গাজা ও সিরিয়ার শিশুরা কেমন আছে ?

লিখেছেন লিখেছেন ফাহমিদা সুলতানা শিল্পী ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৬:১৩:৫৬ সকাল



মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে সিরিয়া এবং গাজাতে যে ধংস লীলা চলছে তা সে দেশের শিশুদের ওপর কেমন প্রভাব পরছে তা আর বলার বা বুঝার অপেক্ষা রাখে না। সেখানকার ধংসযজ্ঞ সিনেমাকেও হার মানায়। বিবিসির সাংবাদিক লাইসে দাউসেত সিরিয়া এবং গাজার শিশুদের ওপর পর্যবেক্ষণ করে এই নিবন্ধনটি লিখেছেন। গাজার এক শিশুর চোখের আর্তনাদ ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেছেন ,১২ বছরের ছেলে সায়িদ যখন দেয়ালে হেলান দিয়ে আমার সাথে কথা বলছিল , তার চোখ দেখে মনে হয়েছিল কেউ যদি তাকে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারত ! আমরা যখন এম্বুলেন্স এ একসাথে বসে হাসপাতালে যাচ্ছিলাম তখন কিছু সময়ের জন্য সস্থি পেয়েছিল সে। সেটা দেখে আমার ভালো লেগেছিল। কিন্তু হাসপাতালে গিয়ে দেখে তার ছোট ভাই মারা গেছে । ১৬ জুলাই গাজায় যখন ইসরাইলি হামলা চালানো হয় তখন সে তার কাজিনদের সাথে বন্দরের কাছে খেলছিল। সে হামলায় তার ৩ কাজিন মারা যায়। আহত হয়েছিল ছোট ভাই। গাজা আয়তনে এত ছোট যে শিশুদের লুকানোর কোনো জায়গা নেই। এখানকার শিশুদের রাস্তায় ,স্কুলে সবখানে সব সময় যুদ্ধ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয় । উল্লেখযোগ্য ভাবে এখানকার শিশু মৃতুর সংখা বেড়েই চলেছে । এদের শৈশব মানে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা,আর ধংস লীলা । জাতিসংঘ চলতি বছরের জুলাইতে জানিয়েছে ,গাজাতে প্রতি ঘন্টায় একটি শিশু মারা যাচ্ছে । গাজার এই হামলার পূর্বে সিরিয়ার শিশুদের অবস্থাও বিশ্ব বিবেককে নাড়িয়ে ছিল। যুদ্ধের পরিনাম হিসেবে এখনো সিরিয়াতে শিশুদের হাতে স্নাইপার দেখা যায়। লক্ষ লক্ষ শিশু ক্ষুধার্ত এবং ভীত-সন্ত্রস্ত,বহু অবরুদ্ধ এলাকায় বিবিধ সমস্যার মধ্যে তারা জীবন যাপন করছে। লাইসে দাউসেত সিরিয়ান শিশুদের সম্পর্কে বলেছেন ,সিরিয়াতে যখনই যাই প্রতিবারই আমি শিশুদের রিদয় বিদারক কান্না বা সংক্রামক হাসি দেখে বুঝতে পারি ওরা আর ছোট নেই ,ওরা সব বুঝে ,ওরা ওদের যুদ্ধের গল্প বলতে সক্ষম। গত ছয় মাস ধরে, আমি এবং পরিচালক- ক্যামেরাম্যান রবিন বার্নওয়েল ছয় সিরিয়ান শিশুর জীবন অনুসরণ করে আসছি। তাদের জীবন চিত্র বলে দেয় -যে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ওরা বেড়ে উঠছে তাতে তাদের ভবিষ্যত সমস্যাগ্রস্থ। '' এক সাক্ষাত্কারে সিরিয়ান শিশু লাইসে দাউসেত কে বলে , আমি এজাদিনে , বয়স ৯। আমি শুধু বয়স এবং চেহারাতেই শিশু। কিন্তু মানবতা ,নৈতিকতার খাতিরে আমি তা নই। আগে ১২ বছরের বয়সী কাউকে তরুণ মনে করা হত। এখন তা মনে করা হয় না। এখন ১২ বছর মানেই তোমাকে জিহাদে যেতে হবে। '' অন্য ৯ বছরের শিশুদের মতই এজাদিনে স্কুলের মাঠে ইচ্ছে মত খেলতে বা কানে হেড ফোন লাগিয়ে গান শুনতে পারত। কিন্তু সে ও তার কিশোর ভাই রয়েছে দক্ষিণ তুরস্কর ফ্রি সিরিয়ান আর্মির একটি উদ্বাস্তু শিবিরে। ইতিমধ্যে তার ভাই সীমান্ত যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। শত শত মাইল দূরে দামাস্কাতে ১৪ বছর বয়সী জালালার পৃথিবীটা হচ্ছে দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের জন্য নিবেদিত প্রান হয়ে পাড়া প্রতিরক্ষা ইউনিট এ যুদ্ধ করা। এই যুদ্ধে তার চাচা ও বাবাও রয়েছেন। জালাল অনুতপ্ত হয়ে জানালো , এই যুদ্ধাবস্থা আমাদেরকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। এখন শিশুরাও রাজনীতি সম্পর্কে সব বুঝে। আমরা সবাই দেশের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত।' ৯ বছরের মরিয়ম জানায়, 'আমি আমার পা হারিয়েছি কারণ বাশার আল আসাদ ক্ষমতায় থাকতে চায়। হোমস শহরের বাইরে একটি গ্রামে সিরিয়ান যুদ্ধ বিমানটি আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় সব কিছু ধংস করে দিল। আমি জানালা দিয়ে দেখলাম ,বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত বার্রেল টি আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। ' সে দিন থেকে মরিয়ম আর অন্য শিশুদের সাথে খেলতে পারে না।

