবু বিলায়ে যায়

বাতাসে বাতাসে কলরোল আজি, ভেঙেছে তন্দ্রা ঘোর

সাহেবজাদীর নেকাব টুটেছে, রাত্রি হয়েছে ভোর।” (এসেছে নূতন দিন)

সমাজে ঈদের খুশীর প্রভাব সম্পর্কে কবি আ.ন.ম বজলুর রশিদ তার 'ঈদ আসে' কবিতায় লিখেছেন-

ঈদ আসে হাসি-খুশী তোমাদের আমাদের সকলের ঘরে

অনেক আনন্দ নিয়ে কিছুক্ষণ ভুলে যাই

দুঃখ জ্বালা যত

আজ শুধু মেলামেশা অন্তরঙ্গ

হয়ে থাকা অবিরত

আল্লাহর প্রশংসায় গান, তাঁর দয়া দাক্ষিণ্যের অমৃত ঝরে।

কবি তফাজ্জল হোসেন খান ঈদ নিয়ে চমৎকার একটি গান লিখেছেন । প্রতি বছর ঈদ এলেই শিশুরা সমবেত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে এ গানটি।

“আজ আনন্দ প্রতি প্রাণে প্রাণে

দুলছে খুশীর নদী প্লাবনে

ঘরে ঘরে জনে জনে

আজি মুখর হব মোরা গানে গানে

ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক

বল ঈদ মোবারক, ঈদ।”

অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিক ঈদের দিনকে খুশীর দিন হিসেবে চিত্রিত করলেও কবি মতিউর রহমান মল্লিক তার গানে লিখেছেন,

“ঈদের খুশী অপূর্ণ রয়ে যাবে ততদিন

খোদার হুকুমাত হবে না কায়েম

কায়েম হবে না যতদিন।”

কবির এ গানের কথাগুলো যৌক্তিক। কারণ দুনিয়ায় খোদার হুকুমাত কায়েমের মাধ্যমেই ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করা সম্ভব। আর এ বৈষম্য দূর হলেই ঈদ হবে সত্যিকার আনন্দের দিন; তা সবার হৃদয়ে বুলিয়ে দেবে প্রেম প্রীতি আর শান্তির পরশ।

এছাড়া ঈদ থেকে শিক্ষা নিয়ে সারাবছর নিজের জীবনকে পরিচালিত করতে পারলেই ঈদ উৎসব সার্থক হবে। ঈদের দিন যেভাবে ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে যায়, সারাবছর ধরে সেই বিভেদের দেয়ালকে তুলে ফেলতে হবে। কবি গোলাম মোস্তফার কথায় -

“আজি সকল ধরা মাঝে বিরাট মানবতা মূর্তি লভিয়াছে হর্ষে,

আজিকে প্রাণে প্রাণে যে ভাব জাগিয়েছে রাখিতে হবে সারা বর্ষে,

এই ঈদ হোক আজি সফল ধন্য নিখিল-মানবের মিলন জন্য,

শুভ যা জেগে থাক, অশুভ দূরে যাক

খোদার শুভাশীষ স্পর্শে।”

বাংলা ভাষায় কবিরা তাদের জ্ঞান এবং আবেগ দিয়ে ঈদকে যেভাবে উপস্থাপন করুক না কেন মূলত সারা বিশ্বের মুসলমানের সর্বজনীন আনন্দ-উৎসব ঈদুল ফিতর। বছরজুড়ে নানা প্রতিকূলতা, দুঃখ-বেদনা সব ভুলে ঈদের দিন মানুষ সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হন। ঈদগাহে কোলাকুলি সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধনে সবাইকে নতুন করে আবদ্ধ করে। ঈদ এমন এক নির্মল আনন্দের আয়োাজন, যেখানে মানুষ আত্মশুদ্ধির আনন্দে পরস্পরের মেলবন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হন এবং আনন্দ সমভাগাভাগি করেন। মাহে রমজানের এক মাসের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নিজেদের অতীত জীবনের সব পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হতে পারার পবিত্র অনুভূতি ধারণ করেই পরিপূর্ণতা লাভ করে ঈদের খুশি। আর আনন্দ ও পুণ্যের অনুভূতিই জগতে এমন এক দুর্লভ জিনিস, যা ভাগাভাগি করলে ক্রমেই তা বৃদ্ধি পায় । ঈদুল ফিতর বা রোজা ভাঙার আনন্দ-উৎসব এমন এক পরিচ্ছন্ন আনন্দ অনুভূতি জাগ্রত করে, যা মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের পথপরিক্রমায় চলতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করে। হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল স. যখন মদীনায় আসেন, তখন দেখেন যে সেখানকার লোকেরা বৎসরে দুই দিন আনন্দ করে, খেলাধুলা করে। তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে এই দুই দিনের পরিবর্তে আরো অনেক ভালো দুটি দিন দিয়েছেন। ১. ঈদুল আযহা। ২. ঈদুল ফিতর। (আবু দাউদ)

ঈদ ধনী-গরিব সব মানুষের মহামিলনের বার্তা বহন করে। ঈদের দিন ধনী-গরিব, বাদশা-ফকির, মালিক-শ্রমিক নির্বিশেষে সব মুসলমান এক কাতারে ঈদের দুই রাকাত ওয়াজিব আদায় এবং একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করে সাম্যের জয় ধ্বনি করেন। রমজান মাসে সংযম ও আত্মশুদ্ধি অনুশীলনের পর ঈদুল ফিতর ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সব শ্রেণীর মানুষকে আরও ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ করে, গড়ে ওঠে সবার মধ্যে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও ঐক্যের বন্ধন। ঈদের দিন মসজিদে, ময়দানে ঈদের নামাজে বিপুলসংখ্যক ধর্মপ্রাণ মুসল্লির সমাগম হয়ে থাকে। সবাই সুশৃঙ্খলভাবে কাতারবদ্ধ হয়ে ঈদের নামাজ পড়েন। নামাজ শেষে ধনী-নির্ধনী, পরিচিত-অপরিচিত সবাই সানন্দে কোলাকুলি করেন। ঈদের জামাতে পার্থিব সুখ-শান্তি, স্বস্তি আর পারলৌকিক মুক্তি কামনা করে আল্লাহর দরবারে বিশেষ মোনাজাত করা হয় । সেই সঙ্গে বিশ্বশান্তি এবং দেশ-জাতি ও মুসলিম উম্মাহর উত্তরোত্তর শান্তি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি ও সংহতি কামনা করা হয় ।

ঈদ ধর্মীয় বিধিবিধানের মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নেয় এবং পরস্পরের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের শিক্ষা দেয়। মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে আমাদের কায় মনোবাক্যে প্রার্থনা হলো জগতের সব মানুষের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি। পৃথিবী সর্বপ্রকার হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানিমুক্ত হোক! সন্ত্রাসের বিভীষিকা দূর হোক! আর্ন্তরদন্দ আর নাশকতা দূর হোক! আগামী দিনগুলো সুন্দর ও সৌন্দর্যম-িত হোক! হাসি-খুশি ও ঈদের আনন্দে ভরে উঠুক প্রতিটি প্রাণ। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সংযম, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ পরিব্যাপ্তি লাভ করুক এটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা। তাই আসুন, ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দিই সবার মনে-প্রাণে। বুকে বুক মিলিয়ে আসুন সবাই সবার হয়ে যাই। সবাইকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও আন্তরিক অভিনন্দন ‘ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক আস্-সালাম।’

বিষয়: বিবিধ

২৭৭২ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

247042
২২ জুলাই ২০১৪ সকাল ০৮:৩৯
মোহাম্মদ নূর উদ্দীন লিখেছেন : ঈদ-মোবারক ! অনেক কষ্ট করে অতবড় অনেক কিছু লিখেছেন !
২২ জুলাই ২০১৪ বিকাল ০৪:০২
191938
এ এম এম নিজাম লিখেছেন : ধন্যবাদ
247224
২২ জুলাই ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:০৮
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ এই পরিশ্রমি পোষ্টটির জন্য। নজরুলের "রমজানের ওই রোজার শেষে" এর আবেদন প্রায় ৭৫ বছর পরেও একই রয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখন ঈদ বা রোজা নিয়ে বিশেষ সাহিত্য রচিত হচ্ছেনা।
২৩ জুলাই ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৩৮
192238
এ এম এম নিজাম লিখেছেন : ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File