বাবা হয়ে বাবা-মাকে উপলব্দি
লিখেছেন লিখেছেন গাজী সালাউদ্দিন ২৪ মার্চ, ২০১৮, ০৭:৩২:২৭ সন্ধ্যা
আলহামদুলিল্লাহ্। গত ১৬ মার্চ শুক্রুবার প্রথম ভাগে আল্লাহ্ আমাকে একটি মেয়ে সন্তান দিয়েছেন। কতশত দুঃচিন্তা, অজানা আতঙ্ক ও সীমাহীন পেরেশানির পর আল্লাহ্ আমাকে স্বস্তি দিয়েছেন। দুঃসহ কষ্ট-যন্ত্রতা ভুগতে ভুগতে ক্লান্ত-দুর্বল, বিবর্ণ আমার স্ত্রীকে ফুটফুটে, চক্ষু শীতলকারী কন্যা শিশুকে উপহার দিয়ে বোধ করি আল্লাহ্ তায়ালা তার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছেন। তার ভাষায়, “আপনার মেয়েকে এতো বেশি মায়া লাগে, তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। কষ্টে বুক ভেঙ্গে যায় তার যত্ন নিতে পারিনা বলে। কবে সুস্থ হব, কবে পারব সঠিকভাবে তার খেয়াল নিতে!”
তার গর্ভকালীন সময়টা আর দশজন মেয়ের মত ছিলনা। অন্তসত্বা হওয়া থেকে শুরু সন্তান জন্ম দানের পূর্ব অবর্ণনীয় ব্যথা-বেদনা সইতে হয়েছে তাকে। যার কারণে সন্তান প্রসবের পর স্বাভাবিকতায় ফিরে আসতে অন্যান্য মায়েদের তুলনায় সময় কিছুটা বেশিই লাগছে। তার কষ্টের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে মাঝে মাঝে বাজে সব চিন্তা মনে এসে ভীড় করত। মনে হত সে বুঝি সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে পারবেনা অথবা মৃত সন্তান। তবে বাচ্চা যেমনই হোক, স্ত্রীকে ছায়ার মত সঙ্গ দিয়ে যাব, এমনটাই স্থির করে নিয়েছি।
যেদিন থেকে জানতে পারি স্ত্রী সন্তান সম্ভবা। তার কিছুদিন পরেই শুরু অসুস্থতা। ডাক্তার, আত্মীয়-স্বজন সবার কমন ডায়ালগ গর্ভ ধারণের প্রথম তিন-মাস এমনই হয়, সয়ে যাও। সয়েও যাওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু কিছু থেকে কিছু হয়নি। কষ্টের তীব্রতা ভুগিয়েছে সন্তান ভূমিষ্ঠের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত। যারা বলেছিল এমন হয়, ঠিক হয়ে যাবে। তারাই শেষে বলতে বাধ্য হয় এমন কষ্ট পাইতে তো কাউকে দেখি নাই।
দিনে রাতে অসংখ্যবার বমি, দাস্ত, জ্বর.........। বমি করতে করতে শরীর যখন নিথর পড়ে থাকত, একটু পানি অথবা অন্যান্য মুখে দেওয়ার পর পেটে যেতে না যেতেই আবারও বমি, দাস্ত। ধীরে ধীরে দাঁড়ানো, বসার শক্তি হারিয়ে ফেলে। পিঠ লেগে যায় বিছানায়। তখন অন্যের সহযোগিতাই ভরসা। ধরে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে যেতে হয়েছে। ঔষধ-খাবাই খাইয়ে দিতে হয়েছে। নিজে কিছু করার মত অবস্থায় ছিলনা, এমনকি শোয়া থেকে ওঠার সময় অন্যের সহযোগিতা নিতে হত। মাঝে মাঝে ক্ষণিকের জন্য সুস্থ-সবল মনে হলেও পরক্ষণেই এমন বমি শুরু করত, অথবা ব্যথায় কান্নাকাটি শুরু করত যে নিজেই দুর্বল হয়ে যেতাম। আল্লাহ্ আমাদেরকে কঠিন পরীক্ষাই করেছেন।
