মারদিয়ানা, বন্ধু আমার! কখনোই ভুলব না তোমাকে ।
লিখেছেন লিখেছেন আরিফা জাহান ২১ মে, ২০১৭, ০৯:৩১:৫৭ রাত
কতক্ষণ আগে রুমে ফিরে আসলাম । এক বুক শুন্যতা আর হাহাকার নিয়ে !
এক কষ্ট ,এই শুন্যতা শুধুই আমার একার ! শুধুই একার!
মারদিয়ানা আমার এক বন্ধু , যাকে বিদায় দিয়ে আসলাম আজ ।
সে চলে গেছে তিউনিসিয়ায় । জানি আর আমাদের দেখা হবে না !
কয়েক বছর আগে টিনেজ বয়সে, যে সময়টাতে আমার বন্ধুরা ফ্যামিলি ছেড়ে তিনদিনের বেশি কোথাও থাকলে কেঁদে মাত করে ফেলত বাসার জন্য, তখন আমি পড়াশোনার জন্য এখানে এসে দিব্যি সহজ এবং ভালভাবেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছিলাম । একটা নতুন দেশ, নতুন ভাষা, নতুন কালাচারের সাথে ।
আর বিদেশে পড়াশুনা করতে এসে অনেক দেশের, অনেক ভাষার, অনেক রঙ্গের অনেক বন্ধু পাই । কিন্তু যারা আমার মোটামুটি কাছের, তাদের ধরন একেকজনের একেকরকম !
কেউ অনেক অদ্ভত স্বভাবের, কেউ অনেক ফানি ,
কেউ আমার থেকে অনেক বড়, আবার একজন বন্ধু আছে যার বয়স মাত্র ১০ বছর !
কিন্তু সে আর আমি যখন একসাথে থাকি তখন কেউ বুঝবে না সে এত ছোট আর আমি এত বড় (যদিও উচ্চতায় সে আমার পেট পর্যন্ত )
এরকমই এক ব্যাতিক্রমি তিউনিসিয়ান মারদিয়ানা , যে আমার থেকে তিন বছরের সিনিয়র হলেও সে আমার অনেক অনেক প্রিয় একজন বন্ধু ।
মারদিয়ানা গতানুগতিক অন্য দশটা মেয়ের মত না ।
প্রচণ্ড উগ্র, রাগী, একরোখা আর সম্পূর্ণ পশ্চিমা জীবনাচারে অভস্থ এই মারদিয়ানার সম্পূর্ণ বিপরীতে চলা এই আমার সাথে বন্ধুত্ব হয় ।
ওর সাথে পরিচয় হয় আমাদের ডরম এর স্পোর ফিল্ডে। ওর সাথে পরিচয়ের ঘটনাটা ছিল খুবি তিক্ত ।
বাস্কেটবল খেলার সময় ও ছিল আমাদের প্রতিপক্ষ । খেলার একপর্যায় এ ওর সাথে ধাক্কা খেয়ে আমরা দুজনের পড়ে যাই ।
ও উঠে আমার দিকে তেড়ে আসে এবং নাকমুখ খেচিয়ে আমাকে বলে '' ব্লাডি বীচ ! দেখে দৌড়াতে পারো না ?
আমি প্রথমে সরি বলতে চাচ্ছিলা, কিন্তু ওর মুখে গালি শুনে খুব রাগ লাগল । বললাম" তুমি প্রচণ্ড বিরক্তিকর আর বদমেজাজি ! দুজনের ভুল থেকেই আমরা পড়ে গেছি কিন্তু তার জন্য তুমি আমাকে নোংরা গালি দিচ্ছো কোন সাহসে ! ''
ও আবার মারমুখী হয়ে তেড়ে আসে আমার দিকে !
প্রায় ঝগড়া শুরু হবে এরকম ।
টিম প্রধান এসে মিটমাট করে।
এরপর থেকে ওকে যেখানেই দেখতাম তার বিপরীতে চলে যেতাম । প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হতো ওকে দেখে।
ওর কোন বন্ধু ছিলনা , সব-সময় একা-একাই থাকতে দেখতাম।
প্রচুর সিগারেট খায় । উচ্চতা ছয়ফুটের কাছাকাছি । সব সময় অনেক ছোট ছোট জামাকাপড় পরে , প্রচণ্ড শীতের সময়ও ওকে জাস্ট একটা মিনি স্কারট আর টপস পরে থাকতে দেখেছি । প্রায় রাতে উছ্রিঙ্খল পার্টি -কনসার্টে যাওয়া তার জন্য পানিভাত ।
এই মারিদিয়ানাই এক সময় হয় আমার অনেক প্রিয় বন্ধু!
সব সময় ব্যাস্ত দিনের শেষে ক্যাম্পাস থেকে রুমে ফিরে আমার সারাদিনের একান্ত কথা, খণ্ড অনুভূতি দুঃখ-কষ্ট সব কিছুই শেয়ার করি আমার প্রিয় সবুজ ডায়েরির পাতায় ।
সেই সবুজ ডায়েরিটাই শুধু জানে আমাদের বন্ধুত্বের কথা !
দিনের পর দিন ডায়েরির পাতাগুলো ভারি হচ্ছিল আমার আর মারদিয়ানার বন্ধুত্বের সাক্ষী হয়ে ।
আমার আরো অনেক বন্ধুরা আছে, যাদের আমি খুব ভালবাসি এবং তারাও আমাকে ভালবাসে । কিন্তু তারা কেউই মারদিয়ানাকে পছন্দ করতনা ।
তারা যে খুব কনজারভেটিভ তা না ।
মারদিয়ানার উছ্রিংখল জীবন, ড্যামক্যায়ার ভাব আর উগ্র আচরণের জন্য কেউ তার বন্ধু হতে চাইত না । আর সে ছিল আমাদের থেকে সিনিয়র ।
তাই মারদিয়ানার কথা আমি কাউকেই বলতাম না ।
সেদিন ছিল প্রচণ্ড তুষারঝড় । ইউনিভার্সিটি থেকে আমাদের প্রানের '' ইয়ুথ এসসিয়েশান '' থেকে আমরা একটা টিম সিরিয়া আর ফিলিস্তিনি রিফুজিয়ানদের জন্য ত্রান সংগ্রহ করছিলাম । D8 এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো থেকে যে কয়জন সদস্য ছিলাম তাদের মধ্যে ২ জন ছিল অনুপস্থিত । তাই অনান্য সদস্যদের কল করা হয় ।
কিন্তু ওই দুর্যোগের মধ্যে কেউ সাড়া দেয়নি শুধু একজন ছাড়া ।
সে হচ্ছে মারদিয়ানা !
সে ছুটে আসে এবং সারা রাত আমাদের টিমের সাথে ত্রান প্যাকেট করে ।
সকালে রাস্তাঘাটের অবস্থা দেখে আমরা ভয় পেয়ে যাই । বরফে ঢেকে গেসে সব রাস্তাঘাট ! আমাদের কার্গো কিভাবে যাবে !
তখন মারদিয়ানা নিজ উদ্যোগে, এক স্যারের গাড়ি করে নিজে ড্রাইভ করে ত্রান গুলো ভাগ ভাগ তহবিলে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নেয় !
সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৩ পর্যন্ত সে ত্রান পৌঁছে দেয়ার কাজ করে ফিরে যায় !
ওর প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞতাবোধ আসে আমার ।
ওইদিন উগ্রতা আর নিরস ব্যাবহারের আড়ালে একটা কোমল সুন্দর মনের সন্ধান পাই আমি ।
আরেকদিন আমি ডাইনিং এ যাওয়ার পথে সিঁড়িতে পা পিছলে পড়ে গিয়ে হাঁটুতে প্রচণ্ড ব্যাথা পাই । দাঁড়াতে পারছিলামনা । আশে পাশে কোন মেয়েই ছিলোনা যে আমাকে তখন একটু সাহায্য করবে !
সেই সময় মারদিয়ানা করিডোর দিয়ে লবিতে যাওয়ার সময় আমাকে এই অবস্থায় দেখে নিজে থেকেই এগিয়ে আসে । প্রায় কোলে করার মত করে ধরে আমার রুমে নিয়ে যায় এবং ডরম এর অথরিটিকে ফোন দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যাবস্থা করে ।
এবং সে ৯ টা থেকে এগারটা পর্যন্ত আমার রুমেই থাকে । তেমন কোন কথা হয় না । জাস্ট '' ক্যামন লাগসে? ব্যাথা কমেছে ? "' দ্যাটস ইট ।
আমি বিছানায় আর ও পাশে চেয়ারে বসে । ও ফোনের দিকে তাকিয়ে কি করছে । আমি ওকে তাকিয়ে দেখি ।
ঘাড় পর্যন্ত বাদামী চুলের আড়ালে ফর্সা মুখটা অর্ধেক দেখা যাচ্ছে ।
একটা সবুজ গেঞ্জি আর কালো হাফপ্যান্ট ।
ওর মুখের মধ্যে এই কোমল আর বাচ্চা বাচ্চা ভাবটা কি আজই দেখছি আমি ? নাকি ওকে দেখতে পারতামনা বলে ওকে এত উগ্র মনে হতো !
ইচ্ছে করে নেমে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে থ্যাঙ্কস দেই।
কিন্তু কেন জানি ইতস্তত লাগে ।
পরেরদিন সন্ধ্যায় আমি ওর রুমে যাই , দেখি ও টেবিলে ল্যাপটপে কি কাজ করছে । রুমে সিগারেটের গন্ধ, এলোমেল বিছানায় সিগারেটের প্যাকেট পড়ে আছে ,আলমিরার দরজাটা খোলা ভেতরে সব কাপড়-চোপড় অগোছালো ।
ফ্রিজের উপর কিছু খালি পানীয়ের বোতল ছড়িয়ে আছে ।
আমাকে দেখে ভ্রূ নাজিয়ে জিজ্ঞেস করে '' কি খবর ? হাঁটু ঠিক হইছে ?
আমি বলি '' হ্যাঁ । কি করছো ।
'' এইত কিছু স্লাইড রেডি করছি । বসো '' বলে আমাকে বিছানায় বসতে ইশারা করে ।
আমার পড়াশুনার কথা জিজ্ঞেস করে , তার পড়াশুনার কথা বলে । মাস্টার্স ফাইনাল কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার এ ।
অনেক গল্প হয় । ও যখন মাঝে মাঝে হা হা করে হাসে তখন ওই হাসিটা আমার খুব ভালো লাগে । একদম সচ্ছ মনের একটা মেয়ে, কোন রাখঢাক নেই ।
আর তাকে দেখে আর তার সাথে গল্প করে যেটা মনে হলো যে ' সে কখনোই খারাপটা মনে রাখে না । এবং কাউকে পরোয়া করে না ।
আমি রুমে ফিরে আসি এবং কাউকে শেয়ার করতে না পারলেও ডায়রিতে লিখি সব ।
এর থেকে প্রায়ই আমদের দেখা হয় ।
সন্ধ্যায় মাঠে খেলি, আড্ডা দেই । অবসরে তার রুমে গিয়ে গল্প করি । সে অনেক মেধাবী আর পড়াশুনায় ভীষণ স্মার্ট !
ওর কাছ থেকে অনেক নতুন নতুন কিছু জানি, শিখি।
আস্তে আস্তে টের পাই ওর মনটা আমার ভাবনার চাইতেও সুন্দর ! বাচ্চাদের মত সুন্দর একটা মন । কোন অভিনয় নেই ,সে যেমন তেমনটাই তার আচরণে ।
কখনোই কারো কোন কিছুতে নাকগলানো কিংবা কারো সম্পর্কে নেগেটিভ কথা বলেনা সে ।
আর সমাজে নামি কিংবা সবাই দাম দিয়ে মাথায় রাখে এরকম কারো সাথে কখনোই আমার বন্ধুত্ব হয়না । বন্ধুত্ব হলেও তাদের
মারিদিয়ানা ।
যার কোন বন্ধু নেই, যাকে কোন মেয়েই পছন্দ করে না ,যে সিগারেট খায়, মিনি ড্রেস পরে তাতে কি !
ও যদি এগোলো খারাপ জানত তাহলে এগুলো ছেড়ে দিতো।
সে মুসলমান হলেও বড় হয়েছে পশ্চিমা আদর্শে । তার পরিবার যেমন শিখিয়েছ, সে সরলমনে সেটাই অনুসরণ করছে এবং তেমনি হয়েছে ।
কিন্তু বড় কথা হচ্ছে সবকিছুর বাইরে তার সুন্দর কোমল আর সচ্ছ একটা হৃদয় !
মারদিয়ানার মা-বাবা বিচ্ছেদ হয়েছে অনেক আগেই নাকি । দুই ভাইবোন ।
ভাইটা জার্মানিতে আর মা তিউনিসিয়ায় ।
মা ব্যাঙ্কের একজন কর্মকর্তা ।
আমি আর মারদিয়ানা অবসরে একসাথে অনেক মজা করতাম । এমনও অনেক হয়েছে ছুটির দিনের আগের রাতে ৩টা -৪টার দিকে আমরা গ্র্যান্ড ফ্লোরে টেবিল টেনিস খেলেছি ।
আমরা ভায়োলিন বাজাতাম । ও চমৎকার ভায়োলিন বাজাতে পারে ।
নিজেরা নিজেরা আজগুবি গল্প বানিয়ে বানিয়ে বলে হাসতে হাসতে মরতাম ।
আমাদের মন খারাপ হলে ২ জনে '' মন খারাপ '' পার্টি দিতাম । যেখানে মিউজিক থাকতো চায়ের কাপ, প্লেট বিস্কিট-কেকের ডিব্বা ।
মারদিয়ানা না হোক সে আমার মত তাতে কি ; ওর একটা সুন্দর মনের সন্ধান ত আমি পেয়েছি !
ও আমাকে ভালবাসে ।
আমি হাতে ব্রেসলেট পড়তে অনেক ভালবাসি এবং অনেক ধরনের ।
সে বিদায় নেয়ার সময় আমার হাতে ছোট একটা বক্স দেয় । আমি রুমে ফিরে এসে সেটা খুলে দেখি তার অনেক পছন্দের কোহিনুর পাথরের সেই ব্রেসলেট যেটা সে আমাকে সাথে নিয়েই কিনেছিল তিন মাস আগে !
আমি সহজে কাঁদতে পারিনা । মারদিয়ানাকেও কোনদিন কাঁদতে দেখিনি আমি ।
বিদায়বেলায় ও আমাকে দীর্ঘক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখে ।
আমার কাছে মনে হয় আমি যদি ওকে জড়িয়ে অঝরধারায় কাঁদতে পারতাম, তাহলে আমার বুকের ভারি পাথরটা কিছুটা হলেও হাল্কা হতো !
আমার বন্ধু মারদিয়ানা !
আজ সে চলে গেছে । ভীষণ মিস করবো আমি তাকে !
তাকে মিস করবে আমার সবুজ ডায়েরির পাতাগুলি !
বিষয়: বিবিধ
১৫৩৯ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ আপনাকে ।
জন্য় মমত্ববোধ থাকতে পারেনা ?
এক্সচেললেনট আপু,
সিসটার মারদিয়ানা একজন ভাল মুসলিমা বানাতে পারতেন। ভিডিও এ প্রসঙ্গে দেওয়া হয়েছিল।
ভালো লাগলো
মন্তব্য করতে লগইন করুন