খেলাফত ও রাজতন্ত্রের সিনোপসিস
লিখেছেন লিখেছেন বোরহান উদ্দিন রুবেল ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১১:৫৭:৫৭ সকাল
খেলাফত ও রাজতন্ত্রের সিনোপসিস
বোরহান উদ্দিন রুবেল
খেলাফত ও রাজতন্ত্র এই বইটির লেখক হলো উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা মওদূদী (র) । যদি বলা হয় ততাকথিত আলেম সমাজ দ্বারা তিনি সবচেয়ে বেশী সমালোচিত হয়েছেন কোন বইটি লিখে তাহলে এক কথায় বলা যাবে তা হল এই বইটি । এই বইটির আলোচনার আগে একটি বিষয় পরিস্কার করা উচিৎ তা হল ............ সমালোচনা কাহাকে বলে ? তাঁর মতে যুক্তি প্রমাণের আলোকে কোন বিষয়কে যাচাই করার নাম হলো সমালোচনা । তিনি মনে করেন এই মানদণ্ডে শুধু আল্লাহ ও তাঁর নবী (আ) গন ব্যেতিত আর কেউ এর আওতামুক্ত নয় । তিনি তাঁর এই বইটি নয়টি অধ্যায়ে ও সবশেষে একটি সমালোচনার জবাব দিয়ে বইটি লিখেছেন । আর তিনি এই বইটির প্রায় ৮০%-৮৫% ভিবিন্ন বই থেকে কোড করেছেন । তিনি এই বইটিতে যেসব বিষয় আলোচনা করেছেন তা সিনোপসিস আকারে দেয়া হলো ।
(১) এই বইটির প্রথম অধ্যায়ে তিনি কুরআন ও হাদিস দিয়ে একটি বিষয় পরিস্কার করেছেন তা হল ধর্ম ও রাজনীতি একটি আরেকটি থেকে পৃথক নয় বরং একটি আরেকটির পরিপূরক । একটি ছাড়া আরেকটির কল্পনা করা যায়না ।
(২) দ্বিতীয় অধ্যায়ে একটি দেশে ইসলামী সরকার ক্ষমতায় আসলে তাঁদেরকে কি কি কাজ করতে হবে তা তিনি বর্ণনা করেছেন । তিনি এখানে ইসলামী সরকারের নয়টি কাজের কথা বলেছেন ।তাঁর মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলো ......... জনগনের মধ্যে সুবিচার করা , শূরা ভিত্তিক শাসন ব্যেবস্থা , জবাবদিহিতা থাকা এবং সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজের নিষেধ করা ।
(৩) তৃতীয় অধ্যায়ে তিনি খেলাফতে রাশেদার বৈশিষ্ট্য হিসেবে সাতটি বিষয় আলোচনা করেছেন । যে সাতটি কাজ খোলাফায়ে রাশেদিনগন তাঁদের শাসন আমলে বাস্তবায়ন করেছেন । তা হলো
(ক) খলিফা অবশ্যই জনগনের দ্বারা নির্বাচিত হতো ।
(খ) তাঁরা তাঁদের শাসন ব্যাবস্থা শূরা বা পরামর্শের ভিত্তিতে পরিচালনা করতো ।
(গ) আল্লাহ ও জনগন বায়তুলমালকে আমানত হিসেবে খলিফার নিকট গচ্ছিত রেখেছে খলিফারা এটা মনে করতো ।
(ঘ) রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাঁর প্রধান কাজ ছিল মানুষের সেবা করা । আর তিনি একমাত্র আল্লাহর খলিফা এটা ছাড়া আর কিছুই নয় এটা মনে করতো ।
(ঙ) খলিফা নিজেকে আইনের আওতাধীন মনে করতো । আর শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা ছিল ।
(চ) শাসন ও বিচার চলতো নিরপেক্ষভাবে । তাতে বংশ-গোত্রের কোন প্রভাব ছিল না ।
(ছ) সেখানে গণতান্ত্রিক শাসন ছিল অথ্যাৎ সবার মতামত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা ছিল ।
(৪) চতুর্থ অধ্যায়ে তিনি আলোচনা করেছেন যে কিভাবে খেলাফত ব্যেবস্থা রাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে গেল । তিনি এখানে ৭ টি পর্যায়ে আলোচনা করেছেন তাঁর মধ্যে কয়েকটি বিষয় দেয়া হল