অসুস্থতার কারণে গর্ভকালীন সময়ের বেশিরভাগ সময় থাকতে হয়েছে তার বাবার বাড়ি গাজীপুরে। পুরোটা সময়জুড়ে অফিস আর শ্বশুর বাড়ি, এই ছিল ছিল ডিউটি। সামর্থ্যের জায়গা থেকে যতদূর সম্ভব চিকিৎস্যা, সেবার ত্রুটি করিনি। তার জন্য কায়িক পরিশ্রমের সর্বোচ্চটাই ঢেলে দিয়েছি। তবুও অবস্থান পরিবর্তন দেখেছি খুব সামান্যই। বাড়িতে অসুস্থ স্ত্রীকে রেখে অফিসে কাজে মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে যেত। বর্ষাকালে যখন তখন বৃষ্টি, কাঁদা মাটি। রাস্তা-ঘাটের অবস্থা ছিল শোচনীয়। তবুও তার সেবা করার তাড়ণায় সব প্রতিকূলতাকে তুচ্ছ করেছি। কতদিন গভীর রাতে বৃষ্টি-পানি মাড়িয়ে তার কাছে ছুটে গেচ্ছি। কোন দিন রাত বারোটা, দুইটা বা তিনটা। রাতের অন্ধকারে লম্বা পথ হেঁটে গেছি গাড়ি না পেয়ে। যাওয়ার পর দেখতাম পড়ে আছে মরার মত। শ্বাসটাই যেন বাকি আছে। এমন দৃশ্য যেকোন বরের জন্য হৃদয় বিদারক, আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি।
ঢাকা থেকে যানযট পেরিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ক্লান্ত শরীর নিয়ে তার কাছে ছুটে যেতাম। যাওয়ার পর ধরে ওঠায়ে হাত-মুখ ধুইয়ে খাইয়ে সান্ত্বনা দিতাম, শোনাতাম নানান আশার কথা। ময়লা কাপড়-চোপর ধুয়ে তারপর খেয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে রাত প্রায় শেষই হয়ে যেত। তারপর ফজর পরেই আবার ছুটতাম অফিসে দিকে। ছুটির দিনটায় চেষ্টা করতাম পুরোটা সময় তার পাশে থাকতে।
আমি আমার কষ্টকে কখনও কষ্ট মনে করিনি। বরং নিজের সবটুকুই করার চেষ্টা করেছি তার জন্য। তার ভাল থাকা আমারও ভাল থাকা। সহধর্মী হিসেবে এটাইতো স্বাভাবিক। আলহামদুলিল্লাহ, তার সেবা করার জন্য আল্লাহ্ আমাকে সুস্থও রেখেছেন। বেচারি মাঝে মাঝে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আক্ষেপ করত, "আমাকে বিয়ে করে আপনার সুখ-শান্তি শেষ......"। জবাবে বলতাম, "হ্যা, কষ্ট আমাদের কিছুটা হচ্ছে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি ধকল যাচ্ছে তোমার শরীরের উপর দিয়ে। আজ তুমি অসুস্থ, কাল আমিও হতে পারি, বিচিত্র কিছু নয়। তাছাড়া স্বামীই তো স্ত্রীর সেবায় এগিয়ে আসবে, আসাই তো উচিত"।
কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য এটাই ছিল যে, সম্ভাব্য সন্তানের বাবা অথবা অতঃপর সত্যিকার বাবা হয়ে আমার নিজের বাবা-মাকে নতুন করে উপলব্দি করার বিষয়টি তুলে আনা।
আমার স্ত্রী যেমন করে পেটে সন্তান নিয়ে সার্বক্ষণিক ব্যথায় ছটপট করেছে, তেমনই করে, নিঃসন্দেহে আমার মাও আমাকে পেটে ধরেছে অসহ্য কষ্ট-যাতনা সয়েছেন। যতবার কাছ থেকে দেখেছি স্ত্রীর নিদারুণ কষ্ট, ততবারই মনে করেছি আমার মাকে। ঝাপসা করে কিছু কিছু মনে পড়ে, খুব ছোট বেলায় মা বলতেন পেটে ধরা, ভূমিষ্ঠ হওয়াকালীন যন্ত্রণা, তারপর পরম মমতা আর ত্যাগ-তিতিক্ষা দিয়ে লালন পালন করার কথা। তাই মায়ের কষ্ট সবসময়ই মনে থাকে তবে নিজের স্ত্রীর সন্তান হওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন করে উপলব্দি করলাম। তাইতো নামাজে, নামাজ শেষে ও বিভিন্ন সময়ে আল্লাহর কাছে আমার স্ত্রীর সুস্থতা কামনার পাশাপাশি মাকেও স্মরণ করেছি, দোয়া করেছি তার জন্য আল্লাহর কাছে।
আর বাবা, তিনি পেটে ধরেন নি ঠিক, কিন্তু আমার মতই স্ত্রী-সন্তানের চিন্তায় দুঃচিন্তায় থেকেছেন সদা ব্যতিব্যস্ত থেকেছেন, পেরেশান হয়েছেন আমাদেরকে সুস্থ রাখার জন্য। আমি যখন স্ত্রী, অনাগত সন্তানের জন্য টাকা-পয়সা খরচ করতে গিয়ে কখনো কখনো দিশেহারা হয়েছি, নিজের সীমিত আয়ের বাইরে মানুষের কাছ থেকে ধার দেনা করতে বাধ্য হয়েছি, টেনেছি ঋণের বোঝা, বাবাও তেমনই করেছেন, আমি অন্তত তাই বিশ্বাস করি। তাইতো বাবার জন্য শ্রদ্ধা, ভালবাসা, আন্তরিকতা, মায়া, তার কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ হয়ে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি অনবরত।
সন্তান সম্ভবা স্ত্রী, তার কষ্ট, নিজের পেরেশানি ইত্যাদির পরেও বাবা-মায়ের ত্যাগ-তিতীক্ষা সম্পর্কে উদাসীন থাকাটা খুব দুঃখজনকই হত। কিন্তু আল্লাহ্ তাদেরকে আমার স্মরণে জাগরূককই রেখেছেন। আলহামদুলিল্লাহ্।
এমন উপলব্দি আল্লাহ্ সবসময়ই মনে জাগরূক রাখবেন, এমনটাই কামনা করি। প্রত্যাশা করি সব সন্তানই তার বাবা-মাকে সদা-সর্বদা শ্রদ্ধার আসনে রাখুক।
সবশেষে আমার মেয়ে ও তার অসুস্থ মায়ের জন্য দোয়া কামনা করছি।
বিষয়: বিবিধ
১৬৪৪ বার পঠিত, ১৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমীন
তবুও যেটুকু সময় ব্যয় করেছেন মন্তব্যটি করায়, তাতেই খুশি হয়েছি অনেক।
জেনে আরও খুশি হলাম আপনার স্বামী আপনার জন্য অনেক করে যাচ্ছেন। আসলেই এমনটাই তো হওয়া উচিত।
আল্লাহ আপনাকে সুস্থ রাখুন খুব করে কামনা করছি।
কেয়ামতের দিন আমার স্ত্রী যেন এমন স্বাক্ষিই দেয়।
মুমতাহিন তাসনিক ত্বোহা। এই হচ্ছে আমার সোনার টুকরার নাম।
আপনার ছেলে মেয়েগুলোর জন্য অনেক অনেক দোয়া ও ভালবাসা রইল।
بَارَكَ اللَّهُ لَكَ فِي الْمَوْهُوبِ لَكَ، وَشَكَرْتَ الْوَاهِبَ، وَبَلَغَ أَشُدَّهُ، وَرُزِقْتَ بِرَّهُ.
“আল্লাহ আপনাকে যা দিয়েছেন তাতে আপনার জন্য বরকত দান করুন, সন্তান দানকারীর শুকরিয়া আদায় করুন, সন্তানটি পরিপূর্ণ বয়সে পদার্পণ করুক এবং তার সদ্ব্যবহার প্রাপ্ত হোন।”
মুনাজাতে দোয়া করেছি আল্লাহ যেন নেক সন্তান দান করেন।
بَارَكَ اللَّهُ لَكَ فِي الْمَوْهُوبِ لَكَ، وَشَكَرْتَ الْوَاهِبَ، وَبَلَغَ أَشُدَّهُ، وَرُزِقْتَ بِرَّهُ.
“আল্লাহ আপনাকে যা দিয়েছেন তাতে আপনার জন্য বরকত দান করুন, সন্তান দানকারীর শুকরিয়া আদায় করুন, সন্তানটি পরিপূর্ণ বয়সে পদার্পণ করুক এবং তার সদ্ব্যবহার প্রাপ্ত হোন।”
আলহামদুলিল্লাহ্
সমবেদনা ও শুভেচ্ছা সানন্দে গ্রহণ করলাম।
আপনাকেও শুভেচ্ছা অনেক দিন পর ব্লগে এলেন। নাকি আপনি নিয়মিতই, আমি আসিনি!
মন্তব্য করতে লগইন করুন