আপনি কি সাচ্চা মুসলমান? আসুন নিজেকে একটু বিশ্লেষণ করি
লিখেছেন লিখেছেন গাজী সালাউদ্দিন ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০৫:৪৭:৪৪ বিকাল
নিয়মিত নামাজ, সকাল-সন্ধ্যা কুরআন তেলাওয়াত, বছর বছর হজ্ব ওমর, মাঝে মাঝে নফল রোজা রাখেন, অভাব অনটন যাই থাকুক কুরবানী করেন, মুখে দাড়ি গায়ে পাঞ্জাবি, বোনেরা বোরকা পরে থাকেন, এতো কিছুর পরে আপনার আমল আখলাক নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়না।
কিন্তু আপনি যখন নামাজ পড়েও মন্দ থেকে বিরত নন, কুরআনী শিক্ষার বাস্তবায়নে আন্তরিক নন, হজ্ব করেন লোক দেখানোর জন্য যার প্রমাণ মিনিটে মিনিটে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট, একবার ঢু মেরেও দেখেন না কিভাবে চলছে প্রতিবেশীদের নিত্য দিন, ঈদ আমল ও উৎসবের সময় হওয়া সত্ত্বেও অনৈসলামিক আনন্দ উৎসবে মেতে থাকেন, বোরকা গায়ে দেয়াটাকে বানিয়ে নেন ফ্যাশনের অংশ, তখন একটা প্রশ্ন মাথায় কিলবিল করে ‘কম কষ্টের আমলগুলো করে এখন অনেকেই সাচ্চা মুসলমান, তুলনায় বেশি কষ্টের আমলগুলো করেন তো?’ যদিও মহান আল্লাহ্ মানুষের উপর এমন কোনো কাজ চাপিয়ে দেননা যা সে করার সামর্থ রাখেনা।
কুরবানীর ঈদ গেল। কুরবানীর পশু কেনা, জবাই, রুটি দিয়ে তৃপ্তি সহকারে খাওয়া ইত্যাদি নিয়ে আগ্রহের অন্ত নেই। ইসলাম তো এটাই চায়, মুসলমানেরা ইসলামের উৎসবগুলো নিয়ে গর্ব বোধ করবে, থাকবে ব্যতিব্যস্ত। কিন্তু কুরবানির পশু হালাল পয়সায় কিনেছেন তো? কুরবানী ওয়াজিব না হওয়া সত্ত্বেও ধার দেনা করে লোক দেখানো কুরবানী দেননি তো? ভেবে দেখা উচিৎ।
ঈদ ইসলাম ধর্মের উৎসব। তাই এক্ষেত্রে ইসলামী রীতি-নীতির চর্চা বাঞ্ছনীয়। অন্যান্য ধর্ম তাদের উৎসবগুলোতে নিজ নিজ আচার অনুষ্ঠান পালন করবে, যা আমার আপত্তির বিষয় নয়। আমার আপত্তি তখনই হয় যখন দেখি নতুন পোশাক কেনা, গরু কেনা, জবাই নিয়ে আপনার সীমাহীন তৎপরতা, অথচ নামাজ, রোজা, যাকাতের সঠিক বণ্টন, হালাল উপার্জন, সুদ মুক্ত জীবন যাপন, মিথ্যা পরিহার, অশ্লীল-নোংরা ইঙ্গিতপূর্ণ ছবি, নাটক, সিরিয়াল নাচ গান পরিহার, নারী পুরুষের মেলামেশায় পর্দা প্রথার অনুশীলন নিয়ে নেই সামান্য তৎপরতা। কেন, ঈদ ইসলাম ধর্মীয় উৎসব হলে উপরোক্ত কাজগুলো কি ইসলামের নয়? আপনার দায়িত্ব নয় কাজগুলো করা?
আনন্দ করার জন্যই আল্লাহ্ আমাদেরকে দুটি ঈদ দিয়েছেন। কিন্তু আনন্দ যেন ধর্মীয় সীমাকে অতিক্রম না করে, সেটাও তো মাথায় থাকা উচিৎ। উৎসবের পাশাপাশি ঈদ আমলেরও সময়। আপনার আমল যখন নামাজ, তসবীহ-তাহলীল, কুরআন-হাদীস অধ্যয়ন, প্রতিবেশির খোঁজ খবর নেওয়ার পরিবর্তে ঈদের জন্য নির্মিত ফিল্ম, নাটক, গানের এ্যালবাম দেখা ও শোনায় কেন্দ্রীভূত থাকে, তখন এক সেকেন্ডের জন্য নিজেকে প্রশ্ন করুন, প্রকৃত মুসলমান হতে পেরেছেন কি?
এইসব বিনোদন সামগ্রী যারা বানাচ্ছেন ও দেখছেন, অধিকাংশই মুসলিম, কিন্তু প্রকৃত মুসলিম? অভিনয়ে শিল্পিদের অবাধ প্রেম, মাত্রাতিরিক্ত উলঙ্গপনা আর আপনাদের সেগুলো দেখা ইত্যাদি কি আপনার পঠিত কুরআন ও হাদীস দ্বারা জায়েজ হয়েছে? ভাবুন, জবাব খুঁজুন।
আপনি বলেন, ‘আমিতো মাঝে মাঝে কুরআন-হাদীস পড়ি। আমল সম্পর্কে ভালো জ্ঞান আছে’। এতো জ্ঞান থাকলেও দিনের পর দিন নামাজ পড়েন না, গান মুভিতে মেতে থাকেন, পর্দার সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও অবাধ মেলামেশায় মত্ত থাকেন, সত্যিই অদ্ভুত! জানা ও মানার মধ্যে বিরাট ব্যবধান!
শুরু করেছিলাম কম কষ্ট আর তুলনামূলক বেশি কষ্টের আমল নিয়ে। নিয়মিত নামাজ পড়া কঠিন, সৃজনাল নামাজ কঠিন নয়। শুক্রুবার, রমজান মাস, মহামান্বিত রজনীগুলোতে মুসল্লিদের আধিক্যতাই তার প্রমাণ। তারপর হাতে তসবীহ, যিকির আযকার, কুরআন তেলাওয়াত ইত্যাদিও তুলনামূলক সহজ আমল।
কিন্তু এই নামাজে, কুরআন তেলাওয়াতে পড়া সূরাগুলো যখন কিছুটা কঠিন আমল করার বাধ্যবাধকতা নিয়ে আসে, তখন কতটা আঞ্জাম দিতে পারেন? একটু হিসেব কষে নিন।
কুরআনে বলা আছে সুদ হারাম, কাজটা কঠিনও। এই কঠিন আমলে আপনার অবস্থা বেশামাল। এই অগ্নি পরীক্ষায় সফল হতে পারছেন না, নাকি পারার চেষ্টাও করছেন না, ভেবে দেখুন। নয়ত সাধের জান্নাত অধরাই থেকে যাবে।
কুরআন বলছে নামাজ অথবা কাজে কর্মে প্রদর্শনী করা যাবেনা। এই সময়ে কাজটি কঠিনও। পারছেন তো ঈদের নামাজে, গরু কেনা ও জবাইয়ে, ঘুরতে গিয়ে, জানাযায়, কবরে লাশ শোয়ানোর সময়, সেলফী তোলা বা প্রদর্শনেচ্ছা থেকে বিরত থাকতে? নিজের কাজগুলো যাচাই করে দেখুন রিয়ামুক্ত কিনা।
লোকের দেখাদেখি, পারিবারিক চাপ, সমাজের চোখ রাঙ্গানী, কিছুটা ধর্মীয় অনুভূতি থেকে গায়ে একটা বোরকা লাগিয়ে বেড়ানো সহজ, কিন্তু আজকের যুগে পর্দার সঠিক নিয়ম মেনে পরা অত্যন্ত কঠিন, ঢিলেঢালা শরীরের গঠন বুঝা যায়না, চকমকে নয় এমন বোরকা বা পোশাক। আপনি পরেন তো এমনটা? এখনতো ইসলাম ধর্মের সব আচার অনুষ্ঠানে, অনুশীলনে সুকৌশলে ফ্যাশন চালু করা হয়েছে।
নামাজের চেয়ে মনযোগ বেশি মসজিদ সুন্দর করায়। ইবাদতের চেয়ে বেশি মনোযোগ দামি পাঞ্জাবি, টুপি, দাড়িতে মেহেদী লাগানো আর স্টাইলিশ দাড়ি রাখায়। রোজার আমলের চেয়ে বেশি মনোযোগ ইফতার সেহরীর আইটেম বানানো, পোশাক কেনাকাটা, নাটক-মুভি তৈরি করায়। পর্দা পালনের চেয়ে বেশি মনোযোগ স্টাইলিশ বোরকা আর মাথায় একটা ঊড়না পেছিয়ে পেছিয়ে হিজাব পরায় ইত্যাদি ইত্যাদি।
এইসব ফ্যাশনের আড়ালে যে মুসলমানদের অন্তরকে শিথিল করে দিচ্ছে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার বিষয়ে, দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে আল্লাহ্র স্মরণ থেকে, সেদিকে যেনো কারোরই খেয়াল নেই। আপনি মুক্ত তো এইসব থেকে? ভাবুন, নিজের মাঝেই জবাব খুঁজুন।
প্রস্তুতি ভালো থাকলে বিয়ে করা সহজ কাজ, কিন্তু ইসলামিক রীতিতে বিয়ে সম্পন্ন করা সহজ কাজ নয়। এই কাজে আপনার অবস্থা একেবারেই বেশামাল।
দেন মোহরের জন্য ঘোষণা দিলেন ১০ লাখ, অথচ দেওয়ার ক্ষমতা নেই ১০ হাজার। লোক দেখানো! বিয়ে জীবনে নিয়ে আসে অপার সুখ শান্তি, অথচ শুরুটা করলেন বিশাল ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে! নাচ-গান, গীত, পান তেল, গায়ে হলুদ, নারী পুরষ নির্বিশেষে মেহেদী লাগানো, গায়রে মাহরাম ভাবি কর্তৃক দেবরকে গোসল করিয়ে দেওয়া, দেবরের ভাবির গায়ের সাথে গা মিশিয়ে ঊঠবস, গায়রে মাহরাম শ্যালিকাদের দুলাভাইয়ের হাত ধরে ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরে বেড়ানো, হলুদ-রঙ মাখামাখি, বউকে উঠানে বসিয়ে মাহরাম গায়রে মাহরাম নির্বিশেষে হাজার হাজার ছবি তোলা তারপর ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া, ইসলাম বহির্ভূত এইসব কাজ বন্ধে আপনি কতটুকু ভূমিকা রাখছেন?
এখন তো অনেক ধার্মিক লোক পর্দা মেইনটেইন করেন, বউকে অন্দর মহলে রেখে নিজে ইচ্ছেমত বিয়ের পোশাকে ছবি তুলে আপলোড করেন, আবার কেউ বউকে নিয়েই ছবি তুলেন তবে হিজাব নিকাব সহকারে। আপনাদের বলছি, বউকে দেখানোর যখন এতোই খায়েশ, তাহলে বোরকা, হিজাব নিকাব খুলেই দেখান না। খুব কষ্টের সাথেই বলতে হচ্ছে, আমরা সবাই স্রোতের সাথে মিশে যাচ্ছি, একটি বারের জন্যও কি স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার চেষ্টা করা যায় না?
তাহলে বিয়েকে ইসলামিক পন্থায় সম্পন্ন করতে আপনার ভূমিকা কতটুকু? ভাবুন, নিজেকে নিজেই বিচার করুন।
সৎকাজের আদেশ বা উপদেশ দেওয়া সহজ কাজ, কিন্তু মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখা বা নিষেধ করা এতো সহজ নয়, করতে গেলে কখনো কখনো কঠিন বাধার সম্মুখীনও হতে হয়, রুষ্ট হয় আপন জনেরাও, তবুও আপনার চেষ্টা কতটুকু?
স্ত্রী, সন্তানদের সাথে সম্পর্ক খুবই ভালো। একটা ধমক দিতেও মন সায় দেয়না, যদি কষ্ট পায়। সেই স্ত্রী সন্তানদের অন্যায় আবদারে পারেন তো মায়া মমতাকে এক পাশে ঠেলে আবদার পূরণে সতর্ক হতে? টিভি, স্মার্টফোন, ল্যাপটপে তারা কি দেখছে, আসক্ত হচ্ছে, আর সেসব থেকে ফিরিয়ে আনার মত কষ্ট সাধ্য কাজটি করছেন তো? গুটি কয়েক অভিভাবক বাদে সব অভিভাবই এই কাজে ফেইল। নানান ব্যস্ততার মাঝে কিছু সময় আলাদা করে সন্তান, স্ত্রীকে ইসলামী অনুশাসনে কায়েম রাখার মত কঠিন আমলটি করার চেষ্টা করেন তো?
ঘরে টিভি আছে, অথচ সিরিয়াল দেখেনা, এমনটা বিরল। এসবে যা দেখানো হয়, তা সব যে খারাপ, বাস্তবতা বিবর্জিত, তা কিন্তু নয়, সমস্যা হচ্ছে আসক্তি। যারা দেখে, তারা নামাজ কালামও পড়ে, কিন্তু এর প্রভাব এতো বেশি যে ছাড়তে পারেনা। একবার ঘোষণা দেন তো দেখি, আজ থেকে আর সিরিয়াল দেখবেন না। পারবেন না। কেননা কাজটা কঠিন। আল্লাহ্ আপনাকে কঠিন কাজ দিয়েই পরীক্ষা করছেন। এখন আপনিই সিদ্ধান্ত নিন, পরীক্ষায় পাশ করবেন নাকি ফেল।
এভাবেই চোখে পড়ার মত কিছু সহজ আমলের বিপরীতে সম্পদের লোভ, ঘুষ বাণিজ্য, চিটিংবাজী, ফাফরবাজী, চোগলখুরি, গীবত, অপবাদ, অহংকার, ব্যবসায় অবৈধ পন্থা অবলম্বন, লেনদেনে স্বচ্ছতার অভাব, অনৈসলামিক সংস্কৃতি-কর্মকাণ্ডে চোখ বন্ধ করে মিশে যাওয়া ইত্যাদি চলছে দেদারছে।
কারা করছে এইসব? শুধু বিধর্মী আর সমাজের বদ লোকেরা? অবশ্যই না। নামাজী, রোজাদার পাঞ্জাবী, টুপি, দাড়িওয়ালা, বোরকাবিহিন, বোরকাওয়ালী নির্বিশেষে সবাই করে যাচ্ছেন। নামাজ রোজা তসবীহ, তাহলীল, আপনাকে বিরত রাখতে পারছে না কারণ সহজ আমলগুলো করেই অর্পিত দায়িত্ব শেষ বলে মনে করছেন, কঠিনগুলো করছেন না, করার চেষ্টাও করেন না, যদিও কোনো আমলই কঠিন নয় যদি নিজেকে সেভাবে গড়ে তোলা যায়, তাহলে কিভাবে নিজেকে সাচ্চা মুসলমান দাবী করেন যখন হাজারটা অনৈসলামিক কাজ করে বেড়ান। একটু ভাবুন!
প্রতিযোগিতা হোক সৎকাজে। এমন কাজে নয় যা আপনাকে শুধু গুটিকয়েক আমলে সীমাবদ্ধ রাখে, মত্ত রাখে এমন কাজে যাতে আপনার আমল হয় কিন্তু প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে গাফেলই থেকে যান।
আসুন, বুঝার চেষ্টা করি, দুনিয়াটা পরীক্ষার জায়গা, পরীক্ষা মানেই কঠোর সাধনায় অবতীর্ণ হওয়া। কম কষ্ট আর বেশি কষ্টের আমলের সম্মীলন থাকবে তাতে। সুতরাং কিছু আমল করে আর কিছু বাদ দিয়ে হবেনা। সবই পালনে অনন্তর চেষ্টা করতে হবে। তবে তো আল্লাহ্ ক্ষমা করবেন।
আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে বুঝার তাওফীক দিন।
বিষয়: বিবিধ
১৩৩৬ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কিন্ত কবে হব পরিপূর্ণ মুসলমান !! একটা করলে আরেকটা ছেরে দেই ।আল্লাহ আমাকে মাফ করুন ।
ধন্যবাদ সাকা ভাইয়া ।
আমরা মানুষ, শত অন্যায়ের হাতছানি দিয়ে ডাকছে শয়তান, মনুষ্য শয়তান। তাই করা ছেড়ে দেওয়া এইসব হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতিটি ভুল থেকে শিক্ষা না নিয়ে বারবার সেই ভুলের উপর কায়েম থাকা ঠিক নয়। এই ক্ষেত্রে মাপ পাওয়া কঠিন হবে. চেষ্টাটা অন্তত ফেয়ার হোক।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ বিষয়গুলো উপলব্ধিতে নেওয়ার জন
ধন্যবাদ আপনাকে............
আপনার প্রোফাইলের ছবিটা সরিয়ে অন্য কিছুর ছবি দেওয়াই উত্তম হবে।
( উচিত কথা ভাই)
ঠিক বলেছেন হতচ্ছাড়া
লিখাটে একটু বড় হয়ে গেছে........ ধন্যবাদ আপনাকে
আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম।
আমীন, ছুম্মা আমীন
হে, অনেক সময় চেষ্টা করেও লেখক লেখাটাকে ছোট করতে পারেন না, করলে তার মনো:পূত হয়না, তাই....
আপনাকেও ধন্যবাদ জনাব।
মন্তব্য করতে লগইন করুন