হুমায়ুন আহমেদের ‘ দেয়াল ’ও একটি পর্যালোচনা

লিখেছেন লিখেছেন বোরহান উদ্দিন রুবেল ০৭ মে, ২০১৪, ০৬:৫১:০৪ সন্ধ্যা

হুমায়ুন আহমেদের ‘ দেয়াল ’ও একটি পর্যালোচনা

বোরহান উদ্দিন রুবেল

‘ দেয়াল ’ হুমায়ূন আহমেদের সর্বশেষ উপন্যাস । তিনি এই উপন্যাসটি শেষ করে যেতে পারেননি । তাঁর এই উপন্যাসটি হল একটি রাজনৈতিক উপন্যাস । বাংলা সাহিত্যের কল্পবিজ্ঞানের জনক বলে খ্যাত হুমায়ূন আহমেদ তাঁর এই অসমাপ্ত রাজনৈতিক উপন্যাস দেয়ালও তিনি কিছু কাল্পনিক চরিত্র এনেছেন । যথারীতি তিনি তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মত এইখানেও কিছু ভালবাসার সংলাপ দিয়েছেন তবে উপন্যাসটি অসমাপ্ত হওয়ার কারনে শেষ পর্যন্ত চরিত্রগুলো মিলানো যায়নি । উপন্যাসের অসমাপ্তের সাথে সাথে চরিত্রগুলোও অসমাপ্ত রয়ে গেছে । তবে তিনি এই কাল্পনিক চরিত্রের মাধ্যমে যুদ্ধের সময়ে ও যুদ্ধের পরবর্তীতে কিছু ভূমিকা রেখেছে । তবে মজার ব্যাপার হল যেই কারনে এই প্রখ্যাত লেখকের বইটি তিনবার সংস্করণের পর প্রকাশ হয়েছে সেই বিষয়টি বিতর্কই থেকে যাবে । তিনি এই বইটিতে মূলত যেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন তা হল যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সহিংসতা , যুদ্ধের পর রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার , আওয়ামীলীগের অত্যাচার , মুজিব হত্যা , খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা দখল , খালেদ মোশারফের হত্যা এবং জিয়া হত্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে ।

তার মধ্যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হল :-

(১) অবন্তি নামের একটি মেয়েকে দেখানো হয় যে, মেয়েটির বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে , তাঁর দাদা সরফরাজ খান একজন অবসরপ্রাপ্ত এসপি(SP) , তাঁর বিয়ে হয় এক পীরের ছেলের সাথে ,তাঁর গৃহশিক্ষকের নাম হল শফিক আর তাঁর বাবার বন্ধু হল খালেদ মোশাররফ ।

(২) রাধানাথ নামের একজন হস্তরেখাবিদ আছে যিনি আদর্শলিপি প্রেসের মালিক তিনি মূলত এগুলোর ছত্রছায়ায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর এজেন্ট ।

(৩) যুদ্ধের সময় শান্তি কমিটির কথা তিনি উল্লেখ করেছেন তবে শান্তি কমিটির যে কথা আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে তাঁর কিছুই তিনি আলোচনা করেন নি ।

(৪) যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে দেশের যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় তাঁর কিছু আলোকপাত তিনি করেছেন । যেমন

(ক) দ্রব্য মুল্যের দাম বৃদ্ধি । তিনি দেখান যে লবণেরই দাম ছিল ৫০ টাকা

(খ) আওয়ামীলীগের সমর্থকদের সাধারন মানুষের উপর অত্যাচার । যেমন , মোজাম্মেল নামের আওয়ামীলীগের এক সমর্থকের গাড়ি আটকিয়ে নববর আর ড্রাইবারকে বেঁধে নববধুকে ধর্ষণ ।

(গ) শেখ কামালের নামেও নাকি গুজব ছিল সারা দেশে যে, তিনি ব্যাংক ডাকাতি করেছেন ।

(ঘ) সর্বহারা যারা ছিল তাদের যেহেতু আর হারাবার কিছুই ছিল না তারা শ্রেণী খতমের নামে আওয়ামীলীগ নেতা কর্মী হত্যায় নেমে যায় ।

( ঙ)আর বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) মাঠে নামে দেশকে বদলে দিতে । তারাও শুরু করে শ্রণীশত্রু খতম করতে ।

(৫) রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার সম্পর্কে তিনি অনেক আলোচনা করেছেন । আর রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারের প্রত্যক্ষসাক্ষী হলেন তিনি নিজেই । কারন শহীদ পরিবার হিসেবে তাদের বরাদ্দকৃত বাড়িটাও তারা দখল করে নেয় । শুধু দখল নয় তাদেরকে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে বাহির করে দেয় সাথে তাঁর ছোট ভাই আমাদের জাফর ইকবাল স্যারকেও ।

(৬) এইদিকে স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সমাবর্তনে শেখ মুজিব উপস্থিত অবে এই উপলোক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে বাকশালে যোগদেয়ার হিরিক পরে যায় । কারন তাদের বলা হয় বিনিময়ে তাদেরকে বেতন বাড়ানো হবে , আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে এবং উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে ।

(৭) মুজিব হত্যার পরিকল্পনা নেয় মেজর ফারুক । তাতে যে কারণটা দেখানো হয় তা হল স্বৈরশাসনের অবসান হবে । তাঁর সাথে ছিল মেজর ডালিম এবং মেজর রশিদ । পরিকল্পনা নেয়ার পর ফারুকের সামনে দুইটি কাজ জরুরি হয়ে পরে ।

(ক) সেনাবাহিনীকে সামলানো । যার দায়িত্ব দেয়া হয় তাঁর ভায়রা মেজর রশিদকে ।

(খ) রাজনৈতিক মোকাবেলা । আর এই সমস্যা সমাধানে তারা খন্দকার মোশতাককে বিকল্প হিসেবে ঠিক করে রাখে ।

(৮) বাংলাদেশের রাজনিতিতে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর তীক্ষ্ণ নজর ছিল । যেটা আরও স্পষ্ট হয় একদিন যখন শেখ মুজিবের সাথে এক বৃদ্ধ দেখা করতে আসে করতে মূলত সে ছিল ‘র’ এর প্রধান মিস্টার কাউ । তিনি এসে মুজিবকে বলেন আপনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে । এটার পরিকল্পনা করা হয়েছে মেজর জিয়ার বাড়িতে বসে মেজর ফারুক , রশিদ ও জেনারেল ওসমানী । মুজিব তাঁর কথা বিশ্বাস করেন নি বলেছিলেন আমারদেশের মানুষ আমি জানি তারা আমার সন্তান সমতুল্য ।

(৯)শেখ মুজিব হত্যা করা হল আশ্চর্য ব্যপার হল হত্যার পর কোন প্রতিবাদ হয়নি । এমনকি রক্ষীবাহিনীও সেদিন নিরব ছিল । রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়াটার ছিল সাভার । সেখানে উপস্থিত ছিলেন তোফায়েল আহমেদ তিনিও কোন প্রতিবাদ করেননি ।তিনিও নাকি ঝিম খেয়ে গিয়েছিলেন । যেই আওয়ামীলীগের অত্যাচারের বিচার না করায় মানুষ তাঁকে ঘৃণা করতে শুরু করলো তারাও কোন প্রতিবাদ করেন নি ।

(১০) শেখ মুজিব মরার পর ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় মিছিল হয়েছিল তবে তা শোক মিছিল ছিলনা তা ছিল আনন্দ মিছিল । এমনকি তাঁর গ্রামের বাড়িতেও হামলা করেছিল সাধারণ জনগণ । যদিও লেখক তা স্বীকার করেন নি ।

(১১) মুজিবের হত্যার পর ক্ষমতায় বসেন খন্দকার মোশতাক । তিনি শেখ মুজিবকে যারা হত্যা করেছে তাদেরকে ‘ সূর্য সন্তান ’ বলেছেন অথচ তিনি মুজিবের খুব কাছের লোক ছিলেন । মন্ত্রী সভায় ছিল পুরুনো আওয়ামীলীগের দশ জন মন্ত্রী , সাত জন প্রতিমন্ত্রী ও তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্টও বহাল ছিলেন । খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র আশি দিন । সে ক্ষমতা থেকে যাওয়ার আগের দিন আওয়ামীলীগ যাতে আর ক্ষমতায় না আসতে পারে তার জন্য খুন করা হয় ৪ নেতাকে ।

(১২) ৪ নভেম্বর মোশতাককে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন খালেদ মোশাররফ । যদিও তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন না তিনি ছিলেন সেনা প্রধান । তবে তাঁর হাতেই ছিল সব ক্ষমতা । জিয়াকে তিনি বন্দি করে রেখে ছিলেন । জিয়াকে মুক্তি করার জন্য জিয়া তাঁর বন্ধু তাহেরকে চিঠি পাঠায় । জিয়াকে মুক্তির জন্য ৭ নভেম্বর সিপাহী বিপ্লব হয় কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে কারন সৈনিকদের মধ্যে জিয়াউর রাহমানের অনেক প্রভাব ছিল । তারা জিয়াকে মুক্ত করে এবং খালেদ মোশাররফকে হত্যা করে ।

(১৩) তারপর ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান তাহেরকে বন্দী করে । তাহেরকে ১৯৭৬ সালের ২১ নভেম্ভর তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় । হত্যার কারন হিসেবে দেখানো হয় সিপাহীদের নিয়ে তিনি বিপ্লব করতে চেয়েছিলেন ।

(১৪) লেখক জিয়াউর রাহমানের প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রশংসা করেছেন । তিনি জিয়াউর রহমানকে একজন সৎ প্রেসিডেন্ট বলে উল্লেখ করেছেন । তাঁর আমলে দ্রব্য মুল্যের দাম ছিল নিয়ন্ত্রিত । তাঁর আমলে বাংলাদেশের সাথে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক বৃদ্ধি পায় ।

(১৫) সেনাবাহিনীর আভ্যন্তরীণ শৃংখলা রক্ষা করার জন্য তিনি অনেক সেনাবাহিনীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ছিলেন । লেখকের মতে তাদের দীর্ঘ শ্বাস এসে জমা হয় ১৯৮১ সালের ৩০মে সার্কিট হাউসে । তাঁকে হত্যা করা হয় তাঁর একজন বিশ্বস্ত সেনা অফিসার মঞ্জুর এর নির্দেশে ।

এখানেই শেষ হয়ে যায় তাঁর উপন্যাস । কারন তিনি তা শেষ করে যেতে পারেননি ।

শিক্ষার্থী : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয়: বিবিধ

৯৬৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File