ছেলেটির মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা (পর্ব-০৮)
লিখেছেন লিখেছেন গাজী সালাউদ্দিন ১৩ মার্চ, ২০১৭, ০৭:৫৬:৫৮ সন্ধ্যা
১০ পর্বের ধারাবাহিক গল্পটি 'HaqIslam' ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া।
অনুবাদ- গাজী সালাউদ্দিন
“হে রব, যা দেখছি, কিভাবে তা এতো সুন্দর হতে পারে”! আহমেদ বিস্ময় প্রকাশ করে।
“কিছুই তো দেখতে পাওনি এখনও। চিরস্থায়ী সৌন্দর্যের কাছাকাছি এখনও আসিনি”! ফেরেশতারা আহমেদের বিস্ময়ের জবাব দেয়।
আলোর গতির চেয়েও দ্রুততায় ফেরেশতারা উপরে ওঠতে থাকে। সাত আসমান অতিক্রম করার সময় অবাক দৃষ্টিতে আহমেদ এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। পেছনে রেখে আসা আকাশের চেয়ে পরের আকাশটা যেন আরো বেশি সুন্দর দেখায়। একটি অবর্ণনীয় সুখানুভূতি আহমেদের সমস্ত মন জুড়ে ছেয়ে যায়।
অন্য দিকে ফেরেশতাদের অপর দলটি মৌ এবং মেয়েটিকে এমন অচিন্তনীয় নির্মম শাস্তি দিতে দিতে নিয়ে যাচ্ছে যে, সাত আসমানের অপরুপ সৌন্দর্যের দিকে ভ্রূক্ষেপই করতে পারছেনা। অনবরত চলছে শাস্তি, সীমাহীন ব্যাথায় কাতর তাদের দুটি কালো চোখ থেকে থেকে অবিরাম ঝরে পড়ছে অশ্রু।
“হে আল্লাহ্! যদি জানতাম মৃত্যু যন্ত্রণা এতো কষ্টের হয়, নিশ্চয় আপনার প্রিয় বান্দা হওয়ার চেষ্টা করতাম! একটিবারের জন্য দুনিয়ায় আবার ফিরে যাওয়ার সুযোগ দিন, খাঁটি বান্দায় পরিণত হব”! মৌ এবং মেয়েটি করুণ স্বরে খোদার কাছে আকুতি জানায়।
“চুপ! এখন তো খুব নিজেদের মুসলমান দাবি কর, অথচ আল্লাহ্কে অমান্য করাই ছিল তোমাদের একমাত্র কাজ! পরিবারের লোকজন বারবার জাহান্নামের শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করার পরেও সঠিক পথে ফিরে আসনি। আখেরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনকেই বেছে নিলে! এমন শাস্তি তোমাদের হাতের কামাই”! ফেরেশতা ক্রুদ্ধ স্বরে জবাব দেয়।
“নিজেদের প্রবৃত্তিকে আল্লাহ্র ইচ্ছার উপর প্রাধান্য দিয়েছিলে। সুতরাং পাপের ফলস্বরূপ জাহান্নামই তোমাদের উপযুক্ত স্থান”!
“এখন বল দেখি, প্রকৃত বিনোদন আসলে কোনটি; দুনিয়ার রঙ তামাশা, নাকি জান্নাতের চিরস্থায়ী সুখ”, ফেরেশতারা মৌ এবং মেয়েটিকে প্রশ্ন করে।
“দেখো, পৃথিবীর সুখ শান্তিকেই যারা চূড়ান্ত মনে করেছে, তারা আগুনে পতিত হয়ে কান্নাকাটি করছে, অপরদিকে যেসব ধার্মিক লোক আল্লাহ্র দরবারে কেঁদেছে প্রতিনিয়ত নাজাপ পাওয়ার আশায়, আজ তারা চিরস্থায়ী সুখের স্থান জান্নাতে হাসি-খুশিতে বসবাস করছে”। মৌ এবং মেয়েটির মেরুদন্ড সজোরে নিচের দিকে নিক্ষেপ করে ফেরেশতারা চিৎকার করে কথাগুলো বলে।
“কিন্তু এতো ব্যাথা যে সহ্য করতে পারছিনা! কিছু ব্যাথা কমিয়ে দিন”, মেয়েটি কান্নাজড়িত কন্ঠে অনুরোধ করে।
“ব্যাথা! তেমন কোনো ব্যাথাই তো পাওনি এখনো! আরো ভয়ংকর, কল্পনাতীত আজাব অপেক্ষা করছে তোমাদের জন্য। এটাই জাহান্নাম, আল্লাহ্র অবাধ্য বান্দাদের জন্য চূড়ান্ত গন্তব্যস্থল”, অনুরোধ তো রাখেই না, ফেরেশতারা বরং আরো বেশি ভয় ধরিয়ে দেয় ইতোমধ্যেই ভিত বিহ্বল মেয়েটির মনে।
ওদিকে মৃত কিশোরদের স্বজনেরা দুনিয়ায় তাদের দাফন সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আহমেদের প্রতি আল্লাহ্র পক্ষ থেকে সম্মান হিসেবে আল্লাহ্ আহমেদের চেহারায় নূর ঢেলে দিয়েছেন, সাথে শোভা পাচ্ছে হাসি-হাসি মুখ। সে দৃশ্য এক ঝলকের জন্য যাদেরই দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, তারা অভিভূত না হয়ে পারেনি।
“আল্লাহ্র পক্ষ থেকে শুভ আলামত, হ্যাঁ, এটি শুভ আলামত”। আহমেদের বাবা শোকের মাঝেও কিছুটা খুশি হয়েই বলেন।
“আমিও এ ব্যাপারে নিশ্চিত, ইনশা আল্লাহ্”। মসজিদের শায়েখ আহমেদের বাবার কথায় সায় দেন।
অপরদিকে নূর তো দূরে থাক, দুর্ঘটনায় মৌ এবং মেয়েটির মুখ বিকৃত হয়ে বীভৎস আকার ধারণ করেছে। কিন্তু কেউ জানেনা, এটা ছিল আল্লাহ্র পক্ষ থেকে অভিশাপ!
আহমেদের বাবা তাঁর অন্যান্য সন্তানদেরকে নিয়ে আহমেদের জানাজার নামাজের সামনের সারিতে দাঁড়ায়।
বড় বড় দাড়ি ও ইসলামী পোশাক পরিহিত শত শত ধার্মিক মুসলিম আহমেদের জানাজার নামাজে ভিড় করে। আহমেদের বাবা অবাক দৃষ্টিতে উপস্থিত ভীড়ের দিকে তাকায়, তখনো দলে দলে মানুষ জানাজার নামাজে আসতে থাকে।
এতো মানুষের উপস্থিতি দেখে মুহাম্মদ আল্লাহ্র দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে।
আগত ধর্মপ্রাণ মুসল্লীদের আধিক্যের কারণে জানাজার নামাজ ৩ বার পড়াতে হয়। কিন্তু কেউ জানেনা, এটা ছিল আল্লাহ্র পক্ষ থেকে এক বিরাট সম্মান।
“আল্লাহু আকবার বলে ইমাম সাহেব জানাজার নামাজ শুরু করেন। আল্লাহ্র প্রতি ভালোবাসা ও ভীতিতে সেখানে একটি ভাব গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। উপস্থিত মুসল্লীগণ প্রাণ খুলে আল্লাহ্র নিকট দুয়া করে আহমেদের জন্য। আহমেদকে ক্ষমা করে দিয়ে তার উপর রহম করার জন্য ফেরেশতারাও আল্লাহ্র নিকট ফরিয়াদ জানিয়ে আহমেদকে নিয়ে সপ্তম আসমানে পৌঁছে যায় এবং তাঁর লিখিত আমলনামাকে ইল্লীনে রেখে আবার দুনিয়ায় ফিরে আসে।
নামাজ শেষে শায়েখের দিকে তাকিয়ে মুহাম্মদ জিজ্ঞেস করে, “মৌ ও মেয়েটির কি খবর?
“মৃত্যু সনদ হাতে না পাওয়ার কারণে শুক্রুবারের পরিবর্তে তাদের দাফন শনিবারে হবে”। শায়েখ জবাব দেয়।
আহমেদের মৃত দেহটি কবরস্থানে নেওয়া হয়। আহমেদের চোখ তখন তার নিজের কবরের দিকে। কবর থেকে বিভিন্ন রঙয়ের আলোর দ্যোতি ছড়িয়ে পড়ছে যেন। কিছুটা দূরে যেন জলপ্রপাত ও গাছের পাতা পতনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। দূর থেকে ভেসে আসছে জান্নাতের ফলফলাদির সুঘ্রাণ; এমন ঘ্রাণ ইতিপূর্বে কখনো অনুভূত হয়নি!
“দয়া করে আমাকে আমার কবরে যেতে দিন!’ আহমেদ উত্তেজনায় ছটফট করে।
“আহমেদ! ধৈর্য ধর”। আহমেদের অস্থিরতা দেখে ফেরেশতারা হেসে জবাব দেয়।
শোক সন্তপ্ত বাবা এবং অন্যান্য সদস্যরা তার মৃত দেহটি কবরে নামালে তা আলোকিত হয়ে ওঠে।
“সুবহানাল্লাহ! আমার সন্তানের দেহ অনেক আলোকিত মনে হচ্ছে”! মুহাম্মদ বলেন।
“মাশাল্লাহ, ধার্মিক লোকদের মৃত দেহ এমনই আলোকিত হয় যখন তাদের আত্মা কবরে থাকতে চায়”, শায়েখ সায় দেন।
স্থানীয় শায়েখের সাথে মুহাম্মদ কবরে নামে। দুজনে মিলে সতর্কভাবে তাকে কবরে রাখার পর মুহাম্মদ গভীর দৃষ্টি দিয়ে আহমেদের চোখে তাকিয়ে থাকে।
শায়েখ দেখে মুহাম্মদের চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি ঝরছে, শোকে তাঁর শরীর কাঁপছে।
“মুহাম্মদ। শক্ত হও, ধৈর্য ধর”। শায়েখ শান্তভাবে বলে।
“হ্যাঁ, কিন্তু পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ........................ শায়েখ, আমি যে কোনোভাবেই নিজেকে সামলাতে পারছিনা”! আহমেদের শিশুর মত কেঁদে ওঠে।
“এটাই তাকদির, এবং নিশ্চিতভাবেই এটি আল্লাহ্র পক্ষ থেকে কঠিন পরীক্ষা। কুরআন এবং সুন্নাহর পথে অটল থাক এবং ইনশা আল্লাহ্, জান্নাতে তোমরা সবাই একই সঙ্গে থাকবে”। শায়েখ সান্ত্বনা দেন।
যদি আহমেদের বাবা আহমেদের এখনকার বাস্তবিক অবস্থা দেখত, সে নিশ্চিতভাবে দুঃখের বদলে সুখে কাঁদত।
খুব কম মানুষই হয়তো উপলব্দি করতে পেরেছে, মানুষের মৃত্যু যে নির্দিষ্ট কোনো বয়স মানে না, আসতে পারে যেকোনো মুহুর্তে কোনো আগাম বার্তা ছাড়াই, আহমেদের মৃত্যুর মাধ্যমে আল্লাহ্ সবাইকে এটাই জানান দিয়েছেন।
চলবে------
আগের পর্বগুলো দেখতে আমার ব্লগ পাতার কিছুটা পেছনের দিকে ঘুরে আসুন।
বিষয়: বিবিধ
১৬৪০ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
শুকরিয়া শুকরিয়া
একথাটি আমাকেঅ খুব খুব ভাবায়। আপনাকে ভাবিয়েছে, আপনার এমনটি মনে হচ্ছে বলেই আমার পরিশ্রম অনেকটাই স্বার্থক। অন্তত একজন মানুষকে হলেও মৃত্যু চিন্তার দিকে নিবদ্ধ করতে পেরেছি।
আপনি একসাথে কয়টা সিরিয়াল লিখতেছেন ?
এই নিয়ে ৩ টা ধারাবাহিক চলছে।
আবারও হাজির হব 'মুসলিম পরিবারের জন্য ৪০ টি পরামর্শে'র শেষ কয়েকটা নিয়ে। তারপর শেষ।
আর তাবাচ্ছুমের আবদারগুলোর কোনো সীমা টানতে পারব বলে মনে হয়না।
মন্তব্য করতে লগইন করুন