'পড়ার বদলে আমি শিখেছি সব ধরনের অস্রের নাম। রাবার বুলেট , বুলেট,ট্রেসার -এ সবের নাম ও আমি জানি। '৮ বছরের শিশু বারা লজ্জাবনত হয়ে এ কথা জানালো। যার পরিবার হোমস শহরের অবরুদ্ধ পুরাতন কোয়ার্টার থেকে পালিয়েছে। এ সব শিশুদের কাছে তাদের পৃথিবী মানেই অবরুদ্ধ ৪ দেয়াল যেখানে কদাচিত বই আর রুটির দেখা মেলে। দামাস্কার বাইরে লাইসে দাউসেত যখন ফিলিস্তিনি ইয়ারমুক শিবিরে ১৩ বছরের শিশু কিফাকে জিগ্যেস করে কেমন চলছে জীবন ? উত্তরে কিফা জানায় ,জীবনটা "স্বাভাবিক"ভাবেই চলছে। যখন জিগ্যেস করা হয় ,তোমরা কি ঠিকমত খেতে পাও ? এ কথা শুনে তার সাহসী চেহারা নিমিষেই মলিন হয়ে যায় । দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল পানি। কাদতে কাদতেই বলল , এখানে কোনো খাবার নেই।' যুদ্ধের এমন পরিস্থিতিই এখন তাদের কাছে স্বাভাবিক জীবন। গাজার পার্শবর্তী জেইতন শহরে একটি গহ্বরময় শেল-এ বাস করে আমের অদা। ৪৫ সদস্যের একটি বড় পরিবারের কর্তা সে। বিবিসি সাংবাদিক লাইসে আমের অদাকে প্রশ্ন করেন , তোমাদের শিশুরা কি ভীত-সন্ত্রস্ত ? আমের অদার পিছনে সিঁড়ির উপর নানা বয়সের শিশুরা গাদাগাদি করে দাড়িয়ে ছিল ,আর কিছু শিশু কংক্রিট মেঝের উপর আড়াআড়ি পা রেখে বসেছিল । গাজায় রাস্তার নিচে দুম করে ইসরায়েলি কামান বা ট্যাংক এ আগুনের দৃশ্যটি একটি নিয়মিত বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। ইসরাইল থেকে নিক্ষিপ্ত রকেট মাটিতে সশব্দে আছড়ে পরার দৃশ্যটিও তাদের কাছে এখন স্বাভাবিক হয়ে দাড়িয়েছে। ৪ বছর বয়সী দিমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আমের অদা আরো জানালো ,ইস্রাইলি সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে এই এলাকার বাইরে ৪৫ সদস্যের পরিবার নিয়ে আমি কোথায় যাব ?এ সবই এখন শিশুদের কাছে স্বাভাবিক ঘটনা। তারা সব জানে। এখানকার শিশুরা প্রায়ই বয়সের চেয়ে বেশি বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলে। ইস্রায়েল এর সতর্কতা,ধর্মঘট সত্তেও একটি পরিবারের ৩ শিশু ছাদের ওপর কবুতর নিয়ে খেলছিল। সেই স্বাভাবিক খেলা ধুলায় তাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে গেল। গাজার বন্দরে ৪ মৃত শিশুর ওপর যখন লাইসে প্রথম রিপোর্ট করে তখন প্রত্যক্ষ দর্শিরা জানায় ,ওই শিশুরা তাদের পরিবারের জন্য বন্দর থেকে ধাতু সংগ্রহ করছিল। যা বিক্রি করে পরিবারকে সাহায্য করা যেত। তাদের বাবা পেশায় জেলে ছিল । সমুদ্রে শিশুদের যাওয়ার অনুমতি নেই বলে তারা যেতে পারে নি। নিহত ২ শিশুর পিতা রমিজ বকর সন্তান শোকে কাতর হয়ে জানালো ,হয় তো ওরা খেলার জন্যই ধাতু কুরাচ্ছিল। আর তাই তো আরব ও ইসরাইলি খেলার বলি হতে হলো তাদের। যুদ্ধের এই ভয়াবহতাই হয়ত তাদের ভবিষ্যত ভাগ্যের খেলার গতি-পথ পরিবর্তন করে দিতে পারে। সিরিয়ান ১১ বছরের শিশু দাদ ভবিষ্যত নিয়ে জানাল তার ঘৃনা। 'আমি ভবিষ্যত ঘৃনা করি ,আমাদেরকে হয় বাচতে হবে নয় তো মরতে হবে। '

বিবিসি অবলম্বনে

বিষয়: বিবিধ

২২৫৯ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

262860
০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ০৬:৪২
কাহাফ লিখেছেন : "যখন জিগ্যেস করা হল:তোমরা কি ঠিক মত খাবার পাও? এ কথা শুনে সাহসী শিশুদের মুখ নিমিষেই মলিন হয়ে যায়।দু'চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে পানি।কাদতে কাদতে বলে-এখানে কোন খাবার নেই।" গাজা ও সিরিয়ার এই সব অসহায় শিশুদের জন্যে কিছুই কী করার নেই আজকের সমাজের?
262879
০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ১০:০৬
বাংলার দামাল সন্তান লিখেছেন : সত্যি আপনার লেখাটি পড়ে চোখের অশ্রু আর ধরে রাখতে পারলাম না, হে আল্লাহ তুমি পৃথিবীতে একজন ওমর পাঠাও।
263057
০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:১৩
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : কিছু বলবার মত ভাষা খুজে পাচ্ছিনা।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File