সৌদি-ইরানের মৃত্যুদন্ড: ইসলামি শরিয়াহর অপব্যাবহার ।

লিখেছেন লিখেছেন মুসাফির মাহফুজ ০৫ জানুয়ারি, ২০১৬, ০১:১১:৪১ রাত



সম্প্রতি সময়ে মুসলিম বিশ্বের দুই আদর্শিক রাষ্ট্রে আলোচিত মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে । একটি হল সুন্নি মুসলিমদের মারকাজ সৌদি আরাবিয়া আর অন্যটি শিয়া মুসলিমদের মারকাজ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান । দুটি আলাদা চিন্তা ও মতের দেশ হওয়া সত্তেও এক জায়গায় তাদের রয়েছে সখ্যতা । তারা উভয়ে ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী পরিচালিত বলে দাবি করে । অর্থাৎ তাদের রাষ্ট্রের সকল কার্য়াবলীর ভিত্তি হলো ইসলামি শরিয়াহর উপর । বিশেষ করে আইন ও বিচার বিভাগ সম্পুর্ন ইসলামের আলোকে সাজোনো । তাদের এই দাবির ফলে মুসলিম এবং অমুসলিম বিশ্বে এক ধরনের চিন্তা ও মনস্তাত্বিক ধারার জন্ম নেয় যে তারা যা করছে তাই ইসলাম। এই দুই রাষ্ট্রে শরিয়াহ শাসনের নামে যে সকল কাজ হচ্ছে তাই ইসলামের প্রাকটিকাল রূপ ।

একজন ইসলামিক স্টাডিজের ছাত্র হিসাবে এটা আমার কাছে পরিষ্কার যে, ইসলামে হুদুদ আইন বর্তমান রয়েছে । হুদুদ আইন বলতে আমরা সেই শাস্তি ব্যবস্থাকে বুঝিয়ে থাকি যা এমন সব অপরাধের শাস্তি হিসাবে কুরআন ও সুন্নাহর পরিষ্কার নির্দেশনা ( নস) দ্বারা সাব্যস্ত । তাই ইসলামি শরিয়াতে হুদুদ আইন বর্তমান আছে । এবং হুদুদ আইনের সর্বোচ্চ পর্যায় হল হত্যা বা কতল । এছাড়াও অপরাধ ভেদে নানা শাস্তি রয়েছে ।

আমি হত্যা নিয়ে কথা বলছি । পবিত্র কুরআনের নস দ্বারা দুটি কারনে হত্যার বিধান প্রমাণ করা যায় । অর্থাৎ দুটি অপরাধ করার জন্য হত্যার আদেশ কুরআনিক নস দ্বারা প্রমাণিত । এক) ইচ্ছাকৃত কাউকে হত্যা করছে এটি সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হলে, দুই) বিবাহিত কোন পুরুষ বা নারী ব্যাভিচার করছে তা চার পুরুষের প্রত্যাক্ষ সাক্ষ্য বা আত্মসাক্ষ্য দ্বারা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হওয়া । এই দুই অপরাধে কুরআন মৃত্যুদন্ড আরোপ করেছে । কেননা এই দুটি অপরাধ মানবতার শেষ রেখাকেও মুছে দেয় । এ নিবন্ধে আমি এ নির্দেশের কারন বর্ননা করার দিকে যেতে চাচ্ছিনা । রাসুলের সা: সুন্নাহ দ্বারা আরো একটি অপরাধের সন্ধান পাওয়া যায় যার জন্যও হত্যা বা কতলের বিধান রাখা হয়েছে । তা হল স্বেচ্ছায় ইসলাম ত্যাগ করে অমুসলিম হওয়ার পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া গেলে । অর্থাৎ যাকে আমরা মুরতাদ নামে জানি ।

এখানেই আমাদের থেমে গেলে চলবে না । ইসলমি শরিয়াতে সকল বিধান প্রয়োগ কারার জন্যও কিছু নিয়ম নীতি বা শর্তারোপ করা আছে । তাই সকল শর্ত পুরোন না করে যদি শাস্তির বিধান কার্যকর করা হয় তবে তা শরিয়াহ অনুমোদন দিবে না ।

ইসলামি শরিয়াহ বিশেষজ্ঞরা হুদুদ আইন প্রয়োগের জন্য কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে অনেকগুলি শর্তের কথা বলেছেন । তারমধ্যে উল্লেখ যোগ্য হল

০১, সমাজ ও পরিবেশ ইসলামিক হতে হবে । যে সমাজে এই অপরাধ সংঘঠিত হচ্ছে তা সম্পুর্ন রূপে জাহিলিয়াত মুক্ত ও ইসলামি আচার-আচারনে পুর্ন হতে হবে । যেখানে সত্য পালনে মানুষ সকল উপকরন পাবে ।

০২, হুদুদ বাস্তবায়ন করার জন্য একটি স্বীকৃত ফোরাম থাকতে হবে । সম্পুর্ণ নিরপেক্ষ ও ইনসাফকারী একটি পরিষদ থাকবে যাদের ব্যাপারে মুসলিম সমাজ অনুমোদন দিবে ।

০৩, একটি সম্পুর্ন নিরাপেক্ষ ও তাকওয়াবান বিচার ব্যাবস্থায় পরিষ্কারভাবে অপরাধ প্রমাণিত হতে হবে । অপরাধীকে তার আত্মপক্ষ সমার্থনের পুর্ন সুযোগ দিতে হবে।

০৪, অপরাধ সংগঠিত হওয়ার পিছনে যদি স্বেচ্ছায় সংগঠন ব্যাতীত অন্য কোন কারন পাওয়া যায় তবে হুদুদ বাস্তবায়ন করা যাবে না । বরং সেখানে তাযীর বা বিচারকের বিবেক দ্বারা লঘু শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে ।

০৫, মৃত্যুদন্ড কেবল মাত্র কুরআন ও সুন্নাহ বর্নিত তিন( হত্যা+ ব্যভিচার+ মুরতাদ ) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে । অন্য কোন অপরাধে এ শাস্তি দেয়া যাবে না ।

এ সকল শর্তারোপের পিছনে স্কলারগন প্রচুর দলীল প্রমাণ পেশ করেছেন । এখানে তা উল্লেখ করে লেখার কলবর বাড়াতে চাইছিনা ।

এগুলো হল মৃত্যুদন্ডের ব্যাপারে ইসলামি শরিয়াহর তাত্বিক আলোচনা । যে সকল শর্ত এখানে আরোপ করা হয়েছে তা যদি সামনে রাখি তাহলে এটা সুর্যের মত পরিষ্কার যে বর্তমান সময়ে মুসলিম বিশ্বে যে সকল মৃত্যুদন্ড দেয়া হচ্ছে তা সবেই শরিয়াহ আইনের বাইরে । সম্প্রতি সময়ের সৌদি আরব ও ইরানে কেবল মাত্র রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত পার্থাক্য থাকার কারনে অনেককে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে । কেবল এই দুই দেশেই নয় বরং যেসকল মুসলিম দেশসমুহে মৃত্যুদন্ড দেয়ার নজির আছে তার সবগুলোই শরিয়াহ আরোপিত শর্ত পুরোন না করেই করছে । বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশও এই রেকর্ডে পিছিয়ে নেই ।

এখন সব থেকে গুরুত্বপুর্ন প্রশ্ন হল যে বর্তমান মুসলিম বিশ্বে কোন অপরাধের শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার সুযোগ আছে কিনা ? কেননা পৃথিবীর কোন মুসলিম দেশই তাদের দেশকে সম্পুর্ণ ইসলামিক করতে পারে নি। তাদের বিচার বিভাগ পুর্ন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নয় বরং তা শাষকদের পছন্দের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে । তাদের সমাজের গরীব ও বিরোধী পক্ষকে দমন করার জন্য শরিয়াহ আইন বাস্তবায়ন করলেও সমাজের বৃত্তবান ও ক্ষমতাবান পক্ষের কোন অপরাধই আইন ও বিচার ব্যবস্থার চোখে পড়েনা ।

এ রকম অবস্থা মুসলিম বিশ্বের সকল দেশেরই । তাই এই অবস্থায় কোন মুসলিম দেশই ইসলামি শরিয়াহর মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করতে পারেনা । প্রফেসর ড. তারেক রামাদান সহ অনেকেই এ ব্যাপারে খোলামেলা মত দিয়েছেন । আমার কাছেও তাদের মতকে অধিক নিরাপদ ও শরিয়াহ সম্মত মনে হচ্ছে । কেননা একই অপরাধ করে ক্ষমতাবান ও বিরোধী পক্ষ আলাদা শাস্তি পেতে পারেনা । আর বর্তমান সময়ে মুসলিম শাসকগন তাদের বিরোধী শক্তিকে দমন করার জন্য শরিয়াহর এই হুদুদ আইন ব্যবহার করছে । তারা ইসলামী হুকুমাত কায়েম করার কোন মানসিকতা পোষন করে না ।

এই নিবন্ধের শেষে এসে একথা পরিষ্কার হচ্ছে যে সৌদি বা ইরান কেউই ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্য হুদুদ কায়েম করছেনা বরং তাদের নিজেস্ব স্বার্থ কায়েম করার জন্যেই শরিয়াহকে ব্যবহার করছে । তাছাড়াও তাদের সমাজ ও বিচার ব্যবস্থায়ও হুদুদ কায়েম করার যোগ্যতা অর্জিত হয়নি ।

আমি শরিয়াহ আইনের বিরোধী নয় । শরিয়াহর আইন চিরন্তন ও শ্বাশ্বত । তার কোন পরিবর্তন নেই । কিন্তু সেই আইন প্রয়োগের যে নীতিমালা শরিয়াহ দিয়েছে তা আগে নিশ্চিৎ করতে হবে । তবেই ইসলামের আসল সৌন্দর্য্য প্রকাশ পাবে । অন্যথায় মাজলুম মানুষের চিৎকারে কেবল আকাশই ভারি হবে তাতে জালিমের অট্টহাসি থামবে না ।

বিষয়: বিবিধ

২১৯০ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

356146
০৫ জানুয়ারি ২০১৬ রাত ০১:৩২
নাবীল লিখেছেন : এই আইন শুধু তাদের রাজতন্ত্র টিকানোর জন্য।
তাদের ঘরে ব্যভিচারে ভরা।
সেই গুলির বিচার সোদি আরবে নাই।

356151
০৫ জানুয়ারি ২০১৬ রাত ০২:১৪
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ পিলাচ
356159
০৫ জানুয়ারি ২০১৬ সকাল ০৮:২১
সঠিক ইসলাম লিখেছেন : ১. শুধু মৃত্যুদন্ডই নয় ইসলামের ফৌজদারী বাকী আইন গুলো কি বাস্তবায়ন করার যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে কোন মুসলিম দেশ ?

২. আপনার মতে শরীয়াহ আইন এবং পাশ্চত্য আইনের মাঝে পার্থক্যগুলো কি কি ? পাশ্চাত্য আইন কি আমাদের মাকাসিদে শরীয়াহ বিরোধী ?

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File