(ক) হযরত আবু বকর ও ওমর (রা) এর শাসন ব্যেবস্থা রাসুল (স) এর শাসনের সাথে মিল ছিল । তাঁর পরবর্তীতে মূলত সেই অপ্রত্যাশিত রাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যায় ।
(খ) হযরত ওসমান (রা) এর শাসন ব্যেবস্তার প্রথম ৬ বছর আবু বকর ও ওমর (রা) এর মতো ছিল । তবে শেষের দিকে এসে ওনার ইজতিহাদে অথবা প্রশাসনিক কিছু ভুল ছিল । বিশেষ করে মুয়াবিয়া (রা) কে এক প্রদেশে অনেকদিন শাসন ব্যেবস্থায় রাখা , মারওয়ানকে নিজের সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ দেয়া , রাসুল (স) যাদের উপর বিরাগ ভাজন ছিলেন তাঁদের ভিবিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া এবং নিজের বংশের লোকদের সুযোগ সুবিধা দেয়া ।
(গ) আলী (রা) এর খেলাফত গ্রহণ । আয়াশা (রা) ভুল বোঝার কারনে উস্ট্রের যুদ্ধ ও মুয়াবিয়া (রা) এর ইজতিহাদের ভুলের কারনে অথবা রাজনৈতিক ভুলের কারনে সিফফিনের যুদ্ধ ।
(ঘ) আলী (রা) এর শাহাদাত বরণ আর মুয়াবিয়া (রা) ক্ষমতায় আসার মাধ্যমে রাজতন্ত্রের সুচনা । তাঁর ছেলে ইয়াজিদকে বাদশা হিসেবে নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠিত হয় ।
(৫) পঞ্চম অধ্যায়ে খেলাফত ও রাজতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করেছেন । একটি রাষ্ট্র ব্যেবস্থা থেকে আরেকটি রাষ্ট্র ব্যেবস্থা মানুষের উপর চেপে বসার কারনে তাঁদের কি অবস্থা হয়ে ছিল আর তাতে তাদে প্রতিক্রিয়া কি ছিল তিনি তাঁর মধ্যে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন ..............................।
(ক) খলিফা নিয়োগে আর রাসুল (স) এর নীতি বাস্থবায়ন হয়নি , বায়তুলমালকে নিজের সম্পত্তি মনে করা , শাসন বিভাগ দ্বারা বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করা এবং বংশীয় ও গোত্রীয় শাসন শুরু করা ।
(খ) মুবিয়া (রা) এর শাসন আমলের রাজনৈতিক ভুলগুলো , ইয়াজিদকে মুয়াবিয়া (রা) পরামর্শ ব্যেতিত খলিফা (বাদশা) ঘোষণা , ইয়াজিদের শাসন আমলের অত্যাচার , হসাইন (রা) এর শাহদাত বরণ , মারয়ানের অত্যাচারী শাসন ।
(গ) ওমর ইবনে আব্দুল আযিযের খেলাফতি শাসন আমলের বর্ণনা দেয়া হয়েছে । তাঁকে বলা হয়েছে তিনি খোলাফায়ে রাশিদিনের মতো তাঁর শাসনামল পরিচালনা করেছেন ।
(ঘ) তিনি দেখাতে ছেয়েছেন খেলাফত থেকে রাজতন্ত্রের দিকে যাওয়ার সাথে সাথে রাজনৈতিক নেতৃত্ব আর ধর্মীয় নেতৃত্ব আলাদা হয়ে যায় ।
(৬) ষষ্ঠ অধ্যায়ে তিনি রাজতন্ত্রের দিকে যাওয়ার সাথে সাথে মুসলিমদের মধ্যে যে কিছু ধর্মীয় মতোবিরোধ শুরু হয় আর তাঁর মাধ্যমে যে কিছু মতবাদ তৈরি হয় তাঁর বর্ণনা দিয়েছেন । যার মধ্যে অন্যতম ছিল চারটি
(ক) শিয়া যারা নিজেদের আলী (রা) এর অনুসারী মনে করে ।
(খ) খারেজী মতবাদ যারা ছিল শিয়া মতবাদের সম্পুন্ন বিরোধী তারা সিফফিনের যুদ্ধের সময় আলী (রা) এর দল থেকে বেরিয়ে যায় ।
(গ) মুরজিয়া সম্প্রদায় যারা শিয়া ও খারিজীদের চরম বিরোধের ফসল ।
(ঘ) আরেকটি হল মুতাযিলা সম্প্রদায় যারা সবকিছু যুক্তির দ্বারা বাস্তবায়ন করতে চায় ।
(৭)সপ্তম অধ্যায়ে ইমাম আবু হানিফার জীবনী দেয়া হয় সাথে সাথে তাঁর কিছু মতামত দেয়া হয় ইসলামের ভিবিন্ন মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে । খোলাফায়ে রাশিদিনের ব্যেপারে ওনার মতামত হল সবাই সত্য পথে ছিলেন তবে কারো কারো ইজতিহাদে কিছু ভুল ছিল ।
(৮)অষ্টম অধ্যায়ে ইমাম আবু হানিফার অন্যতম শাগরেদ ইমাম আবু ইউসুফের জীবনী ও তাঁর কর্ম আলোচনা করেন । হানাফি ফিকাহ সকলনে তাঁর অবদান আলোচনা করা হয় । তিনি যে আব্বাসি খলিফা হারুনুর রশিদের আমলে একটি শাসন বেবস্থা প্রনয়ন করেন তারও বর্ণনা করা হয় ।
(৯) নবম অধ্যায়ে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনার জবাব দেন । তাঁর মধ্যে অন্যতম হল সমালোচনার সঠিক মাধ্যম , ওসমান (রা) এর নিকটাত্মীয়দের ব্যাপারে অসমান কর্মধারার ব্যাখ্যা , বায়তুল মাল থেকে সাহায্য প্রসঙ্গে , আলী (রা)এর খেলাফত প্রসঙ্গে , ওসমান (রা) এর হত্যা প্রসঙ্গ , ইজতিহাদী ভুল কি আর কি নয় এবং ইয়াজিদের উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে ।
সর্বশেষে তিনি কিছু প্রশ্ন রাখেন যদি কেউ এগুলোর উত্তর তালাস করে তাহলে যে বিষয় গুলো নিয়ে সমালোচনা করেছে বা করবে তারা আর সমালোচনা করবে না । তাঁর মধ্যে অন্যতম হল যদি কেউ মনে করেন সাহাবীদের সমালোচনা করা যাবে না তাঁদেরকে তিনি প্রশ্ন করেন সাহাবীদের মাঝে সিফফিনের যুদ্ধ হয়েছে ও উস্ট্রের যুদ্ধ হয়েছে কি না ? যদি উত্তর হয় হ্যাঁ তাহলে আলোচনা করলে সমালোচনা হয় কিনা ? যদি উত্তর হয় না তাহলে এটা ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে হবে । এভাবেই তিনি যুক্তি ও প্রমাণের সহিত তাঁর সমালোচনাকারীদের জবাবের মাধ্যমে তাঁর বইটি শেষ করেন ।।
শিক্ষার্থী – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিষয়: বিবিধ
১৯৪২ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমাদের কিছু আলেম যেভাবে পির দের সমালোচনার উর্ধে মনে করেন তার জন্যই এই অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন গ্রন্থটির সমালোচনা করেন। অথচ বইটি পড়লে বুঝা যায় এতে হযরত উসমান (রাঃ) এবং হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এর প্রতি কোন অসন্মান করা হয়নি। কিছূ আলেম যারা তাদের রুজির খাতিরে তখন রাজতন্ত্রের সমর্থক হয়েছিলেন তাদের মতই এই যুগের কিছু আলেম তাই করছেন। অথচ ইসলামের প্রধান মুজতাহিদ গন ইমাম মালিক খেকে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল পর্যন্ত সকলেই রাষ্ট্রিয় জুলুম এর শিকার হয়েছেন।
সংক্ষিপ্ত এবং মূল বিষয়গুলো আপনি দিয়েছেন। আপনাকে মোবারকবাদ। আশা করছি আল্লামার মৌলিক বইগুলো এভাবে পাব। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন