ঘনিষ্ঠজনদের মৃত্যু জীবন সম্পর্কে ভাবিয়ে তুলছে
লিখেছেন লিখেছেন গাজী সালাউদ্দিন ১৪ নভেম্বর, ২০১৭, ০১:০৪:৫৪ দুপুর
আরও একটি মৃত্যু। আরও একজন নারীর বিধবা হওয়া, এতীম সন্তানদের নিয়ে অকুল সাগরে হাবুডুবু খাওয়া। বলছি আমার মামার কথা। বাংলাদেশের প্রত্যাশিত আয়ুস্কাল অনুযায়ী উনি আরও ২০ বছরের মত বেঁচে থাকতে পারতেন। পারতেন স্ত্রী-সন্তানদেরকে সবকিছু গুছিয়ে-বুঝিয়ে দিয়ে জীবনের যবনিকা করতে। কিন্তু পারেননি, তাঁর বহু আগেই পরপারের ডাক এসে যায়। যে ডাকে সাড়া দেওয়ায় কাল ক্ষেপণের কোনো সুযোগ নাই। তাই অগোছালো রেখেই গত শনিবার (১১ নভেম্বর ২০১৭) দিবাগত রাতে মৃত্যুবরণ করেন। ইন্না লিল্লাহি অ ইন্না ইলাইহি রাজেওন (নিশ্চয় আমরা আল্লাহ্র জন্য এবং অবশ্যই তাঁর দিকে ফিরে যাবো)।
গত কয়েক বছরে এতো এতো ঘনিষ্ঠজনদের মৃত্যুর সাক্ষী হয়েছি যে, জীবন নিয়ে প্রথাগত ভাবনাগুলো নিয়ে আর ব্যতিব্যস্ত থাকতে পারিনা। আমার দুই নানা, শৈশবের নিরাপদ আশ্রয়স্থল দাদা, চাচা, দুই মামা, দুলাভাই, দুই বোনের শ্বশুর, দুই বোনের শ্বাশুরি, যুবতী চাচাতো বোন, বাবার বন্ধু অর্থাৎ চাচা, আঁশে পাশের দাদা-দাদী, নানা-নানী, কাকা, জ্যাঠা সহ বহু সংখ্যক আত্মীয় ক্যান্সার, কিডনী, হৃদ রোগ, স্ট্রোক সহ নানাবিধ ভয়ানক রোগব্যধির শিকার হয়ে মারা গেছেন। তাদের মধ্যে চাচা ক্যান্সারে, মামা কিডনীর রোগে, দুলাভাই ডায়াবেটিস, চোখের সমস্যা, পায়ের সমস্যা, পচন রোগে মারা যায়। যাদের সবাই প্রত্যাশিত আয়ুস্কালের বহু আগেই মারা যান।
আমার ঘোরতোর শত্রুর কখনো কিডনীর কিংবা ক্যান্সার রোগ হোক, আমি তা চাইবনা। কেননা, এসকল রোগীদের কি অবর্ণনীয় যন্ত্রণা আর স্বজনদের সীমাহীন পেরেশানি, দেখেছি আমি খুব কাছ থেকে। আল্লাহ্র কাছে সবসময় বলি, এমন রোগ দেওয়ার আগে সকাল সকাল তুলে নিয়ে যাক, সেই ভাল। কেননা, রোগের এমন তীব্রতায় আল্লাহ্র নাফরমানী, তাঁর ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সম্ভাবনা নাকচ করে দেওয়া যায়না।
সমাজে প্রচলিত কম কিছু কথা যা মানুষ হরহামেশাই বলে থাকে যেমন- মৃত্যু কখনো বলে কয়ে আসেনা, প্রত্যেককেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে, মৃত্যুর কোনো সিরিয়াল নাই কিন্তু জন্মের সিরিয়াল আছে, ধন-সম্পদ কিছুই কবরে যাবেনা, একবার চলে গেলে কখনো ফিরে আসেনা, মৃত্যু সবসময়ই একমুখী, মানুষের জীবনের এক সেকন্ডের ভরসা নাই ইত্যাদি ইত্যাদি। চির সত্য কথা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কথাগুলো কেবল কথাতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়, সে অনুযায়ী আমল করা হয়না। হ্যাঁ, হয়না। যদি হতো, পার্থিব জীবনের মায়া-মোহ-বিলাসিতা আমাদেরকে উন্মাদ করে দিতো না।
খুব কাছ থেকে এতো এতো মৃত্যু দেখছি কিংবা হারাচ্ছি খুবই নিকটাত্মীয়দেরকে, কারো মৃত্যু স্বাভাবিক কিংবা কেউবা আকস্মিক-অস্বাভাবিকভাবে। তাদের বিদায়ে শোকাহত হই, বিয়োগবেদনা সইতে পারিনা, অথচ তাদের মত করেই যেকোনো সময় নিজের মৃত্যুকে উপলব্দিতে আনতে পারিনা। কখনো উপলব্দিতে আসলেও সদা প্রস্তুত থাকতে পারিনা। গাড়িতে বসে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান-মুভি দেখছি, অথচ দুর্ঘটনার শিকার হতে গাড়ি যেকোনো সময়, কেননা গাড়ি দুর্ঘটনার খবর বিচিত্র নয়। পৃথিবীর নানা প্রান্তে গাড়িতেই অনেকের জীবন প্রদীপ নিভে যেতে পারলে আমার গাড়ি কেন নয়! মুভি দেখা অবস্থায় মারা গেলে অন্তিম মুহুর্তে আমার অর্জনটা কি?
খেতে বসে, গোসলখানায়, পায়খানায়, ঘুমে, বসে, শুয়ে, আড্ডারত অবস্থায়, হাঁটার সময় অথবা কাজের সময় সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের আকস্মিক মৃত্যুর খবর আমাদের অজানা নয়। এতো এতো মানুষের যদি এভাবে মৃত্যু হতে পারে, পায়না কোনো সময় শেষকালে একটু উপভোগ করে নিতে কিংবা দরকারী কাজগুলো সেরে নিতে, আমি কেন নয়! সেসব মৃত্যুর মিছিলে আমার শামিল হওয়া তো অসম্ভব নয়। তবে কেন আমার এতো উদাসীনতা!
আমি যদি একজন টগবগে তরুণ, শক্ত-সামন্ত যুবক, পরিণত পৌঢ় বয়সের কেউ হয়ে থাকি, এ বয়সের কারও মৃত্যু আমাকে কেন ভাবায় না, জাগায় না, প্রস্তুত করেনা পরকালের জন্য।
জীবনে বহু মানুষকে দেখেছি পার্থিব ভোগ-বিলাসে মজে যেতে যেতে হঠাৎ থমকে যেতে। আচমকা এমন ভয়ানক রোগ এ্যাটাক করেছে যে, অর্থ সহায়-সম্পদ সবই নিঃশেষ চিকিৎসা ব্যয়ে, জীবনের সকল ছন্দ নষ্ট হয়ে তখন বেঁচে থাকার জন্যই বেঁচে থাকা। তখন সব সাফল্য, অর্জন মিথ্যা, চাওয়া শুধু একটাই একটু সুস্থ থাকা।
তাদের এক সময়ের সম্পদের গরম, ভোগ-বিলাসে অন্ধ-বিভোর, আরেক সময়ে অধঃপতন দেখে দেখে পার্থিব জীবনের চলমান স্রোত আমাকে খুব একটা টানেনা। নিতান্তই যা না করলে নয়, তাই করি, এর বেশি কিছু করা আমাকে শোভা পায়না।
খুব সাধামাটা জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। খাইখাই চাইচাই পাইপাই মানুষদের নানামুখী চাপ অবলিলায় তুচ্ছ করে যাই শুধুই মৃত্যু ভাবনায়। এটা লাগবে, ওটা লাগবে, লাগতেই হবে, এসব কথা আমার কাছে অর্থহীন।
হয়তো খুব জানা কথা, পুরনো কথা, সাধারণ কথা, ঘর-বাড়ি, দালান-কোঠা, দামী-আরামদায়ক আসবাবপত্র, কিন্তু নিঃশ্বাসটা বন্ধ হয়ে গেলে স্থান হবে কোথায়, তিনহাত মাটির নিচেই তো। নাকি কবরেও আসবাবপত্রের সুব্যবস্থা থাকবে? মামাকে যখন কবরে শোয়ানো হয়, এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম সেদিকে। পিঠের নিচে একটা মাত্র কাপড় আর উপরে একটা। গ্রামে এখন শীত। অথচ কাঁথা, কম্বলের বদলে এ কেমন শোয়ার ব্যবস্থা! এতো আসবাবপত্র তাহলে কি কাজে লাগল। আপনারা বলবেন, তাঁর স্ত্রী-সন্তানেরা ব্যবহার করবে। কিন্তু তাদের শেষ শোয়া কি মামার মত হবেনা? সবমিলিয়ে কি দাঁড়াল, আগে পরে সবার যাত্রা সে একই দিকে।
সময় হয়েছে আমার প্রত্যাশার লাগাম টেনে ধরার, অতিমাত্রায় ব্যয়ের পরিবর্তে মিতব্যয়ী হওয়ার, তুচ্ছ প্রয়োজনকে তুচ্ছ করেই দেখার, অত্যাবশ্যকীয় করে নয়, অন্ধভাবে না ছুটে সতর্ক হয়ে পথ চলার, নশ্বর পৃথিবীকে নশ্বর জ্ঞান করে আমল করার, চিরস্থায়ী না ভেবে, পার্থিব সফলতাকে একমাত্র সফলতা না ভেবে পরকালীন সফলতাই প্রকৃত সফলতা মনে প্রাণে ধারণ করা, সকল কাজকর্ম যেন পরকালীন মুক্তির কারণ হয় সেভাবে উদ্দেশ্য স্থির ও কাজের বাস্তবায়ন করার।
আমার মামা আর কখনোই ফিরে আসবেনা। কখনই না। ভাবুন তো, আপনি কোনো বিয়ে বাড়িতে, প্রিয় কারো সাথে সাক্ষাত করতে, পরীক্ষার ভাইভা দিতে, চাকুরীতে জয়েন করতে, প্রথম মাসের টাকা তুলতে, বিয়ে করে বাস্র ঘরে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন, প্রথম সন্তানের মুখ দেখতে যাচ্ছেন, কিন্তু তাঁর আগেই কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে বা অন্য কোনো ভাবে মারা গেলেন, পৌঁছতে পারলেন না নির্দিষ্ট গন্তব্যে। পারবেন কি দ্বিতীয় বারের মত জীবিত হয়ে সেসব প্রিয় গন্তব্যে যেতে? সম্ভব? এসব ভাবতে গেলে আমার গায়ের পশম খাড়া হয়ে ওঠে।
একমার মৃত্যুই শেষ কথা। সামনে পড়ে থাকুক হাজারো পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন কিন্তু আমাকে দিয়ে হচ্ছেনা, দুই, তিন, চার..................... মাস, বছর...............যুগ, শতাব্দি পরেও আমার উপস্থিতি সম্ভব নয়!
বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান গগনবিদারী চিৎকার-কান্নাকাটি করলেও আমাকে ফেরানো সম্ভব নয়। আমার মৃত্যু হবে এমনই একরোখা, গোয়ার, একগুঁয়ে। কারো অনুরোধ, অনুনয়-বিনয় শোনেনা, শোনার রেকর্ড। একবার মরার পর দ্বিতীয়বার এসে পুনরায় নিজেকে শুদ্ধ করে মৃত্যুর দিকে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা যখন নাই, কখনই সম্ভব নয়, তাহলে কোনো একটি মুহুর্তও মৃত্যুদাতার স্মরণ, শোকরিয়া, ভয় থেকে উদাসীন থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
আল্লাহ্ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন।
বিষয়: বিবিধ
১৬৫৭ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আত্মীয় স্বজনের অসুখ বিসুখ হলে কাজে কর্মে মন দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
খুব ধকল যাচ্ছে ইদানিং।
আল্লাহ্ আপনাকেও উত্তম প্রতিধানে ধন্য করুন।
এজন্যই হাদিসে হয়ত বলা হয়েছে, শেষযুগে ফেৎনার সময় মুমিনের জন্য দুর্গম উর্বর পাহাড় অথবা বৃষ্টিপাত হয় এমন বিচ্ছিন্ন গ্রামে বসবাস করতে। তার জন্য উৎকৃষ্ট সম্পদ ও জীবিকা মেষপালন। মুসা (আঃ) আল্লাহকে প্রশ্ন করেছিলেন আল্লাহ আপনি যদি মানুষ হতেন, তবে আপনি আপনার রবের কাছে কি চাইতেন? আল্লাহ জবাব দিয়েছিলেন সুস্হ্যতা এটিই সবচেয়ে বড় নিয়ামত। আল্লাহ যেন আমাদের ঈমান নিয়ে সুস্হ ও স্বাভাবিক মৃত্যুই দান করেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন