রাসূল সাল্লালাহু আলাহিস সালাম রমজানে যেভাবে রোজা পালন করতেন

লিখেছেন লিখেছেন এ এম এম নিজাম ০৭ জুলাই, ২০১৪, ১২:১৩:৪০ রাত

এবাদতের বিভিন্ন প্রকার ইবাদতের দ্বারা রাসূল সা. রোজার দিনগুলোকে শোভিত করতেন—অত্যন্ত আগ্রহ ও ব্যাকুলতার সাথে তিনি সেহরি ও ইফতার গ্রহণ করতেন। রোজা ভাঙার সময় হলে দ্রুত ইফতার করে নিতেন, পক্ষান্তরে সেহরি করতেন অনেক দেরিতে, সুবহে সাদিকের কিছু পূর্বে সেহরি সমাপ্ত করতেন। ইফতার করতেন ভেজা বা শুকনো খেজুর, অথবা পানি দিয়ে। ভেজা খেজুর দিয়ে সেহরি করাকে পছন্দ করতেন তিনি। জাঁকজমকহীন স্বাভাবিক সেহরি ও ইফতার গ্রহণ করতেন সর্বদা।

রমজানে রাসূলের এ আচরণ বিষয়ে বিভিন্ন হাদিসে উল্লেখ পাওয়া যায়—আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :—

كان النبي صلي الله عليه و سلم يفطر قبل أن يصلي على رطبات، فإن لم تكن رطبات فتميرات، فإن لم تكن تميرات حسا حسوات من ماء

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত আদায়ের পূর্বে কয়েকটি ভেজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন, যদি ভেজা খেজুর না থাকত, তবে সাধারণ শুকনো খেজুরই গ্রহণ করতেন। যদি তাও না থাকত, তবে কয়েক ঢোক পানিই হত তার ইফতার।

আবু আতিয়া হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমি এবং মাসরুক আয়েশা রা.-এর নিকট উপস্থিত হলাম। মাসরুক তাকে উদ্দেশ্য করে বলল : মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু’ সাহাবি উপস্থিত হয়েছে, যাদের কেউ কল্যাণে পশ্চাৎবর্তী হতে আগ্রহী নয় ; তাদের একজন মাগরিব ও ইফতার উভয়টিকেই বিলম্ব করে, অপরজন দ্রুত করে মাগরিব ও ইফতার। আয়েশা বললেন : কে মাগরিব ও ইফতার দ্রুত করে ? বললেন : আব্দুল্লাহ। আয়েশা উত্তর দিলেন : রাসূল সা. এভাবেই রোজা পালন করতেন।

আব্দুল্লাহ বিন আবি আউফা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :—

كنا مع رسول الله صلى الله عليه و سلم في سفر في شهر رمضان، فلما غابت الشمس قال: يا فلان انزل فاجدح لنا! قال: يا رسول الله إن عليك نهاراً!، قال: انزل فاجدح لنا!، قال: فنزل فجدح، فأتاه به فشرب النبي صلى الله عليه و سلم ثم قال بيده: إذا غابت الشمس من ها هنا وجاء الليل من ها هنا فقد أفطر الصائم

একবার, রমজান মাসে আমরা রাসূলের সাথে সফরে ছিলাম। সূর্য অস্তমিত হলে তিনি বললেন, হে অমুক ! নেমে এসে আমাদের জন্য ছাতু ও পানি মিশ্রিত ইফতার পরিবেশন কর। লোকটি বলল : হে আল্লাহর রাসূল ! এখনও তো দিবসের কিছু বাকি আছে। রাসূল পুনরায় বললেন : নেমে এসে আমাদের জন্য ছাতু ও পানি মিশ্রিত ইফতার পরিবেশন কর। বর্ণনাকারী বলেন : সে নেমে এসে ছাতু ও পানির ইফতার প্রস্তুত করে রাসূলের সামনে উপস্থিত করলে তিনি তা গ্রহণ করলেন। অত:পর তিনি হাতের ইশারা দিয়ে বললেন : সূর্য যখন এখান থেকে এখানে অস্ত যাবে এবং রাত্রি আগত হবে এতটুকু অবধি, তখন রোজাদার রোজা ভাঙবে।

জনৈক সাহাবির সূত্র ধরে আব্দুল্লাহ বিন হারেস বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আমি রাসূলের নিকট হাজির হলাম, তিনি সেহরি খাচ্ছিলেন। রাসূল বললেন : নিশ্চয় তা বরকত স্বরূপ, আল্লাহ পাক বিশেষভাবে তা তোমাদেরকে দান করেছেন, সুতরাং তোমরা তা ত্যাগ কর না।

যায়েদ বিন সাবেত হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমারা রাসূলের সাথে সেহরি খেলাম, অত:পর তিনি সালাতে দণ্ডায়মান হলেন। আমি বললাম : সেহরি ও আজানের মধ্যবর্তী সময়ের স্থায়িত্ব কতটা ? তিনি বললেন : পঞ্চাশ আয়াত তেলাওয়াত পরিমাণ দৈর্ঘ্য। বিলম্বে সেহরি গ্রহণ রোজার জন্য সহজ, রোজাদারের জন্য প্রশান্তিকর ; এবং বিলম্বে সেহরি গ্রহণের কারণে ফজরের সালাত ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না।

আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : মোমিনের উত্তম সেহরি শুকনো খেজুর।

আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :—

قال رسول الله صلي الله عليه و سلم -وذلك عند السحور-: يا أنس إني أريد الصيام، أطعمني شيئاً، فأتيته بتمر وإناء فيه ماء، وذلك بعد ما أذن بلال

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেহরিকালিন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন—হে আনাস, আমি রোজা রাখতে আগ্রহী। আমাকে কিছু আহার করাও। আমি তার সামনে শুকনো খেজুর এ একটি পাত্রে পানি উপস্থিত করলাম। বেলালের (প্রথম) আজানের পর তিনি সেহরি গ্রহণ করেছিলেন।

উপরোক্ত হাদিসগুলো সামনে রেখে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, রাসূল ইফতার করতেন দ্রুত—আনাস রা.-এর স্পষ্ট হাদিস এ বিষয়ের উৎকৃষ্ট প্রমাণ, তিনি বলেন : আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে, এমনকি এক ঢোক পানি দিয়ে হলেও, ইফতার করা ব্যতীত মাগরিবের সালাত আদায় করতে দেখিনি।

আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূল বলেছেন—

تسحروا ولو بجرعة من ماء

এক ঢোক পানি দ্বারা হলেও, তোমরা সেহরি গ্রহণ কর।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উবুদিয়ত ও দাসত্বের সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা পেরুনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, সাধ্যানুসারে যাবতীয় উপকরণ ব্যবহার করে কর্মের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করতে প্রয়াসী হয়েছেন।

কীভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান যাপন করেছেন, সানুপুঙ্খ দৃষ্টিতে আমরা যদি তা বিবেচনা করি, তবে দেখতে পাব, রোজাদারদের যারা সেহরি গ্রহণ করেন না, বা করলেও, সম্পন্ন করেন অনেক দ্রুত—মধ্যরাতে, তারা অবশ্যই সুন্নতের সঠিক পথ-বিচ্যুত। দ্রুত সেহরি গ্রহণের কারণে নফ্সকে অযথা ভোগানো হয়। মূলত: রাসূল আমাদের জন্য হেদায়েতের যে আদর্শ রেখে গিয়েছেন, তার পুণ্যবান সহচরগণ সমুন্নত করেছেন যে আদর্শ ও কর্মনীতির মৌল-পন্থা, তার অনুসরণ ও অনুবর্তনেই সাফল্য ও কল্যাণ। আমর বিন মায়মুন রা. বলেন : মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিগণ ছিলেন সকলের চেয়ে সর্বাধিক দ্রুত ইফতারকারী, এবং বিলম্বে সেহরি গ্রহণকারী।

বর্তমান সময়ে ইফতার ও সেহরিকে কেন্দ্র আমরা যে জাঁকজমক ও আচার-অনুষ্ঠান দেখতে পাই, রাসূল কোনভাবেই এর বৈধতা প্রদান করেননি। অতিরিক্ত ভোজন ও বিলাসী আহারের ফলে নফ্স অলসতায় আক্রান্ত হয়, এবাদতের ক্ষেত্রে তার মাঝে সীমাহীন শৈথিল্য ছড়িয়ে পড়ে। সে তাই, বঞ্চিত হয় এ মহান মৌসুমের প্রকৃত ফললাভে। দু:খজনক বিষয় এই যে, কোথাও কোথাও দেখা যায়, মানুষ হারাম ও অবৈধ খাদ্য দিয়ে ইফতার ও সেহরি গ্রহণ করছে, সেহরি ও ইফতারের পিছনে ব্যায় করছে অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ। মানুষ কতটা নির্বিকার হয়ে পড়েছে, এগুলো তার জ্বলন্ত প্রমাণ। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন।

