শবে বরাত বিতর্ক : ইসলামিক দৃষ্টিকোণ

লিখেছেন লিখেছেন মুসাফির মাহফুজ ০৯ জুন, ২০১৪, ০৪:৩৫:২৭ বিকাল



'শব' একটি ফারসী শব্দ এর অর্থ রাত। 'বারায়াত'কে যদি আরবী শব্দ ধরা হয় তাহলে এর অর্থ হচ্ছে সম্পর্কচ্ছেদ, পরোক্ষ অর্থে মুক্তি। যেমন কুরআন মাজীদে সূরা বারায়াত রয়েছে যা সূরা তাওবা নামেও পরিচিত। ইরশাদ হয়েছে :

০১ : আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা। (সূরা তাওবা, ১):

০২ : তোমাদের মধ্যকার কাফিররা কি তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ? না কি তোমাদের মুক্তির সনদ রয়েছে কিতাবসমূহে? (সূরা কামার, ৩৪)

আর 'বারায়াত' শব্দকে যদি ফারসী শব্দ ধরা হয় তাহলে উহার অর্থ হবে সৌভাগ্য। অতএব শবে বরাত শব্দটার অর্থ দাড়ায় মুক্তির রজনী, সম্পর্ক ছিন্ন করার রজনী। অথবা সৌভাগ্যের রাত, যদি 'বরাত' শব্দটিকে ফার্সী শব্দ ধরা হয়।

শবে বরাত শব্দটাকে যদি আরবীতে তর্জমা করতে চান তাহলে বলতে হবে 'লাইলাতুল বারায়াত'।

সার কথা হল 'বারায়াত' শব্দটিকে আরবী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সম্পর্কচ্ছেদ বা মুক্তি। আর ফারসী শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সৌভাগ্য।

আল-কুরআনে শবে বরাতের কোন উল্লেখ নেই

শবে বরাত বলুন আর লাইলাতুল বারায়াত বলুন কোন আকৃতিতে শব্দটি কুরআন মাজীদে খুজে পাবেন না। সত্য কথাটাকে সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায় পবিত্র কুরআন মাজীদে শবে বরাতের কোন আলোচনা নেই।

অনেককে দেখা যায় শবে বরাতের গুরুত্ব আলোচনা করতে যেয়ে সূরা " আদ-দুখান" এর প্রথম চারটি আয়াত প্রমান হিসেবে পেশ করেন। আয়াত সমূহ হল :

حم ﴿১﴾ وَالْكِتَابِ الْمُبِينِ ﴿২﴾ إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ ﴿৩﴾ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ ﴿৪﴾ (الدخان: ১-৪)

অর্থ : হা-মীম। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমিতো এটা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। আমি তো সতর্ককারী। এই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়। (সূরা দুখান, ১-৪)

এ আয়াতদ্বয়ের তাফসীরে অধিকাংশ মুফাসসির বলেনঃ এ আয়াত দ্বারা রমযানের লাইলাতুল ক্বাদরকেই বুঝানো হয়েছে। যে লাইলাতুল কাদরের চারটি নাম রয়েছে: ১. লাইলাতুল কাদর, ২. লাইলাতুল বারা’আত, ৩. লাইলাতুচ্ছফ, ৪.লাইলাতুল মুবারাকাহ। শুধুমাত্র ইকরিমা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, এ আয়াত দ্বারা শা’বানের মধ্যরাত্রিকে বুঝানো হয়েছে। এটা একটি অগ্রহণযোগ্য বর্ণনা।

আল্লামা ইবনে কাসীর (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) বলেন, আলোচ্য আয়াতে ‘মুবারক রাত্রি’ বলতে ‘লাইলাতুল ক্বাদর বুঝানো হয়েছে, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেনঃ

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ - سورةالقدر:1

আমরা এ কোরআনকে ক্বাদরের রাত্রিতে অবতীর্ণ করেছি। (সূরা আল-কাদরঃ১)।

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেনঃ

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ - سورة البقرة:185

রমযান এমন একটি মাস যাতে কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। (সূরা আলবাকারাহঃ১৮৫)।

যিনি এ রাত্রিকে শা‘বানের মধ্যবর্তী রাত বলে মত প্রকাশ করেছেন, যেমনটি ইকরিমা থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি অনেক দূরবর্তী মত গ্রহণ করেছেন; কেননা কোরআনের সুস্পষ্ট বাণী তা রমযান মাসে বলে ঘোষণা দিয়েছে’। (তাফসীরে ইবনে কাসীর (৪/১৩৭)।

অনুরূপভাবে আল্লামা শাওকানীও এ মত প্রকাশ করেছেন। (তাফসীরে ফাতহুল ক্বাদীর (৪/৭০৯)।

সুতরাং ভাগ্য রজনী হলো লাইলাতুল ক্বাদর যা রমযানের শেষ দশদিনের বেজোড় রাত্রিগুলো।

আর এতে করে এও সাব্যস্ত হলো যে, এ আয়াতের তাফসীরে ইকরিমা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) মতভেদ করলেও তিনি শা’বানের মধ্য তারিখের রাত্রিকে লাইলাতুল বারা’আত নামকরণ করেননি।

শরীয়তের মানদন্ডে শাবানের ১৫তম রজনীর মাহাত্ম্য:

শাবানের মধ্য রজনী একটি পবিত্র ও মাহাত্ম্যপূর্ণ রজনী। এর রয়েছে স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ করুণা ধন্য এ রাত। এ রাতে ইবাদাত-বন্দেগী করা উত্তম। এ মর্মে কুরআনে কিছু না থাকলেও হাদীসের মধ্যে রয়েছে সুস্পষ্ট বক্তব্য। একাধিক হাদীস দ্বারা এই মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত।

নিন্মে হাদীসগুলো সূত্র ও স্তর বিবরণসহ উল্লেখ করা হলো:

১. মু‘আয বিন জাবালের হাদীস:

হযরত মু‘আয বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (স.) ইরশাদ করেন,

يَطْلُعُ اللَّهُ إِلَى خَلْقِهِ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ

“আল্লাহ তাঁর সমস্ত সৃষ্টির দিকে শাবানের মধ্যরাতে দৃষ্টি দেন। অতঃপর তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে মাফ করে দেন, শুধুমাত্র মুশরিক ও হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত”।

এ হাদীসটি ইবনি হিব্বান তাঁর ছহীহের বর্ণনা করেছেন।

“হাদীসটি ইমাম তাবারানী তাঁর আল-মু‘যাম আল-কাবীর ও আছ-ছগীরের মধ্যে রিওয়ায়িত করেছেন। এ দুটোতেই হাদীসটির বর্ণনাকারীরা নির্ভরযোগ্য”।

২. হযরত আবু বকরের হাদীস:

হযরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (স.) বলেছেন,

(إذا كانت ليلة النصف من شعبان ينزل الله تبارك وتعالى إلى سماء الدنيا فيغفر لعباده إلا ما كان من مشرك أو مشاحن لأخيه

যখন শাবানের মধ্য রাত আসে, আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে অবর্তীর্ণ হন। তারপর সব বান্দাকে মাফ করে দেন। শুধুমাত্র মুশরিক ও যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রতি শত্রুতাভাবাপন্ন তাদেরকে ছাড়া”।

ইমাম হাইসামী مجمع الزوائد এ বলেন:

হাদীসটি ইমাম বাযযার বর্ণনা করেছেন। এর সনদের মধ্যে আবদুল মালিক বিন আবদিল মালিক নামে একজন রাবী আছেন। ইবনু আবি হাতিম আল-জারহ অত-তাদিল কিতাবে তার কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তাকে দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেন নি। এছাড়া, সনদের অন্যান্য সব রাবী (বর্ণনাকারী) বিশ্বস্ত”।

৩. আবু ছা‘লাবাহর হাদীস:

হযরত আবু ছা‘লাবাহ থেকে বর্ণিত। নবী (স.) ইরশাদ করেন,

يطلع الله إلى عباده ليلة النصف من شعبان فيغفر للمؤمنين ويمهل الكافرين ويدع أهل الحقد لحقدهم حتى يدعوه

“আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অর্ধ শাবানের রাতে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং সমস্ত মুমিনকে মাফ করে দেন। তবে কাফিরদেরকে অবকাশ দেন। আর হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারীদেরকে পরিত্যাগ করেন, যতক্ষণ না তারা হিংসা-বিদ্বেষ বর্জন করে”।

ইমাম হাইসামী বলেন:

তাবারানী হাদীসটি বেওয়ায়েত করেছেন। এর মধ্যে আল-আহওয়াস বিন হাকীম নামে একজন রাবী আছেন। তিনি দুর্বল”।

৪. আবু মুসা আশ‘আরীর হাদীস:

আবু মুসা আশ‘আরী (রা.) রাসূল (স.) থেকে বর্ণনা করেন,

إِنَّ اللَّهَ لَيَطَّلِعُ في لَيْلَةِ النِّصْفِ من شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خلقة إلا لِمُشْرِكٍ أو مُشَاحِنٍ

“নিশ্চয়ই আল্লাহ অর্ধ শাবানের রাত্রিতে তাকান। তারপর মুশরিক ও মুশাহিন (অন্যের প্রতি বৈরিভাব পোষণকার) ব্যতীত তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন”।

ইমাম ইবনু মাজাহ এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। مجمع الزوائد (মাজমাউয যাওয়াইদ) নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে, إسناده ضعيف এর সনদটি দুর্বল। তবে ইমাম আলবানী বলছেন, حديث حسن এটি একটি হাসান হাদীস।

৫. হযরত আবু হুরায়রার হাদীস:

عن أبي هريرة قال قال رسول الله -صلى الله عليه وسلم-: إذا كان ليلة النصف من شعبان يغفر الله لعباده إلا لمشرك أو مشاحن

হযরত আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (স.) বলেন, “যখন অর্ধ শাবানের রাত্রি আসে, আল্লাহ তাঁর সব বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। তবে মুশরিক ও মুশাহিন ব্যতীত”।

ইমাম ইবনুল হাইসামী এ হাদীস প্রসঙ্গে বলেন, “হাদীসটি ইমাম বাযযার বর্ণনা করেছেন। এর সনদের মধ্যে হিশাম বিন আবদুর রহমান নামে এক ব্যক্তি আছেন। তাকে আমি চিনি না। তবে অন্যান্য সবাই নির্ভরযোগ্য”।

৬. হযরত ‘আইশার হাদীস:

ক. ইমাম তিরমিযি হযরত ‘আইশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন,

فَقَدْتُ رَسُولَ الله -صلى الله عليه وسلم- لَيْلَةً فَخَرَجْتُ فإذا هو بِالْبَقِيعِ فقال: أَكُنْتِ تَخَافِينَ أَنْ يَحِيفَ الله عَلَيْكِ وَرَسُولُهُ، قلت: يا رَسُولَ اللَّهِ إني ظَنَنْتُ أَنَّكَ أَتَيْتَ بَعْضَ نِسَائِكَ، فقال: إِنَّ اللَّهَ عز وجل يَنْزِلُ لَيْلَةَ النِّصْفِ من شَعْبَانَ إلى السَّمَاءِ الدُّنْيَا فَيَغْفِرُ لِأَكْثَرَ من عَدَدِ شَعْرِ غَنَمِ كَلْبٍ

“একদা রাত্রিতে আমি রাসূল (স.) কে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই তার সন্ধানে বের হলাম। জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে তাকে পেলাম। তিনি বললেন, তুমি কি আশঙ্কা করছিলে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (স.) তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি ভেবেছিলাম, আপনি অপনার অন্য কোন স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা অর্ধ শাবানের রাত্রিতে দুনিয়ার আকাশে অবর্তীর্ণ হন এবং বনী কালবের ছাগল পালের লোমের চেয়ে অধিক পরিমাণ মানুষের গুনাহ মাফ করে দেন”।

ইমাম তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন,

حَدِيثُ عَائِشَةَ لَا نَعْرِفُهُ إلا من هذا الْوَجْهِ من حديث الْحَجَّاجِ وسَمِعْت مُحَمَّدًا يُضَعِّفُ هذا الحديث

‘আইশার হাদীসটি হাজ্জাজের এই সূত্র ছাড়া অন্য কোন ধারা থেকে আমাদের জানা নেই। মুহাম্মাদ এই হাদীসটিকে দুর্বল বলেছেন বলে শুনেছি’।

খ. ইমাম বায়হাক্কী বর্ণনা করেন,

أن عائشة قالت: قام رسول الله -صلى الله عليه وسلم- من الليل يصلي فأطال السجود حتى ظننت أنه قد قبض فلما رأيتُ ذلك قمت حتى حركت إبهامه فتحرك فرجعت، فلما رفع الي رأسه من السجود وفرغ من صلاته قال: يا عائشه أو يا حميراء: أظننت أن النبي قد خاس بك؟ قلت: لا والله يا رسول الله، ولكنني ظننتُ أنك قبضت لطول سجودك، فقال: أتدرين أي ليلة هذه؟ قلت: الله ورسوله أعلم قال هذه ليلة النصف من شعبان، إن الله عز وجل يطلع على عباده في ليلة النصف من شعبان، فيغفر للمستغفرين، ويرحم المسترحمين، ويؤخر أهل الحقد كما هم)

হযরত ‘আইশা (রা.) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (স.) রাতে নামাযে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সিজদা করলেন যে, আমার আশঙ্কা হলো, তাঁর হয়তো ইনতেকাল হয়ে গেছে। আমি তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে ‘আইশা, অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা! তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল (স.) তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যু বরণ করেছেন কিনা? নবীজী জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত)। আল্লাহ তা‘আলা অর্ধ শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি প্রদান করেন, ক্ষমা প্রার্থনাকারীদেও ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই”।

গ. ইমাম বায়হাকীর অন্য বর্ণনায় রয়েছে,

فقال هذه الليلة ليلة النصف من شعبان، ولله فيها عتقاء من النار بعدد شعور غنم كلب،لا ينظر الله فيها إلى مشرك ولا إلى مشاحن ولا إلى قاطع رحم ولا إلى مسبل ولا إلى عاقّ لوالديه ولا إلى مدمن خمر، قال: ثم وضع عنه ثوبيه فقال لي: يا عائشة تأذنين لي في قيام هذه الليلة، فقلت: نعم بأبي وأمي فقام فسجد ليلا طويلا حتى ظننت أنه قبض، فقمت التمسته ووضعت يدي على باطن قدميه فتحرك ففرحت وسمعته يقول في سجوده: أعوذ بعفوك من عقابك، وأعوذ برضاك من سخطك، وأعوذ بك منك جل وجهك لا أحصي ثناءً عليك، أنت كما أثنيتَ على نفسك، فلما أصبح ذكرتهن له فقال يا عائشة: تعلمتِهنَّ؟ فقلت: نعم. فقال: تعلميهنَّ وعلميهنَّ؛ فإن جبريل عليه السلام علمنيهنَّ وأمرني أن أرددهن في السجود

‘অতঃপর তিনি বললেন, এই রাত্রিটি হচ্ছে অর্ধ শাবানের রাত্রি। এই রাতে আল্লাহ কালব গোত্রের ছাগলের গায়ে যে পরিমাণ পশম আছে, সেই পরিমাণ লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেন। তবে আল্লাহ এ রাতে মুশরিক, বিদ্বেষপোষণকারী, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, হাটুর নীচে পোশাক পরিধানকারী, মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান এবং মাদকাসক্তের প্রতি তাকান না। অতঃপর আবরণ সরিয়ে বললেন, হে ‘আইশা! তুমি কি আমাকে এই রাত্রে ইবাদাত করার অনুমিত দিবে? আমি বললাম, অবশ্যই, আমার বাবা-মা আপনার জন্য কুরবান হোক। অতঃপর তিনি দাঁড়ালেন এবং এত লম্বা সিজদা করলেন যে, আমার ভয় হলো, তিনি মনে হয় ইনতেকাল করেছেন। তাই আমি উঠে তার শরীর স্পর্শ করলাম। তাঁর পায়ের তলদেশে হাত রাখলাম। তাঁর পা নড়ে ওঠলো। আমি খুশী হলাম। তাকে শুনতে পেলাম, তিনি বলছেন, (হে আল্লাহ) তোমার ক্ষমার দ্বারা তোমার শাস্তি হতে আশ্রয় চাই। তোমার সন্তুষ্টির দ্বারা তোমার ক্রোধ থেকে বাঁচতে চাই। তোমার থেকেই তোমার কাছে আশ্রয় চাই। তোমার প্রশংসা করে শেষ করতে পারব না। তুমি তেমন, যেমনটি তুমি নিজেই নিজের প্রশংসা করেছ। অতঃপর যখন সকাল হলো, আমি এ দু‘আটি বললাম। রাসূল (স.) বললেন, ‘আইশা, তুমি মুখস্ত করে ফেলেছ? বললাম, হ্যাঁ। এগুলো মানুষকে জানিয়ে দাও, শিখিয়ে দাও। জিব্রাইল (আ.) আমাকে এগুলো শিখিয়েছেন এবং সিজদাতে এ দু‘আ পুনরাবৃত্তি করতে বলেছেন’।

ইমাম বায়হাকী হাদীসটি বর্ণনা করে বলছেন, এটির সনদ দুর্বল।

৭. হযরত আবদুল্লাহ বিন ‘উমরের হাদীস:

عن عبد الله بن عَمْرٍو انَّ رَسُولَ الله -صلى الله عليه وسلم- قال: يَطَّلِعُ الله عز وجل إلى خلقة لَيْلَةَ النِّصْفِ من شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِعِبَادِهِ الا لاِثْنَيْنِ: مُشَاحِنٍ وَقَاتِلِ نَفْسٍ

হযরত আবদুল্লাহ বিন ‘উমার (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (স.) বলেন, “আল্লাহ অর্ধ শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি তাকান। অতঃপর সব বান্দাকে ক্ষমা করে দেন, দু’ শ্রেণী ব্যতীত: ক. মুশাহিন (বিদ্বেষপোষণকারী) ; খ. মানব হত্যাকারী”।

ইমাম হাইসামী বলেন,

رواه أحمد وفيه ابن لهيعة وهو لين الحديث وبقية رجاله وثقوا

“ইমাম আহমাদ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এর সনদের মধ্যে রয়েছে, ইবনু লাহীয়াহ। তিনি লাইয়্যেনুল হাদীস (হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে কিছুটা কোমলাতা/দুর্বলতা বিশিষ্ট)। তবেঅন্যান্য সব রাবী নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত”।

৮. আওফ বিন মালিকের হাদীস:

عن عوف بن مالك قال قال رسول الله: – الله عليه وسلم- (يطلع الله تبارك وتعالى على خلقه ليلةَ النصف من شعبان، فيغفر لهم كلِّهم إلا لمشركٍ أو مشاحن

হযরত আওফ বিন মালিক থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (স.) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় সৃষ্টির উপর শাবানের মধ্যরাতে দৃষ্টি নিবন্ধন করেন। এবং তাদের সবাইকেই মাফ করে দেন। শুধুমাত্র মুশরিক ও মুশাহিন ছাড়া।

ইমাম হাইসামী বলেন,

رواه البزار وفيه عبدالرحمن بن زياد بن أنعم وثقه أحمد بن صالح وضعفه جمهور الأئمة وابن لهيعة لين وبقية رجاله ثقات

বাযযার হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এতে আবদুর রহমান বিন যিয়াদ বিন আনউম রয়েছে। ইমাম আহমাদ তাকে নির্ভরযোগ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে অধিকাংশ আলিম তাকে দুর্বল আখ্যায়িত করেছেন। এছাড়া , ইবনু লাহিয়াহও আছেন। যিনি একটু নরম। বাকী সব রাবী সিকাত”।

৯. কাসীর বিন মুররা আল-হাদরামীর হাদীস।

عن كثير بن مرة الحضرمي، قال: قال رسول الله -صلى الله عليه وسلم-: (إن اللهَ ينزل ليلةَ النصف من شعبان، فيغفر فيها الذنوب إلا لمشركٍ أو مشاحن

হযরত কাসীর বিন মুররা আল-হাদরামী থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (স.) বলেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ শাবানের মধ্য রাতে অবতীর্ণ হন। তারপর এ রাতে মুশরিক ও মুশাহিনের গুনাহ ব্যতীত অন্য সব গুনাহ ক্ষমা করে দেন”।

হাদীসটি ইবনু আবি শাইবাহ, আবদুর রাজ্জাক তাদের মুছান্নাফে এবং বাযযার তাঁর মুসনাদের বর্ণনা করেছেন।

এতক্ষণে আমাদের সামনে যে বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে তাহলো, উপরিউক্ত হাদীসগুলোর সনদসমূহ সমপর্যায়ের নয়। কিছু শুদ্ধ, আবার কিছু দুর্বল। তবে সবগুলো একত্রিত করলে এ কথা না বলে কোন উপায় নেই যে, এ রাতটির ফজিলত একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য।

এজন্য গবেষকগণ বলছেন,

বর্ণনার সবগুলো ধারা একত্রিত করলে হাদীসগুলোর সর্ব নিন্মস্তর হবে ‘হাসান লিগইরিহা’।অনেকগবেষক আবার স্পষ্ট করে বলছেন যে, এদের সবগুলো ধারা সমন্বিত করলে ‘ছহীহ লিগইরিহা’র পর্যায়ভুক্ত হবে। কারণ এগুলো যে সব ধারাই বর্ণিত হয়েছে, তাতে নিজেরাই ‘হাসান’ হিসেবে গণ্য।

এ প্রসঙ্গে শরীয়াহ বিশেষজ্ঞ সর্বজন স্বীকৃত আলেমদের বক্তব্য বিষয়টিকে আরো প্রতিভাত করবে। নিন্মেতা প্রদত্ত হলো,

ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ বলেন,

وأما ليلة النصف من شعبان ففيها فضلٌ، وكان في السلف من يصلي فيها، لكنَّ الاجتماع فيها لإحيائها في المساجد بدعةٌ، وكذلك الصلاة الألفية

“অর্ধ শাবানের রাতের মাহাত্ম্য রয়েছে। সালাফদের মধ্যে কেউ কেউ এ রাতে নামায পড়তেন। তবে মসজিদের মধ্যে এ রাতে ইবাদাতের জন্য একত্রিত হওয়াটা বিদ‘আত। তদ্রƒপ আলফিয়্যাহ নামক বিশেষ নামায আদায় করা”।

তিনি আরো বলেন,

ليلةُ نصف شعبان رويَ فيها من الأخبار والآثار ما يقتضي أنها مفضلة ومن السلف من خصَّها بالصلاة فيها وصوم شعبان جاءت فيه أخبار صحيحة أما الصوم يوم نصفه مفرداً فلا أصل له، بل يكره، قال: وكذا اتخاذه موسماً تصنع فيه الأطعمة والحلوى وتظهر فيه الزينة وهو من المواسم المحدثة المبتدعة التي لا أصل لها، وما قيل من قَسْمِ الأرزاق فيها لم يثبت

অর্ধ শাবানের রাত্রির ব্যাপারে অনেক হাদীস ও আছার বর্ণিত হয়েছে। যদ্বরা এ রাতের মাহাত্ম্য ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। সালাফ বা পূর্বসুরীদের মধ্যে কেউ কেউ এ রাতে বিশেষ করে নামায আদায় করতেন। শাবান মাসের রোজার ব্যাপারে বিশুদ্ধ হাদীস এসেছে। তবে শুধুমাত্র পনেরতম দিবসে একটি রোজা পালন করার কোন মূলভিত্তি নেই। বরং তা মাকরূহ। তিনি আরো বলেন, তদ্রƒপ এটিকে রকমারী খাদ্য, হালুয়া তৈরি ও সাজ-সজ্জা প্রকাশের উপলক্ষ বানানো বিদআত। যার কোন ভিত্তি নেই। আর এ রাতে রিযিক বন্টিত হয় এ মর্মে যা কিছু বলা হয় তা প্রমাণিত হয়নি” ।

আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী অর্ধ শাবানের রাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসগুলো নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি কথা শুরু করেছেন এভাবে,

্রحديث صحيح روي عن جماعة من الصحابة من طرق مختلفة يشد بعضها بعضاًগ্ধ،

“হাদীসটি ছহীহ। একদল সাহাবী থেকে বিভিন্ন সূত্রে তা বর্ণিত হয়েছে। যাদের একটি আরেকটিকে মজবুত করে”।

আরশেষ করেছেন এ কথা বলে,

্রوجملة القول أن الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح بلا ريب، والصحة تثبت بأقل منها عدداً، مادامت سالمة من الضعف الشديد كما هو الشأن في هذا الحديثগ্ধ،

মোটামুটি কথা হলো, এই সব ধারায় বর্ণিত হাদীসটি নিঃসন্দেহে ছহীহ বা বিশুদ্ধ। এর চেয়ে কমসংখ্যক সূত্র দিয়েও হাদীসের বিশুদ্ধতা প্রমাণিত হয়। যদি না তাতে প্রবল কোন দুর্বলতা থাকে। যেমনটি এই হাদীস”।

এ রাতের ব্যাপারে কোন বিশুদ্ধ হাদীস নেই, এ মতের প্রবক্তাদের দাবী খন্ডন করতে গিয়ে আল্লামা আলবানী বলেন,

্রليس مما ينبغي الاعتماد عليه، ولئن كان أحد منهم أطلق مثل هذا القول، فإنما أتي من قبل التسرع، وعدم وسع الجهد لتتبع الطرق على هذا النحو الذي بين يديكগ্ধ.

এটা নির্ভরযোগ্য কথা নয়। এ ধরনের কথা যদি কেউ সাধারণভাবে বলেও থাকে, তবে তা নিতান্তই তাড়াহুরোপ্রসূত। হাদীসটির সবগুলো সূত্র বা বর্ণনার ধারা গবেষণায় যথাসম্ভব শক্তি ব্যয় না করেই এমনটি বলা হতে পারে”।

হাদিস গুলো পর্যালোচনা

উল্লিখিত আলোচনায় এটা স্পষ্ট যে, শা‘বানের মধ্যরাত্রির ফযীলত বিষয়ে যে সব হাদীস বর্ণিত হয়েছে তার সবগুলোই দুর্বল অথবা বানোয়াট ।

প্রাজ্ঞ আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, দুর্বল হাদীস দ্বারা কোন আহকাম- বিধান প্রমাণ করা যায় না। দুর্বল হাদীসের উপর আমল করা জায়েজ । যদিও তার জন্য কয়েকটি শর্ত লাগিয়েছেন তারা। শর্তগুলো নিম্নরূপ -

১. হাদীসটির মূল বক্তব্য অন্য কোন সহীহ হাদীসের বিরোধীতা করবেনা, বরং কোন শুদ্ধ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।

২. হাদীসটি একেবারেই দুর্বল অথবা বানোয়াট হলে চলবে না।

৩. হাদীসটির উপর আমল করার সময় এটা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে প্রমাণিত বলে বিশ্বাস করা যাবে না। কারণ রাসূল থেকে প্রমাণিত বলে বিশ্বাস করলে রাসূলের উপর মিথ্যাচারিতার পাপ হবে, ফলে জাহান্নাম অবধারিত হয়ে পড়বে।

৪. হাদীসটি ফাদায়িল তথা কোন আমলের ফযীলত বর্ণনা সংক্রান্ত হতে হবে। আহকাম (ওয়াজিব, মুস্তাহাব, হারাম, মাকরূহ) ইত্যাদি সাব্যস্তকারী না হতে হবে।

৫. বান্দা ও তার প্রভুর মাঝে একান্ত ব্যক্তিগত কোন আমলের ক্ষেত্রে হাদীসটির নির্ভরতা নেয়া যাবে। তবে এ হাদীসের উপর আমল করার জন্য একে অপরকে আহবান করতে পারবে না।

এ রাতে করণীয়:

উপরোক্ত হাদীসগুলো দ্বারা এ রাতের মাহাত্ম্য প্রমাণিত হলেও সেগুলোতে এ রাতের করণীয় কি তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। শুধুমাত্র হযরত আইশার হাদীসে কিছু নমুনা পাওয়া যায়। তবে করণীয়র চেয়ে এগুলোতে বর্জণীয় কাজের প্রতিই অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।

আর সে গুলো হচ্ছে:

১. শিরক

২. অন্যদের প্রতি বিদ্বেষ পরায়ণ হওয়া,

৩. কাউকে হত্যা করা,

৪. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা;

৫.টাখনুর নীচে কাপড় পরা.

৬. মা-বাবার অবাধ্য হওয়া

৭. মদ সেবন করা।

তাই এ রাত্রির মাহাত্ম্য অর্জন করতে হলে প্রথমেই এ সব কাজ থেকে নিজেকে পবিত্র করতে হবে। তাওবাহ ও পারস্পরিক সম্পর্ক সুসংহত করে নেয়ার মাধ্যমে। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানির মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে।

বেশির হাদীসে দুটো জিনিস বেশি এসেছে। শিরক ও বিদ্বেষ। কারণ এদুটো এমনই মারাত্মক অপরাধ, যা মানুষের ধার্মিকতার মূলে কুঠারাঘাত করে। শিরকের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। আর হিংসা-বিদ্বেষের মাধ্যমে মানুষের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। সমাজে অরাজকতা সৃষ্টি হয়। মুসিলম উম্মাহর মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি হয়।

এছাড়া ও যে কাজ গুলো করা যেতে পারে, তাহলো,

ক. নফল নামায, জিকির-আজকার, তিলাওয়াত,ইলম চর্চা, দুআ ইত্যাদি।

তবে তা একাকী করাই উত্তম। কিন্তু মনে রাখতে হবে,

এ রাতের কোন নির্দিষ্ট নামায বা অন্যকোন নির্দিষ্ট ইবাদাত নেই।

যেমনটি অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়। এ রাত উপলক্ষ্যে, জামাতের সাথে বিশেষ ধরনের নামায আদায় করা, কিংবা অনিবার্য মনে করে মিলাদ মাহফিল করা বা মিষ্টি-হালুয়া ইত্যাদি বিরতণ, কিংবা ভাগ্য রজনী মনে করে সারা বছর ভালো খাওয়া যাবে এ নিয়্যতে এ রাতে রকমারী সুস্বাদু খাদ্য ব্যঞ্জনা খাওয়া, মসজিদ-মাজার ইত্যাদি আলোকসজ্জিত করা, ঈদ উৎসবের আমেজ নিয়ে আড়ম্বতাপূর্ণ পরিবেশে একত্রিত হওয়া, এ রাতকে লাইলাতুল কদরের সমপর্যায়ে নিয়ে প্রাপ্তির চেয়ে অধিক প্রদান করা এগুলো সবই হচ্ছে বাড়াবাড়ি। মোট কথা, এ রাতের মাহাত্ম্য আছে, তবে সীমালংঘনের সুযোগ নেই।

শবে বরাত সম্পর্কিত প্রচলিত ভ্রান্ত বিশ্বাস ও আমলঃ

শবে বরাত যারা পালন করেন তারা শবে বরাত সম্পর্কে যে সকল ধারণা পোষণ করেন ও উহাকে উপলক্ষ করে যে সকল কাজ করে থাকেন তার কিছু নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ

তারা বিশ্বাস করে যে, শবে বরাতে আল্লাহ তা'আলা সকল প্রাণীর এক বছরের খাওয়া দাওয়া বরাদ্দ করে থাকেন। অর্থাৎ এই রাতে রিজিক লিল্পবদ্ধ করা হয়।

এই বছর যারা মারা যাবে ও যারা জন্ম নিবে তাদের তালিকা তৈরী করা হয়।

এ রাতে বান্দার পাপ ক্ষমা করা হয়।

এ রাতে ইবাদাত-বন্দেগী করলে সৌভাগ্য অর্জিত হয়।

এ রাতে কুরআন মাজীদ লাওহে মাহফুজ হতে প্রথম আকাশে নাযিল করা হয়েছে।

এ রাতে গোসল করাকে সওয়াবের কাজ মনে করা হয়।

মৃত ব্যক্তিদের রূহ এ রাতে দুনিয়ায় তাদের সাবেক গৃহে আসে।

এ রাতে হালুয়া রুটি তৈরী করে নিজেরা খায় ও অন্যকে দেয়া হয়।

বাড়ীতে বাড়ীতে এমনকি মসজিদে মসজিদেও মীলাদ পড়া হয়।

আতশবাযী করা হয়।

সরকারী- বেসরকারী ভবনে আলোক সজ্জা করা হয়।

সরকারী ছুটি পালিত হয়।

পরের দিন সিয়াম (রোযা) পালন করা হয়।

কবরস্থানগুলো আগরবাতি ও মোমবাতি দিয়ে সজ্জিত করা হয়।

লোকজন দলে দলে কবরস্থানে যায়।

মাগরিবের পর থেকে মাসজিদগুলি লোকে পরিপূর্ণ হয়ে যায়।

যারা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে ও জুমু'আয় মাসজিদে আসেনা তারাও এ রাতে মাসজিদে আসে। মাসজিদগুলিতে মাইক চালু করে ওয়াজ নাসীহাত করা হয়।

শেষ রাতে সমবেত হয়ে দু'আ-মুনাজাত করা হয়।

বহু লোক এ রাতে ঘুমানোকে অন্যায় মনে করে থাকে।

সারা রাত নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে একশত রাকাত, হাজার রাকাত ইত্যাদি সালাত আদায় করা হয়, কুরআন তিলাওয়াত করা হয়। ইত্যাদি।

আকিদা ও আমলের স্থান, কাল, পাত্রভেদে পার্থক্যঃ

শবে বরাত সম্পর্কে উপরোল্লিখিত কাজ ও আকীদাহসমূহ শবে বরাত উদযাপনকারীরা সকলেই করেন তা কিন্তু নয়। কেহ আছেন উল্লিখিত সকল কাজের সাথে একমত পোষণ করেন। আবার কেহ কিছু কিছু কাজের সাথে একমত পোষণ করেন। যেমন কেউ কেউ আতশবাযী, আলোক সজ্জা পছন্দ করেন না, কিন্তু কবরস্থানে যাওয়া, হালুয়া-রুটি, ইবাদাত-বন্দেগী করে থাকেন। আবার অনেক আছেন যারা এ রাতে শুধু সালাত আদায় করেন ও পরের দিন সিয়াম (রোযা) পালন করেন। এ ছাড়া অন্য কোন আমল করেন না। আবার অঞ্চল ভেদে 'আমলের পার্থক্য দেখা যায়।

আবার বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা রয়েছে। যেমন কেউ কেউ ঐ রাতে কুরআন নাজিল হয়েছে এটা বিশ্বাস করেন না কিন্তু এ রাতে আল্লাহ তা'আলা সকল প্রাণীর এক বছরের খাওয়া দাওয়া বরাদ্দ করে থাকেন। অর্থাৎ এই রাতে রিজিক লিল্পবদ্ধ করা হয় এটা বিশ্বাস করে।

এই প্রচলিত আমল গুলোর মধ্যে কিছু কিছু আমল ভাল তবে ভ্রান্ত বিশ্বাসের কারনে ঐ আমল গুলো বিদাতে পরিনত হয়েছে। যেমন সারা রাত সালাত আদায় করা একটি ভাল কাজ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই ভাল কাজটি শুধু ঐ রাতে কেন? অন্য কোন সাধারন রাতে কেন করা হবে না?

শা‘বানের মধ্যরাত্রির পরদিন কি রোযা রাখা যাবে?

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বহু সহীহ হাদীসে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি শা‘বান মাসে সবচেয়ে বেশী রোযা রাখতেন। (এর জন্য দেখুনঃ বুখারী, হাদীস নং ১৯৬৯, ১৯৭০, মুসলিম, হাদীস নং ১১৫৬, ১১৬১, মুসনাদে আহমাদ ৬/১৮৮, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ২৪৩১, সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস নং ২০৭৭, সুনানে তিরমিঝি, হাদীস নং ৬৫৭)।

সে হিসাবে যদি কেউ শা‘বান মাসে রোযা রাখেন তবে তা হবে সুন্নাত। শাবান মাসের শেষ দিন ছাড়া বাকী যে কোন দিন রোযা রাখা জায়েয বা সওয়াবের কাজ। তবে রোজা রাখার সময় মনে করতে হবে যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেহেতু শা‘বান মাসে রোজা রেখেছিলেন তাকে অনুসরন করে রোযা রাখা হচ্ছে।

অথবা যদি কারও আইয়ামে বিদের নফল রোযা তথা মাসের ১৩,১৪,১৫ এ তিনদিন রোযা রাখার নিয়ম থাকে তিনিও রোযা রাখতে পারেন। কিন্তু শুধুমাত্র শা‘বানের পনের তারিখ রোযা রাখা বিদ‘আত হবে। কারণ শরীয়তে এ রোযার কোন ভিত্তি নেই।

নিয়্যাতই এখানে পার্থক্য নির্ণয়কারী। রাসূল (স.) বলেন, নিয়্যাতের উপরই নির্ভরশীল মানুষের আমল”।

যারা এই রাতকে মর্যাদা সম্মত বলেছেন

এই সূত্রেই অনেক হাদীসবিদ শাবানের মধ্যরাতের ফযীলত রয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেনঃ

• ইমাম আহমাদ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)। [ইবনে তাইমিয়া তার ইকতিদায়ে ছিরাতে মুস্তাকীমে (২/৬২৬) তা উল্লেখ করেছেন]

• ইমাম আওযায়ী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)। [ইমাম ইবনে রাজাব তার ‘লাতায়েফুল মা‘আরিফ’ গ্রন্থে (পৃঃ১৪৪) তার থেকে তা বর্ণনা করেছেন]

• শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)। [ইকতিদায়ে ছিরাতে মুস্তাকীম ২/৬২৬,৬২৭, মাজমু‘ ফাতাওয়া ২৩/১২৩, ১৩১,১৩৩,১৩৪]।

• ইমাম ইবনে রাজাব আল হাম্বলী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)। [তার লাতায়েফুল মা‘আরিফ পৃঃ১৪৪ দ্রষ্টব্য]।

• প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা নাসিরুদ্দিন আল-আলবানী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) [ছিলছিলাতুল আহাদীস আস্সাহীহা ৩/১৩৫-১৩৯]

যারা একে বিদায়াত বলেছেন :

এ ধরণের ইবাদত সম্পূর্ণরূপে বিদ’আত — চাই তা ব্যক্তিগতভাবে হোক বা সামষ্টিকভাবে।

এজন্যই শাইখ আব্দুল আজীজ ইবনে বায (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) সহ আরো অনেকে এ রাত্রির অতিরিক্ত ফযীলত অস্বীকার করেছেন।

ইমাম ‘আতা ইবনে আবি রাবাহ, ইবনে আবি মুলাইকা, মদীনার ফুকাহাগণ, ইমাম মালেকের ছাত্রগণ, ও অন্যান্য আরো অনেকেই এ মত পোষণ করেছেন। এমনকি ইমাম আওযায়ী যিনি শাম তথা সিরিয়াবাসীদের ইমাম বলে প্রসিদ্ধ তিনিও এ ধরনের ঘটা করে মাসজিদে ইবাদত পালন করাকে বিদ‘আত বলে ঘোষণা করেছেন।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের কে তার বিধান অনুযায়ী আমল করে তার সন্তুষ্টি অর্জন করার তাওফিক দান করুন ।আল্লাহর বার্তাবাহকের সুন্নতকে সমন্নুত করে বিদায়াত মুক্ত সমাজ গড়ার তাওফিক দান করুন । আমিন

বিষয়: বিবিধ

২০৪৭ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

232829
০৯ জুন ২০১৪ বিকাল ০৪:৫৬
নীল দাদা লিখেছেন : খুবই প্রয়োজনিয় একটি বিষয় উপস্থাপন করেছেন।
জাযাকাল্লাহ্।
০৯ জুন ২০১৪ রাত ০৮:১৭
179619
মুসাফির মাহফুজ লিখেছেন : জাঝা কাল্লাহ
232839
০৯ জুন ২০১৪ বিকাল ০৫:২১
আল্লাহর সন্তুষ্টি লিখেছেন : অনেক ধন্যবা
পিলাচ
০৯ জুন ২০১৪ রাত ০৮:১৭
179620
মুসাফির মাহফুজ লিখেছেন : শুকরিয়া ভাই
232843
০৯ জুন ২০১৪ বিকাল ০৫:২৪
মেঘ ভাঙা রোদ লিখেছেন : অনেক বরকতময় একটি পোষ্ট। কাজে লাগবে অনেক
০৯ জুন ২০১৪ রাত ০৮:১৭
179621
মুসাফির মাহফুজ লিখেছেন : ধন্যবাদ অনেক অনেক
232946
০৯ জুন ২০১৪ রাত ০৮:৫৮
চক্রবাক লিখেছেন : তথ্য বহুল পোস্ট, ভালো লাগলো ধন্যবাদ!
233195
১০ জুন ২০১৪ দুপুর ১২:১৭
ইমরান ভাই লিখেছেন : জাজাকাল্লাহু খায়রান দারুন তথ্যবহুল উপস্তাপনা। Thumbs Up
233204
১০ জুন ২০১৪ দুপুর ১২:৩৭
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : দরকারী পোস্ট, পড়ে উপকৃত হলাম।
234051
১২ জুন ২০১৪ সকাল ০৬:৫৮
প্রবাসী মজুমদার লিখেছেন : আমার কাছে মনে হয়, সস্তা এবং সুবিধাবাদি রাস্তায় জান্নাতের যাবার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠা অবুঝ মানুষগুলোই এসব কাজে লিপ্ত হয়। নিয়মিত ফরজ আদায়ের চেয়ে এসব দিবসের উসিলায় জান্নাতে যাবার জন্যই ফেতনা সৃষ্টিকারী মানুষগুলো এসব দিন নিয়ে বাড়াবাড়িতে মেতে উঠে। ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File