ফিরোজা
লিখেছেন লিখেছেন আরিফা জাহান ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬, ০৬:৩৮:২০ সন্ধ্যা
...... আরিফা বোকামি করোনা! ভিতরে আসো ,ঠাণ্ডা লেগে অসুখ করবে আবার !
ভিতর থেকে জেইদা আমাকে সতর্ক করে ।বারান্দায় আমি চাদরটা আরো ভাল করে জড়িয়ে গুটিসুটি মেরে বসি ।
এরকম পরিবেশ রেখে ভিতরে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না ।
হলিউডের গা ছমছম করা এডভ্যাঞ্জার ফিল্মে দেখা বাড়িগুলোর মতই দেখতে দিলানদের এই বাগানবাড়িটা । এরকম বাড়িতে একদিন না থাকতে পারলে আমার জীবনের অর্ধেকেই পানসে পানসে থাকত মনে হচ্ছে !
ভিতরে ফায়ারপ্লেসে আগুন দেয়া আছে ।
জেইদারা ঘুমিয়ে যাবে । সারাদিন অনেক পরিশ্রম হয়েছে তাদের আর আমিও পরীক্ষা শেষ করেই তাদের সাথে চলে আসি এখানে ।
বনের মত এলাকায় দিলানদের এই বাগানবাড়িটাতে পানি,ইলেকট্রিক থেকে শুরু করে থাকার জন্য সব সুব্যাবস্থাই রয়েছে ।
কারন কোন অবসর বা লম্বা ছুটি দিলানরা নাকি এখানেই কাটায় ফ্যামিলিসহ ।
( টার্কিতে কর্মজীবী মানুষেরা ছুটি পেলে অনেকেই ফ্যামিলিসহ শহর থেকে ঘুরতে যায় প্রকৃতির অনেক কাছাকাছি । যাদের একটু বেশি টাকা পয়সা তাদের অনেকেরই শহরের বাইরে এরকম বাড়ি থাকে ।)
কয়টা বাজে এখন ? ১২ টা?
রাত খুব বেশি হয়নি অথচ চারদিকের নিরব নিস্তব্দ পরিবেশে মনে হচ্ছে এখন গভীর রাত । হিম ঠাণ্ডা । হাতমোজা, পামোজা ,জ্যাকেট, চাদর, ক্যাপ দিয়ে নিজেকে মুড়িয়ে বসলেও হাতপা জমে যাচ্ছে । তারপরও ভিতরে যেতে ইচ্ছে করছে না ।
রাতের রহস্যময় আলো আঁধারিতে সামনের নীল পানির ওই ছোট্ট জলাশয় আর স্থির গাছপালাগুলো দেখে মনে হচ্ছে এ যেন অচিন এক জগৎ !
এ জগৎটা যেন কাউকে নিয়ে দেখার মত না ! নিস্তব্দ ঘুমন্ত নিরব পৃথিবীতে একা একা নিশাচরের মত জেগে থাকলেই যেন এ জগতটাকে দেখা যায় !
...... আরিফা ! ভিতরে চলে আসো ।
ঘুম জড়ানো কণ্ঠে আমায় আবার ডাকে জেইদা ।
বিদেশের এই জীবনে অনেক মুখের ভিড়ে কয়েকটা মুখের ছবি খুব আপন মনে হয় । তার মধ্যে এই জেইদা ।
সে আমার থেকে ২ বছরের সিনিয়র হলেও আমার খুব ভাল বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী । সময়ের সাথে সাথে এটা আমি বুঝেছি । আমায় কখনো বলেনি কিংবা আমিও না ।
মনে পড়ে গত বছর বরফে ভিজে বিষম জ্বর বাঁধিয়েছিলাম । আসরের সময় জ্বর নিয়ে রুমে এসে অচেতনের মত কতক্ষন পড়েছিলাম জানিনা । একসময় কপালে একটা ঠাণ্ডা কোমল হাতের অনুভবে ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে দেখি জেইদা আমার মাথার পাশে বসে আছে ! রাত তখন ২/৩ টার মত হবে ।
আমাদের এই ডরমেটরিতে স্টুডেন্টদের রান্না করার কোন ব্যাবস্থা অর পারমিশান নাই । তারপরও জেইদা কষ্ট করে গরম পানি জোগাড় করে সুপ বানালো আমার জন্য । ওষুধ জোগাড় করল ।
একটানা ৭দিন ভীষণ জ্বরে ছিলাম ।
এই সাতটা দিনই সে আমার পাশে ছিল একজন মায়ের, মত বোনের মত, একজন বন্ধুর মত ।
রাতেও সে আমার কাছেই ছিল এই সাত দিন । কি লাগবে ,কখন ওষুধ খেতে হবে , অসহ্য মুহূর্তগুলোতে গল্প করে সে আমার অসুস্থতার কষ্টকে ভুলাতে চেষ্টা করত ।
শান্ত-স্থির আর অসম্ভব সুন্দর আমার এই বন্ধুটার মনটাও অসম্ভব সুন্দর ।
আমার সাথে তার সুখের মুহূর্তগুলো শেয়ার করা, খারাপ সময়ে সাপোর্ট দেয়া নতুন নতুন অনেক কিছু শেখানো, সে এখন এই ডরমেটরিতে থাকে না কিন্তু আমার সাথে তার বন্ধুত্ব আগের মতই ।
সামার ভেকশানে কয়েকদিনের জন্য দেশে গিয়েছিলাম । আসার পর সে খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চায় আমার দেশের কথা, ফ্যামিলি, গ্রাম ,দেশের মানুষের কথা ।
খুব আগ্রহ নিয়ে সব ছবি দেখে ।
আমি তাকে শুনাই আমার দেশ আর গ্রামের গল্প, শুনাই আমার ছোটসময়ের খেলার সাথী ফিরোজা রুমাদের গল্প !শীতের আগমনীতে গাছের পাতাগুলো ঝরে যাচ্ছে । মাঝে মাঝে হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা দমকা হাওয়ায় কানে আসে শুকনো পাতা উড়ার শব্দ, ,আবার পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ ।
জেইদা আমাকে ডাকার পর হঠাৎ কেন জানি ফিরোজার কথা মনে পড়ে ।
দেশে বেড়ানোর সময় একদিন বিকেলে এক মহিলা দুইটা বাচ্চা সাথে করে আসল । কোলের বাচ্চাটার বয়স এক বছরের মত হবে আর শাড়ীর আঁচল ধরে থাকা বাচ্চাটার বয়স ৩/৪ হবে ।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখে হাসছে । তার দুই বাচ্চার সাস্থ্য আর তাদের পোশাক-আশাকে দারিদ্রতা আর অভাবের ছাপ স্পষ্ট, জীর্ণ- মলিন হলেও মহিলাটার হাসির মধ্যে তেমন কোন চিহ্নই নেই !
লাজুক-উজ্জল আর প্রানবন্ত আন্তরিক সেই হাসি ।
ভীষণ চেনা লাগছে কিন্তু ধরতে পারছিনা সে কে ?
...... আমারে চিনতাছ না ??
বলে সে ভিতরে আসে । বাচ্চাটাকে নিচে বসিয়ে সে আমার কাছে এসে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে আমার হাতটা ধরে ।
.......কিরুম আছ ? আমারে ভুইলা গেছো ?
এবার আমি চিনতে পারি তাকে ! ফিরোজা !!
...... ফিরোজা তুমি !? কেমন আছ ? একি অবস্থা হইছে তোমার ! এই দুই বাচ্চা তোমার ?
সে লাজুক ভঙ্গিতে হাসে । বলে,
...... কতদিন পরে তোমারে দেখতাছি । তুমি আইছ হুনছি কিন্তু সংসারের কামকাজ থুইয়া আইতাম পারিনা । কালহা (গতকাল) ওর বাপেরে অনেক কইয়া ২ দিনের লাইগা আইছি ।
মিনিমাম ৮/৯ বছর আমি ওকে দেখিনা । আগের ফিরোজার সাথে এই ফিরোজার সব কিছু মিলাতে কষ্টই হচ্ছিল । শুকিয়ে হাড্ডিসার হয়ে গেছে । আমার হাত ধরে সে ,কঠিন বাস্তবতা আর সংসারের ঘানি টেনেই হয়ত হাতের কোমলতা হারিয়ে গেছে । বাচ্চা দুটোকে দেখলেই বোঝা যায় অপুষ্টিতে ভুগছে ।
বয়স্ক মহিলাদের মত শাড়ি পরায় তাকেও বেশি বয়সের মনে হচ্ছে ।
দারিদ্রতার ছায়ায় চেহারাটা মলিন হয়ে গেছে, চোখের নিচে কালি কিন্তু হাসিটা তার এখনো আগের মতই উজ্জল । দারিদ্রতার কষাঘাত তার হাসিটাকে মলিন করতে পারেনি ।
ওকে দেখে ভীষণ ভালো লাগে আমার ! কতদিন পর দেখা আমার সেই শৈশবের খেলার সাথী, স্কুলের সাথী !
ওর সাথে আমার অনেক ভাব ছিল ।
গ্রামের মেঠোপথ ধরে বইখাতা নিয়ে স্কুলে যেতাম । ও প্রায়ই আগে স্কুলে এসে আমাদের বাড়ি চলে আসত আমাকে নিতে ।
আমাদের প্রাইমারী স্কুলের পেছনে একটা বিল যেটাতে অনেক শাপলা আর ঢেপ হতো । ও প্রায়ই আমাকে শাপলা ঢেপ তুলে দিত ।
ওর সাথে কোন খেলায়ই আমি পারতাম না ।
ও অনেক জিন-ভুত ,পেত্নির কিচ্ছা জানত ।
ওই সময় আমার মনে হতো ফিরোজা অনেক কিছু পারে, ও অনেক কিছু জানে ।
ওর মত যদি এত কিছু পারতাম !
ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় একদিন শুনি ওর বিয়ে হয়ে গেছে ! সমবয়সীরা দলবেঁধে ওকে দেখতে যাই ।
গিয়ে দেখি ২ দিন আগে সেই ফ্রক পড়া মেয়েটা তার চেয়ে দিগুণ একটা লাল শাড়ি পরে বসে আছে । দুই হাতে কাঁচের চুড়ি, ছোট্ট নাকে বিশাল একটা নাকফুল , মুখে পাউডার লিপসটীক ।
আমাদের দেখে সেদিন লাজুক হেসে মুখ ঢেকেছিল দুই হাতে ।
কতইবা বয়স ছিল ওর ? বড়জোর ১২ ।
জীবনের কঠিন বাস্তবতা আর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অচেনা সেই বউ সাজা ছোট ফিরোজা আজ আমার সামনে বসে আছে । খেটে খাওয়া গ্রামীণ গৃহবধূর প্রতিচ্ছবি সে ! তার এখন দুইটা সন্তান ।
তার বিয়ের পর মাত্র ২ বার তার সাথে দেখা হয়েছিল ।
সে তার জীবন সংসারের গল্প করে আমার সাথে । স্বামীটা নাকি বাদাইমা কোন কাজ কাম করতে চায়না । আগে ভ্যান চালাইত পরে জুয়া খেলায় হেরে ভ্যান বেঁচে দিসে । মাঝে মাঝে নাকি তাকে মারেও ।
খুব কষ্ট লাগল শুনে !
এখানে ওখানে কাজ করে তাঁকে সংসার চালাতে হয় । বাপের বাড়িও গরিব ।
সে একসময় জানতে চায় তুরস্ক কি রকম, আমি ক্যামনে থাকি ।
আমি তাঁকে তুরস্কের গল্প বলি, ছবি দেখাই । সে আমাকে বলে,
...... তুমি ত বিদেশে থাহ, এমনেই বড়লোক তাইলে আর লেহাপড়া কইরা কি হরবা (করবা) ?
খুব হাসি পায় তার সরল কথা শুনে । আমাদের দেশের গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের ধারনা এটাই ,যারা বিদেশে থাকে তারা সবাইই বড়লোক !
আমি তার বাচ্চাদের চকলেট দিই । সে বলে, ইতা কি (এগোলো ) তুরস্কের চকলেট ?
...... হ্যাঁ
সেও আগ্রহ ভরে হাত বাড়িয়ে চকলেট নেয় কিন্তু খায়না । সবগুলো আঁচলে বেঁধে নেয় । বাড়ি গিয়ে হয়ত তার ছোট ভাইবোনদের দিবে ।
এ ধরনের চকলেট বাংলাদেশে পাওয়া গেলেও সে বিদেশি চকলেট ভেবেই তৃপ্তি পাবে ।
ফায়ারপ্লেসের আগুন নিভু নিভু করছে । আমি রুমে এসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই ।
আচ্ছা এখন যদি দেখি গাছপালার ফাকে অস্পষ্ট আলো ছায়ায় ফিরোজা দাঁড়িয়ে আছে !
কেমন হবে ?
আমি গিয়ে ওর হাতটা ধরব আমার চাদরের একপাশ দিয়ে ওকে জড়িয়ে নিব । বলব ,
......ফিরোজা ল (চল) আসমানের তারার আলোয় আমরা দুইজন হাইটা (হেঁটে) যাই অচিন এক দেশে !
সে হেসে আমার হাত ধরবে ।সব ভুলে আমি হেঁটে যাবো আমার শৈশবের সেই প্রিয় খেলার সাথীর সাথে ।
আমাদের পিছনে পড়ে থাকবে যান্ত্রিক শহর, এই বাগানবাড়ি, গ্রামের মেঠোপথ আর শাপলাফোটা সেই বিল !
বিষয়: বিবিধ
১২৯২ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন