ছেলেটির মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা (পর্ব-০৭)
লিখেছেন লিখেছেন গাজী সালাউদ্দিন ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ০৬:৫৫:৩৬ সন্ধ্যা
১০ পর্বের ধারাবাহিক গল্পটি 'HaqIslam' ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া।
অনুবাদ- গাজী সালাউদ্দিন
(উল্লেখ্য, এই পর্বটি অনুবাদ করার সময় আমি বারবার আবেগে আপ্লুত হয়েছি, কেঁদেছি। সত্যিই, কোনো সন্তান যখন আল্লাহ্র পথে ফিরে আসে, ধার্মিক বাবা মায়ের সে আনন্দের তুলনা হয়না)
আহমেদ দৃষ্টিকে জমিনের দিকেস্থির রেখে রাস্তা পার হতে উদ্যত হয়। এদিকে শয়তান মৃত্যুর উপস্থিতি টের পেরে দৌড়ে তার শত্রু আহমেদের দিকে এগিয়ে যায়।
“আহমেদ, তাকাও না একবার এই সুন্দরীর দিকে! সে খুবই রূপসী! তোমার সন্তুষ্টির কারণ হবে.........”! শয়তান ফিস ফিস তাকে প্ররোচিত করার চেষ্টা চালায়।
অকস্মাৎ কয়েক গজ দূরে একটি চলন্ত ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। আর সেটি তাদের দিকেই আসছে দেখে ভরকে গিয়ে সবাই চিৎকার শুরু করে। এমন কিংকর্তব্যবিমুর মুহুর্তেও আহমেদ লক্ষ করে বয়স্ক ধার্মিক মহিলাটি নিয়ন্ত্রণ হারানো ট্রাকের তলায় পিষ্ট হতে যাচ্ছে। কাঁধের ব্যাগটি ছুঁড়ে ফেলে ঐ মহিলাটিকে ট্রাকের সংঘর্ষ থেকে বাঁচাতে শরীরের সমস্ত শক্তিকে এক সঙ্গে কাজে লাগিয়ে ছুটে যায়।
“আল্লাহ্র শপথ, যদি আল্লাহ্র জন্য আমি কিছু করে থাকি, তাহলে এই মহিলাটিকে রক্ষা করাই হবে আমার সে কাজ। মনে মনে এ বুলি আওড়িয়ে সাহস সঞ্চয় করে দৌড়ে গিয়ে মহিলাটিকে রাস্তার পাশে ঠেলে দিতে সক্ষম হয়। ততক্ষণে ট্রাকটি চাপা দেয় মৌ এবং তার সঙ্গে থাকা মেয়েটিকে। পরক্ষণেই আহমেদের উপর আঁচড়ে পড়ে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তিন কিশোরের রক্তে রঞ্জিত হয় পিচ ঢালা পথ।
“হে আল্লাহ্, আমি ভীত সন্ত্রস্ত। এভাবে মরতে চাইনা। এখনও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে পারিনি। এখনও রোজা রাখিনি.........”, আহমেদ কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বলে চলেছে, সে সাথে গাল বেয়ে নেমে আসছে অশ্রুর বান। দেহ ও মাথা থেকে তাজা রক্ত বের হয়ে চলেছে অবিরাম।
সংঘর্ষটির বিকট আওয়াজে অনেকেই ঘরের বাইরে এসেছে। সে সঙ্গে স্থানীয় মসজিদের ইমামও দৌড়ে আসেন ঘটনার আকস্মিতা বুঝার জন্য। ঘটনাস্থলে ইমাম সাহেব আহমেদকেও রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে যান।
“আহমেদ”! রক্তমাখা হাত ধরে ইমাম সাহেব চিৎকার করে ডেকে ওঠেন এবং মৃত্যু পথযাত্রী আহমেদকে বলেন, “ঘোষণা কর, শাহাদাহ”।
আহমেদ একটি অদ্ভূত মৃদুমন্দ শীতল বাতাস অনুভব করে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে উপরে তাকিয়ে দেখতে পায় এমন কিছু দৃশ্য যা পূর্বে কখনও কল্পনাও করেনি।
অত্যাশ্চর্য ফেরেশতাদের দু’টি দল আকাশ থেকে নেমে আসছে। এক দল সূর্যের ন্যায় আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছে। যতদূর চোখ যায়, ততদূর তাদের ডানাগুলো বিস্তৃত। তাদের দেহ ও মুখ থেকে দ্যুতিমান সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ছে। অন্য দলটি মুখ ও দেহে অন্ধকার-ভয়ংকর রূপ ধারণ করে বজ্রপাতের ন্যায় আওয়াজ করে নেমে আসছে আর তাদের হাতে শোভা পাচ্ছে নির্যাতনের সব উপায়-উপকরণ।
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”, আহমেদ পড়তে শুরু করে।
ইমাম হাসছে, কপোল ভিজে যাচ্ছে চোখের পানিতে। আহমেদের কপালে ঘাম জমা হতে দেখে ইমাম সাহেবের মনে পড়ে ভ্রূ ঘর্মাক্ত অবস্থায় কেউ যখন মারা যাওয়া ভাল লক্ষণ।
আহমেদ এখনও জানেনা ফেরেশতাদের কোন দলটি তাকে নিয়ে যাবে। হঠাৎ আহমেদ অনুভব করে একটি মুক্তির অনুভূতি, যা তার জীবদ্দশায় কখনো অনুভব করেনি। সে দেখতে পায়, অনুপম সৌন্দর্যের অধিকারী ফেরেশতারা তার দিকেই তাকিয়ে আছে!
ব্যাথা থেকে মুক্তি পেতে আহমেদ তাদের দিকে হাত দু’টি বাড়িয়ে দেয়।
“আর কেঁদোনা আহমেদ। আমাদের সঙ্গে এসো। আমরা তোমার বন্ধু। তোমাকে অনেক ভালবাসি আহমেদ। আল্লাহ্র সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আমরাই তোমার দেখাশোনা ও যত্ন নেব। আর হ্যাঁ, আল্লাহ্ তোমার প্রতি খুবই খুশী”, ফেরেশতারা আহমেদকে অভয় দেয়।
ফেরেশতারা ধীরলয়ে খুব সতর্কভাবে আহমেদের আত্মাকে দেহ থেকে আলাদা করে যেভাবে একজন মা তার নবজাতক শিশুকে কোলে তুলে নেয়।
তবুও আত্মাকে দেহ থেকে আলাদা করার ব্যাথায় আহমেদের চোখ জল ছেড়ে দেয়। বিভিন্ন রঙয়ের চমৎকার আলোয় সজ্জিত বিছানার মত একটি অবিশ্বাস্য রকমের দোলনা দেখতে পায়, যার বাহক একজন ফেরেশতা। ফেরেশতারা তাঁর আত্মাকে দোলনার উপর রাখে, অন্য একজন ফেরেশতা তাতে ছিটিয়ে দেয় সুগন্ধময় কস্তুরী, যার সুবাস আহমেদ এর আগে কখনো পায়নি।
আহমেদকে যখন খুব সম্মানের সাথেই মৃত্যুবরণ করানো হচ্ছে, ঠিক তখনই ভয়ংকর রূপ ধারণকারী ফেরেশতাদের দলটি মৌ এবং সঙ্গী মেয়েটির মাথায় একের পর একের আঘাত হেনে চলেছে!
মৌ ও মেয়েটির আত্মাকে তুলে নেওয়ার ব্যাথায় কাতর তাদের গগণ বিদারী বিকট চিৎকার যাতে আহমেদের কানে না আসে, ফেরেশতারা সে ব্যাবস্থাও করে।
“হে আল্লাহ্, না! রহম করুন! আমি একজন মুসলমান, আমি একজন মুসলিম!” শাস্তির ফেরেশতারা আত্মাকে বের করে নেওয়ার সময় মৌ চিৎকার করে বলতে থাকে যদি বা তাদের করুণা হয়।
“মুসলিম! মুসলমানের নামটিকে আর অপমান করো না! তুমি আল্লাহ্কে অমান্য করেছো এবং তাঁর শাস্তিকে উপেক্ষা করেছো! এখন থেকে চিরকাল তুমি শাস্তি ভোগ করতে থাকবে! ফেরেশতারা ধকমে ওঠে এবং দুই বন্ধুর আত্মাকে অন্ধকার কালো আগুনের বিছানায় নিক্ষেপ করে।
“আল্লাহ্ তোমার উপর অভিসম্পাত করুন মৌ! আল্লাহ্ তোমাকে দ্বিগুন শাস্তি দিন!” মেয়েটি সজোরে চিৎকার করে বলে যখন তার মাংস খসে পড়ে, হাডি দেখা যায় আর ধীরে ধীরে মর্মান্তিকভাবে আগুনের বিছানায় জ্বলতে থাকে।
“আমি তো তোমাকে পাপ করতে বাধ্য করিনি! তুমিই স্বেচ্ছায় আমার কাছে এসেছ!” মৌ কাঁদতে কাঁদতে জবাব দেয়।
“চুপ কর! তোমাদের তর্ক-বিতর্ক বিচার দিবসের জন্য রেখে দাও!” ফেরেশতাগণ ধমক দেয়।
এক পর্যায়ে তারা উভয়েই দেখতে পায়, আহমেদ পরম শান্তিতে আছে।
“রাস্তায় আহমেদের কথাগুলোই যদি শুনতাম তাহলে আমিও এখন তাঁর সাথে থাকতাম”। ব্যাথায়, অনুশোচনায় কাতর মৌ এভাবেই হা হুতাশ করে।
আহমেদের বাবা রাস্তায় বের হয়ে আসেন কি ঘটেছে দেখার জন্য।
আহমেদের বাবার চোখ পড়ে রাস্তায় শায়িত রক্তে ভেজা ছেলের দেহের উপর।
“হে আল্লাহ্, না! আহমেদের বাবা চিৎকার করে ওঠেন।
ইমাম সাহেব দেখতে পান আহমেদের বাবা তাঁর দেহের দিকে দৌড়ে আসছে। তিনি দ্রুত জড়িয়ে ধরেন এবং চেষ্টা করেন আহমেদের মৃতদেহ তাঁর বাবাকে দূরে রাখতে।
“কি হয়েছে? সে কি ঠিক আছে?” আহমেদের বাবা এক রাশ আশঙ্কা নিয়ে চিৎকার করে জানতে চায়।
ইমাম সাহেব আহমেদের বাবার কাঁধ নিজের বাহুর সঙ্গে আগলে নেন।
“আল্লাহ্ আপনার আহমেদকে তাঁর কাছে তুলে নিয়ে গেছেন”। ইমাম সাহেব ধীরস্থির ভাবে জবাব দেন।
“হে আল্লাহ্! আমার সন্তান, আমার সন্তান”! আহমেদের বাবা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন, তার দেহ অবশ হয়ে আসে, জমিনে ঢলে পড়েন।
ইমাম সাহেব আহমেদের বাবাকে জমিনে বসানোর চেষ্টা করেন।
“মুহাম্মদ, আমার কথা শোনো। তোমার ছেলে আল্লাহর কাছে ফিরে গেছে। আজ তাকে মসজিদে নামাজ পড়তে দেখেছি। প্রায় ২ ঘন্টা ধরে তাঁর কৃত কর্মের জন্য আল্লাহ্র দরবারে কান্নাকাটিও করেছে। তাঁর সাথে আমার চমৎকার কথাবার্তা হয়েছে, এমনকি সে তোমাদের জন্য কিছু উপহার কিনেছে। প্রিয় ভাই মুহাম্মদ, তোমাদের জন্য সুখবর, সে মরণের সময় শাহাদাহ পড়েছে। শুধু তাই নয়, একজন বয়স্ক ধার্মিক মহিলাকে দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। সে আকাশের দিকে তাকিয়েছে এবং শেষ নিঃশ্বাসের আগেও হেসেছে”। “এটা নাও”, ইমাম সাহেব তাঁর হাতে থাকা আহমেদের কাঁধের ব্যাগটি মুহাম্মদের হাতে তুলে দেয়।
ব্যাগটি ধরার আগে পর্যন্ত আহমেদের বাবা ঘোরের মধ্যে ছিলন। ধীরে ধীরে ব্যাগটি খুলেন। তাতে রাখা আছে তাঁর নিজের জন্য একটি সুগন্ধীর বক্স এবং মজাদার চকলেটের বক্স আহমেদের মায়ের জন্য।
সুগন্ধীর প্যাকেটে লিখা মেসেজটি তিনি পড়তে শুরু করেন:
“প্রিয় বাবা, এটা আপনার জন্য। আমি সবকিছুর চাইতে আল্লাহ্কে বেশি ভালবাসি এবং তোমাকে ও মাকে সুখী করার জন্য যা কিছু করার দরকার, আমি সবই করবো। আজ রাতে তোমার সাথে মসজিদে একই সাথে নামাজ পড়ার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে আছি”!
আহমেদের বাবা চোখের পানিকে আজ আর রোধ করার চেষ্টা করেন না, কোনো বাধা না পেয়ে ঝর ঝর করে পড়তে থাকে অশ্রু।
“আমার সন্তান আমায় গর্বিত করেছে! আল্লাহু আকবার! আল্লাহু আকবার! মুহাম্মাদ ওঠে দাঁড়ায় এবং দৌড়ে বাড়ি যায়।
“আলিয়া! আলিয়া! দেখো, আমাদের আহমেদ আমাদের জন্য কি উপহার দিয়েছে”! আহমেদের বাবা চকলেটের বক্সটি স্ত্রীর হাতে দিয়ে মেসেজটি পড়তে বলে:
“প্রিয় মা। এই চকলেটগুলো তোমার জন্য। তোমাকে শাররিক ও মানসিকভাবে অনেক আঘাত দিয়েছি। আল্লাহর শপথ, এমনটি আর কখনো করবো না মা। শপথ করে বলছি, তোমাদের মলিন মুখ আর কখনোই দেখতে চাইনা। আল্লাহর শপথ, আমরা এক সাথে আল্লাহর প্রার্থণা করবো, একই সাথে একটি বড় পরিবার হয়ে জান্নাতে বিচরণ করবো”।
“সুবহানাল্লাহ! লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ! আমার সন্তান আল্লাহর দিকে ফিরে এসেছে”, আলিয়া মহানন্দে আল্লাহ্র দরবারে শুকরিয়া জানায়।
আহমেদ সম্পর্কে ইমাম সাহেবের কথাগুলো মুহাম্মদ স্ত্রীর কাছে সবিস্তারে বর্ণনা করে।
মারা যাওয়ার সময় আহমেদ যে সম্মান ও চমৎকার অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, তা কেউ জানেনা, আর কেউই জানেনা মৌ এবং তার সঙ্গে থাকা মেয়েটি কি ভয়াবহ পরিণতির শিকার হয়েছে, হচ্ছে এবং হতেই থাকবে।
চলবে-----
আগের পর্বগুলো পড়তে নিচের লিংকগুলোতে ক্লিক করুন।
ছেলেটির মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা (পর্ব-০১)
ছেলেটির মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা (পর্ব-০২)
ছেলেটির মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা (পর্ব-০৩)
ছেলেটির মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা (পর্ব-০৪)
ছেলেটির মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা (পর্ব-০৫)
ছেলেটির মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা (পর্ব-০৬)
বিষয়: বিবিধ
১১১৯ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কিন্তু মৃত্যু পথযাত্রী মানুষ কি এসব ঘটনা বলে যেতে পারে ?
পারেনা বলেইতো মানুষের এতো অহংকার দেমাগ
আমীন আমীন আমীন
যথার্থই বলেছেন। যিনি লিখেছেন, তাঁর জন্য অনেক অনেক দোয়া এবং শ্রদ্ধা নিবেদন।
ইনশা আল্লাহ্
আমার জন্য আপনার দোয়া আল্লাহ্ কবুল করুন।
জাযাকাল্লাহু খাইর
ছুম্মা আমীন।
দুয়া রাখবেন যেন দুটি হাত আল্লাহ্ সচল রাখেন, মেধা বাড়িয়ে দেন।
জাযাকাল্লাহু খাইর
মন্তব্য করতে লগইন করুন