ছেলেটির মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা (পর্ব-০৫)
লিখেছেন লিখেছেন গাজী সালাউদ্দিন ২২ নভেম্বর, ২০১৬, ০৫:৫২:৫২ বিকাল
১০ পর্বের ধারাবাহিক গল্পটি 'HaqIslam' ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া।
অনুবাদ- গাজী সালাউদ্দিন
আহমেদের বাবা মা উভয়ে হাসপাতালের বিছানায় সংজ্ঞাহীন আহমেদের পাশে বসে আছেন।
হঠাৎ আহমেদের চোখ নড়ে ওঠে, এবং এর মিনিট কয়েক পর সে চোখ খুলে তাকায়।
“আল্লাহু আকবর! আমাদের ছেলে! তোমার কেমন লাগছে বাবা?” আহমেদের মা নিজের হাতের সাথে তার হাত চেপে ধরে অধীর অপেক্ষার অবসান হওয়া মাত্রই আনন্দে উদ্বেলিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, আর চোখ দিয়ে ঝরতে থাকে আনন্দ অশ্রু।
“......যখন দেখি গাড়িটি আমার দিকে আসছে......আমার মনে হচ্ছিল..... আমি বুঝি মরতে যাচ্ছি.....” আহমেদ অনুচ্চ স্বরে বলে ওঠে।
“তোমরা কতক্ষণ ধরে এখানে অপেক্ষা করছ?” আহমেদ জিজ্ঞেস করে।
“প্রায় ১১ ঘণ্টা। এই কক্ষে আমরা নামাজও পড়েছি”, আহমেদের বাবা শান্তভাবে জবাব দেন।
“..... আমার বাবা আমার জন্য এতো লম্বা সময় ধরে বসে আছেন এবং আল্লাহ্র প্রতি তাদের ইবাদত বন্দেগীও অব্যাহত রেখেছেন। অথচ আমি একটি মিনিটের জন্যও বাবা মায়ের সাথে বসে দুটো ভালো কথা বলেনি! এমনসব কাজই করেছি যা আল্লাহ্র বিরাগভাজন হওয়ার কারণ.......” আহমেদ বিস্মিত মনে ভেবে যায়।
ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই চোখের কোণায় জল এসে টলমল করে। তা বাবার চোখ এড়ায়না, আহমেদকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করেন, “কি হয়েছে আহমেদ, কাঁদছো কেন?”
“হুম.....জানিনা কেন...... হয়তো বেঁচে থাকতে পারায় সুখানুভূতির বহিঃপ্রকাশ” আহমেদ এক রাশ বিষন্নতা, বিভ্রান্তি নিয়ে বাবার কথায় প্রতিউত্তর করে।
দু’দিন পর আহমেদ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়। সে রাতে আহমেদ বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে, আর তখন তার বন্ধু মৌ কল করে।
“হে আহমেদ, শুনেছি তুমি নিরাপদেই বাসায় ফিরেছ, তাই ভাবলাম ফোন করে তোমার খোঁজ খবর নেই”। ফোনের ওপাশ থেকে মৌ বলে।
“ভালো করেছ”। আহমেদ জবাব দেন।
“আহমেদ শোন। যেহেতু সেদিন রাতে তোমার অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার কারণে নাইট ক্লাবের যাওয়ার পরিকল্পনাটি মাটি হয়ে যায়, তা বলছি আজ রাতে যাবে? জানো, তোমার দুর্ঘটনায় আমি খুবই রাগান্বিত ছিলাম! তবুও সেদিন রাতে ক্লাবে যাই। একটা মেয়ের সাথে খোশ গল্প করে দারুণ সময় কাটিয়েছি। তোমারও সে মেয়েটিকে দেখা উচিৎ।
“মো। ভালো হও, আমি সত্যিই যেতে চাইনা। আমার এক্সিডেন্ট হওয়াটা কি আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্ক বার্তা নয়?
“ওয়ার্নিং! তুমি বাজে বকছো আহমেদ! তুমি গোঁড়া হয়ে যাচ্ছো না তো? তুমি তো ভালো করেই জানো, তাদের জীবন কতইনা ডিজগাস্টিং!”
“হ্যাঁ, ধরে নিলাম তাদের জীবনে এখন উপভোগ্য নয়, কিন্তু তারা সবাই নিশ্চিত একদিন তাদের সবাইকে মরতে হবে, এবং আজকের নিরানন্দ জীবনের বিনিময়ে জান্নাতে অপরিমেয় সুখ সাগরে অবগান করবে” আহমেদ জবাব দেয়।
“আহমেদ, ছাড়ো ঐসব কথা! আমরা মুসলমান! আমরা জান্নাতে যাবো। কিছু সময়ের জন্য দোজখে আমাদের শাস্তি হতে পারে, কিন্তু পর্যায়ক্রমিকভাবে আমরা সবাই জান্নাতে যাবো, সুতরাং ভয় কিসের? তাছাড়া, আল্লাহ্ পরম দয়ালু! তিনি বলেছেন, যদি তুমি বিশ্বাস করো। তাহলে তোমাকে ক্ষমা করে দেবেন!” মৌ ত্রুটিপূর্ণ ধর্মীয় জ্ঞান নিয়েই বিজ্ঞের মত কথাগুলো বলে চলে।
“হুম। আমি জানিনা। আমাকে ভাবতে দাও। আজকে রাতে নয়, আমার বাহুতে এখনো প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হচ্ছে, আগামী কাল তোমার কথার জবাব দেবো”।
“ঠিক আছে। আগামী কাল আমাকে ফোন করতে ভুলো না যেন! আমাকে এখন বদ্ধ ঘরে দম বন্ধ করা বিরক্তিকর পরিবেশে বসে থাকতে হবে আর শুনতে হবে আমার বাবার কুরআন তেলোয়াত! তাদের জীবনটা বড্ড বেশি একঘেয়ে, এমনকি আমি জানিনা কিভাবে তারা হাসে!”
কথা শেষ হলে আহমেদের মন বিষণ্ণতায় ছেয়ে যায়। জীবনে এই প্রথম আল্লাহর ভয়ে তার মন অস্থির হয়ে ওঠে, তার ভয় হয়, আল্লাহ্ কি না করতে পারেন তার সাথে! আহমেদ ধেয়ে আসা চোখের পানি আটকে রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
“...... কিভাবে আল্লাহ্ আমাকে এখনও ভালোবাসবেন? কখনও একটা মিনিট সময়ও আল্লাহর জন্য ব্যয় করেনি! আমি আমার মায়ের শরীরে আঘাত করেছি, অথচ তিনি আগের মতই আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন স্নেহ করে, মমতার বন্ধনে আগলে রাখেন! আল্লাহ্ কিভাবে আমায় ক্ষমা করবেন......!” আহমেদ ভাবনার গভীরে ডুবে যায়।
পরের দিনেও আহমেদের বাহুতে খুব ব্যথা অনুভূত হয়। রাতে নাইট ক্লাবে যেতে মৌয়ের প্রস্তাবটি প্রত্যাখান করে। তার পরিবর্তে জীবন সম্পর্কে ভেবে ভেবে সারাদিন কাটিয়ে দেয়।
দিন চলে যায়, আমরাও আহমেদের জীবনাবসান দেখার খুব কাছাকাছি এসে পড়েছি, অর্থাৎ শেষ দিন......
কেউ জানেনা, রুহ কবজ করার জন্য আজরাইল কখন শিয়রে চলে আসে।
দিনটি বৃহস্পতিবার। আহমেদ সকাল সকাল ঘুম থেকে জেগে ওঠে। রাতে ঘুম ভালো হয়নি, দুঃস্বপ্ন তাড়া করেছে।
ধীরে ধীরে টেবিলে গিয়ে বসে। মনে হয় ঘরে কেউ নেই। সে টেবিলের উপর বাবার কাজের কিছু ফাইল পত্র দেখতে পায়। সে সেগুলো একটা একটা করে টেবিল থেকে বাবার ডেস্কে রাখতে গেলে একটা ছোট ডাইরি ফ্লোরে পড়ে যায়।
পেপারগুলো সতর্কভাবে তুলে রাখার পর আহমেদ কৌতুহলবশত ছোট ডাইরিটি খুলে দেখে, যার ফ্রন্ট পেইজে কুরআন থেকে আল্লাহর বাণী লেখা:
“হে, আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ্ সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করেন। তিনি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। (৩৯:৫৩)”
অকস্মাৎ আহমেদের চোখ থেকে ঝর ঝর করে পানি পড়তে শুরু করে। তাঁর হাত কাঁপতে থাকে আর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। সে আরও কয়েক পাতা উল্টায় আর পড়তে থাকে:
“...... আমি আল্লাহর কাছ থেকে দূরে ছিলাম। আমি আমার আত্মার বিরুদ্ধে অন্যায় করেছি। আল্লাহ্ থেকে অনেক দূরে ছিলাম। আমি আল্লাহর দিকে ফিরে আসি এবং তারপর আবারও পাপে নিমজ্জিত হই। তখন আমি দুই সন্তানের পিতা ......”।
আহমেদ পাতা উল্টায় এবং যতই পড়তে থাকে, তত আরও বেশি অবাক হয়।
“......আহমেদ, আমার তৃতীয় সন্তান। তখন তার বয়স পাঁচ বছর। সেই আমাকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দিয়েছে। একদিন আমাকে টিভিতে নাচ গানের অনুষ্ঠান দেখার সময় সে দেখে ফেলে এবং জিজ্ঞেস করে, “এখন যদি একজন ওস্তাদ রুমে আসে আর তোমাকে দেখে, তাহলে তুমি কি করবে? আমি জবাব দেই, দ্রুতই টিভি বন্ধ করে ফেলব। আমার সন্তান আমাকে পালটা জবাব দেয়, কিন্তু বাবা আল্লাহ্ তোমাকে সব সময় দেখছে এবং সকল ওস্তাদ তাঁর ভয়ে তটস্থ থাকে। আমার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। নিজের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে পড়ি। তারপর আমি আল্লাহর দিকে ফিরে আসি। আল্লাহর প্রতি নিবেদিত প্রাণ হতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। আমার আলিয়াও আমার মত প্রতিজ্ঞা করে”, আহমেদ পড়তে থাকে।
“...... আমার আহমেদ খারাপ সঙ্গের মিশে গেছে। সে ধর্ম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আমি ব্যর্থ। আমার সন্তান আমার জীবনের গতিধারা বদলে দিয়েছে, কিন্তু আমি কিভাবে তাকে বদলাবো? কোন কাজ করলে আমার সন্তানকে আল্লাহ্র দিকে ফেরানো যাবে?......”
আহমেদ ডাইরিটি বন্ধ করে। গাল বেয়ে অশ্রু পড়ে। আহমেদ কলম খাতা হাতে নেয়, লিখে-
“বাবা। আমি তোমার ডাইরি পড়েছি। বাল্য কালে একটি প্রশ্ন করে তোমার জীবনকে আল্লাহ্র দিকে নিবদ্ধ করিয়েছি। ডাইরিতে লেখা তোমার কথাগুলো আমাকে আল্লাহ্র প্রতি ধাবিত করেছে...............”
লেখা শেষে আহমেদ চিরকুটটি তাঁর বাবার ডাইরির ভেতর রেখে দেয়।
আহমেদ উঠে দাঁড়ায় এবং এই প্রথম স্বেচ্ছায় অজু করে। জামা কাপড় পরে প্রস্তুত হয়ে মসজিদের দিকে যাত্রা করে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর বন্ধু মৌ সেই পথ দিয়েই যাচ্ছে। মৌ কি আহমেদকে জাহান্নামের পথে যেতে উদবুদ্ধ করবে? আহমেদ কি মৌকে জান্নাতের পথে নিয়ে আসতে প্রচেষ্টা চালাবে? এই মুহুর্তে আহমেদ যে পথে আছে, অটল অবিচল থাকতে পারবে কি সে পথে?
চলবে--------
আগের পর্বগুলো দেখতে-
ছেলেটির মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা (পর্ব -০১)
ছেলেটির মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা (পর্ব- ০২)
ছেলেটির মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা (পর্ব- ০৩)
ছেলেটির মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা (পর্ব- ০৪)
বিষয়: বিবিধ
১৪৮৪ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনাকে আমি নিষেধ করেছি, ভিডিও লিংক দেবেন না! তবুও দিলেন!!!!! এটা আমার খুবই অপছন্দ!
Free speech,
এটা ব্লগ, তো কি হয়েছে! আপনার যা খুশি করুন না। আমার পাড়ায় আমার অপছন্দের কাজ কেন?
আশা করি, এমন আর করবেন না।
বেশ হৃদয়স্পর্শী ঘটনা।
চলতে থাকুক…।
সর্বাবস্থায় ভালো থাকুন এই প্রার্থনা।
আপা, সত্যিই তাই। লিখতে গিয়ে আমার ভেতরেও খুব নাড়া পড়ে। আমি কেঁদেছিও কিছুটা।
সঙ্গেই থাকুন। ইনশাআল্লাহ্, চালিয়ে যাবো
আমার জন্য আপনার দোয়া আল্লাহ্ কবুল করুন।
দোয়া আপনার জন্যও
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। এই ধারাবাহিকের সঙ্গেই থাকুন।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ পনি
আপনার ধন্যবাদ স্বানন্দে গ্রহণ করলাম
স্থবির হয়ে থাকা হৃদয়গুলোকে নাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যেই কিন্তু আমার এই ক্ষুদ্র সাধনা।
আমীন ছুম্মা আমিন।
বুবু, আল্লাহ আপনাকে অনেক অনেক ভালো রাখুন
ইনশাআল্লাহ্, চালিয়ে যেতে চাই
মন্তব্য করতে লগইন করুন