আমাদের ফররুখ আহমেদ

লিখেছেন লিখেছেন আরিফা জাহান ০১ জানুয়ারি, ২০১৬, ০৫:৪৫:৫৮ বিকাল

ফররুখ আহমেদ । একটি নাম, বাংলা সাহিত্যাকাশে সর্বক্ষণ জ্বলতে থাকা জ্বলজ্বলে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম । যাদের কথা মনে করতে হলে কোন নির্দিষ্ট দিন ,সময়ের দরকার হয় না ।

ফররুখ আহমেদ যিনি পৃথিবীর প্রত্যেকটি সৃষ্টি দিয়েই আমাদের মানসলোক সাজিয়ে দেয়ার প্রত্যয়ে ছিলেন ।

রাতের শেষাংশে চাঁদের নিভু নিভু আলোয় খণ্ড খণ্ড মেঘের আড়ালের জগতটাকে দেখেছিলেন নতুন সময়ের রুপে । ঝিরঝির বাতাসে কাঁপা নারকেলের পাতার ধ্বনিতে শুনিয়েছেন নতুনের গান ।

হতাশার জাহাজে সাওয়ারি যাত্রিদের দেখিয়েছেন নতুন সবুজ দ্বীপের সন্ধা,ন রেনেসাঁর আলো ।

১৯১৮ সালে (তৎকালীন যশোর জেলার অন্তর্গত) মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামে কোন এক শুভক্ষনে জন্ম নেয়া ডাগর চোখের সেই ভাবুক ছেলেটিই আমাদের ছোটবড় সকলের কবি ফররুখ আহমেদ ।

যিনি তাঁর সব মাধুরী ছন্দ আর ভালবাসা দিয়ে উজাড় করে দিয়ে গেছেন আমাদের সাহিত্য ভাণ্ডার ।

সাহিত্যের নানা শাখায় ছিল উনার সতস্ফূর্ত বিচরণ । তাঁর রচিত বেশিরভাগ সাহিত্যেই ধর্মীয় প্রভাব চোখে পড়ে বেশি । উনি সনেটের ধারায় কিছু রচনা করেছিলেন । বলতে গেলে বাংলাভাষার এক অসাধারন অমুল্য সম্পদ ''হাতেম তাঈ'' যা অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত ।

যাতে তিনি অসাধারন আর মোহনীয় ছন্দ মুসলমানদের ঐতিহ্য তুলে ধরেছেন ।

সাতশত বছরের সুখ সমৃদ্ধ জাতি নিজেদের হেলায় ইংরেজদের গোলামির জিঞ্জীরে বেঁধেছিল এবং মুসলিম নেতৃত্বের কিছু ভুল গাফিলতি আর গাদ্দারির কোটি মানুষের জীবনে নেমে এসেছিল যে দুর্ভোগ আর দুর্দশার অন্ধকার সেসব করুন অবস্থা তুলে ধরেছেন উনি তাঁর ''পাঞ্জেরী'' কবিতায় ।

রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?

শুধু গাফলতে শুধু খেয়ালের ভুলে,

দরিয়া- অথই ভ্রান্তি- নিয়াছি ভুলে,

আমাদেরি ভুলে পানির কিনারে মুসাফির দল বসি

দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াছে তাদের সেতারা, শশী।

মোদের খেলায় ধুলায় লুটায়ে পড়ি।

কেটেছে তাদের দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্বরী।

সওদাগরের দল মাঝে মোরা ওঠায়েছি আহাজারি,

ঘরে ঘরে ওঠে ক্রন্দনধ্বনি আওয়াজ শুনছি তারি।

ওকি বাতাসের হাহাকার,- ও কি

রোনাজারি ক্ষুধিতের!

ও কি দরিয়ার গর্জন,- ও কি বেদনা মজলুমের!

ও কি ধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয়ভেরী।

তাঁর কবিতায় লেখনীতে বার বার উচ্চারিত হয়েছে মজলুমদের কথা মানবতার কথা ।

''লাশ'' কবিতায় ইংরেজদের চাপিয়ে দেয়া ভারতবাসীর উপর বাস্তব ভয়াবহতার কথা আর ইংরেজদের প্রতি ঘৃণা তুলে ধরেছেন সুনিপুণভাবে ।

হে জড় সভ্যতা!

মৃত-সভ্যতার দাস স্ফীতমেদ শোষক সমাজ!

মানুষের অভিশাপ নিয়ে যাও আজ;

তারপর আসিলে সময়

বিশ্বময়

তোমার শৃংখলগত মাংসপিন্ডে পদাঘাত হানি

নিয়ে যাব জাহান্নাম দ্বারপ্রান্তে টানি;

আজ এই উৎপীড়িত মৃত্যু-দীর্ণ নিখিলের অভিশাপ বও:

ধ্বংস হও

তুমি ধ্বংস হও !!

উনার রচিত কাবগ্রন্থের মধ্যে ;

সাত সাগরের মাঝি, সিরাজাম মুনীরা, নৌফেল ও হাতেম, মুহূর্তের কবিতা,ধোলাই কাব্য,

হাতেম তায়ী, নতুন লেখা, কাফেলা, হাবিদা মরুর কাহিনী, দিলরুবা , সিন্দাবাদ উল্লেখযোগ্য ।

ছাত্রবস্থায় তিনি বামপন্থী রাজনীতির অনুরাগী থাকলেও চল্লিশ এর দশকের দিকে উনার রাজনেতিক মতাদর্শে পরিবর্তন আসে ।

উনি উনার কর্মজীবন শুরু করেন কলকাতায় আইজি প্রিজন অফিসে । ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইতে ,১৯৪৫ সালে জলপাইগুঁড়িতে একটি ফার্মে এবং ১৯৪৬ সালে মাসিক ''মুহাম্মদী''র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেও স্থায়ীভাবে চাকরি নেন ঢাকা বেতারে ।

উনাকে রেনেসাঁর কবি বলা হলেও তিনি আসলে মানবতার কবি, ছোট-বড় সবার কবি, ফুলপাখিদের কবি ।

বলতে গেলে আমাদের শেশবের সোনালী দিনগুলির অনেকটা ভাগই উনার রচনার মধ্যে দিয়েই পেয়েছি ।

যেমন ;

পাখির বাসা , হরফের ছড়া, চাঁদের আসর ,ছড়ার আসর ,ফুলের জলসা ,মজার ব্যাপার! মজার ব্যাপার!

কোথায় পাব মজার ব্যাপার?

চলছে-সব-ই সোজাসুজি

তাইতো মিছে খোঁজাখুঁজি

ভেবে ভেবে হদ্দ সবাই,

মজার ব্যাপার পাই কোথায় ভাই?

আবার শিশুদের ডেকেছেন তিনি,

আয় গো তোরা ঝিমিয়ে পড়া

দিনটাতে,

পাখির বাসা খুঁজতে যাব

এক সাথে।

নিজের জ্ঞানের দেন্যতা নিয়ে আমার লিখায় উনার সৃষ্টি তুলে ধরা অসম্ভব ।

তাঁর অনবদ্য সাহিত্য সৃষ্টির জন্য তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার ,ইউনেস্কো পুরস্কার, আদমজী পুরস্কারসহ, মরণোত্তর একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক পান ।

কবির শেষ জীবন কেটেছিল অনেক অর্থকষ্টে । ১৯৭৪ সালে ১৯ অক্টোবর কবি উনার নিজবাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ।

বিংশ শতাব্দী ১৯১৮ থেকে ১৯৭৪ এই সময়টা পৃথিবী পেয়েছিল এমন এক সন্তান, যিনি এখনো বেঁচে আছেন উনার সব সৃষ্টি নিয়ে আমাদের আমদের ভালবাসায় । উনি বেঁচে আছেন মানবতার আর প্রেমের গানে ।

উনি বেঁচে আছেন শিশুর হাসিতে, পাখির কলকাকলিতে ,বেঁচে আছেন রবির আলোতে, ফুলের ঘ্রানে ।

উনি বেঁচে আছেন উনার ''পাঞ্জেরীতে '' !!

বিষয়: বিবিধ

১২৮৪ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

355934
০১ জানুয়ারি ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:৫২
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চমৎকার পোষ্টটির জন্য অনেক ধন্যবাদ। "লাশ" এর মত কবিতা বিশ্বসাহিত্যে নাই।
355944
০১ জানুয়ারি ২০১৬ রাত ০৯:০৩
শেখের পোলা লিখেছেন : কবি স্মরণিকা ভাল লাগল৷ ধন্যবাদ৷৷
355945
০১ জানুয়ারি ২০১৬ রাত ০৯:১১
আরিফা জাহান লিখেছেন : ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File