অন দ্যা ওয়ে

লিখেছেন লিখেছেন আরিফা জাহান ১৩ মে, ২০১৭, ১১:৪৬:০৮ রাত

প্লেনে অথবা বাসে প্রায়ই দেখি আমার আশেপাশের সহযাত্রীরা কিভাবে আরামসে ঘুমোচ্ছে ।

আর আমি ?

হাহ ! ঘুম ত দূরের কথা চোখ বন্ধ করতেও ইচ্ছে করেনা, সে যত লং জার্নিই হোক না কেন ।

মনে পড়ে গত বছর একটা ট্যুরে একটানা ২৩ ঘণ্টা বাসে ছিলাম । বন্ধুরা সবাই হৈ-চৈ করেছি ,ছবি তুলেছি ,খেয়েছি সব একসাথে; শুধু ঘুমের বেলায় ওরা নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে আর আমি চলন্ত বাসের জানালা দিয়ে রাতের প্রকৃতি দেখছি ।

কয়েকদিন আগে ছোট একটা ট্যুরে দেশে গিয়েছিলাম; তখনো একি কাহিনী ।

আজকে প্লেনটা যখন ফুলস্পীডে উড়া শুরু করে, তার একটু পরই প্লেনের ভিতর সব লাইট অফ করে দেয়া হয় ।

মিনিট দেশেক পর নিভুনিভু নীলচে ডিম আলোয় আশেপাশে তাকিয়ে দেখি বেশিরভাগ যাত্রীরাই সিটে হেলান দিয়ে ঘুমের জগতে ।

ডানপাশের সামনের সিটটাতে একজন মধ্যেবয়স্ক লোক এমনভাবে হা করে ঘুমুচ্ছিল ,দেখে মনে হচ্ছিল উনার মুখে একটু পানি ঢেলে দিলে ভালো হত ।

আমার পাশে যে বসেছে সে ১৩ অথবা ১৪ বছরের এক কিশোর । তাকে দেখলাম সারাক্ষন আইপ্যাডে গেম নিয়ে পড়ে থাকতে ।

ওর প্যাড এর তাকিয়ে আমার মনে পড়ল আজ সারাদিন একবারও মেইল চেক করা হয়নি !

আর এখন মনে পড়লেই কি হবে !

সব এখন প্লেন সবধরনের নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন ।

থাকবে আরও চার ঘণ্টা ।

সামনের টিভি স্ক্রিন অন করলাম । আট টা মাত্র চ্যানেল আর সবগুলিতেই মুভি চলছে ।

পছন্দের কিংবা দেখে সময় কাটানো যায় এই কিসিমের একটা মুভিও পেলাম না ।

শুধু একটা চ্যানেলে দেখলাম কুং ফু পাণ্ডা ৩ দেখাচ্ছে ।

ভালো লাগলেও আগে এটা কয়েকবার দেখা হয়ে গেছে ।

টিভি অফ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকানোর সময় চোখ পড়ল বামপাশের সিটে ।

একজন যাত্রীকে দেখলাম সটান হয়ে বসে আছে ।

এদিকেই তাকিয়ে আছে !

নীল আবছা আলো-আঁধারিতেও চোখে পড়ল ওর নীল চোখ দুটো ।

আমি তাকাতেই খুব অমায়িক ভঙ্গিতে হাসি দিয়ে অন্য দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে নিলো ।

মনে পড়েছে এয়ারপোর্টে ওয়েটিং এ এই যাত্রীকে আমি সারাক্ষনই বই পড়তে দেখেছি ।

রুশ ভাষায় লিখা বই এর নাম দেখে মাথা-মুণ্ড কিছুই বুঝিনি ।

আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম কি অদ্ভত অন্ধকার ! অনেক নিচে মিটি মিটি অনেক আলো দেখা যাচ্ছে ।

হয়তবা কোন শহর !

মেঘের উপর দিয়ে আমাদের প্লেনটা যাচ্ছে সেটা বুঝতে পারছি কিন্তু কিছুই দেখা যাচ্ছে না ।

অনেকক্ষন সম্মোহকের মত তাকিয়ে দেখি বাইরে এই পৃথিবীটাকে ।

ক্যামন জানি একধরনের শুন্যতার অনুভূতি ।

এক সময় জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে দেখি আমার পাশে বসা বাচ্চা ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে । কেন জানি

ওর মুখের দিকে তাকিয়ে খুব মায়া লাগে ।

মনে হচ্ছে আমার আপন ছোট ভাই ঘুমোচ্ছে !

বাদামি রঙের চুল, কানে তখনো হেডফোন লাগানো ।

কোন দেশের হতে পারে ?

আমার অভিজ্ঞতা বলছে ও খুব সম্ভবত জার্মানির ।

ওর চেহারা আর গায়ের রং তাই বলছে ; যদিও আমি শিউর না ।

কফি খেতে ইচ্ছে করছিল ।

এয়ার হোসটেজ কে নক করতে গিয়ে আবার চোখ গেল ওই বামপাশের সিটটাতে ।

ওই নীলচোখের যাত্রীটাকে দেখলাম সেই রহস্যময় নীল চোখে একই ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ।

চোখ পড়তেই আবার সেই হাসি দিয়ে আবার ঘাড় ঘুড়িয়ে নেয়া ।

অদ্ভত !

কেন জানি আমার হাত দুটো ঠানডা অনুভব হলো ! শিরদাড়া বেয়ে গেল এক ঠাণ্ডা অনুভূতি !

আমি আমার সিটের উপরের লাইট অন করি । পাশের বাচ্চা ছেলেটা জেগে উঠে , চোখ কচলে ঘড়ি দেখে ।

আমি জিজ্ঞেস করি '' কফি খাবে?

সে পরিষ্কার ইংরেজিতে বলে '' হ্যাঁ

আমি ব্ল্যাক কফি নিই আর ও নেয় চকলেট কফি ।

'' আমি জায়াদ মার্সি তুমি ?

বলে সে তার ছোট হাত বাড়িয়ে দেয় ।

ও বাবা কি স্মার্ট !

'' আমি আরিফা । তোমার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম ।

শিশুসুল্ভ ভঙ্গিতে '' ধন্যবাদ ।

সে বলে '' তোমার নামটা সুন্দর ।

হা হা হা হাউ সুইট !

'' তোমার নামটাও সুন্দর '' আমি বলি

জিজ্ঞেস করি সাথে কে তোমার ?

'' মা ' সে উত্তর দেয় । ইশারায় সামনের সিট দেখায় ।

দেখি হাফপ্যান্ট আর সাদা গেঞ্জিপরা সোনালী চুলের এক মহিলা ঘুমোচ্ছে । বয়স বত্রিশ তেত্রিশ এর মত হবে ।

এক সময় জায়াদ মার্সি আবার সিটে মাথা হেলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে । আমি জেগে থাকি ।

ওর মাকে তাকিয়ে দেখি অনেক লম্বা আর ফর্সা মহিলা । নীল আলোয় মনে হচ্ছে ভিন গ্রহের মেয়ে !

আমি আবার সম্মোহকের মত জানালা দিয়ে দেখি বাইরের অন্ধকার পৃথিবীটাকে । প্লেন চলছে ফুল স্পীডে ।

যাত্রীরা সব ঘুমোচ্ছে , চোখ বুলাই প্লেনের ভিতরে ।

আড় চোখে তাকিয়ে দেখি বামপাশের ওই নীলচোখের অদ্ভত যাত্রীটাকে ।

সামনের ছোট ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে একমনে বই পড়ছে !

আমরা মনে হয় সাগর অতিক্রম করছি । আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে ।

কারন বেশ শীত শীত অনুভূতি ।

জায়াদ মার্সী শীতে হেলান দেয়া থেকে উঠেআরও গুটিসুটি মেরে বসে ।

ওর সিটের কম্বলটা বের করে ওর গায়ে জড়িয়ে দিই ।

ঘুম জড়ানো গলায় ও বলে'' থ্যাংস ''

জানালা দিয়ে এই অন্ধকারেও বহু নিচে দেখা যাচ্ছে নীল একটা রেখা !

মানে সাগর !

আর মাঝে মাঝে ছোট ছোট আলোর বিন্দু ।

হয়তবা কোন জাহাজ হবে ।

সেই জাহাজেও হয়ত ঘুমিয়ে আছে এক ছোট্ট জায়াদ মার্সী আর পাশে বসে আছে আরিফা !

বিষয়: বিবিধ

১০৩৮ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

382995
১৬ মে ২০১৭ বিকাল ০৪:২২
আব্দুল মান্নান মুন্সী লিখেছেন : প্লেনে চরেছি বিভিন্ন রুটে কিন্তু আমার পাশের সীটে কোন মায়াবিনী ভাগ্য়ে জুটেনি- জুটেছে বিরক্তিকর নাক ঘুঙ্গানি অথবা নতুন কেউ যাকে বিমান চড়ার অভিজ্ঞতা বর্ননা করতে করতেই লেন্ডিং টাইম হয়ে যেতো,অসাধারন লিখেছেন ! মজা পেলাম বিষন,অনেক গুলো পিলাচ Rose
১৬ মে ২০১৭ বিকাল ০৫:০২
316366
আরিফা জাহান লিখেছেন : হি হি হি । ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File