মানুষ সতত ধোঁকায় আক্রান্ত নিজেকে নিয়ে ; নিজেকে সে বঞ্চিত করছে এমন সৌভাগ্য ও অবশ্যম্ভাবী ফলশ্র“তি থেকে, যা হতে পারত তার নাজাতের উপকরণ, পরকালিন জান্নাতী দরজার চাবি স্বরুপ। যেদিন কাজে আসবে না পাহাড়সম সম্পদ, একপাল সন্তান-সন্ততি, আল্লাহ যাকে বিশুদ্ধ অন্তরে শোভিত করেছেন, কেবল তার ললাটেই শোভা পাবে মুক্তির সৌভাগ্য। ইহকালিন নশ্বর কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে মানুষ ত্যাগ করছে-হেলায় হারাচ্ছে পরকালিন অবিনশ্বর প্রাপ্তিকে, এবং রমজান মাসে রাসূল নির্দেশিত কর্মপন্থা ও আহার-ভোজনের নীতিমালা অনুসরণ না করে—আল্লাহর সাথে এবাদতের ক্ষেত্রে দূরত্ব সৃষ্টি, পাপাচার-অনাচারে আক্রান্ত হওয়া ছাড়াও—আক্রান্ত হয় নানারকম দৈহিক অসুস্থতা, স্বাস্থ্যহানিতে, যার জের টানতে হয় দীর্ঘ সময়।

আত্মার প্রবঞ্চনা ও মোহ হতে যে সতর্ক সতত, নিজেকে তার রক্ষা করাই কাম্য। সময় বয়ে যাচ্ছে নিরবধি, সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে ক্রমাগত, যে কর্ম পরকালে কাজে আসবে, বয়ে আনবে মহান ফলাফল, তা ক্রমে নি:শেষ তলানিতে এসে ঠেকছে। রাসূলের পুণ্যময় আচরণ ও জীবনাচারের যে আলো আমাদের স্পর্শ করেছে, তা নিয়েই যে ব্যক্তি বেঁচে থাকতে প্রয়াসী, রাসূলের পূর্ণাঙ্গ অনুবর্তনই যার ইহকালীন একমাত্র অবলম্বন, পার্থিব আস্বাদকে ছুঁড়ে মারা তার দায়িত্ব; আলস্য পরিহার করে ধর্মের মৌলিক এবাদতে নিজেকে নিয়োগ করা, সৌভাগ্যের অনুষঙ্গের মাধ্যমে আত্মায় ও মননে শোভিত হওয়া, এবং অধিক-হারে কল্যাণ-কর্মে ব্রতী হওয়া তার একমাত্রিক কর্তব্য।

বিষয়: বিবিধ

১১৮৭ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

242400
০৭ জুলাই ২০১৪ রাত ১২:১৮
সন্ধাতারা লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ খুব ভালো লাগলো লিখাটি
242403
০৭ জুলাই ২০১৪ রাত ১২:২৬
খেলাঘর বাধঁতে এসেছি লিখেছেন : ভিজন বিলাসী আহার করতে মানা কেন? কে কি খাবে তা আল্লা সবার জন্মের আগেই গোডাউনে স্টক করে রেখেছেন।

আর ৪০ উদ্ধ বয়সে প্রতি দিন খেজুর খেলে শরীরে সুগার প্রবলেম হতে পারে তা নবী হয়তো জানতেন্না।
242413
০৭ জুলাই ২০১৪ রাত ০১:৪৩
আফরা লিখেছেন : অনেক ভাল লেখা শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ ।
242658
০৭ জুলাই ২০১৪ রাত ০৮:৫৫
এ এম এম নিজাম লিখেছেন : ভাই আপনি পুরোটা লেখাটা মনযোগ দিয়ে পড়লে অবশ্যই বুঝতে পারতেন যে কেন ভোজন বিলাসী খাওয়া ইফতার এবং সাহরীতের মানা করেছন? আর মানাই বা করলেন কোথায় সেখানেতো খাবার গ্রহণে সংযত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

আর খেজুরের যে বিষয়টিতে আপনি যা বলেছেন,তা নিয়ে আপনার আরো গবেষনা করা দরকার।
৥ খেলাঘর বাধঁতে এসেছি ৥
242726
০৮ জুলাই ২০১৪ রাত ০৩:০০
নাহিন লিখেছেন : ইসলামের সমলাচোনা করা কিছু লোকের মানোসিক রোগ,
243039
০৯ জুলাই ২০১৪ রাত ০৪:২৪
ভিশু লিখেছেন : অনেক কিছু জানতে পারলাম আপনার এই তথ্যবহুল লেখাটি থেকে! মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর রাসূলের (সা.) যথার্থ অনুসরণ করার তৌফিক দিন, আমীন! জাযাকাল্লাহ খাইরান!
244612
১৪ জুলাই ২০১৪ দুপুর ১২:৫১
ইবনে হাসেম লিখেছেন : কবে কোথা থেকে যে এতো জাকজমকপূর্ণ ইফতার আর সেহরীর আয়োজন শুরু হলো, কেউ যদি জানাতেন?

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File